পূর্ণিমা_সন্ধ্যায় পর্ব_২৮

0
917

পূর্ণিমা_সন্ধ্যায়
পর্ব_২৮
#লেখিকাTasneem Tushar

প্রায় ভোর রাত।

পৌনে তিনটা বাজে। হরর মুভি দেখা শেষে ভয় কাটিয়ে পরিবেশ হালকা করার জন্য সবাই মিলে কিছুক্ষন কার্ড গেম খেলে। এরপর ক্লান্ত হয়ে সবাই যে যার মত ঘুমাতে চলে গেছে। তিয়াশাও এখন বাংক বেডের দোতলায় শুয়ে আছে। পৌষী ও প্যাট্রিসিয়া বেঘোরে ঘুম। কিন্তু তিয়াশার চোখে এক ফোটা ঘুম নেই, শুধু এপাশ ওপাশ করছে। মাথার মধ্যে জন্মদিনের ঘটে যাওয়া ঘটনা ঘুরপাক খাচ্ছে। আদিল ফিরে আসার পরে তার সাথে কোনো কথা বলেনি তিয়াশা। আদিলের কাছ থেকে এখনো জানা হয়নি কেন এমন ভয়ঙ্কর প্ল্যান করেছিল? কি উদ্দেশ্য ছিল তার?

পাশ ফিরে শুতেই জানালা দিয়ে দেখতে পায় আকাশে ঝলমলে তারা জ্বলে উঠেছে। তিয়াশা উৎসুক দৃষ্টিতে তারা গুলো দেখতে থাকে কিন্তু মনের মধ্যে ঠিকই চলছে অনেক প্রশ্নের ঝড়। সেসব ভাবতে ভাবতেই একটা হামি তুলে তিয়াশার চোখ প্রায় লেগে আসে। ঠিক তখনই গগন বিদাড়ি চিৎকারে তিয়াশার পিলে চমকে উঠে। ধরফড়িয়ে উঠে বাংক থেকে লাফ দিয়ে নেমে যায় তিয়াশা।
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন



নেমেই কটেজের সদর দরজার দিকে দৌড় দেয়। মনে হচ্ছে কারো আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। কেউ বোধহয় কোনো বিপদে পড়েছে। কাউকে ডাকবে কিনা ভাবছে তিয়াশা। পরক্ষনেই আবার চিৎকার শুনতে পেলে, তিয়াশা আর কিছু না ভেবেই অন্ধকারের মধ্যেই দরজা খুলে বাহিরে বেরিয়ে যায়।

অন্ধকার হাতরেই আর্ত চিৎকার অনুসরণ করে এগোতে থাকে তিয়াশা। দৌড়তে দৌড়তে পৌঁছে যায় বীচের কাছাকাছি। চিৎকারটি আরো জোড়ালো শোনা যাচ্ছে এখন। আশেপাশেই হয়তো আছে বিপদগ্রস্ত মানুষটি। হঠাৎ খেয়াল হয় তার সাথে ফোন রয়েছে। ফোন বের করে টর্চ লাইট অন করে তিয়াশা। এখন একটু ভালো দেখতে পাচ্ছে সে।

চিৎকারটি এখন গোঙানির শব্দে পরিণত হয়েছে। তিয়াশা এদিক ওদিক ফোনের টর্চ লাইটের আলো সরিয়ে দেখতে থাকে কাউকে দেখতে পায় কিনা। একটা সময় খেয়াল করে কিছু একটা নড়াচড়া করছে। সেদিকে ভালোভাবে আলো ধরতেই দেখতে পায় একটা মানুষের দেহ পরে আছে বালিতে। তিয়াশা দৌড়ে যায়, ফোনটি হাত থেকে নামিয়ে রেখে হাটু গেড়ে বসে বিপদগ্রস্ত মানুষটিকে ডাকতে থাকে।

“এই যে শুনছেন? আপনার কি হয়েছে? আপনার কোনো সাহায্য লাগবে? এখানে কিভাবে এলেন?”

কোনো কথা নেই, শুধু গোঙানির শব্দ আসছে। তিয়াশা ভালোভাবে দেখার জন্য টর্চ লাইটের আলো সেই মানুষটির মুখে ফেলতেই আঁতকে উঠে অস্ফুট চিৎকার বেরিয়ে আসে। একটি সুক্ষ রক্তের ধারা দেখতে পায় তিয়াশা। সাথে সাথে কাঁপা হাতে মানুষটির মাথা কোলে রেখে ডাকতে থাকে কান্নারত কন্ঠে,

“আদিল?…মি. আদিল? বলুন না কি হয়েছে আপনার।”

আদিল কিছু বলছেনা, শুধু পেট চেপে গোঙাচ্ছে। তিয়াশা আবার জিজ্ঞেস করে,

“আদিল কি হয়েছে আপনার? কারা আপনার এই অবস্থা করেছে?”

তিয়াশা দিশেহারা হয়ে ফোন তুলে আদনানের নাম্বারে ডায়াল করে, কিন্তু ফোন বন্ধ পাচ্ছে।

পরপর প্যাট্রিসিয়া ও ম্যাথিউ এর ফোনে ট্রাই করে। কিন্তু নাহ ফোন ঢুকছেনা, আসলে নেটওয়ার্ক পাচ্ছেনা। তিয়াশা কান্না করে দেয় এবার। কি করবে বুঝতে পারছেনা।

বিড়বিড় করে বলতে থাকে,

“নাহ্ ৯১১ এই ফোন দিতে হবে।”

এই বলেই ফোনটিতে ডায়াল করতে যাবে অমনি শুনতে পায় অট্টহাসি। তিয়াশা এখন ভরকে যায়। একেতো আদিলের সাথে অঘটন ঘটেছে আর এদিকে অট্টহাসি, নিশ্চয়ই আদিলকে আহত করা খারাপ মানুষটি আশেপাশেই আছে।

আবার ডায়াল করতে নিবে তখনই হাতের থেকে ফোনটি খপ করে নিয়ে নেয় কেউ। তিয়াশা ঘটনার আকস্মিতায় চমকে যায়। তাকিয়ে দেখে তিয়াশার কোলে মাথা রেখে আদিল দিব্যি অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে। চোখ তার ছানাবড়া। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেনা তিয়াশা।

তিয়াশা ভ্যাবাচেকা পূর্ণ চাহনি নিয়ে বসে আছে। আসলেই বুঝতে পারছেনা কি হয়েছে। আদিল হাসছে না সে ভুল দেখছে। নিশ্চিত হবার জন্য বলে উঠে,

“আদিল? আপনার কি হয়েছে? আপনি ঠিক আছেন তো? আপনি কি হাসছিলেন? কিন্তু আপনি হাসলে চিৎকার করলো কে? আর চিৎকার করলে হাসলো কে?”

ধ্যাৎ কি যে হচ্ছে কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা। পাগল হয়ে যাবো বোধহয়।

হঠাৎ তিয়াশার হাত ধরলে তিয়াশা আবার তাকায় আদিলের দিকে। আদিলের হাতে তার ফোনটি তাতে এখনো টর্চ লাইটটি জ্বলছে। এবং সেই আলোয় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে আদিল তার বত্রিশটি দাঁত বের করে খিলখিল করে হাসছে।

“অসহ্য।”

বলেই তিয়াশা উঠে সরে দাঁড়ায় আর আদিলের মাথা ধুপ করে বালিতে যেয়ে পরে। তিয়াশা কোনদিকে না তাকিয়ে হনহনিয়ে চলে যাচ্ছে আর তখন মনে পরে তার ফোনটি আদিলের হাতে। ফিরে আসলে দেখে আদিল উঠে বসেছে। তিয়াশা আদিলের হাত থেকে টেনে নিজের ফোনটি নিতে গেলে, আদিল খপ করে তিয়াশার হাত শক্ত হাতে ধরে ফেলে। তিয়াশা হাত ঝেড়ে ফেলে চোখ রাঙিয়ে তাকায় আদিলের দিকে। আদিল ও সাথে সাথে সুর তোলে,

“শোনো গো রূপসী ললনা
আমাকে যখন তখন চোখ রাঙানো চলবেনা।”

তিয়াশা হনহন করে কটেজের দিকে রওনা দেয়। আদিল ও পেছন পেছন আসতে থাকে তিয়াশার। তিয়াশা বিরক্তি নিয়ে বলে উঠে,

“আপনি আসছেন কেন? আসবেন না আমার সাথে।”

আদিল আবার ও মজা করে গেয়ে উঠে,

“তুমি যেখানে, আমি সেখানে
সেকি জানোনা…

একি বাঁধনে, বাঁধা দুজনে
ছেড়ে যাবোনা।”

*

তিয়াশার কাছে এসে কানে হাত দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে আদিল। চোখের দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছে সে লজ্জিত তার প্রত্যেকটি কৃতকর্মের জন্য।

“আমাকে ক্ষমা করা যায় কি?”

তিয়াশা চুপচাপ দাঁড়িয়ে। আদিলের কানে ধরে তার সামনে হাটু গেড়ে বসে থাকাটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত তার কাছে। আদিল আবার বলে উঠে,

“খুব বেশি কষ্ট দিয়েছি?”

“উঠুন আপনি।”

“আগে বলো ক্ষমা করেছ?”

“হুম”

“কি হুম?”

“করেছি।”

“কি করেছি?”

“ক্ষমা।”

“সত্যি?”

“হুম।”

তারপর তিয়াশা চলে যেতে নেয় আর আদিল তিয়াশারা হাত টেনে ধরে বলে,

“থাকো কিছুক্ষন।”

“হাত ছাড়ুন।”

“উহু, চলো আমার সাথে।”

“কোথায়?”

“তোমাকে কিছু দেখাবো।”

তিয়াশার চোখে হাত দিয়ে ঢেকে নিয়ে যেতে থাকে আদিল। তিয়াশা অস্থির হয়ে বলে উঠে,

“আরে করছেন কি?”

“আমার উপরে ভরসা রাখো।”

তিয়াশাকে নিয়ে সাগরের পাড়ে দাঁড়ায়, তারপর চোখের থেকে হাত সরিয়ে আঙ্গুল দিয়ে নিশানা করে দেখায় সমুদ্রের পাড়। তিয়াশা খুশিতে লাফিয়ে উঠে, আয়নার মতো স্বচ্ছ জলে যেন প্রতিফলিত হচ্ছে আকাশের অসংখ্য উজ্জ্বল তারা। মনে হয় কোটি জোনাকির আলো আছড়ে পড়ছে পাড়ে ঢেউয়ের সাথে সাথে। কি অপরূপ, মনোমুগ্ধকর দৃশ্য, প্রকৃতি যেন নিজ হাতে লাখো নীল আলোয় সাজিয়ে দিচ্ছে সমুদ্রের পার ঢেউয়ের তালে তালে মিলিয়ে।

তিয়াশা তাকিয়ে ঢেউয়ের দিকে আর আদিল এই অন্ধকারেই তার ভালোবাসার দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে তিয়াশার দিকে। তিয়াশার উচ্ছাসে সে নিজেও আনন্দের জোয়ারে ভাসছে। এক পর্যায়ে আদিল তিয়াশার আরেকটু কাছে এসে হাতের আঙ্গুল স্পর্শ করে বলে,

“তিয়াশা।”

তিয়াশা মুগ্ধ নয়নে যেন ধ্যানে নিমজ্জিত হয়ে নীল আলোর খেলা দেখছে ঢেউয়ের সাথে সাথে। শুধু বলে,

“হুম?”

“জানো? এ উজ্জ্বল নীল আলো আর কিছুর নয়, এক ধরণের সামুদ্রিক ফাইটোপ্লাঙ্কটনের। এর নাম ডিনোফ্ল্যাজেলাটিস যার রয়েছে লুসিফেরাস নামক রাসায়নিক উপাদান যা আলো সৃষ্টি করতে পারে। খুবই ক্ষুদ্র হয় এই জীবগুলো।”

তিয়াশা খুশি হয়ে বলে উঠে,

“ধন্যবাদ।”

“কেন?”

“এই যে এত সুন্দর একটি দৃশ্য দেখানোর জন্য।”

“তোমার ভালো লেগেছে?”

“অসম্ভব ভালো লেগেছে।”

কিছু ভাবতে ভাবতে আদিলকে প্রশ্ন করে,

“একটা প্রশ্ন করি?”

“হুম, করো যা ইচ্ছা।”

“আপনি এত ভালো, তাহলে আমার জন্মদিনে আমাকে এতটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে কেন ফেলেছিলেন?”

“তোমার পুনর্জন্মের জন্য।”

“মানে?”

“তুমি খুব নরম স্বভাবের তিয়াশা। তোমাকে কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলে শক্ত করার জন্য করেছি। এই যে দেখো সেদিনের সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কারণেই কিন্তু আজ তুমি একা অন্ধকারে বের হতে ভয় পাওনি।”

তিয়াশা ভেবে দেখে তাইতো। আসলেই সেদিনের পর থেকে মনে হয় সে নিজেকে যে কোনো পরিস্থিতিতে সামলাতে পারবে। নিজের উপরে আস্থা আছে এখন তার।

“কি ভাবছো?”

“এমনি, কিছুনা।”

“তুমি জানো সেদিন প্রত্যেকটা পদক্ষেপে তোমার সাথে সাথে ছায়ার মতো ছিলাম আমি। তোমাকে একা এক মুহূর্তের জন্যও ছেড়ে দেইনি।”

তিয়াশা অবাক তাকিয়ে থাকে, মুখে কোনো কথা নেই। মনে মনে ভাবছে এই মানুষটা এত কিছু ভেবেছে তাকে নিয়ে। এত কিছু করেছে তার জন্য। এক ধরণের শ্রদ্ধার অনুভূতি সৃষ্টি হয় তিয়াশার মধ্যে আদিলের প্রতি। তিয়াশা বলে,

“আপনাকে ধন্যবাদ।

“সত্যি? সত্যি রাগ নেইতো?”

“উহু। রাগ অভিমান চলে গেছে। সত্যিই আমার পুনর্জন্ম হয়েছে সেদিনের পর থেকে। আমি এখন সত্যিই অনেক কনফিডেন্ট নিজের ওপর।”

“কিন্তু… কিন্তু তখন কেন এমন করলেন? আপনি জানেন আপনাকে ঐ অবস্থায় দেখে কতটা ভয় পেয়েছি?”

“কেন ভয় পেয়েছ কেন?”

“কেন মানে? আপনার যদি সত্যি কিছু হয়ে যেত?”

“হলে কি হতো?”

“উফ কি হতো মানে কি? আল্লাহ মাফ করুক।”

“কেন? আমার জন্য মায়া হয় তোমার?”

তিয়াশা ইতস্তত হয়ে বলে,

“ন..না…তা না।”

“তাহলে কাঁদলে কেন আমাকে ব্যথায় ছটফট করতে দেখে?”

তিয়াশা মুচকি হেসে জানায়,

“সব প্রশ্নের উত্তর হয়না।”

এরপর দুজনই বেশ কিছুক্ষন নীরবে নিভৃতে একসাথে সমুদ্রের পাড় ধরে হেঁটে বেড়ায়। এক সময় হাটতে হাটতে তিয়াশার কানে ফিসফিস করে হঠাৎ আদিল বলে উঠে,

“ভালোবাসি।”

“আমিও।”

চলবে…

আগের পর্বের লিংক: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/permalink/947465892350797

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে