@পূর্ব-রোদ?
#পূর্ব_২১
#লেখিকা_আমিশা_নূর
এক সময় মেঘ গাড়ি থামালো।রোদ তাড়াতাড়ি সারপ্রাইজ বলে নিনা হাসানের চোখ বেঁধে নিলো।রোদের পাগলামো দেখে মেঘ মুচকি হাসলো।নিনা হাসান হাসি মুখে সামনে এগোচ্ছে।বাড়ির ভিতর প্রবেশ করার আগ মুহুর্তে মেঘের কল এলো।যার ফলে রোদ নিনা হাসাকে একাই বাড়ির ভিতর নিয়ে যায়।
নিনা হাসান বাড়িতে পা রাখতে ছোট্ট বাচ্চা হাসি’র শব্দ কানে বেসে আসলো।তার মুখে লেগে থাকা হাসি নিভে গেলো।আস্তে আস্তে সামনে এগোতে কানে ভেসে আসলো ঘুম পাড়ানির গান।যেটা নিনা হাসান তার মেয়ে নীরা’কে ঘুমানোর সময় শুনাতো।পেছন দিক থেকে রোদ এসে চোখের কালো বাঁধন খুলে দিলো।চোখের পাতা জোড়া পিট পিট করে নিনা হাসান খুলতেই দেখলো তার চোখের সামনে বড় একটি ছবি।তার মেয়ে নীরা’র হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে রেখেছে।
পুরাতন সেই ছবিটা দেখে নিনা হাসান চোখের জল ধরে রাখতে পারলো না।তার চারিদিকে আলো জ্বলে উঠলো এবং আরো কয়েক রকমের ছবি সামনে এলো।সব ছবিতেই তার ছোট্ট মেয়েটি সাথে তিনি আছেন।নিনা হাসান চারিদিকে তাকালো।চারদিকেই একই রকম ছবি।নিনা হাসান পেছন ফিরতেই দেখতে পেলো একটি মেয়ের চোখ থেকে অজরে জল পড়ছেে।উনার বুঝতে বাকি রইলো না যে মেয়েটি তার নিজের।অজান্তে দৌড়ে গিয়ে তার আদুরে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলো।
।
।
“আপনি কে বলবেন?কখন থেকে প্যাঁচাল করে যাচ্ছেন।”
“কুল মি.মেঘ!একটা মেয়ে আপনার সাথে ফোনে কথা বলছে আর আপনি কি-না বিরক্ত হচ্ছেন?”
“হ্যা বিরক্ত হচ্ছি।কে বলুন তো আপনি?”
“আমি আপনার ফ্যান!”
“আমি কোনো সেলেব্রিটি নই যে ফ্যান হবেন।”
“ফ্যান হতে হলে সেলেব্রিটি হতে হয় না।”
“দূর রাখেন তো কল।”
মেঘ আর এক সেকেন্ডও কথা না বলে কল কেটে দিলো।রাফিয়া নিজের হাতের নক কামড়াতে লাগলো।তিহান,পূর্ব বলে দিয়েছে মেঘের সাথে আধ ঘন্টা কথা বলতে কিন্তু মেঘ তো দশ মিনিটই বললো না।রাফিয়া মেঘ’কে আবার কল দিলো।কিন্তু ওপাশ থেকে ব্যাস্ত বললো।হয়তো ব্লক করে দিয়েছে।রাফিয়া তিহান’কে কল দিলো কিন্তু রিসিভ হলো না।রাফিয়া দুঃখ,কষ্ট,রাগে নিজের চুল নিজে ছিড়তে লাগলো।
।
।
মেঘ বাড়ির ভিতর ঢুকতে দেখলো তার মা একটা মেয়ে’কে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।সে কিছু বুঝতে না পেরে চারপাশে তাকালো।তার মায়ের সাথে থাকা একটি ছোট্ট মেয়ের ছবি দেখলো।এই মেয়ের ছবিটা মেঘ আগেও দেখেছে।এবং মেয়েটা তার মায়ের কী তাও মেঘ জানে।কিন্তু যাকে জড়িয়ে ধরেছে তার সাথে কী সম্পর্ক মেঘ বুঝছে না।একটু দূরে চোখ যেতে দেখলো রোদ ছলছল চোখে সামনের দৃষ্টটা দেখছে।আর অন্যপাশে পূর্ব আর তিহান দাঁড়িয়ে আছে।সবার দৃষ্টি “মা-মেয়ে’র” দিকে বিধায় কেউ খেয়াল করলো না মেঘ উপস্থিত হয়েছে।
নিনা হাসান-নাবিলা কেউ একে অপরকে ছাড়ছে না।ছেড়ে দিলেই যেনো অতিতের মতো হারিয়ে যাবে।দু’জনের চোখে জল ছাড়া অন্য কোনো ভাষা নেই।তখন নাবিলা বললো,
“কেমন আছো মা?”
“তোকে ছাড়া একদম ভালো ছিলাম না।তুই কোথা থেকে এলি?আমাকে জানালি না কিছু?”
এই প্রশ্নের উত্তরে নাবিলা কিছু বললো না।নিনা হাসানকে চেয়ারে বসিয়ে রোদকে ইশারা করলো পানি নিয়ে আসতে।রোদ পানি নিয়ে আসলে নিনা হাসানকে খেতে দিলো।পানি পান করা হয়ে গেলে নিনা হাসান অস্থির হয়ে বলে,
“তুই কোথায় ছিলি?কতো খুঁজেছি তোকে।এতো দিনে মনে পরলে আমায়?”
“সরি মা।বাবা’র সাথে আমেরিকায় ছিলাম।এখানে এসে তোমার দেখা পাবো তা কোনোদিন ভাবিনি।”
“একটি বার আমার খবর নিতে পারিস নি?”
“তুমিও তো নাও নি।”
“কে বললো নেইনি?এই বাড়িটায় অনেকবার এসেছি কিন্তু তোদের কাউকে খুঁজে পাইনি।আমেরিকা চলে যাবি তা কি আমি জানতাম?”
“লাভ ইউ মা!আর কোথাও যাবো না তোমাকে ছাড়া।প্রমিস!”
তারা মা-মেয়ে মান অভিমান ভাঙতে লাগলো।ওদের কথাবার্তা শুনে মেঘ এটুকু বুঝলো তার মায়ের হারানো সন্তান নাবিলাই হলো নীরা!তার মা কতোটা আপসেট ছিলো এই মেয়েটার জন্য।আর আজ থেকে যেনো তা মায়ের কোনো কষ্টই না থাকে তা মনে মনে প্রার্থনা করলো মেঘ।তারা মা মেয়ে কথা বলতে বলতে নিনা হাসান সামনে তাকিয়ে দেখলো মেঘ দাঁড়িয়ে আছে।হাতের ইশারায় নিনা হাসান তাকে কাছে ডাকলো।মেঘ’কে দেখে বাকিরা সবাই সমানে অবাক হলো।তাদের বুঝতে বাকি রইলো না যে রাফিয়া মেঘকে সামলাতে পারেনি।নিনা হাসান মেঘকে কাছে ডেকে নাবিলাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
“ও হলো মেঘ!বাবা’র বাড়ি থেকে মেঘের বাবার সাথেই আমার বিয়ে দেয়।জানিস মেঘ কোনোদিনও আমাকে সৎমা মনে করেনি।নিজের মায়ের চেয়েও বেশি ভালোবেসে।”
“তুমিও তো আমাকে কম ভালোবাসো না মা!”
নিনা হাসান তার দু সন্তানকে দু হাতে জড়িয়ে ধরলো।এভাবে তারা কতক্ষণ ছিলো জানে না।নিনা হাসানের হুস আসতে বাকি তিন মূর্তির দিকে তাকিয়ে বললো,
“তোমরা সবাই মিলে এসব করেছো?”
“হুম আন্টি।নাবিলাপু বলেছিলো।”
“কিন্তু সেদিন আমাকে ডাইরেক্টলি বললে পারতে তোমরা।”
“অসস্তি হচ্ছিলো মা!” (নাবিলা)
“তুই এখানে কোথায় থাকছিস?”(নিনা হাসান)
“ভাড়া বাসা নিয়ে থাকতাম।”
“কিন্তু এখানে কেনো থাকিসনি?”
“এ বাড়িটা কাল পরিষ্কার করলাম।এখন থেকে এবাড়িতে থাকবো।”
“না আমার সাথে থাকবি।”
“তাহলে তুমিও থেকে যাও।”
অনেক জোরাজোরি করে শেষ পর্যন্ত নিনা হাসান রাজি হলো।তিনি মেঘকেও সাথে করে রাখতে বললেন।মেঘের বাবা বিজনেসের কাজে বাইরে গেছে।এ ক’দিন ওরা তিনজন নাবিলা’র সাথে এবাড়িতে থাকবে।রোদ একপাশে দাঁড়িয়ে তাদের হাসি-খুশিটা অনুভব করছিলো।তখন মেঘ এসে তার পাশে দাঁড়ালো।রোদ তার দিকে তাকাতেই রোদ’কে জড়িয়ে ধরে বললো,
“থ্যাংক ইউ রোদ!থ্যাংক ইউ সো মাচ!তুমি জানো না আমার কতো বড় উপকার করেছো।”
এভাবে হুট করে মেঘ তার উপর ঝাপিয়ে পড়ায় রোদ কিছুই বুঝলো না।সবাই সামনের দিকে আছে বিধায় কারো চোখে সে দৃশ্য পরলো না।কিন্তু পূর্ব ঠিকই দেখলো।এই মুহুর্তে রোদ-মেঘ’কে দেখে পূর্বের কেমন অনুভূতি হচ্ছে সে নিজের জানে না।শুধু তার মনে হচ্ছে রোদ মেঘের মাঝে হারিয়ে গেলো।
মেঘের মধ্যে হুস আসায় রোদকে ছেড়ে দিয়ে একটু দূরে দাঁড়ালো।অসস্তি নিয়ে বললো,
“আ’ম সরি রোদ!তোমার অনুমতি না নিয়ে…”
“ইট’স ওকে।”
“তাহলে কাল পার্টিতে আসছো তো?”
“কোন পার্টি?”
“সে কি ভূলে গেছো?কম্পিউটার ক্লাস…”
“ওহ।হ্যা ইনশাআল্লাহ যাবো।”
“তুমি আসলে নিজেকে ধন্য মনে হবে।”
মেঘ মুচকি হেসে কথাটি বললো।ভদ্রতা দেখিয়ে রোদও হাসলো।তবে মনের ভিতর খচখচ করলো।কোথাও পূর্ব এসব দেখে রেগে যাবে না তো।তারপর নিজেই নিজেকে বললো,”পূর্ব রাগলে তোর কী?রোদ তুই পরিবর্তন হচ্ছিস।পূর্বকে নিয়ে বেশি ভাবছিস।এবার আর ভাববি না।”
দূর থেকে পূর্ব সবটা দেখলো।এসব দেখে পূর্বের যেমন গা জ্বালা করছে তেমন কষ্টও হচ্ছে।ভী-ষ-ণ কষ্ট হচ্ছে!আজ অবধি রোদের কাছ থেকে পজিটিভ কিছু পেলো না।পূর্বের মনে হলো সে রোদের পথের কাটা।
।
।
কিছুক্ষণ আগে পূর্ব-রোদ বাড়িতে ফিরেছে।পূর্ব একটা কথাও বলেনি।রোদ নিজে অবাক হলেও কিছু জিজ্ঞেস করেনি।চাবি দিয়ে দরজা খুলে পূর্ব ভিতরে প্রবেশ করলো।তখন অবশ্য রাত দশ-টা।পূর্ব ফ্রেশ হয়ে বেলকোনিতে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো।রোদ কাপড় পাল্টানোর জন্য অন্যরুমে গেলো।রোদও ফ্রেশ হয়ে রুমে এসে দেখে পূর্ব এখনো বেলকোনিতে দাঁড়িয়ে।এবার রোদ খুব বিরক্ত হলো।হালকা রাগ নিয়ে পূর্বে সামনে গিয়ে বললো,
“কী হয়েছে কী?এভাবে হরিচন্দন মার্কা হয়ে আছেন কেনো?”
রোদের প্রশ্নের কোনো জবাব পূর্ব দিলো না।বরং রোদের কথায় কোনো রিয়েক্টই করলো না।রোদ আবারো বললো,
“কিছু জিজ্ঞেস করছি আমি পূর্ব!”
“তুমি কি মেঘ’কে ভালোবাসো?”
“হুয়াট?”
পূর্বের প্রশ্ন শুনে রোদ হতবাক হয়ে গেলো।সমানে রেগেও গেলো।প্রতিদিনটা দিন পূর্ব মেঘ’কে নিয়ে কথা বলে।রোদ রেগে বললো,
“কতোবার বলেছি মেঘ যাস্ট মাই ফ্রেন্ড!”
“তুমি কী চাও আমরা আলাদা হয়ে যায়?ডিভোর্স হয়ে যাক!”
পূর্বের পরের কথা শুনে রোদ কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেললো।তার মনটা যেনো কাঁচের গ্লাসের মতো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো।নিঃশব্দে অনুভূতিরা যেনো বিদায় নিলো।রোদ ছলছল চোখে পূর্বের দিকে তাকালো।কিন্তু পূর্ব আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো।রোদের কাছে তখন পূর্বের করুন চাহনি নজরে পরেনি।বরং রোদ নিজের চোখের জল আটকিয়ে বললো,
“যদি তুমি ডিভোর্স দাও আমার আপত্তি নেই!”
রোদ কোনো কথা না বলে চুপচাপ বিছানায় এসে শুয়ে পরলো।রোদ জানে আজ তার বালিশ চোখের জলে ভিজে যাবে।কিন্তু কেনো তার চোখে জল তা রোদ জানে না।শুধু এটুকু জানে পূর্ব ডিভোর্সের কথা বললে তার কষ্ট হয়।খু-ব কষ্ট হয়!
পূর্ব এক ধ্যানে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।পূর্বের চোখ জ্বালা করছে।গলা লেগে আসছে।ডিভোর্স!মানে তো দুটো ব্যাক্তি আলাদা হওয়া।ডিভোর্স হলে হয়তো রোদ মেঘের কাছে চলে যাবে।তাকে বিয়ে করবে।কতোটা হ্যাপি থাকে রোদ যখন মেঘের সাথে থাকে।পূর্ব মনেমনে প্রতিজ্ঞা করলো ডিভোর্সের পর সে নিজ হাতে রোদকে মেঘের কাছে তুলে দিবে।
।
।
সূর্যি মামা’র কিরণ রশ্মি রোদের চোখের পাতার পড়তে ঘুম ভেঙে গেলো।পাশে থাকিয়ে দেখলো পূর্ব ঘুমিয়ে আছে।কাল রাতে কাঁদতে কাঁদতে রোদের কখন চোখ লেগে আসে সে বুঝতে পারেনি।আর পূর্ব কখন ঘুমিয়েছে তাও জানে না।রোদ এক ধ্যানে পূর্বের দিকে তাকিয়ে রইলো।তখন পূর্ব একটু নড়েচড়ে উঠতেই রোদ নিজের চোখ বন্ধ করে নিলো।কারণ রোদ জানে পূর্বের ঘুম ভাঙলেই সে তার কপালে চুমু এঁকে দিবে।
পূর্বের ঘুম ভাঙ্গতেই প্রতিদিনে মতো রোদের কাছে গেলো।কিন্তু তার চোখের সামনে রোদকে মেঘের জড়িয়ে ধরার দৃশ্য ভেসে উঠলো।পূর্ব রোদের কপালে আর ঠোঁট ছোঁয়ালো না।বরং দূরে সরে এসে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
দরজা খুলার শব্দ পেয়ে রোদ চোখ খুললো।সে ভেবেছিলো পূর্ব প্রতিদিনের মতো হয়তো আজও চুমু দিবে।কিন্তু কাছে এসে দূরে সরে যাওয়ায় রোদ অবাক হলো।তখন তার মনে পরলো কাল রাতে পূর্ব ডিভোর্সের কথা বলেছিলো।মুহুর্তে রোদের মুখের রং পাল্টে গেলো।এক দল কালো মেঘ তার চেহেরা দখল করে নিলো।রোদের মনে হচ্ছে তার জীবনের মূল্যবান জিনিসটা হারিয়ে গেছে।খু-ব দূরে চলে গেছে।খু-ব দূরে!
[চলবে]
বি.দ্রঃভূলক্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন❤