পূর্ব-রোদ পর্ব-৩৩

0
2167

@পূর্ব-রোদ?
#পর্ব_৩৩
#লেখিকা_আমিশা_নূর

শত হলেও নিলয় তার বন্ধু!বিপদে-আপদে সবটা সময় ছায়ার মতো পাশে লেগে ছিলো।আজ শেষ মুহুর্তে মেঘ কিছুতেই নিলয়কে একা ছাড়বে না।কোনোদিনও না!এখন নিলয়ের পাশে মেঘকে খুব প্রয়োজন।খু-ব!


“নাবিলা,পূর্ব-রোদ কোথায় গেলো?দেখতে পাচ্ছি না।”

চাঁদনি মোহাম্মদের কথা শুনে নাবিলা স্ব জোরে হেসে উঠলো।তারপর হাসি থামিয়ে বললো,”আছে আশেপাশে।”
“হাসছো কেনো?”
“আন্টি তুমি জানো না কী একটা…..হাহাহাহা।”

ততক্ষণে তাদের দুজনের কাছে রোদের মা ছায়া আহমেদও এসে যায়।নাবিলা’কে হাসতে দেখে তিনি বললেন,”না হেসে বলো কী হয়েছে?ওদের কেক কাটতে হবে তো।”

পেছন থেকে রাফিয়া সবটা বলতে যাবে তখন নাবিলা রাফিয়ার মুখ চেপে ধরে বললো,”আন্টি আন্টি ওটা হাস্যকর।তোমাদের বলা যাবে না।”

নাবিলা’র কথা বলার ডিজাইন দেখে চাঁদনি এবং ছায়া আহমেদ দুজনে একসাথে বললো,”ওওওও”

সবাই পূর্ব-রোদকে নিয়ে কথা বলছিলো।তখন সবার দৃষ্টি গিয়ে পড়লো সিঁড়ির দিকে।একরাশ লজ্জা নিয়ে,গাড় খয়েরী রংয়ের শাড়িতে গোলাপি কালারে আঁচল,উপরের সাদা রংয়ের কৃত্রিম বেলি ফুলের আর্ট।হাত ভর্তি মেজেন্টা কালারের চুরি,কানে সোনালী রংয়ের ঝুমকা,গলায় তার বাবার দেওয়া চেইন,ঠোঁটে খয়েরী লিপস্টিক,চোখ ভর্তি গাড় কালো কাজল,চুল খোঁপা করা।সব মিলিয়ে যেনো নিখুঁত স্ত্রী!

রোদ’কে সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখে সবাই মুচকি হাসলো।কিন্তু রাফিয়া ‘হা’ করে তাকিয়ে আছে।রোদ তাদের কাছে এসে বললো,”কী হয়েছে রাফিয়া?হা করে আছিস কেনো?”
“ইয়াআআআর!তোকে দেখে ক্রাশ খেলাম।হায়!তেরা রুপ দেক্ষার মে মার জায়োনগা!”

রাফিয়ার মন্তব্য শুনে সবাই হেসে উঠলো।তখন রোদের ছোট বোন আলো নাগের ঢগায় নেমে আসা চশমা ঠিক করে বললো,

“আপি তোর খোঁপায় যদি ফুল দিই না তাহলে আরো সুন্দর দেখাবে।”
“লাগবে না ফুল।”

রোদ চারপাশ তাকিয়ে পূর্বের খোঁজ করছে।তখন নাবিলা তার কানে কানে বললো,”পূর্ব তৈরি হচ্ছে।”

নাবিলা’র কথায় রোদ হচকিয়ে উঠলো।রোদ চেহেরা দেখে মনে হলো কিছু চুরি করতে গিয়ে রোদ ধরা পড়েছে।তা দেখে নাবিলা বাঁকা হাসলো।তাদের সবার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে পূর্বের আগমন হলো।রোদ আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো খয়েরী রংয়ের পাঞ্জাবির সাথে পায়জামা ম্যাচ করা।রোদ আজ প্রথম পূর্বকে খয়েরী রঙে দেখলো।দু’জনকে দেখে মনে হচ্ছে তারা একে অপরের জন্য তৈরি।

রোদের মা পূর্বের কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলাতে চাইলে পূর্ব নিচু হয়ে বললো,”মামুনি,চুলের স্টাইল নষ্ট হয়ে যাবে।”
“চুপ বেয়াদব!আমার ছেলের উপর কারো যেনো নজর না লাগে।”

রোদের মা নিজের চোখ থেকে কাজলের কালো ফোঁটা নিয়ে পূর্ব গলায় লাগিয়ে দিলো।তাদের দু’জন’কে দেখে পূর্বের মা রোদের কাছে গিয়ে বললো,
“এ্যাঁহহ।তোর ছেলের চেয়ে আমার মেয়েকে বেশি সুন্দর লাগছে।কোনো পরীর থেকে একটুও কম না।এই নে কালো টিক্কা লাগিয়ে দিলাম।”

ছায়া আহমেদের মতো চাঁদনি মোহাম্মদও রোদের কানের লতি’তে কাজলের চিহ্ন দিলো।চাঁদনি মোহাম্মদের কর্ম দেখে ছায়া আহমেদ ভেংচি দিয়ে বললো,

“তোর মেয়ের চেয়ে আমার ছেলে বেশী সুন্দর!”
“মোটও না।আমার মেয়ে চাঁদের মতো সুন্দর।”
“চাঁদনি তুই কী বললি এটা?চাঁদের নিজস্ব কোনো আলো নেই তারমানে রোদও প্রকৃত সুন্দর না।হাহা”

ছায়া মোহাম্মদের কথা শুনে উপস্থিত সবাই উচ্চস্বরে হেসে ফেললো।এমনকি রোদও হাসছে।চাঁদনি হাসান কিঞ্চিৎ রেগে বললেন,”রোদ তুই হাসছিস ক্যান?আগে তো আমার সাথে তাল মিলাই ঝগড়া করতি।”

চাঁদনি মোহাম্মদে কঠিন দৃষ্টি দেখে রোগ চুপসে গেলো।পূর্ব তাদের থামিয়ে বলল,”আচ্ছা।রোদ পিওর সুন্দর!ঠিক আছে?”
“পূর্বঅঅঅ।তুই আমার ছেলে হয়ে চাঁদনির মেয়েকে সুন্দর বলছিস?”

দুই মহিলা রেগে গেছে দেখে বাকিরা মিটিমিটি হাসছে।তখন আফসোসের স্বরে ছায়া আহমেদ বললেন,

“বুঝেছিস চাঁদনি।ওরা আগের মতো নেই।চল রে যাই।আমাদের দুজনের ঝগড়া করে কোনো লাভ নেই।”

ছায়া আহমের তার বান্ধবীর হাত ধরে সেই স্থান ত্যাগ করলো।নাবিলা কিছুক্ষণ সন্দিহান দৃষ্টিতে পূর্ব-রোদের দিকে তাকিয়ে রাফিয়াকে বললো,

“রাফিয়া তোমার না পানি খেতে ইচ্ছে করছিলো?চলো যাই।”
“পানি?আমি…”
“চলো চলো।”

নাবিলা এক প্রকার টেলেঠুলে রাফিয়া’কে নিয়ে গেলো।সেই জায়গায় তখন শুধু পূর্ব-রোদ ছিলো।রোদ হাত কচলাতে লাগলো।তখন পূর্ব তার কাছে এসে বললো,”কী ব্যাপার শঙ্খপুষ্পি?লজ্জা পাচ্ছো নাকি?”
“ল..লজ্জা?লজ্জা কেনো পাবো?”
“ওহ হো..তাহলে লজ্জা পাও না?ভয় পাও?”
“না।তো..তোমাকে..’

রোদের বলতি বন্ধ হয়ে গেলো যখন পূর্ব তার অনেকটা কাছে চলে এলো।একটুখানি মাথা উচু করে রোদের কপালে চুমু দিলো।তারপর শীতল কন্ঠে বললো,” সবসময় এভাবে হাসিখুশি থেকো শঙ্খপুষ্পি!তোমার ভালো’তে আমিও ভালো।”

রোদ পূর্বের বুকে মাথা রাখলো কিছুক্ষণ।তারপর তাদের কানে ভেসে আসলো চাঁদনি মোহাম্মদের কন্ঠস্বর।হয়তো কেক কাটে নতুন বছর শুরু করার জন্য ডাকছে।পূর্ব-রোদ তাড়াহুড়ো করে বাকিদের কাছে গেলো।


“মেঘ তুই কোথায় যাচ্ছিস?”
“মা আমি একটু নিলয়ের সাথে ইন্ডিয়া যাচ্ছি।কিছু’দিন পর চলে আসবো।”
“কীহ?হুট করে এভাবে?মেঘ,নিলয় যাওয়ার আগে আমাকে জানালো না?”
“মা নিলয়ের সময় ছিলো না।আমি এখন চলে যাচ্ছি।বাবাকে জানিয়ে দিও।”
“নীরা জিজ্ঞেস করলে?”
“নাবু ঢাকায় কিছুদিন থাকবে।আর ও ফোন করলে বলিও অফিসের কাজে বাইরে গেছি।”
“কিন্তু…”
“মা প্লিজ,যা বলেছি তাই করিও।”
“আচ্ছা।”

নিনা হাসান থেকে বিদায় নিয়ে মেঘ রেলওয়ে স্টেশনে উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়লো।এখন নিয়লের কাছে থাকার সময়!নিলয়কে বিপদের মুখে রেখে মেঘ পালিয়ে যেতে পারে না।কোনো দিনও না!


“মা তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।”
“ধন্যবাদ কেনো?”
“তুমি যদি অমন কন্ডিশন না দিতে তাহলে হয়তো আমি আর রোদ কোনোদিনও ভালো হতাম না।”
“হাহ!এই কথা?শুন পূর্ব তোরা আগে থেকেই ভালোবাসতি সেটা তোদের বুঝানোর জন্য আমি হেল্প করেছি মাত্র।অবশ্য আমার সাথে তিহানও ছিলো।”
“কীহ?তিহান?”
“হুম।একদম তিহানকে বকবি না।ওর জন্য সবটা এতো সহজ হয়েছে।”
“হুহ।আমাকে না জানিয়ে এতোকিছু করলো বলদটা।”

পূর্বের কথা শুনে চাঁদনি মোহাম্মদ শুধু হাসলেন।পূর্ব তার মায়ের রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমে চলে এলো।এখন সূর্য ডুবুডুবু!তাদের বিবাহ বার্ষিকীর ছোট্ট অনুষ্টান’টাও শেষ হয়ে গেছে।তবে অনুষ্ঠানে থাকা বাকি লোকজন পূর্বের বাড়িতে থেকে গেলো।পূর্ব রুমে ঢুকে দেখলো রোদ আনমোনা হয়ে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।পূর্ব তার পাশে গিয়ে বললো,

“মুখটা শুকনো কেনো?”
“পূর্ব তুমি সত্যি চলে যাবে?”
“রোদ তুমি আবার শুরু করেছো?”
“আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না পূর্ব।খুব কষ্ট হবে।”
“নিজেকে সামলাও রোদ।ভালোলাগা’টাকে করো উপর নির্ভর করে থেকো না।”
“যাও কানাডা!আর কোনোদিন আসবে না।”
“রোদ তুমি কিন্তু কাল রাতে ঘরটা খুব সুন্দর করে সাজিয়ে ছিলে।”

রোদ চোখের কোণে থাকা অভি বিন্দু মুছে নিয়ে আড়চোখে পূর্বের দিকে তাকালো।সে ভালোভাবে বুঝছে কথা ঘুরানোর জন্য পূর্ব এমনটা বলছে।রোদ পূর্বের কথার উত্তর দিয়ে বললো,”সবকিছু আমি সাজিয়ে ছিলাম।”
“হু।বেশ হয়েছিলো।কিন্তু তুমি সারারাত কেঁদেই কাটালে।”

ওমনি রোদের গলায় কান্নাটা আটকে গেলো।রোদ ঠোঁট উল্টিয়ে কাঁদতে যাবে তখনি পূর্ব রোদের মাথাটা নিজের কাঁদে রাখলো।তার নিজেরও বেশ কষ্ট হবে রোদকে ছাড়া থাকতে।কিন্তু রোদের সামনে কিছু তেই দূর্বল হওয়া যাবে না।নাহলে রোদ আরো নরম হয়ে যাবে।

পূর্ব-রোদের কানে ভেসে আসলো ছায়া আহমেদের কন্ঠস্বর।রোদ চেয়ার ছেড়ে রুম থেকে বেরুতে যাবে তখন পূর্ব পিছু ডাকলো।রোদ ভ্রু-কুচকে পূর্বের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো।পূর্ব রোদের কাছাকাছি এসে বললো,”আমার ফ্লাইট ১০তারিখ।”

“দশ তারিখ” শব্দটা শুনে রোদ থমকে গেলো।দশ তারিখ!তাহলে তো মাত্র চারদিন বাকি।চারদিন পর পূর্ব তিন বছরের জন্য গায়েব হয়ে যাবে?ইচ্ছে করলে যখন তখন পূর্বকে আর ছোঁয়া যাবে না।বিনা কারণে ঝগড়া দেওয়া হবে না।সকাল বেলা পূর্বের চেহারা দেখা হবে না।কেমন কষ্ট এটি?এতো কষ্ট!

[চলবে]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে