#পূর্ণতার মাঝেও অপূর্ণতার ছোয়া
#লেখিকাঃশুভ্রতা শুভ্রা
#পর্বঃ১২
আদিল মনে মনে বলল, -“হায় রে ভালোবাসা কাউকে কাদায় কাউকে হাসায়। প্রথম ভালোবাসা হয় তো সত্যিই কাদায়।”
——————
প্রায় দেড় বছর পর আজ বাংলাদেশে ফিরছে আদিল। এই দেড় বছরে অনেক চেষ্টা করেছে সে শুভ্রার কথা ভুলে যেতে। কিন্তু ভুলে যাবো বললেই কি আর ভুলে যাওয়া যায়। দেশের মাটিতে পা রাখতে মনটা প্রশান্তিতে ভরে উঠলো ওর। সে দেখলো ওকে রিসিভ করার জন্য অনুভব, রাজিব আর অভ্র দাড়িয়ে আছে। ওদের দেখে মুচকি হাসলো আদিল।
ওরা সবাই এসে আদিলকে জরিয়ে ধরল। অভ্র বলল,-“শয়তান তুই আমাদের না বলে হুট করে বিদেশ কেন চলে গেলি। জানিস আমাদের কতো মন খারাপ হয়েছিল।”
আদিল বলল, -“বাদ দে এসব। চল বাসায় যাই আম্মু অপেক্ষা করছে হয় তো।”
ওরা সবাই বাড়ি পৌঁছতেই আদিলের মা দৌড়ে এসে আদিলকে জরিয়ে ধরে চোখের পানি ছেড়ে দিলেন।
আদিল ওর আম্মুকে সামলিয়ে সামনে এগিয়ে যেতেই দেখলো নুসরাত গাল ফুলিয়ে ছলছল চোখে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।
আদিল ওর কাছে যেতেই নুসরাত কান্না করে দিলো। সে বলল, -“ভাইয়া তুই যে শুভ্রা আর অনিক ভাইয়াকে ভালো রাখতে বিদেশ গেছিলি। কিন্তু অনিক ভাইয়া ভালো থাকলেও শুভ্রা ভালো নেই।”
আদিল বলল, -“মানে কি বলছিস এগুলো? কি হয়েছে শুভ্রতার! বল”
অভ্র বলল, -“আরে ভাই বলিস না এই দেড় বছরে অনেক কিছু হয়ে গিয়েছে। আমার বোনটা এখন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। ওর সবচেয়ে বড় ভুল হয় তো ছিলো কাউকে অতিরিক্ত ভালোবাসা।”
আদিল বলল, -“কি হয়েছে তোরা আমাকে সব ক্লিয়ার করে বলছিস না কেন? আর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে মানে।” আদিল বলতে বলতে ধপ করে সোফায় বসে পরলো সে মাথার চুল টেনে ধরলো।
কিছুক্ষণ ওই রকম করে বসে থেকে হঠাৎ করে উঠে দাড়িয়ে দৌড়ে গিয়ে অভ্রের সামনে দাড়িয়ে ওর হাত ধরে বলল “কোথায় শুভ্রতা, আমি এখনি যাবো ওর কাছে প্লীজ প্লীজ।”
অভ্র বলল, -“শান্ত হ দোস্ত। একটু রেস্ট নিয়ে নে তারপর না হয় তোকে নিয়ে যাবো।”
আদিল বলল, -“না আমি এখনি যাবো।”
আদিলের জেদের কাছে হার মেনে অভ্র বাধ্য হয়ে ওকে শুভ্রার কাছে নিয়ে গেলো।
আদিল দেখলো একটা অন্ধকার রুমে জানালার পাশে বসে আছে একটা মেয়ে। চুলগুলো এলোমেলো, গায়ের পোশাকের অবস্থাও খারাপ, চোখে নিচে কালো দাগ পরে গিয়েছে, কেমন যেন সাদাটে ভাব এসেছে ওর মুখে। শুভ্রার এমন অবস্থা দেখে আদিলের বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো।সে আর কিছু না ভেবে দৌড়ে গিয়ে শুভ্রাকে জরিয়ে ধরলো।
শুভ্রা কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না। হঠাৎ করেই শুভ্রা আদিলকে ধাক্কা দিয়ে নিজেও ছিটকে অন্যদিকে সরে গেলো।
হঠাৎ ধাক্কা দেওয়ায় আদিল পরে গেলো। অভ্র গিয়ে ওকে উঠিয়ে রুম থেকে বাহিরে নিয়ে এলো।
আদিল ছলছল দৃষ্টিতে অভ্রের দিকে তাকিয়ে বলল “ওর কি হয়েছে,আর অনিক কোথায়?”
অভ্র একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল, -“ওদের বিয়ের পর কয়েকমাস সব প্রায় ঠিকঠাকই ছিল। সমস্যা তো হলো যখন অনিকে ফুফু আর ফুফাতো ভাই বোন ওদের সঙ্গে দেখা করতে এলো। অনিকের ফুফু সবসময়ই চেয়েছেন অনিকের সঙ্গে তার মেয়ের বিয়ে দিতে। তিনি এসেই ওদের সম্পর্কে ফাটল ধরানো চেষ্টা করে। ওনি কিভাবে যেন খবর পেয়ে গিয়েছিলেন অনিকের বন্ধুও শুভ্রাকে পছন্দ করতো। আর ওনার পক্ষে জানাও বেশি টাফ ছিলোনা। কারণ উনি ওনাদের এলাকার এমপি ছিলেন আর ওনার অনেক লোক আছে খোজখবর নেওয়ার। ওনি তোর পিক আর শুভ্রার পিক একসঙ্গে এডিট অনিককে দেখিয়ে মিথ্যা কথা বলেছেন। এমনকি অনিকের বাবা সব বুঝতে পেরেছিলেন বলে ওর ফুফু ওনাকেও খুন করে এবং তা তুই করছিস বলে চালিয়ে দেন।”
আদিল বলল, -“আমি কেমনে কি। আমি তো দেশেই ছিলাম না।”
অভ্র বলল, -“ওইটাই তো ওর মা নেই দেখে ছোট থেকে ও ওর ফুফুর কাছে মানুষ। ওই মহিলা যা বলছে তাই বিশ্বাস করছে। আমরা অনেক চেষ্টা করছি আসল ঘটনা বলার কিন্তু পারিনি। অনিক ওর বাবা মারা যাওয়ার পর প্রতিদিন রাতে বাসায় এসে শুভ্রাকে মারতো আর ফুফুতো বোনের সঙ্গে বিয়ে কথা বলতো। অতিরিক্ত মানসিক চাপের জন্য শুভ্রা এমন হয়ে গিয়েছে। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি কিন্তু লাভ হয়। ডাক্তার বলেছে ও যেটার জন্য ডিপ্রশনে গিয়েছে। সেটাই পারে একমাএ ওকে সারিয়ে তুলতে।”
আদিল বলল, -“এখন অনিক কোথায়?”
অভ্র বলল, -“ও ওর বাসায় আছে।”
আদিল বলল, -“ওর ফুফাতো বোন কোথায়?”
অভ্র ফুস করে নিশ্বাস ছেড়ে বলল, -“শুভ্রার সঙ্গে ডিভোর্স হওয়ার পর ওদের বিয়ে হয় বিয়ের ছয়মাস পর অনিকের প্রায় অর্ধেক সম্পত্তি নিয়ে ও অন্য ছেলের সঙ্গে চলে যায়। পুরোটাই নিতো কিন্তু পারেনি।”
আদিল উঠে দাড়িয়ে বলল, -“আঙ্কেল আন্টি কোথায়?”
অভ্র বলল, -“আম্মু আব্বু তো রুমে কেন কি হয়েছে?”
আদিল বলল, -“আমি কি যেতে পারি।”
অভ্র বলল, -“হুম কেন না। কিন্তু কি হয়েছে বলবি তো!”
আদিল আর কিছু না বলে রুমের দরজার সামনে গিয়ে দাড়ালো। কোনো মতে শুভ্রার আম্মু আব্বুকে রাজি করিয়ে শুভ্রাকে বিয়ে করলো সে। শুভ্রা আগের থেকে অনেক চুপচাপ হয়ে গেছে। আগে আদিলের সঙ্গে থাকলেই ঝগড়া করতো। কিন্তু এখন কথা বলে না বললেই চলে।
দিন যায় আর আস্তে আস্তে আদিলের সঙ্গে থাকতে থাকতে শুভ্রা অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। খুশেই কাটছিলো ওদের দিন। কিন্তু ওই যে বলে সুখ ক্ষণিকের জন্য আসে। তেমনটা আদিল ও শুভ্রার সঙ্গে ও হয়।
অনিক আদিল আর শুভ্রাকে একসঙ্গে ওই সেই নদীর পাড়ে দেখতে পায়। আসলে হয় তো সবার মন খারাপ থেকে ভালো করার জায়গা একই ছিলো।
আদিল প্রায় প্রতিদিন তার শুভ্রতাকে নিয়ে সেই নদীর পাড়ে ঘুরতে যেতো। হঠাৎ করেই একদিন অনিক ওদের তুলে নিয়ে যায়। ওদের দুইজনকে চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে রাখে। ওরা পিটপিট করে চোখ খুলতেই সামনে অনিককে দেখতে পায়। শুভ্রা অনিককে দেখে নিজেকে অনেকটা গুটিয়ে নেয়।
অনিক তার গান আদিলের কপালে ঠেকিয়ে বলল, -“কেন তুই আমার আব্বুকে মারলি? তুই তো জানতিস আমার মা আমার জন্মের সময়েই মারা গিয়েছিলেন আর আমার বাবা। কি অপরাধ করেছিলেন ওনি? তোর শত্রু তো আমি ছিলাম তাহলে কেন তুই ওনাকে কেন কেন বলল?
আদিল বলল, -“তোর ফুফু তোকে…..
আদিলের কথার মাঝখানেই লামিয়া বেগম মানে অনিকের ফুফু এসে বললেন,
-“অনিক তুই এখনো একে বাঁচিয়ে রাখছিস কেন? ও তোর বাবাকে খুন করেছে ওর বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই।”
অনিক গুলি করে আদিলকে কিন্তু তার আগেই পুলিশ এসে অনিকের হাতে গুলি করায় ওর নিশানা অন্যদিকে চলে যায় আর গুলি গিয়ে লাগে লামিয়া বেগমের বুকে।
লামিয়া বেগম বুকে হাত চেপে ধরে শুভ্রার দিকে গান তাক করে বললেন তুই ছিলি আসল ঝামেলা তোকে আমার আগে মারতে হতো বলেই তিনি গুলি করে দিলেন। আদিল অনেক চেষ্টা করলো নিজেকে ছাড়িয়ে শুভ্রাকে বাঁচাতে কিন্তু সে নিজেকে ছাড়ানোর আগেই গুলি শুভ্রার মাথা লাগলো। শুভ্রা সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে গেলো। আদিল “শুভ্রতা” বলে চিল্লিয়ে উঠলো।
অভ্র রাজিব অনুভব দৌড়ে এলো। পুলিশ এসে অনিককে নিয়ে গেলো।
রাজিব এসে আদিলকে খুলে দিতেই আদিল দৌড়ে শুভ্রা কাছে বসে ওকে ডাকতে লাগলো অনুভব বলল, -” ওকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিতে হবে চল।”
আদিল শুভ্রাকে কোলে নিয়ে দৌড়ে বাহিরে বের হয়ে গাড়িতে বসলো। সবাই মিলে শুভ্রাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। ওকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হলো। অন্যদিকে আদিল শুভ্রার এমন অবস্থা দেখে কি করবে কিছু বুঝতে পারছে না। ও অপারেশন থিয়েটারের সামনেই ঠাস করে বসে পরলো।
কিছুক্ষণ পর আবার উঠে অভ্র রাজিব আর অনুভবের কাছে এসে বলতে লাগলো, -” আমিই শুভ্রতাকে আগলে রাখতে পারিনি তাই না বল।” ওরা আদিলকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। হঠাৎ আদিল অজ্ঞান হয়ে গেলো।
দীর্ঘ তিনঘন্টা পর শুভ্রার অপারেশন শেষে ডাক্তার বের হলেন আর যা বললেন তার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলো না। ওনি বললেন,
-“শুভ্রার স্মৃতি থেকে দীর্ঘ তিন চার বা এর বেশি সময়ের স্মৃতি মিশে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।”
আদিলের এই কথা শুনে যেন ওর পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেলো। ও ধপ করে বসে পরল।
পরের দিন গুলোতে শুভ্রার আর কিছুই মনে ছিলো না। কিছু মনে করাতে গেলেই তার মাথা ব্যথা করতো আর সে অজ্ঞান হয়ে যেতো। আর অতিরিক্ত অজ্ঞান হলে তার কোমায় চলে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিলো। তাই…..
(চলবে)