পুতুল ছেলেটি পর্ব-১০

0
1046

#পুতুল_ছেলেটি
#Part_10
#Writer_NOVA

দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমেছে অনেক আগে।আছরের নামাজ পরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে সাহিয়া।ওরা যেই দালানে থাকে তার পাশেই মেইন রোড।বারান্দায় দাঁড়ালে রাস্তার সবকিছু দেখা যায়।ওদের বাসার বরাবরি আফজাল সাহেবের একটা ছোট চায়ের দোকান।তিনি খুব বৃদ্ধ মানুষ।সাহিয়া,সাজিয়া তাকে দাদু বলে সম্বোধন করে। ছেলে তিনটার বিয়ে দিয়েছে। তারা তাদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত।বাবা-মায়ের কোন খোঁজ খবর নেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না।নিজের খরচ চালাতে আফজাল সাহেব কারো কাছে হাত পেতে ভিক্ষা না করে এই ছোট চায়ের দোকান খুলেন।বিকেল হলে বেশ ভীড় দেখা যায়।তার চায়ের খ্যাতি পুরো মহল্লায় আছে।তাই বৃদ্ধ, মধ্যবয়স্ক,যুবক সবাই তার দোকানে চা পান করতে আসে।বিকেল হলে তিনি একা হাঁপিয়ে ওঠেন চা বানাতে বানাতে।তাই ১৫ বছর ছেলে লিপু কাজ করে।কিন্তু সে ভারী অলস টাইপের ছেলে।দোকানে আসা লোকদের সাথে আড্ডায় মেতে যায়। কিছু সময় পর পর আফজাল সাহেবের ডাকে ছুটে আসে।

গুণ গুণ করে গান গাচ্ছে।এর এদিক সেদিক দেখছে সাহিয়া।হঠাৎ আফজাল দাদুর দোকানের দিকে চোখ গেলো।অনেক মানুষের ভীড় দেখা যাচ্ছে। এটা নিত্য দিনের ব্যাপার।কিন্তু এরপর যা দেখলো তার জন্য প্রস্তুত ছিলো না।অবাক চোখে কিছু সময় দাঁড়িয়ে থেকে ছুট লাগালো দোকানের দিকে। যাওয়ার আগে সাজিয়াকে ডেকে বললো।

সাহিয়াঃ দিদিয়া, তুমি কি আমার সাথে যাবে?ও দিদিয়া,আমি ডাকছি শুনছো তুমি? আমার সাথে যাবে তুমি?

সাজিয়া, তুরাগের সাথে কথা বলছিলো।সাহিয়ার ডাকে উত্তর দিলো।

সাজিয়াঃ কি হয়েছে হিয়া?কোথায় যাবি?

সাহিয়াঃ অনেক দিন ধরে আফজাল দাদুর চা খাওয়া হয় না।আমার অনেক খেতে ইচ্ছে করছে। তুমি কি যাবে আমার সাথে?

সাজিয়াঃ চা খেতে মন চাইলে ঘরে বানিয়ে খা।বাইরে যাওয়ার দরকার নেই। দোকানে অনেক মানুষ। ছেলেদের মাঝে গিয়ে চা খাওয়ার কোন মানে হয় না।

সাহিয়াঃ আমি এতো জ্ঞান বিতরণ শুনতে চাইনি।তুমি যাবে কি না তা জিজ্ঞেস করেছি।যেতে চাইলে হ্যাঁ বলবে, না যেতে চাইলে না বলবে।এত কথা শোনানোর কি দরকার?ধূর,কাউকে যেতে হবে না। আমি একাই চলে যাচ্ছি।

সাহিয়ার কথা সাজিয়ার কান দিয়ে ঢুকলো না। কারণ সে আবারো তুরাগের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পরেছে।পা টিপে টিপে আস্তে করে দরজা খুলে বের হয়ে গেলো সাহিয়া।তার মা দেখলে আচ্ছা বকুনি দিবে।সিঁড়ি দিয়ে তাড়াহুড়ো করে নেমে গেল।

💗💗💗

আকিব নিজের মনে মনে নীলাভকে বকছে আর কাজ করছে।কোথায় ভেবেছে আজ কোন কাজ নেই আরামে ঘুমাতে পারবে।তা না করে এখন কাজ করতে হচ্ছে। এই ছেলেটার যে কখন কি হয় তা এতবছর একসাথে থেকেও বুঝতে পারলো না।আফজাল সাহেব নীলাভকে সব দেখিয়ে দিচ্ছে। আর নীলাভ চা বানাচ্ছে। আকিব চা ভর্তি কাপ সবার সামনে নিয়ে পরিবেশন করছে।

আজ লিপু আসেনি।তাছাড়া আফজাল সাহেবের শরীরটাও ভালো না।তাই আজ দোকান বন্ধ করে বাসায় চলে যেতে চেয়েছিলো।তখনই আকিব ও নীলাভের সাথে দেখা।ওরা এই রাস্তা দিয়ে একটা কাজ সেরে ফিরছিলো।এদিক দিয়ে আসার সময় খেয়াল করলো আফজাল সাহেব তার দোকান বন্ধ করছে।তাই ওরা তাকে জিজ্ঞেস করে সব কথা জানতে পারলো।তাই নীলাভ ঠিক করলো আজকের বিকেলে তাকে সাহায্য করবে।যা ভাবা তাই কাজ। নীলাভ চা বানাতে লেগে পরলো।

নীলাভঃ হা করে কি দেখছিস?চায়ের কাপগুলো দিয়ে আয়।কাজের কাজ কিছু করিস না।দুই মিনিট কাজ করলে পাঁচ মিনিট রেস্ট নিস।

আকিবঃ গত আধা ঘণ্টা কাজ করে মাত্র বসলাম।আর তুই বলিস আমি দুই মিনিট কাজ করে পাঁচ মিনিট রেস্ট নেই 😤।(রেগে)

নীলাভঃ কথা কম বল।তুই যে কি কাজ করছিস তাতো আমি দেখতেই পারছি।

আকিবঃ আমি তো জানি তুই এখানে কাজ করছিস কেন?কি ভেবেছিস, আমি কিছু বুঝি না?তুই যে সাহিয়াকে দেখার জন্য এখানে কাজ করছিস তা আমি ভালো করেই জানি।নয়তো তুই সর্টকার্ট রাস্তা ছেড়ে এই রাস্তা দিয়ে কেন এলি?

নীলাভঃ ফালতু কথা কম বল আকিব।আমার কাছে এই রাস্তা কম দূরে মনে হয়েছে।তাই আমি এই রাস্তা দিয়ে এসেছি। কাউকে দেখার জন্য নয়।

আকিবঃ ঐ সব ভাব আমার সাথে নিস না।তুই স্বীকার না করলেও আমি জানি। তুই সাহিয়াকে দেখতেই এসেছিস।

নীলাভঃ আমাকে রাগাস না।আরো মানুষ এসে পড়েছে। তাদের চায়ের কাপ দিয়ে আয়।(ঝাড়ি মেরে)

আকিবঃ হুম পরিসই তো ঐ ঝাড়ি মারতে।কখনো আমার কাছে স্বীকার করতে পারলি না।আমি জানি তুই সাহিয়াকে অনেক ভালোবাসিস।তোর হাব-ভাবে তাই বোঝা যায়। এখন আবার তাকে এক পলক দেখার জন্য এখানে ছুটে এসেছিস।

নীলাভঃ হ্যাঁ,তুই তো সবজান্তা সমসের।তুই জানবি না তো কে জানবে?তুই যা বলবি তাই ঠিক ভাই। এখন দয়া করে চায়ের কাপ দিয়ে এসে আমাকে উদ্ধার কর।

নীলাভ চায়ের পাত্রের ফুটন্ত গরম পানিতে চা-পাতি, চিনি দিতে মনোযোগ হলো।আকিব বির বির করে নীলাভকে আবারো একদফা বকে নিলো।তারপর ট্রে হাতে নিয়ে সবাইকে চা পরিবেশন করতে লাগলো।

💗💗💗

সাহিয়া দৌড়ে রাস্তার অপর পাশে এসে দাঁড়ালো। তখন সে নীলাভকে চায়ের দোকানে দেখেছে।এখনও এসে দেখলো নীলাভ কেটলি থেকে কাপে চা ঢালছে।ছেলেটাকে যত দেখে তত অবাক হয়।কাজ ছাড়া এক মুহুর্তও থাকতে পারে না। এখন আফজাল দাদুকে তার কাজে সাহায্য করছে।এরকম ছেলে খুব কম দেখা যায়।যে নিজের কাজের পাশাপাশি অন্যের কাজে হেল্প করে।চেনা নেই, জানা নেই , এমনকি জীবনেও দেখা হয়নি।সেই আফজাল দাদুর কাজে সাহায্য করছে নীলাভ।ওর কাজের প্রতি শ্রদ্ধা, ভক্তি দেখে সাহিয়া আরো বেশি করে ওর প্রেমে পরে যাচ্ছে।

সাহিয়াঃ আমি এখন দোকানে যাই কি করি?এতগুলো ছেলের মাঝখানে আমি একটা মেয়ে। বিষয়টা তো খারাপ দেখায়।কে বলেছিলো আজকে এত মানুষ হতে।আমি আমার পুতুল ছেলেটির হাতে চা খাবো।আর আজই সবাইকে এসে হানা দিতে হলো।কি আর করার?একটু অপেক্ষা করি।যদি ভিড় কমে।

সাহিয়া দাঁড়িয়ে রইলো।পনের মিনিট হয়ে গেছে। কিন্তু লোক কমার বদলে বেড়েই যাচ্ছে। সাহিয়া দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ভিড় কমছে না।আরো দশ মিনিট পর কমে গেল।দোকানের সামনের টুলে দুজন বসে আছে। সেটা দেখে সাহিয়া খুশিতে এক দৌড় দিয়ে এসে সেই টুলে বসলো। তারপর জোরে চেঁচিয়ে বললো।

সাহিয়াঃ এক কাপ চা দেও তো।চিনি কম দিবে।

মেয়ের কন্ঠ পেয়ে আকিব ও নীলাভ দুজনেই চমকে সামনে তাকালো।তাকিয়ে সাহিয়াকে দেখে আরেক দফা চমকে গেলো।

সাহিয়াঃ আশ্চর্য, আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছো কেন তোমরা?আমি কি এলিয়েন নাকি?আমার পুতুল ছেলের হাতের স্পেশাল চা খাবো।ও পুতুল ছেলে, জলদী জলদী করে আমায় চা তৈরি করে দেও।আমি বেশি সময় বসে থাকতে পারবো না।

আকিবঃ নে নীলাভ,তোর জুলিয়েট চলে এসেছে। আরে রোমিও এখানে আর জুলিয়েট আসবে না তা কি হয়?কত ভালোবাসে তোকে।আর তুই মেয়েটার ভালোবাসা বুঝেও না বোঝার ভান করিস।নীলাভ,
এবার তোর প্রিয় মানুষটার জন্য গরম গরম এক কাপ চা বানিয়ে ফেল।স্পেশাল হওয়া চাই। স্পেশাল মানুষ বলে কথা।

আকিবের টিটকারি মিশ্রিত কথা শুনে নীলাভ ওর দিকে খাইয়া ফালামু লুক দিলো।আকিব চুপ হয়ে গেলো। আকিব আস্তে কথা বলায় সাহিয়া শুনতে পায়নি।সে এখন পা দুলিয়ে রাস্তার দুই পাশে চোখ বুলচ্ছে।যদি কোন পরিচিত কেউ চলে আসে তাহলে ওর ব্যন্ড বাজবে।নীলাভ এই মেয়ের বাচ্চামো যত দেখছে তত শর্কড হচ্ছে। ও কখনো ভাবেনি সাহিয়া ওকে দেখে এখানেও চলে আসবে।

সাহিয়াঃ কিগো চা কি দেবে?নাকি চলে যাবো।

💗💗💗

সাহিয়ার কথার উত্তর আফজাল সাহেব দিলেন।সে সাহিয়াকে তার বাচ্চামো স্বভাবের জন্য অনেক
পছন্দ করে।

আফজালঃ সে কি দাদুভাই?চা না খেয়ে চলে যাবে কেন?একটু বসো। ওরা তো বানিয়ে দিচ্ছে।

সাহিয়াঃ কেমন আছো তুমি দাদু?তোমার শরীর কি ঠিক হয়েছে?

আফজালঃ আলহামদুলিল্লাহ, আগের থেকে একটু ভালো আছি।আজকে শরীরটা অনেক দূর্বল লাগছিলো।তাই দোকান বন্ধ করে দিচ্ছিলাম।তখন আল্লাহ আমার জন্য এই দুই নাতিকে পাঠিয়ে দিলো।

সাহিয়াঃ দেখতে হবে তো কার পুতুল ছেলে😎।আমার পুতুল ছেলে বলে কথা।(ভাব নিয়ে)

সাহিয়া কথাটা বলে নীলাভের দিকে তাকিয়ে দেখলো, নীলাভ ওর দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সাহিয়া একটা বোকা হাসি দিলো।যেটা দেখে নীলাভ মাথা নিচু করে চায়ে কন্ডেস মিল্ক মেশাতে মনোযোগ দিলো।চা বানানো শেষ হতেই আকিব গিয়ে চায়ের কাপ দিলো।

সাহিয়াঃ যে চা বানিয়েছে আমি তার হাত থেকে চায়ের কাপ নিবো। তোমার থেকে নয়।তাই তুমি ভাগো।আর তাকে গিয়ে বলো চায়ের কাপ আমার কাছে দিয়ে যেতে।

সাহিয়ার কথা শুনে আকিব অবাক।ঠোঁট উল্টে ছোট বাচ্চাদের মতো করে অভিমানি সুরে সাহিয়া কথাটা বলেছে।আকিব এসে নীলাভের হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিলো।

আকিবঃ যে বানিয়েছে তার হাত থেকে নিবে।যাও তুমি গিয়ে দিয়ে আসো।(ঠাট্টার সুরে)

নীলাভ বড় একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে চায়ের কাপ নিয়ে দোকানের বাইরে বেরিয়ে এলো।মেয়েটার বাচ্চামো দেখতে দেখতে এবার বোধহয় সে পাগল হয়ে যাবে।সাহিয়ার দিকে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিতেই সাহিয়া খুশিমনে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে নীলাভের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটা হাসি উপহার দিলো।নীলাভ আবার নিজের কাজে ফিরে গেল।সাহিয়া এক ধ্যানে নীলাভের দিকে তাকিয়ে চা শেষ করলো।নীলাভ কাজের মাঝে বারবার আড়চোখে ওকে খেয়াল করেছে। সেটা বুঝতে পেরে সাহিয়া মিটমিট করে হাসলো।চা শেষ হতেই নীলাভের হাতে একটা চকচকে দশ টাকার নোট বাড়িয়ে দিলো।রাস্তা দিয়ে এক দৌড় দিলো।যেতে যেতে নীলাভের দিকে তাকিয়ে বললো।

সাহিয়াঃ টাকার মধ্যে আমার মোবাইল নাম্বার আছে।রাতে কল দিও।আমি তোমার কলের অপেক্ষায় থাকবো।যদি কল না করো তাহলে তোমার ৩৬০ ডিগ্রি বাজাবো।মনে রেখো কথাটা।

সাহিয়া গেইটের ভেতরে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেলো।আর ওর কথা শুনে নীলাভ পুরো থ মেরে দাঁড়িয়ে রইলো। টাকার দিকে তাকিয়ে দেখলো।সেখানে কালো কালি দিয়ে স্পষ্ট মোবাইল নাম্বার লিখা আছে। আকিব তো সাহিয়ার কান্ড দেখে হতবাক।

আকিবঃ মেয়েটা দেখছি তোর থেকেও দুই ডবল আগে।তোকে অনেক ভালোবাসে নীলাভ।

আকিবের কথার বিনিময়ে নীলাভ মুচকি হাসলো। তারপর টাকার নোট-টাকে একটা ভাজ দিয়ে পকেটে ঢুকিয়ে রাখলো।নীলাভের এই কান্ড দেখে আকিব চোখগুলোকে রসগোল্লা বানিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে