#পুতুল_বিয়ে
(এক আপুর জীবন কাহিনী)
#৯ম_এবং_শেষ_পর্ব
#অনন্য_শফিক
‘
‘
‘
টানা পানি ভাঙতে শুরু করে আমার।আর শরীর হয়ে আসে অসাড়। বিছানা থেকে কিছুতেই উঠতে পারি না। আমার ভয় করছে। খুব ভয় করছে।
আমার শাশুড়ি পাড়ার ধাত্রীকে ডেকে আনেন।ধাত্রী এসে আমায় দেখে বলে,’এইডা কোনো সমস্যাই না। আউয়াল কবিরাজের কাছ থিকা উতার পড়া (পানি পড়া)নিয়া আসো গিয়া।খাওয়াইয়া দিলেই দেখবা আবু (বাচ্চা)নিজেই খালাস হইয়া গেছে!’
আমার শাশুড়ি মিতুলকে খুঁজতে থাকেন। তাকে বাড়িতে খুঁজে পান না।ফোন করেন। রিং হলেও সে রিসিভ করে না। অবশেষে আমার শাশুড়ি নিজেই পানি পড়া আনতে যান। পানি পড়া নিয়ে আসেন আরো ঘন্টাখানেক পর। তখনও পেটের ব্যথাটা চিনচিনে। কষ্ট হচ্ছে খুব আমার।
সুলেমা ধাত্রী তাড়াহুড়ো করে আমায় পানি পড়া খাইয়ে দেয়।একটু পানি ছিটিয়েও দেয় শরীরের উপর।
পানি পড়ায় কোন কাজ হয় না।ব্যথা বাড়ে না। আমার সাড়া শরীর তখন কাঁপতে শুরু করে।সুলেমা ধাত্রী তার ইচ্ছেমতো চেষ্টা কসরত করে যাচ্ছে।আমি জানি এইসব কিছু আমার জন্য কতটা ক্ষতিকর। কিন্তু আমি না বলতে পারছি না।না বললে ওরা কেউ শুনবে না!
মিতুল তো জানে দু’দিন ধরে আমার শরীর খারাপ।সে নিজেই তো এর জন্য দায়ী।ওর কী উচিৎ ছিল না আমার পাশে থাকা! আমার জন্য কিছু একটা করা!
এতো দিন পর আমি বুঝতে পারি মিতুল আসলে আমার কেউ না।এই জীবন মরনের সন্ধিক্ষণেও যেহেতু সে আমার পাশে রইলো না তবে সে আমার হতে পারে কী করে?
আমার কান্না আসছে। বুকের ভেতর থেকে তীব্র বেগে ঝড়ের মতো তান্ডব চালিয়েছে সেই কান্না। আমি দু হাতে মুখ চেপে ধরে কান্না শুরু করেছি। আমার শাশুড়ি তখন বলে,’কাঁদবা না।আল্লা খোদার নাম নেও।আল্লা খোদার নাম নেও।আল্লাই আসান করবো!’
আমি চুপিচুপি আল্লাহকে ডাকি।আর মার কথা ভাবি।বড় বোনের কথা ভাবি। কেন আমি অতগুলো ভুল করলাম?কেন অন্ধ আবেগের পেছনে দৌড়ালাম দিনের পর দিন? কার জন্য আমি কাঁদলাম রাতভর। চোখের জল ফেলে কার জন্য বালিশের পেট ভেজালাম!
মা যদি আজ পাশে থাকতো তবে কোন ভয় ছিল না।হাতে একটা পয়সা না থাকলেও তিনি পয়সা জোগাড় করতেন।প্রয়োজনে নিজের শেষ সম্বলটুকুও বিক্রি করে দিতেন। তবুও আমার একটু কষ্ট হতে দিতেন না!
আমার সবকিছু এখন চোখের সামনে ভাসছে। একবার ছোট্ট বেলায় ঈদের বাজারে একটা লাল টুকটুকে জামা দেখে পছন্দ হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মার কাছে বললাম। কিন্তু মার হাতে জামা কেনার মতো টাকা নাই। তিনি রেগে গিয়ে বাজারেই আমায় বললেন,’খালি জামা জামা করস!টাকা কই থেকে আসে?টাকা নাই। জামা কেনা যাবে না!’
সেদিন বাজার থেকে ফেরার সময় কী যে কান্না করেছিলাম আমি!মার প্রতি খুব রাগ হয়েছিল।মনে হয়েছিল আমার মা খুব খারাপ। খুব খুব খারাপ!যার সন্তানের প্রতি কোন মায়া নাই। ভালোবাসা নাই।সে আবার মা হয় কী করে!
কিন্তু ঈদের দিন সকাল বেলা অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটলো।ঘুম থেকে মা আমায় ডেকে তুললেন।আমি ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলে তাকাতেই দেখি মার হাতে সেই লাল টুকটুকে জামা।মা বললেন,’এই নে তোর কলিজা!’
সেদিন জামাটা হাতে নিয়ে কী যে খুশি হয়েছিলাম আমি! আমার জীবনে কোনদিন এমন খুশি হতে পারিনি আমি!
সবকিছু মনে পড়ছে আমার। সবকিছু। এতো দিন আমি অন্ধ ছিলাম।একটা ভ্রান্ত ঘোরের ভেতর ছিলাম আমি!সব ভুলগুলোকেও তখন সঠিক মনে হতো।কারোর কথাই আমার মাথায় ঢুকতো না।মনে হতো ওরা ভুল বলছে।আর আমি যা করছি তাই ঠিক!
কিন্তু আজ আমি বুঝতে পারছি। বুঝতে পারছি জীবনের ভয়ংকর একটা পর্যায়ে এসে পৌঁছে গিয়েছি আমি!যেখান থেকে বেরুবার আর কোন পথ নাই!
দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা এলো।পেটের ব্যথা তখনও বাড়ছে না। আমার শাশুড়ির তেমন তাড়াহুড়ো নেই। তখন রক্ত ভাঙতেও শুরু করেছে।আমি ভয়ে শিউরে উঠছি।মনে হচ্ছে মৃত্যু খুব কাছে।
এই সময় বড় চাচী এসে তাড়া দিলেন। আমার শাশুড়িকে তিনি বললেন,’মেয়েটার যদি কিছু হয় তখন বুঝবা কত ধানে কতো চাল!ওর মা আর মামারা তোমায় জন্মের শিক্ষা দিয়ে ছাড়বে!’
আমার শাশুড়ি তখন ভয় পেয়ে গেলেন।আর তাড়াহুড়ো করে একটা সিএনজি ডেকে সরকারি সদর হসপিটালে নিয়ে গেলেন। কিন্তু ওখানে গিয়ে পড়লাম আরো বিপাকে।নার্সেরা কাছে তেমন ঘেঁষে না।ডাক্তার আসে না।
এদিকে আমার অবস্থা সঙ্কটাপন্ন। মৃত্যুর খুব কাছাকাছি আমি।তখন আর ওদের কারোর উপর আমি ভরসা করতে পারি না। মিতুল হসপিটালে এলেও আমায় একটা ভালো কথা বলে সান্তনা দেয়নি।মনে একটু সাহস জোগায়নি। হসপিটালে আমায় রেখে আবার কোথায় যেন ও নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে।
আমি তখন আমার শাশুড়ির কাছ থেকে ফোন নিয়ে বড় আপুর ফোনে কল করি।বড় আপু প্রথম বারেই ফোন রিসিভ করে।বলে,’কি রে রাফি তোর কোন সমস্যা?’
আমি সঙ্গে সঙ্গে হাউমাউ করে কেঁদে উঠি।কথা বলতে পারি না। তবুও কষ্ট করে বলি,’আপারে,আমি জেলা সদর হসপিটালে ভর্তি।তোরা তাড়াতাড়ি আয়।দেরি করলে আমারে আর পাবি না!’
কথাটা বলে শেষ করতে করতে হাত থেকে ফোন পরে যায় নীচে। আমিও কেমন গোঙাতে থাকি কষ্টে। তীব্র যন্ত্রণায়। তখনও রক্ত ভাঙছে। কিন্তু নার্স ডাক্তারেরা আসছে না!
আপুদের আসতে এক ঘন্টা সময় লাগে।আপু আর মা আসে।মামারা কেউ আসেনি।কারণ তারা আমার নামও শুনতে পারে না।আমি তাদের মান সম্মান জলে ভাসিয়ে দিয়েছি! আমি মরে গেলেই বরং তাদের জন্য ভালো ।
আপু আর মা এসে আমার এই অবস্থা দেখে পাগলের মতো হয়ে যায়।আপু তখন একটা সি এনজি ভাড়া করে সঙ্গে সঙ্গে এই হসপিটাল থেকে একটা প্রাইভেট হসপিটালে নিয়ে আমায় ভর্তি করায়। ওখানে ভর্তি হওয়ার পর ডাক্তার আমায় দেখে আঁতকে উঠে।বলে,’অনেক দেরি হয়ে গেছে। বাচ্চাটা মে বি পানি শূন্যতাই এক্সিডেন্ট হতে পারে!’
কথাটা শুনে ফেলি আমি।আর তখন চিৎকার করে কেঁদে উঠে বলি,’আমায় মেরে ফেলুন। তবুও আমার বাবুর যেন কোন ক্ষতি না হয়!’
আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহর অসীম দয়া। হসপিটালে ভর্তি হওয়ার আধঘন্টা পরই আমার সিজার হয়। এবং সুস্থ সুন্দর ছেলে বাচ্চার জন্ম হয়। বাচ্চা জন্মের পরেও তার বাবার দেখা নাই। শুধুমাত্র আমার শাশুড়ি একদিন ওখানে ছিলেন। তারপর তিনি চলে যান। আমার পেছনে যতো খরচ পত্তর প্রয়োজন সব দেন আমার মা আর বড় আপু।ওরা এক পয়সাও দেয়নি।
অবশেষে আমার ছেলেকে আমি কোলে তুলে নিয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই। হয়তোবা আমার একটু দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু আমি বুঝতে তো পারি!তাই মনে মনে কঠিন শপথ করি।বলি যে, আমার ছেলেকে আমি একা মানুষ করবো। তাকে এমনভাবে গড়ে তুলবো যে কি না নারীদের সম্মান দিতে জানবে। যেখানেই সে দেখবে কোন নারীকে অসম্মান করা হচ্ছে,ঠকানো হচ্ছে সেখানেই সে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমার ছেলে পৃথিবীর অবহেলিত, নির্যাতিত সকল নারীর অধিকার আদায়ে লড়বে! নারীর অধিকার আদায়ে তার জীবন উৎসর্গ করবে!
(আপুদের কাছে বিনীত অনুরোধ, আপনারা রাফির মতো অন্ধ ভালোবাসার মোহে নিজের সুন্দর জীবন নষ্ট করবেন না।আর ভাইয়ারাও ভালোবাসার নাম নিয়ে মিতুলের মতো কোন মেয়ের সুন্দর একটা জীবন নষ্ট করে দিবেন না এভাবে, অবলীলায়! ভালো হোক সবার!)
___সমাপ্ত___