@পূর্ব-রোদ?
#পর্ব_১৯
#লেখিকা_আমিশা_নূর
মেঘ রোদের সামনে মুচকি হাসলেও মনের ভিতর খচখচ করলো।শুধুমাত্র রোদের কথা রক্ষার্থে মেঘ হ্যা বলেছে।নাহলে মেঘ’র কোনো ইচ্ছে ছিলো না।
।
।
“নাবিলপু চলো।”
“কাম অন গাইস!আমি বুঝতে পারছি না মেঘের বাড়িতে কেনো যেতে হবে?রোদ আর মেঘ কফি শপে গেছিলো মেনে নিলাম।মেঘে’র সাথে ফ্রেন্ডশীপ করলো মেনে নিলাম।ওর সাথে অভার টাইম আড্ডা দিলো তাও মানলাম।কিন্তু এখন…”
“ওয়েট ওয়েট,রোদ মেঘের সাথে আড্ডা কখন দিলো?”
“কেনো তোদের মনে নেই?পরশু মেঘ বললো আর রোদও মেনে নিলো।”
“ওহ।বাহ পূর্ব!তুই তো দেখি মেঘ-রোদের প্রত্যেকটা পয়েন্ট খুব ভালো করে মনে রেখেছিস।”
নাবিলা’র কথা শুনে পূর্বের ইচ্ছে করছে নিজের গালে দুটো চড় দিতে।প্রথম চড়,রোদ-মেঘের প্রত্যেক পয়েন্ট মনে রাখার জন্য।দ্বিতীয় চড়,পয়েন্ট যে মনে আছে সেটা নাবিলা’র সামনে বলার জন্য।নাবিলা এখন তার ফালুদা করার সুযোগ ছাড়ে না।পূর্বকে উদ্দেশ্য করে রোদ বললো,
“যার আসতে ইচ্ছে করবে সে আসবে আর ইচ্ছে না করলে আসবে না।নাবিলাপু তুমি আসো।”
“এই না না আমিও যাচ্ছি।”
পূর্বের কথা শুনে নাবিলা বাকা হাসলো।তারা দুজন মেঘের সামনে গেলো।ওদের দেখে মেঘ কিছু বললো না।মেঘ-পূর্ব দুজনেই একে অপরকে অপছন্দ করছে।কিন্তু মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে দুজনেই স্বাভাবিক।
।
।
“মা..মা।”
“হ্যা আসছি।”
রান্না ঘর থেকে শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে নিনা হাসান তাদের সামনে আসলো।মুহুর্তে নাবিলা সেদিনের মতো ইমোশনাল হয়ে গেলো।চোখে কোণে পানির কণা দেখা গেলো।পূর্ব তার হাত’টা শক্ত করে ধরলো।নাবিলা আড়চোখে পূর্বের দিকে তাকালো।পূর্বের দৃষ্টি তাকে শান্তনা দিচ্ছে।নাবিলা চোখের কোণে জল নিয়ে মুচকি হাসলো।এই তো তার বন্ধু।যে তার সব বিপদ-আপদের সাথী।যে তার পাশে ছায়া হয়ে সবসময় থাকে।
“আরে রোদ মা!কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ আন্টি।আপনার শরীর ঠিক আছে?”
“শরীর তো আলহামদুলিল্লাহ!মেঘ,রোদ আসবে আমাকে বলিস নিই তো?”
“সারপ্রাইজ মা!”
“এমন সারপ্রাইজ দিস না আবার যাতে আমি স্টক করে বসি।”
নিনা হাসানের কথা শেষ হতেই মেঘ আর তিনি দুজন হু হু করে হেসে উঠে।নাবিলা’র কাছে তার মায়ের হাসি ভালো লাগলেও খারাপ লাগলো মেঘের সাথে হাসতে দেখে।নিনা হাসানের দৃষ্টি নাবিলা আর পূর্বের দিকে পড়তে জিজ্ঞেস করলো,
“আরে তোমরা?বসো বসো..”
নিনা হাসানের কথা শুনে ওরা তিনজন সোফায় বসলো।জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে নিনা হাসান মেঘের দিকে তাকিয়ে ছিলো।উনার দৃষ্টি বুঝে রোদ উত্তর দিলো,
“ওরা দুজন আমার ফ্রেন্ড।ও নাবিলা আর ও পূর্ব।”
“ওহ।তোমরা বলো কী খাবে?চা না কফি?”
“আন্টি এখন কিছু খাবো না।”
“আরে তা কি করে হয়?রহিমা,রহিমা চা দিয়ে যাও।”
নিনা হাসান যথেষ্ট হাসিমুখে কথা বলছেন।নাবিলা এক ধ্যানে শুধু তার মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে।কতো বছর পর চেহেরাটা এতো কাছ থেকে দেখছে!চেহেরায় বয়সের ছাপ পড়ে গেছে।গালে কোণায় কোণায় কালো দাগ,বা’ঠোঁটের উপরের কালো তিলচিহ্ন,কালো মধ্যে হালকা ছাই রংয়ের একটি কাথান শাড়ি পরেছেন।হাতে সোনালি কালারের দুটি চুড়ি পরেছেন।আর চেহেরায় হাসি লেগে আছে।
“আরে নাবিলা…”
“নী..রা আমার নাম নীরা!”
“নী..নীরা?”
নিনা হাসানের বুকটা ধক করে উঠলো।কতো বছর পর এই নাম শুনছে।”নীরা!”তার ছোট চার বছরের মেয়ের নাম।নিনা হাসানের কানে ভেসে আসলো ঝুনঝুনির মতো সেই হাসি।চোখের সামনে ভেসে উঠলো খেলনা নিয়ে খেলা করা সেই মেয়েটি’র দৃশ্য।এমনটা আজ প্রথম হয়নি।যখনি নীরা নামের কাউকে দেখে বা নামটা শুনে তখনি সেই দৃশ্য ভেসে উঠে।
“কিন্তু এই মাত্র রোদ বললো আপনার নাম নাবিলা।”(মেঘ)
“ওটা আমার ভালো নাম।নিকনেইম নী..নীরা।”
তাদের কথা শুনে নিনা হাসান ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলেন।তাকিয়ে দেখলেন রহিমা চা নিয়ে এসেছে।নিনা হাসান সবার হাতে চায়ের কাপ তুলে দিলেন।নাবিলা’র দিকে সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে থাকিয়ে দেখলেন মেয়েটির মুখে একটা মায়া মায়া ভাব।থুতনি’তে একটি বড় তীল চিহ্ন।তিলচিহ্ন!হ্যা এইটা তো তার মেয়ে নীরা’র ছিলো।কোথায় এইটা তার মেয়ে নয়তো?নাকি চতুর্থ বারের মতো ভূল করতে যাচ্ছে?নীরা নাম শুনে এই পর্যন্ত তিনটে মেয়েকে জেরা করেছন।নিনা হাসান দ্বিধা দ্বন্ধে ভুগলো সে কী করবে?নাবিলা’কে কী জিজ্ঞেস করবে কোনে কিছু?নাকি গত বারের মতো ভূল হবে?
“নীরা?” এই দু অক্ষরের শব্দটা নাবিলা’র কানে বার বার বাজতে লাগলো।সে বিশ্বাস করতে পারছে না তার মা তাকে “নীরা!” নামে ডাকছে।তার মায়ের দেওয়া নামে।নাবিলা’র ইচ্ছে করছে সবাইকে জোরে জোরে বলতে তার মা’কে পেয়ে গেছে।
“সরি তোমার নাম তো নাবিলা।”
“না ম..আন্টি নীরা বলুন!বড় শখ করে আমার মা নীরা রেখেছিলেন আমার মা!”
“তোমার মা কোথায়?”
“আছে।ভালো আছে!”
“তোমার থুতনির তীল চিহ্ন কী আগে থেকে আছে?”
“হ্যা।ছোট থেকে।”
নাবিলা কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে হুঁচট খাচ্ছে।এতো বছর পর হুট করে নিনা হাসানের সামনে নিজেকে মেয়ে হিসাবে পরিচয় দেওয়াটা থতমত লাগছে।বিশেষ করে মেঘের সামনে।নাবিলা লক্ষ্য করলো নিনা হাসান কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে আছেন।যেন হুট করে কিছু একটা মনে পড়ে গেলো।হঠাৎ মেঘের ফোন বেজে উঠাই মেঘ রুমের দিকে এগোলো।মেঘ চলে যাওয়া’য় নাবিলা যেনো সস্তি পেলো।তখন নিনা হাসান জিজ্ঞেস করলো,
“নাবিলা,তোমার বাবা কী করে?না মানে কোথায় উনি?”
“বাবা আমেরিকা।আমি এখানে মায়ের সাথে আছি।”
“ওহ।”
নিনা হাসান হতাশ হলেন।তারমানে নাবিলাও তার মেয়ে না।তাহলে নীরা আছে কোথায়?তিনি নাবিলা’র দিকে আরো কিছুক্ষণ সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।হঠাৎ মেঘ তাদের সামনে উপস্থিত হয়ে বললো,
“মা কাল নিলয় আসছে।”
“কী?এতো জলদি?”
“হুম।”
“যাক এবার আসলে ছেলেটার বিয়ে করিয়ে দিবো।সাথে তোর ও।”
কথাটি বলে নিনা হাসান হাসলেন।নাবিলা’র ভিতরটা চুরমার হয়ে গেলো।যেন মনের ভিতর সদ্য কাটা গেঁথে আছে।এতোটা কষ্ট হচ্ছে “নিলয়” নামটা শুনে।এই মানুষটাকে খুঁজতেই তো নাবিলা বাংলাদেশে এসেছে।কিন্তু সে মূল জিনিসটাই পায়নি।কী অদ্ভুত!
“রোদ,তোমরা কিন্তু দুপুরের খাবার খেয়ে যাবে।”
“আরে না আন্টি..”
“রোদ মায়ের হাতের খাবার খাওয়া মিস মানে তুমি খুব মূল্যবান কিছু হারিয়েছো।”
“তাই নাকি?তাহলে তো খেতেই হয়।”
রোদ মুচকি হেসে কথা বলছে।যা পূর্বের একদম ভালো লাগছে না।কী দরকার মেঘের সাথে হেসে কথা বলার?আজ অবধি কোনো দিন তার সাথে তো বলেনি এমন করে।যে কাজের জন্য এখানে আসা সেটাই তো হচ্ছে না পূর্ব ফিসফিস করে নাবিলা’কে বললো,
“কি রে?কিছু বলবি?”
“এভাবে হুট করে পরিচয় দিতে অদ্ভুত অদ্ভুত লাগছে।তার চেয়ে বরং আমার মাথায় একটা প্ল্যান ঘুরছে তা বলি।”
“হুম বল।”
“গাধা!পরে বলবো।”
“আসো তোমরা খাবার টেবিলে।”
“এখন না আন্টি।আরো পরে”(রোদ)
” আচ্ছা তাহলে বাড়িটা ঘুরে দেখলো।মেঘ,ওদের নিয়ে যা।”
“হুম।”
মেঘের সাথে সামনে রোদ হাটছে পেছনে নাবিলা আর পূর্ব।পূর্বের খুব রাগ হচ্ছে!নানিলা’র দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো পূর্ব।এখন তার মেঘের সাথে নাবিলাকে মারতে ইচ্ছে করছে।
।
।
পূর্ব নিজের রুমে বসে রাগে ফুলছে।রোদ বেলকোনিতে দাঁড়িয়ে মেঘ’র সাথে ফোনে কথা বলছে।কিন্তু কী এতো কথা বলছে সেটাই পূর্ব বুঝতে পারছে না।কিছুক্ষণ আগেই তো ওদের বাড়ি থেকে ফিরলো আর এখন কিসের কথা?পূর্বের ইচ্ছে করছে নাবিলা’কে মারতে।ওর জন্যই তো রোদ মেঘের সাথে এতোটা লেগে আছে।পূর্ব চুপিচুপি বেলকোনিতে গেলো।তখন রোদ হু হু করে হাসছে।পূর্ব এক ধ্যানে সেই হাসির দিকে তাকিয়ে রইলো।আজ রোদ’কে সম্পূর্ণ শঙ্খপুষ্পি লাগছে।পূর্ব নামটা বেশ ভালোই দিয়েছে।পূর্ব নিজের অজান্তে রোদকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।হঠাৎ ঠান্ডা হাতের ছোঁয়া পেয়ে রোদ কেঁপে উঠলো।সে ভালো করেই জানে এইটা পূর্ব।কারণ পূর্বের ঘ্রাণ সে ভালো ভাবেই চিনে।পূর্ব এতোটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো যে রোদ চেয়েও নড়াতে পারলো না।ওদিকে ফোনে মেঘ হ্যালো হ্যালো করছে।রোদ বুঝতে পারলো একসময় ‘হ্যালো’ বলাটা বন্ধ হয়ে গেছে।হয়তো কোনো সাড়া না পেয়ে কেটে দিয়েছে।
আজ পূর্ণিমা!চাঁদ মামা চারিদিকে আলো ছড়িয়ে দিয়েছে।পূর্ব-রোদ”এর গা ছোঁয়ে দিচ্ছে সেই আলো!তাদের অজানা ভালোবাসা’য় চাঁদ নিজেই যেনো সাক্ষী।পূর্ব রোদ’কে নিজের দিকে ঘুরিয়ে রোদের ঠোঁট জোড়া নিজে দখল করে নিলো।রোদ জানে না সে কোথায় আছে?কী করছে?তবু এটুকু বুঝতে পারছে এ’সময়টা ভালোলাগা’র সময়।অদ্ভুত সময়!জোসনা’য় যেনো তাদের অদ্ভুত অনুভূতি’র সাক্ষী!
।
।
প্রতিদিনের মতো সকালে ঘুম ভাঙতে পূর্ব রোদের কপালে চুমু দিলো।কখনো রোদ জেগে থাকলে আর কখনো রোদ ঘুমিয়ে থাকলে।তবে রোদ জানে পূর্ব প্রতিদিন তার ঠোঁট জোড়া রোদের ত্বকে ছোঁয়া দে!
অনেক আগে রোদের ঘুম ভেঙ্গেছে।শুধু চোখ বন্ধ করে ছিলো।কারণ সে জানে পূর্ব তার কপালে চুমু দিবেই।তাই রোদ বুঝেও না বুঝার ভান করে।রোদ চোখ বন্ধ করেই বুঝতে পারলো পূর্ব বিছানা থেকে নামতে যাচ্ছে।কিন্তু রোদকে অবাক করে দিয়ে পূর্ব তাকে জড়িয়ে ধরে আবারো শুয়ে পড়লো।ঘুম লাগা কন্ঠে পূর্বে বলছে,
“শঙ্খপুষ্পি,তুমি এভাবে ঘুমিয়ে থাকো আমি দেখি!তুমি জানো ঘুমিয়ে থাকলে তোমাকে কতো সুন্দর লাগে?একদম শঙ্খপুষ্পি’র মতো লাগে।ইশ!”
রোদে গলায় পূর্ব তার মাথা রেখেছে।রোদের কাতুকুতু লাগছে।কিন্তু পূর্ব’কে নড়াতে গেলে বুঝে ফেলবে সে জেগে ছিলো।রোদ আস্তে আস্তে ঘুম ভাঙ্গার অভিনয় করলো।কিন্তু কোনো লাভ হলো না।পূর্ব আগের মতো করেই শুয়ে আছে।এবার রোদ মনে মনে বললো,”হরিচন্দন,সর না ব্যাটা!কতক্ষণ এভাবে থাকবি?”
রোদ হাত-পা নেড়ে সদ্য ঘুম ভাঙ্গার অভিনয় করলো।পাশে তাকিয়ে দেখলো পূর্ব ঘুমের নাটক করছে।রোদ বিড়বিড় করে বললো,”আমার চেয়েও বড় অভিনেতা!”
[চলবে]