পূর্ব-রোদ পর্ব-৪+৫

0
2957

পর্ব ৪+৫
@পূর্ব-রোদ?
#পর্ব_০৪
#লেখিকা_আমিশা_নূর

রোদ মেইন সুইচ অফ করতেই বাড়ির ভিতর হালকা হইচই শুরু হলো।চুপিচুপি পূর্বের জানলার সামনে মই বেয়ে উঠে বক্সে করে আনা “তেলেপোকা” ছেড়ে দিলো।মুহুর্তেই পূর্বের রুম থেকে চেচামেচি শুনা গেলো।রোদ শয়তানি হাসি দিলো।রোদের হাসি বেশিক্ষন স্থায়ী হলো না কারণ এর মধ্যে রাফিয়া’র চিৎকার শুনা গেলো।

“এই রাফিয়া কী সত্যি সত্যি ভূত দেখলো?”বিড়বিড় করতে করতে রোদ রাফিয়ার কাছে গেলো।রাফিয়া’র পুরা শরীর ভয়ে কাঁপছে।রোদ সামনে তাকিয়ে দেখলো কেউএকজন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে।চাঁদের আলোতে ভালো খেয়াল করে রোদ পেছন থেকে বুঝলো ওটা পূর্বের বন্ধু তিহান।তিহান পেছনে ঘুরছে মনে হতেই রোদ রাফিয়ার হাত ধরে গাছের পেছনে নিয়ে গেলো।


বিদ্যুৎ চলে যাওয়া তিহান বাইরে আসছিলো।তখনি একটি মেয়ের চিৎকার তার কানে ভেসে আসলো।তিহান পেছনে ফিরতে দেখলো কেউ নেই।তিহানের মনে ভয় হলো।একে তো রাত তার উপর হুট করে বিদুৎ চলে যাওয়া,তিহান বাইরে আসতেই একটি মেয়ের চিৎকার!তার মনে হচ্ছে আশেপাশে কেউ আছে।সবমিলিয়ে তিহানের যখন মনে হলো কোনো আত্মা আছে ভয়ের ছুটে দৌড়ে বাড়ির ভিতর ঢুকে গেলো।


” পেত্নী চিৎকার করছিলি কেন?ঐটা হরিচন্দনের বন্ধু “ইন্না-লিল্লাহ!”
“রোওওদ!ছেলেটা পুরা নায়ক!”

রোদ রাফিয়া’র দিকে তাকিয়ে দেখলো সে একটা ঘোরের মধ্যে আছে।রোদের ইচ্ছে করছে রাফিয়া’কে এখানেই মেরে পুঁতে দিতে।নিজেরা একটা মিশনে এসে আর রাফিয়া কি’না রাত বারোটাইও ক্রাশ খাচ্ছে?বিরক্তি নিয়ে রোদ পূর্বের জানালার পাশে গেলো।রাফিয়া পেছন পেছন গেলো।


“আআআ রাহান পোকা উড়ছে!” (পূর্ব)
“পোকা নই কুত্তা!তেলেপোকা!”(রাহান)
“কী?আআআআ।আমাকে বাচা তোরা।আআআ”

রোদ জানালা দিয়ে হালকা আলোতে দেখলো পূর্ব রাহানের পেছনে লুকিয়েছে।পূর্বের অবস্থা দেখে রোদ হাসি আটকাতে না পেরে খিলখিলয়ে হেসে দিলো।হাসির শব্দ শুনে পূর্বসহ তার বন্ধুরা জানালার দিকে তাকালো।ততক্ষণে রোদ মই বেয়ে নেমে গেছে।তখনি ওদের কানে আবারো ভেসে আসলো তিহানে আওয়াজ।

“ভূওওওত।পূর্ব তোদের বাড়ির বাইরে পে..পেত্নী আছে।”
“কী?তারমানে একটু আগে পে..পেত্নী হাসছিলো?”

পূর্বের বন্ধু রুমানের কথা শুনে সবাই ভাবতে থাকলো।পূর্বের কানে একটু আগের হাসির শব্দ ঝনঝনিয়ে বাজছে।তার নাজেহাল অবস্থা দেখে প্রতিদিন যে হাসে তারই তো হাসি এইটা।পূর্বের বুঝতে বাকি রইলো না এইসব কাজ কার?


রোদের নিজেকে হালকা মনে হচ্ছে।পুরা একটা দিন অপেক্ষা করার পর প্রতিশোধ নিতে পারলো।যদিও মনের মধ্যে ভয় হচ্ছে পূর্ব তাকে চিনে ফেলেছে বলে।কিন্তু তাও আনন্দটা বেশি হচ্ছে।নিজের মধ্যে খুশি সীমাবদ্ধ রাখতে না পেরে রোদ কানে ইয়ারফোন গুঁজে “বেবি ডল” গানে ডান্স করতে লাগলো।হঠাৎ তার মনে হলো রাফিয়া’কে সাথে নিয়ে ডান্স করা উচিত।কিন্তু রাফিয়া নিজের বাড়ি চলে গেছে।সকালে একসাথে ডান্স করবে ভেবে নিয়ে নাচ থামিয়ে চুপিচুপি আলোর পাশে ঘুমাতে গেলো।বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করতেই আলোর কন্ঠ শুনা গেলো,

“রাত বারোটাই বরের সাথে দেখা করতে যাবি ভাবতে পারিনি।গুড নাইট!”

চমকে গিয়ে রোদ আলোর দিকে তাকিয়ে দেখলো কথাগুলো চোখ বন্ধ করেই বলছে।পূর্বের থেকে প্রতিশোধ নিতে গেলো আর আলো বলছে কি’না দেখা করতে গেলো?ধ্যাত!অল্প বয়সের মেয়েগুলো দু লাইন বেশি বুঝে।


সকালের সূর্য উঁকি দিতেই পূর্ব বাড়ির বাইরে গেলো।বাইর থেকে তার জানালার পাশে গিয়ে দেখলো মই লাগানো।পূর্ব এবার নিশ্চিত হলো কাল রাতে এই জায়গায় কোনো ভূত-প্রেত ছিলো না।এসব কাজ কে করতে পারে?প্রশ্ন মাথায় আসতেই রোদের খিলখিলিয়ে হাসা চেহেরা সামনে ভাসছে।কিন্তু পরশু রোদের পরিক্ষা।সে কীভাবে এখানে আসবে?

কথাগুলো ভাবতে ভাবতে খালি পায়ে হাঁট ছিলো।তখনি পায়ে কিছু একটা আটকে গেলো।হাত দিয়ে উঠিয়ে নিয়ে একটা লেডিস গলার চেইন।পূর্ব ভালোভাবে খেয়াল করে দেখলো এইটা সেই চেইন যেটা রোদ কোনোদিন গলা থেকে খুলে না।পূর্বের জানা মতে এইটা রোদের বাবা’র দেওয়া শেষ উপহার।যার জন্য রোদ খুব যত্ন সহকারে রাখে।এই চেইন এখানে মানে পূর্ব সিওর রোদ আসছিলো।রেগে গিয়ে পূর্ব চেইনটা হাতের মুঠোয় চেপে ধরলো।বিনিময়ে চেইনে থাকা সুইচের মতো জায়গা হাতে ঢুকে গেলো।


“রোদ তোর গলার চেইনটা কোথায়?কালকে তো দেখলাম।”
“চেইন?”

তার মায়ের কথা শুনে রোদ গলায় হাত দিয়ে দেখলো চেইনটা নেই।রোদের বুক’টা ধক করে উঠলো।রোদের কাছে এই চেইনটা অনেক বেশিই গুরুত্বপূর্ণ!তাড়াতাড়ি দৌড়ে রুমে গিয়ে চেইনটা খুঁজতে লাগলো।অনেক খুঁজাখুজির পরও যখন চেইনটা পেলো না তখন রোদের কান্না পেলো।হঠাৎ কাল রাতের কথা পড়তেই রোদ উঠে দাঁড়ালো।তড়িঘড়ি করে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লো।রোদ’কে বেরুতে দেখে তার মা জিজ্ঞেস করলো,

“এতো সকালে কোথাই বেরুচ্ছিস?”
“মামুনি কাজ আছে একটু।রাফিয়া আয়..”
“আরে শুন তো..” (মামুনি)

সকালবেলা রোদের বাসায় রাফিয়া আসছিলো রোদের সাথে দেখা করতে।এখন রোদ রাফিয়া’র হাত ধরে বেরিয়ে গেলো।তার মাথায় এখন শুধু ঘুরছে ‘যেভাবেই হোক চেইন পেতে হবে’।

“মোহাম্মদ মঞ্জীল” এর সামনে রাফিয়া বাইক থামালো।রোদ দৌড়ে পূর্বের জানালার সামনে গেলো।গিয়ে দেখলো মইটা সরানো।তারমানে কেউ একজন এই জায়গায় এসেছিলো।পাগলের মতো রোদ চেইনটা খুঁজতে লাগলো।চেইটা খুঁজে না-পেয়ে রোদ কাঁদতে লাগলো।কোনোদিন রোদের মাথায় আসেনি পাল্টা জবাব দিতে গিয়ে মূল্যবান জিনিস হারাতে হবে।মাটিতে বসেই রোদ কাঁদতে লাগলো।হঠাৎ তার কানে পূর্বের কন্ঠ বাজলো,

“আরে আরে জাদুমন্ত্রী কাঁদতেও জানে?আমি তো ভাবছিলাম শুধু কাঁদাতে জানে।”

পূর্বের কথা শুনে রোদ মাথা উঠালো।কাঁদতে কাঁদত রোদের দুধে আলতা সাদা বর্ণের ত্বক গোলাপী বর্ণ ধারণ করেছে।পূর্বের ঠোঁট কোনে হাসি দেখে রোদের বুঝতে বাকি রইলো না যে পূর্ব সব জানে।

“কিছু খুঁজছো?রকেট টাইপ কিছু?”

পূর্বের পরের কথা শুনে চেইনটা যে পূর্বের কাছে তা রোদ বুঝে গেলো।রেগে গিয়ে পূর্বের দিকে তেড়ে গেলো রোদ।হাফ-হাতা টি-শার্ট ধরে পূর্বকে ধমক দিয়ে বললো,

“তুই নিয়েছিস না আমার চেইন?বল?তোর লজ্জা করে না আমার জিনিস তোর কাছে রাখতে?”
“তোর জিনিস জেনে শুনে আমার কাছে আসলো কেন?আমি তো আর নিতে যায় নি।”
“চুপ!আমার চেইন দিয়ে দেয়।”

রোদের চেচামেচি শুনে পূর্বের বন্ধুরা বেরিয়ে গেলো।তিহান দৌড়ে ওদের থামাতে গেলে রাফিয়া তিহান’কে থামিয়ে বললো,
“বিষয়টা ওদের দুজন’কে মিটিয়ে নিতে দাও!”

“কাল রাতে তুই তো এসেছিলি না আমার জানালার পাশে।তুই এতোটা নির্ধয়?”
“কী করেছ আমি?তুই যাস্ট আমার চেইন’টা দেয়।”
“কী করেছিস তুই?কাল রাতে মেইন সুইচ অফ করে দিয়ে তুই তেলেপোকা ছেড়ে ছিস।ছোট বেলা থেকে আমার তেলেপোকা ভয় করে আর তুই সেটার সু্যোগ…”
“বেশ করেছি!চুলকানি পাতা দিয়ে তুই আমাকে কী করেছিস?”
“তুই আগে দিছিস তিহানের জুতা’তে।”
“পাউডার আমি ” ইন্না-লিল্লাহ’র জন্য দিয়ে ছিলাম।তুই কেন পড়ছিলি?দোষটা তোর।”

দুজনে চেচামেচি’ পূর্বের বন্ধু আর রাফিয়া কান চেপে ধরলো।ওরা দু’জন এতোটা রেগে আছে যে কেউ ওদের সামনে যেতেই ভয় পাচ্ছে।হঠাৎ রোদের বলা শেষের কথাটি কানে আসতেই তিহান চোখ বড় বড় করে বললো,”ইন্না-লিল্লাহ!আমি কী করলাম?”তিহানের কথা শুনে সবাই ওর দিকে তাকালো।ওর বাকি বন্ধু বিরক্ত হলেও রাফিয়া তিহানকে শান্তনা দিয়ে বললো,”আপাতত তুমি চুপ থাকো!রোদ রোদ ঝগড়া কন্টিউ কর।”ওরা চারজন যেনো বিষয়টা খুব মনোযোগ ূিয়ে উপভোগ করছে।


“পূর্ব আমার চেইন দে।নয়তো আম্মি বাবাই’কে ডাকবো।”
“ডাক ডাক!আমিও বলে দিবো তুই রাতে এসে তেলেপোকা ছড়িয়ে দিছিস।বেয়াদব মেয়ে!ভয়ে আমি হার্ট এ্যাটাক করলে কী হতো?”
“বেশ হতো!তুই মরলে আমার শান্তি।এখন চেইন দিবি কি’না?”
“দিবো না।কী করবি তুই?”
“হরিচন্দঅঅঅন!”

রেগে গিয়ে আবার কিছু বলার আগে রোদ নিজেকে কন্ট্রোল করে বললো,

“তুই খুব ভালো করে জানিস চেইনটা আমার কাছে কতোটা ইম্পর্ট্যান্ট।”
“আই ডোন্ট কেয়ার!”

রোদ বুঝে গেলো পূর্ব কিছুতেই এখন চেইন দিবেনা।হাতের আঙ্গুল দিয়ে চোখের নিচের জল মুচে বললো,

“কী চাস তুই?চেইনটা কী করলে দিবি?”
“উমমম!বেশি কিছু না।আমার পায়ের জুতোটা কেমন যেন ময়লা হয়ে গেছে।পরিষ্কার করে দিবি নিজের ওড়না দিয়ে।”

শেষের বাক্যটি পূর্ব রোদের ওড়না ধরে টেনে বললো।রেগে গিয়ে রোদ বললো,

“অসম্ভব!”
“তাহলে আঙ্কেলের দেওয়া শেষ স্মৃতিটাও ভূলে যা।”
“পূর্বঅঅ!”

রোদ জানে পূর্বকে ধমকিয়ে লাভ নেই।যা বলেছে তা না করলে কিছুতেই চেইন পাবে না।তার কাছে এখন চেইন বেশি ইম্পর্ট্যান্ট।পরে না হয় এর বদলা নিবে।নিচু হয়ে রোদ পূর্বের জুতা পরিষ্কার করছে।পূর্বসহ বাকিরা সবাই অবাক হয়ে গেলো।ওরা সবাই মনে করেছিলো রোদ চেইনের জন্য অতো নিচু হবে না।কিন্তু সবাই’কে অবাক করে দিয়ে রোদ বিপরীতটা করলো।পূর্বের নিজের মধ্যে কেমন যেন অপরাধ হলো।কিন্তু রাতে কথা মনে পড়তেই সব ধোঁয়াশা হয়ে গেলো।জুতা পরিষ্কার করা শেষ হলে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে রোদ বললো,

“দেখো পূর্ব আমি তোমার জুতো পরিষ্কার করে দিয়েছি।এবার প্লিজ চেইন’টা দিয়ে দাও!”

রোদের কান্নাকাটি,অনুরোধ দেখে পূর্বের খারাপ লাগতে শুরু করলো।তার শুধু মনে হচ্ছে রোদের দূর্বলতা’র সুযোগ নেওয়া ঠিক হয়নি।পেন্টের পকেট থেকে পূর্ব চেইন বের করে রোদের হাতে দিয়ে বললো,

“নেয়!তোর জাদুমন্ত্রী’র জিনিস আমার কাছে রাখার ইচ্ছে নেই।না জানি এর ধারা কখন আমাকেই বশ করে রাখিস।”

পূর্বের কথাগুলো রোদের কানে সুইচের মতো সুক্ষ্মভাবে ঢুকে গেলো।তবুও চুপচাপ রাফিয়ার হাত ধরে বেরিয়ে এতো।তিহান বিড়বিড় করে বললো,

“কথায় আছে,” বাঘ শিকার করার আগে শান্ত থাকে!ইন্না-লিল্লাহ” না জানি রোদ ভাবির পরের স্টেপ কী হয়?”

রোদ গেইট থেকে বের হতেই পূর্বের মা বাইরে বেরিয়ে এলো।পূর্বের মা তাদের সবার উদ্দেশ্য বললো,”কী হয়েছে এখানে?চেচামেচি’র আওয়াজ শুনলাম।”

পূর্বের মায়ের কথা শুনে রাহান ফিসফিস করে তিহান’কে বললো,”পুরা মুভি শেষ হতেই উনার এন্ট্রি নিতে হলো!”
“ইন্না-লিল্লাহ!চুপ কর।”

“পূর্ব কী হয়েছিলো?রো..”
“রাফিয়া।রা..রাফিয়া এসেছিলো জাদুমন্ত্রীর খুঁজ নিতে।আমি বলে দিয়েছি ও নিজের বাড়ি।”

চাঁদনি মোহাম্মদের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে পূর্ব নিজের অজান্তেই মিথ্যা কথা বললো।

“রাফিয়া?কিন্তু ওর বাড়ি তো রোদের পাশেই!”
“হ্যা!আশেপাশে নাকি ওর ফুফির বাসায় আসছিলো,ও ভাবছে জাদুমন্ত্রী এখনো এখানে আছে তাই ওর খুঁজ নিচ্ছিলো।”
“ওহ।কিন্তু চেচামেচি?”

এবার পূর্ব চরমভাবে ফেসে গেলো।রাফিয়া’র সাথে তো পূর্বের কোনোদিন ঝগড়া হয় না।তাহলে মাকে কী বলবে?তখনি তিহান ওর পাশে এসে বললো,

“আমার সাথে বাড়াবাড়ি করছিলো আন্টি।ইন্না-লিল্লাহ!মেয়েটা খুব বাচাল।”
“এই!বাচাল বলবি না।”

এতোক্ষণ ধরে তিহানের মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরছিলো।না পারতে তিহান পূর্বের মাকে জিজ্ঞেস করলো,

“বাই দ্যা ওয়ে আন্টি! আপনি এতোক্ষণ কোথায় ছিলেন?”
“আমি একটু ওয়াশরুমে ছিলাম।”
“ওয়াশরুম?পূর্ব আন্টি ওয়াশরুমে ছিলো।ওয়াশরুম!রাহান আন্টি ওয়াশরুমে ছিলো।ভালো আন্টি।”
“ধূর পাগল।নাস্তা করতে আয়।”

পূর্বের মা বাড়িয় ভিতর ঢুকে গেলো।তিহান বিড়বিড় করে “ইন্না-লিল্লাহ!” বললো।পূর্ব সেদিকে মাথা না ঘামিয়ে রোদ’কে নিয়ে ভাবতে লাগলো।আজকের কাজের জন্য পূর্বের নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে।বরাবরই ছোট বেলা থেকে রোদ কান্না করলে পূর্বের নিজেকে অপরাধী মনে হয়।কিন্তু তবুও ঝগড়া করা থামায় না।

#পর্ব_০৫
#লেখিকা_আমিশা_নূর

পূর্বের মা বাড়ির ভিতর ঢুকে গেলো।তিহান বিড়বিড় করে “ইন্না-লিল্লাহ!” বললো।পূর্ব সেদিকে মাথা না ঘামিয়ে রোদ’কে নিয়ে ভাবতে লাগলো।আজকের কাজের জন্য পূর্বের নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে।বরাবরই ছোট বেলা থেকে রোদ কান্না করলে পূর্বের নিজেকে অপরাধী মনে হয়।কিন্তু তবুও ঝগড়া করা থামায় না।


“রোদ তোর কাল বাদে পরশু পরিক্ষা আর তুই সকাল বেলা কিছু না বলে বেরিয়ে গেলি?”
“রাফিয়ার কাছে একটা ম্যাথ নিয়ে আলোচনা করছিলাম।”
“ওহ।ওমন তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেলি আমি উল্টা পাল্টা ভাবছিলাম।যা ফ্রেশ হয়ে আয়।”
“হুম।”

মাথা নিচু করে রোদ নিজের রুমে চলে আসলো।শান্তভাবে বিছানায় বসে একটু আগের দৃশ্য মনে করতে লাগলো।হাতের মুঠোতে থাকা চেইনের দিকে তাকিয়ে মনেমনে বললো,”আমাকে দিয়ে?মিসেস রোদেলা মোহাম্মদ’কে দিয়ে হরিচন্দন নিজের জুতা মুছালো তো?আমিও এর শেষ দেখে ছাড়বো।”
পরক্ষণে চেইন হারানোর কথা মাথায় আসতেই বললো,”না না ওর সাথে ঝগড়া দিতে গিয়ে চেইন হারিয়ে যাচ্ছিলো।এই চে..চেইনটা আমার কতো আপন!এই চেইন যেটার দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে পূর্ব আমাকে হাতের আঙ্গুলে নাচালো।এবার আমিও পূর্বকে এড়িয়ে যাবো।তখন দেখি কীভাবে কী করে?”


আজ সকাল থেকে রোদের মন খুব ফ্রেশ।যদিও হালকা ভয় হচ্ছে কিন্তু এক্সাইটেড বেশি।আজ থেকে সকাল দশটার সময় রোদের পরিক্ষা শুরু।এখন সাড়ে আটটা।রোদ রুমের মধ্যে নুডলস খেতে খেতে ম্যাথ দেখছিলো।রোদের একটাই লক্ষ্য জিপিএ ফাইভ!কারন পূর্বের চেয়ে তাকে ভালো রেজাল্ট করতে হবে।পূর্বের প্রতি সেমিস্টারে ফাস্ট ক্লাস আসে।তাই রোদ কেও ভালো করতে হবে।রোদ নুডলসের বাটি এক পাশে রেখে এক ধ্যানে আগের করা ম্যাথগুলোর উপর চোখ বুলাচ্ছিলো।তখনি তার রুমে কেউ একজন প্রবেশ করে বললো,

“নয়টা বাজতে আর পাঁচ মিনিট বাকি।তাড়াতাড়ি আসো!”

দুলাইনের কথাটা রোদের মাথার উপর দিয়ে গেলো।পেছন ফিরে দেখলো ফর্মাল ড্রেসে,পেন্টের পকেটে দু’হাত দিয়ে পূর্ব দাঁড়িয়ে আছে।রোদ হা করে তাকিয়ে রইলো।প্রথম পূর্বকে ফর্মাল ড্রেসে এই প্রথম দেখছে,তার উপর এতো মধুমাখা কথা,রোদ’কে আদেশ দেওয়া।সব মিলিয়ে রোদের মাথা ঘুরে গেলো।বিড়বিড় করে বললো,”হায় আল্লাহ!আজকে সূর্য কোন দিকে উঁকি দিছে?”
“হা করে কী দেখছো?তাড়াতাড়ি আসো।”

রোদের এবার মনে হলো সে সব কল্পনায় দেখছে।নাহলে সামনাসামনি এতো ভদ্রভাবে পূর্ব কোনোদিনও কথা বলবে না।কল্পনা মনে করে রোদ বিষয়টা এড়িয়ে আবারো পড়তে লাগলো।পরক্ষণে মনে হলো পূর্বকে নিয়ে এমন সুন্দর কল্পনা তো জীবনেও দেখেনি।তাহলে আজকে হঠাৎ পূর্বের ভদ্র ভূত তার সামনে কেনো আসবে?নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে রোদ বিড়বিড় করে বললো,”রোদ তুই দুদিন ধরে হরিচন্দনকে নিয়ে বেশি ভাবছিস তাই এমন হচ্ছে।নয়টা বেজে গেলো এবার পরিক্ষার জন্য বাড়ি থেকে বের হো।”

রুম থেকে বেরুনোর সময় রোদ খেয়াল করলো পূর্ব এখনো দাঁড়িয়ে আছে।তার কল্পনায় আসা পূর্ব মনে করে রোদ বললো,”তুই কী মনে করিস নিজেকে?যখন ইচ্ছে আমাকে কাঁদাস।সারাক্ষণ ঝগড়া করিস।এবার আমি ঠিক করে নিয়েছি তোর সাথে কথায় বলবো না।শুধু শুধু দাঁড়িয়ে না থেকে ভাগ এখান থেকে।”

পূর্বের গায়ে হালকা চড় দিয়ে রোদ কথাগুলো বললো।তখনি তার মনে হলো কল্পনায় আসা কোনো ব্যাক্তিকে তো ছুঁয়া যায় না।তারমানে পূর্ব সত্যি সত্যি এখানে আছে?

“তত..তুই সত্যি এখানে?”
“তোকে আমি পরে দেখছি।এখন নিচে চল।”

রোদ দৌড়ে নিচে গেলো।গিয়ে দেখলো পূর্বের বাবা-মা এসেছে।এবারে সে অবাকের উচ্চ সীমানায় পৌঁছে গেলো।রোদকে দেখতে পেয়ে চাঁদনি মোহাম্মদ বললো,”এইতো এলি তুই।পূর্ব কোথায়?”
“এইতো মা।রোদ চলো তোমাকে এক্সাম হল’এ ড্রপ করে আসি।”

রোদ শুধু অবাকের পর অবাক হচ্ছে।পরিক্ষা’র হল’এ যাবে তাও পূর্বের সাথে?রোদ “না” বলতে গিয়ে আবার মনে মনে ভাবলো পূর্ব করতে চাই চাইছে কী?এতো ভালো হওয়ার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে।আমি দেখি কী কী করে?

“আচ্ছা আসি আমি।তোমরা সবাই দোয়া করিও।” (রোদ)
“যাহ।সাবধানে যাবি।পূর্ব বাইক আস্তে চালাবি।”(চাঁদনি)

রোদ নিজ ইচ্ছায় সব মেনে নিচ্ছে দেখে পূর্ব অবাক হলো।নরমাল বিহেভ বলতে ওদের মধ্যে ঝগড়াটা।পূর্ব মনে করেছিলো ভালো ব্যবহার করলে রোদ চেচামেচি শুরু করবে।ওর সাথে যেতে চাইবে না।কিন্তু উল্টো সব মেনে নিলো।


রোদ বাইরে বের হতে দেখলো তার বাবা’র পুরনো মোটরসাইকেল’টা দাঁড় করানো।অনেকদিন ধরে বাইকটাতে ধূলো পড়াছিলো কিন্তু এখন একদম পরিষ্কার।যদিও পুরনো কিন্তু স্মৃতি জড়ানো।রোদ হা করে বাইকটার দিকে তাকিয়ে রইলো।তখন পূর্ব এসে বললো,

“তোমার তো অনেক ইচ্ছে ছিলো বাবা’র সাথে উনার মোটরসাইকেলে করে এইচএসসি পরিক্ষা’র হল’এ যেতে।উনি তো বেঁচে নেই ভাবলাম আমি স্বামী হয়ে আমার স্ত্রীর ইচ্ছেটুকু পূরন করি!”

রোদের কানে পূর্বের বলা শেষ কথাটা বার বার বাজছে।পূর্ব তাকে নিজের স্ত্রী বলছে?স্বামী দাবি করছে?রোদের ইচ্ছের দাম দিচ্ছে?কিন্তু পূর্ব এসব করছে কেনো?তাদের মধ্যে তো কোনোদিন স্বামী-স্ত্রী’র সম্পর্ক ছিলো না।তাহলে আজ কেনো পূর্ব সেই অধিকার নিয়ে কথা বলছে?পূর্বের কথায় রোদের মনে অনেক প্রশ্নের উদয় হয়েছে।পরিক্ষা হয়ে গেলে রোদ পূর্বের থেকে এমন করার কারণ জিজ্ঞেস করবে।

পূর্ব বাইকে বসলে রোদ গিয়ে তার পেছনে বসলো।আলতো করে পূর্বের কাঁধে হাত রাখলো।রোদের ছোট বেলার কথা মনে পড়ে গেল।এরকম বাইকে করে রোদ পিএসসি পরিক্ষা দিতে গেছিলো।তবে পূর্বের জায়গায় তার বাবা ছিলো।আজ বাবার জায়গায় পূর্ব বসে আছে ভাবতে বৈশাখের মাতাল হাওয়া রোদ’কে ছুঁয়ে গেলো।রোদ চাইছে সময়টা এখানেই থেমে যাক!স্থীর হয়ে যাক সবকিছু!


“চাঁদনি পূর্বের এতো ভালো ব্যবহার?রোদের নরমাল বিহেভ..এসব কী?” (ছায়া)
“ওদের ভালো ব্যবহার দেখে তোর ভালো লাগছে না?” (চাঁদনি)
“আহা!ভালো কেনো লাগবে না।এই রকম একটা দিনের জন্য এতো বছর অপেক্ষা করেছিলাম।আর সেই দিন দেখে খুশি হবো না?কিন্তু হুট করে পরিবর্তন?”
“পরশু দিন পূর্ব আমাদের বাসায় এসেছিলো।খুব সকালে।তুই জানিস না মনে হয়।”
“পরশু দিন?”

রোদের মা মিসেস ছায়া একটুখানি জোর দিয়ে ভাবতেই মনে পড়লো রোদ সেদিন সকালে রাফিয়া’র বাসায় গেছিলো।

“পরশুদিন তো রাফিয়া’র বাসায় গেছিলো।তারমানে রোদ তোদের বাসায় গেছিলো?কিন্তু কেনো?”

সেদিন চাঁদনি মোহাম্মদ সব কিছু না জানার ভান করে থাকলেও তিনি সবই জানতেন।তিহানের থেকে চাঁদনি মোহাম্মদ সব কিছু জিজ্ঞেস করলে তিহান সব বলে দেয়।সেদিনের রাত এবং সকালের ঘটনা ছায়া’কে খুলে বলতেই রোদের মা হতাশ হলেন।তাকে হতাশ হতে দেখে চাঁদনি মোহাম্মদ বললেন,

“ছায়া এভাবে ভেঙ্গে পরিস না।”
“কী হবে ছেলে-মেয়ে দু’টোর?ওদের বুঝ কখন হবে?এভাবে…”

ছায়া’র গলায় কান্না কান্না ভাব।কন্ঠ স্বর জড়িয়ে আসছে।ছায়া’র অবস্থা দেখে চাঁদনি মোহাম্মদ সোফার তার পাশে বসে শান্তনা দিয়ে বললো,

“ছায়া শান্ত হো তুই।আমি কথা দিচ্ছি তোকে আজকের পর থেকে ওদের মধ্যে সবকিছু, সবকিছু নরমাল হয়ে যাবে।”
“কিন্তু কী ভাবে?”
“আমার উপর আস্তা আছে তো তোর?আমি সব ঠিক করে দিবো।”

চাঁদনির কথায় ছায়া বিশ্বাস রাখলো।মাধ্যমিক থেকে দুজন খুব ঘনিষ্ঠ বান্ধবী।কলেজে তো সবাই ওদের বন্ধুত্ব দেখে জেলাস হতো।ওদের মাঝে ছায়া মানসিক ভাবে দূর্বল হলেও চাঁদনি মোহাম্মদ যথেষ্ট সবল।বরাবর ছায়া ভেঙ্গে পড়লে তার পাশে সবসময় চাঁদনি নামক ‘ছায়া’টা থাকে।


“পরিক্ষা কেমন হয়েছে?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো।”
“ফুল মার্ক্স করেছো?”
“হ্যা।”

পূর্ব যেসব প্রশ্ন করছে রোদ শান্তভাবে সবটার উত্তর দিচ্ছে।রোদ দেখতে চাইছে পূর্ব আরো কী কী করে?পূর্ব মোটরসাইকেলে বসলে রোদও তার পেছনে বসলো।দুজনে কোনো কথা বলছে না।তবে রোদের মনে অনেক প্রশ্ন।নিজের মধ্যে আগ্রহ দমিয়ে রাখতে না পেরে বললো,

“এতো নরমাল বিহেভ ক্যান করছিস?তোরে কে সুপারি দিছে?”
“রোদেলা!স্বামীর সাথে কেউ তুই-তোকারি করে না।”
“তোরে আমি জীবনেও স্বামী মানিনি আর না মানবো।”
“বিয়ে হয়ে গেছে তাই মানা না মানাতে কিছু আসে যায় না।”

পূর্বের কথা শুনে রোদ কিছু বলার শব্দ খুঁজে পেলো।সে না মানলেও তাদের বিয়ে হয়ে গেছে।তবে রোদ নিশ্চিত পূর্বের এমন ব্যবহারের পেছনে “কিন্তু” অবশ্যই আছে।নাহলে যার সাথে চিরশত্রুতা তার সাথে হুট করে নরমাল বিহেভ করাটা মানায় না।

রোদ অনেকক্ষণ ধরে পূর্বের হাতের পিটের দিকে তাকিয়ে আছে।মাধ্যমা থেকে অনামিকা আঙ্গুল পর্যন্ত কাটা দাগ।লাল হয়ে আছে কাটা অংশে।হয়তো কাল’কের কাটা!কিন্তু পূর্ব কাটলো কোথায়?প্রশ্নটা পূর্বকে করতে গিয়ে নিজের মধ্য আড়ষ্টতা অনুভব করলো।তাদের সম্পর্ক যদি অন্য চার-পাঁচটা স্বামী-স্ত্রীর মতো হতো তাহলে হয়তো প্রশ্ন করলে মানা যেতো।কিন্তু এখন..?

সেদিনের পর থেকে পূর্ব প্রতিদিনই রোদ’কে পরিক্ষার হল’এ নেওয়া-আসা করতো।পূর্বের নরমাল বিহেভটা রোদের কাছে অদ্ভুত মনে হতো শুধু।রোদের পরিক্ষা প্রায় শেষের দিকে।প্রত্যেক পরিক্ষায় পূর্বের সাপোর্ট সবচেয়ে বেশি পেয়েছে।তবে রোদের কাছে এসব আদিক্ষেতা ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি।

রোদের পরিক্ষা আর মাত্র দুটো বাকি।তবে আজ শুক্রবার।সকাল বেলা চোখ খুলতেই বিরিয়ানি’র সুগন্ধি নাকে বেঁধে গেলো।সুবাশে রোদ চোখ বন্ধ করে সুগন্ধ অনুভব করলো।একটুপর বিছানা ছেড়ে তাড়াতাড়ি রান্না ঘরে গেলো।গিয়ে দেখলো তার মামুনি চুলার উপরে থাকা বিরিয়ানির নেড়ে দিচ্ছে।তার পাশে রাফিয়া বসে নিজের ইচ্ছে মতো কথা বলছে।

(চলবে..)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে