পূর্ণিমা_সন্ধ্যায়
পর্ব_০৮
#লেখিকা_তাসনীম_তুষার
তিয়াশা আপ্রাণ চেষ্টা করছে হিংস্র মানুষরূপী পশুটার হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর।
ভেবে পায়না তিয়াশা, তার সাথেই কেন এমনটা হচ্ছে। সে তো যথেষ্ট শালীনতা বজায় রেখে চলে এই বিদেশ বিভুঁয়ে থেকেও। হাতে গোনা কয়েকটা মানুষের সাথে চলাফেরা করে। কোনো বারে বা আড্ডায় পর্যন্ত যায়না। নেশা বা বাজে কোনো কিছুর সাথেই সে নিজেকে জড়ায় না। সবকিছু থেকে নিজেকে এক প্রকার গুটিয়ে রাখে। তাহলে কেন? কেন বার বার আঘাত পাবে সে? এর কারণ কি তার সহজ সরলতা, নম্রতা ভদ্রতা? মানুষ কে বিশ্বাস করা আর সাহায্যের প্রতিদানে এটাই কি তার পাওনা?
দম বন্ধ হয়ে আসছে তিয়াশার, রাগে ক্ষোভে ঘৃণায় কান্না পাচ্ছে। ড্যানিয়েল জোর পূর্বক তিয়াশার দুই হাত চেপে অনেকটা তিয়াশার উপরে চলে আসে। তিয়াশা আপ্রাণ চেষ্টা করছে হাত ছাড়ানোর। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে ড্যানিয়েলের বিয়ারের খালি বোতলটা হাতের নাগালে পেয়ে যায় তিয়াশা, বাঁচার তাগিদে ওটা দিয়েই সজোরে আঘাত করতে যায় সে। কিন্তু লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয়, অন্য কিছুতে বাড়ি লেগে কাঁচের বোতলটা ভেঙে যায়।
খুব দ্রুত ঘটছে সব ঘটনাগুলো, তিয়াশা কি করছে না করছে নিজেও ভাবার সময় পাচ্ছে না। তিয়াশার হৃদপিন্ড এত জোরে লাফাচ্ছে যেন এখনি বের হয়ে আসবে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। নাহ আর সহ্য করতে পারছেনা সে। সাহস করে তার দুই হাতে যত শক্তি ছিল তার সবটুকু দিয়ে ড্যানিয়েলের বুকে ধাক্কা দেয়। তাল সামলাতে না পেরে অন্য দিকের জানালাতে যেয়ে বাড়ি খায় মাতাল ড্যানিয়েল। হাতে কিছু সময় পায় তিয়াশা এবং তৎক্ষণাৎ গাড়ির দরজা জানালা আনলক করে ফেলে সে।
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
গাড়ির দরজা খুলে বের হতে নিবে অমনি বিশাল এক থাবা এসে তিয়াশার নাক মুখ চেপে ধরে। টেনে হিচড়ে গাড়ির ভেতরে ঢুকাতে চেষ্টা করছে তিয়াশাকে। চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছেনা তিয়াশা, তাও নিজেকে বাঁচাতে আসেপাশে কিছু একটা খোঁজার আশায় হাতড়াতে থাকে। পেয়ে যায় গাড়ির চাবি, সেটা দিয়ে ড্যানিয়েলের বাহুতে বেশ কয়েকবার আঘাত করলে মুখের উপর থেকে হাতের চাপ একটু কমতেই কোনোরকমে সেই নরক থেকে হাচড়ে পাঁচড়ে বের হয়ে আসে সে। প্রাণপণে দৌড়োতে থাকে সে সার্ভিস লেইন ধরে।
হঠাৎ সামনে একটি অবয়ব দেখতে পায় তিয়াশা যেন তার দিকেই আসছে। দূরে কাউকে দেখতে পেয়ে যেন তিয়াশার মনে আশার আলো দেখা দেয়। এই বুঝি কেউ তাকে উদ্ধার করতে এসেছে এই নরক থেকে। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনা সে, চোখে পানি চলে আসে। এক মুহূর্তের জন্য পেছনে তাকিয়ে দেখে শয়তানটাও বের এসেছে গাড়ি থেকে।
আর কিছু না ভেবে, চোখের পানি মুছতে মুছতে দৌড় দেয় সে অচেনা অবয়বটার দিকে। হঠাৎ তিয়াশারা খেয়াল হয় হাত দিয়ে রক্ত ছুটছে তার।
লাল টুকটুকে তাজা রক্ত দেখে প্রচন্ড আঁতকে উঠে তিয়াশা। পুরা দুনিয়াটা কেমন যেন দুলে উঠে ওর, চোখে ঝাপসা দেখতে থাকে। ক্ষণিকবাদেই অন্ধকার যেন তার চারপাশ গ্রাস করে নেয়।
*
মাথাটা তীব্র যন্ত্রনা করছে, ধীরে ধীরে চোখ খোলার চেষ্টা করছে তিয়াশা। তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে সে এখন কোথায় আছে। ঝাপসা চোখে দেখতে পায় দূরে দুজন পুলিশ দাঁড়িয়ে কথা বলছে কারো সাথে। তিয়াশার চোখ আবার বন্ধ হয়ে আসতে নিলে একটা আবছা চেহারা ভেসে আসে তার মুখের কাছে। তিয়াশা ভয়ে চিৎকার করে উঠে এলোপাতাড়ি হাত পা ছুড়তে থাকে সেই ব্যক্তিকে মারার উদ্দেশ্যে।
কানের কাছে শুনতে পায় কেউ আশ্বস্ত কন্ঠে বলছে,
“ভয় পেওনা। কিছু হবেনা তোমার। কেউ কিছু করতে পারবেনা তোমার। প্লিজ শান্ত হও।”
তিয়াশা ভালো ভাবে তাকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। আবছা ভাবটা ধীরে ধীরে কেটে গেলে তিয়াশা দেখতে পায় সামনে থাকা ব্যক্তিটির কলার তার হাতের মুঠোয় মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আছে। তিয়াশা অস্ফুট স্বরে বলে উঠে,
“আ..পনি…? আ… আদিল? আদিল মুজদাহীর?”
উঠে বসার চেষ্টা করলে আদিল বলে,
“তুমি উঠনা এখন। বিশ্রাম নাও।”
“আমি কোথায় এখন?”
“তুমি এম্বুলেন্স এ। তোমার প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য। পুলিশও এসেছে, ইনভেস্টিগেশন চলছে।”
তিয়াশার চোখের কোণ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে, সে আহত কণ্ঠে বলে,
“ড্যানিয়েল…”
আর কিছু বলতে পারেনা, কান্নায় তার কথা যেন দলা পাকিয়ে আসছে। অঝোর ধারায় কান্না শুরু করে তিয়াশা। আদিলের চোখেও পানি চলে এসেছে। তিয়াশার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“অপরাধী ধরা পড়েছে তিয়াশা। তুমি নিশ্চিত থাকো, সে তার উপযুক্ত শাস্তি পাবেই।”
তারপর একটা ক্লিয়ার প্লাস্টিক ব্যাগ থেকে তিয়াশার মোবাইলটি হাতে দিয়ে বলে,
“পুলিশ গাড়ি থেকে এটা খুঁজে পেয়েছে। আমার ধারণা এটা তোমার। তুমি কি চাও আমি তোমার কোনো পরিচিত কাউকে ফোন দিয়ে জানাই?”
তিয়াশা কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন থেকে প্যাট্রিসিয়ার নম্বর বের করে আদিলকে দিয়ে বলে,
“আমার বন্ধু, একসাথে পড়াশোনা করি তাকে একটু ফোন দিয়ে এখানে আসতে বলেন। তাহলেই হবে।”
আদিল দেরি না করে তিয়াশার ফোন থেকেই প্যাট্রিসিয়াকে ফোন দেয় এবং সব কিছু জানিয়ে ঘটনাস্থলে আসতে বলে।
ইতিমধ্যে তিয়াশার জ্ঞান ফিরেছে দেখতে পেয়ে পুলিশ এসে তিয়াশার কাছে ঘটনার বিস্তারিত জেনে নেয়। তারপর তাকে আশ্বস্ত করে বলে যে অপরাধীকে ধরে ফেলা হয়েছে এবং সে তার কৃতকর্মের ফল ভোগ করবে। তারপর তিয়াশাকে হাসপাতালে ট্রিটমেন্টের জন্যে নিতে চাইলে তিয়াশা কান্না করে উঠে বলে,
“No, I don’t want to go to the hospital. I wanna go home.” (না, আমি হাসপাতাল এ যেতে চাইনা। আমি বাড়ি যেতে চাই।)
“But we need to make sure that you are in good health mam.” (কিন্তু আমাদের নিশ্চিত হতে হবে যে আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন ম্যাডাম।)
তিয়াশা তখন উৎকণ্ঠিত হয়ে বলে,
“I am ok sir. Please I need to go home. I will be properly taken care of at home.” (আমি ঠিক আছি জনাব। অনুরোধ করছি, আমি বাসায় যেতে চাই। বাসাতেই আমার সঠিক পরিচর্যা হবে।)
“Ok. Would you be able to go home by yourself.” (আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি নিজে নিজে বাড়িতে যেতে পারবেন?)
প্যাট্রিসিয়া ও ম্যাথিউ তখন ঘটনাস্থলে পৌঁছে এবং তিয়াশার পাশে দাঁড়িয়ে পুলিশকে বলে,
“We will take her to home, sir. Thank you for your help.” (আমরা তাকে তার বাসায় নিয়ে যাবো। ধন্যবাদ আপনাদের সহযোগিতার জন্য।)
প্যাট্রিসিয়া তিয়াশাকে ভালোভাবে ধরে অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামায়। আদিল অনুরোধ করে প্যাট্রিসিয়াকে যেন সে তিয়াশাকে নিয়ে আদিলের গাড়িতে উঠে যেহেতু সেটি বেশ বড় গাড়ি এবং তিয়াশা দরকার হলে শুয়ে যেতে পারবে। প্যাট্রিসিয়া ও আদিলের কথায় সম্মতি জানিয়ে তিয়াশাকে ধরে আদিলের গাড়িতে নিয়ে বসায়। আদিল ড্রাইভিং সিটে বসে আর প্যাট্রিসিয়া তিয়াশাকে ধরে পেছনের সিটে বসেছে।
তিয়াশা পুলিশের সামনে নিজেকে যথেষ্ট শক্ত রেখেছিল। কিন্তু গাড়িতে বসেই প্যাট্রিসিয়াকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দেয়। কান্নারত কন্ঠে পুরোটা ঘটনা খুলে বলে। পরে আদিলের সাথেও পরিচয় করে দেয়।
তারপর তিয়াশা তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানায় সময়মত পৌঁছানোর জন্য।
প্যাট্রিসিয়া তিয়াশার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,
“This gentleman deserves your thanks, Tee. Luckily he somehow managed to be here.” (এই ভদ্রলোকই তোমার ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য, টি। সৌভাগ্যপূর্ণ বসত সে সঠিক সময়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছিল।)
তারপর কৌতূহল নিয়ে আদিলকে জিজ্ঞেস করে,
“Mr. Muzdahir, how did you get in spot on the right time?” (মিস্টার মুজদাহির,আপনি কিভাবে সঠিক সময়ে সঠিক জায়গাতে উপস্থিত হলেন?)
*
তিয়াশাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে সবাই যে যার বাসায় চলে যায়। তিয়াশার মা নীলিমা হাবিব তিয়াশার বন্ধুদের থেকে সবটা শুনে খুব কষ্ট পায় মনে। তিনি তিয়াশাকে এ বিষয়ে আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি, কারণ তার উপর দিয়ে অনেক ধকল গিয়েছে, এখন মেয়েকে কিভাবে স্বাভাবিক করা যায় সেটা নিয়েই চিন্তিত তিনি।
তিয়াশা হাতমুখ ধুয়ে চুপচাপ খাবার খেয়ে নিজের বিছানায় এসে ঘুমানোর চেষ্টা করে, কিন্তু বারবার চোখের সামনে তার সেই ভয়ানক দৃশ্য ভেসে উঠতে থাকে। তিয়াশার মনে ভাবনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ আদিলের কথা মনে পরে তিয়াশার। এই স্বল্পপরিচিত লোকটা কিভাবে যেন সবসময় তিয়াশার বিপদে দেবদূত হয়ে আসে। তিয়াশা মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে এবং আনমনে ধন্যবাদ জানায় আদিলকেও।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় আদিল তার সাথে বাংলায় কথা বলেছে। সেটা নাহয় তিয়াশার নাম অথবা আইডি কার্ড দেখে ধারণা করে নিয়েছে।
কিন্তু একটা প্রশ্ন রয়েই যায়, আদিল কিভাবে সঠিক সময়ে তিয়াশার কাছে পৌঁছায়? আদিল করছিল টাই বা কি সেখানে?
পর্ব ০৯ আসছে…
আগের পর্বের লিংক:
পর্ব ০৭: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/permalink/926433071120746/