পুতুল ছেলেটি পর্ব-০৯

0
1020

#পুতুল_ছেলেটি
#Part_09
#Writer_NOVA

কফি হাউসে গোমড়া মুখে বসে আছে সাহিয়া।এই মুহুর্তে ওর যে কি পরিমাণ রাগ উঠছে একমাত্র ওই বলতে পারবে। বসে থাকতেও পারছে না আবার উঠে যেতেও পারছে না।ওর সামনে বকবক করেই যাচ্ছে তোরাব।সাহিয়ার এখন রাগ উঠছে ওর বোনের ওপর।সে তার হবু বরের সাথে দেখা করতে আসবে আসুক না।তাকে আবার জোর করে আনার কি দরকার।সে না আসলে তো এই তোরাবকেও সহ্য করতে হতো না।

তোরাবঃ সাহিয়া, এনি প্রবলেম?কখন থেকে দেখছি তুমি কিছুটা ছটফট করছো।ভাইয়া আর ভাবী ভেতরে আছে।তোমার যদি অসুবিধা হয় তাহলে আমি ডেকে আনি।(ব্যস্ত হয়ে)

সাহিয়াঃ আই এম ওকে মিস্টার তোরাব।আপনার ব্যস্ত হতে হবে না।এমনি একটু অস্বস্তি লাগছে। (মুখে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে)

তোরাবঃ কি হয়েছে তোমার?কেন অস্বস্তি লাগছে? আমাকে বলো, আমি চেষ্টা করবো সলভ করার।

সাহিয়াঃ ইস,ঢং। এই ব্যাটার ঢং দেখে বাঁচি না।যত্তসব ন্যাকামো।এমন একটা ভাব দেখাচ্ছে, মনে হচ্ছে আমার বয়ফ্রেন্ড। ফালতু কাজ-কাম।(মনে মনে)

তোরাবঃ বললে না তোমার কেন অস্বস্তি লাগছে। আমি চেষ্টা করবো সেটা দূর করতে।

সাহিয়াঃ আমি যে গাউনটা পরেছি তাতে অনেক অস্বস্তি লাগছে। আপনি কি আমার গাউনটা পরবেন?আর আপনার শার্ট-প্যান্ট আমি পরবো।আসলে জামা-কাপড় এক্সচেঞ্জ করার কথা বলছি।

দাঁতে দাঁত চেপে কথাগুলো বলে একটা রাগী লুক দিলো সাহিয়া।তোরাব কিছুটা বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে পরে গেল।এই মেয়ে যে এরকম কিছু বলবে তা ক্ষুণাক্ষরে টের পাইনি সে।তাই মুখটা চুপসে গেল তার।

সাহিয়াঃ কি মিস্টার, পারবেন না তো?তাহলে এখানে চুপ করে বসে থাকেন।একটা কথাও আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই না। (ধমকের সুরে)

সাহিয়ার ধমক শুনে তোরাব পুরো চুপ হয়ে গেল।সাহিয়া বিরক্তি সহকারে ওয়েটারকে ডাকলো।মোটামুটি ৫ ফুট ৮ ইঞ্চির কাছাকাছি একটা ছেলে সামনে এসে দাঁড়ালো। পরনের তার ওয়েটারের ড্রেস।সাহিয়া তার দিকে না তাকিয়ে মেনু কার্ড দেখে অর্ডার দিলো।

সাহিয়াঃ একটা কোল্ড কফি,আরেকটা ডার্ক কফি।তোরাব আপনি কি কোল্ড কফি খাবেন?দিদিয়ার থেকে শুনেছিলাম আপনি নাকি ডার্ক কফি ছাড়া অন্য কিছু খান না।তাই এটাই অর্ডার করলাম।

তোরাবঃ জ্বি আমি ডার্ক কফি ছাড়া অন্য কিছু খাবো না। আমার জন্য আর কিছু অর্ডার করতে হবে না।

সাহিয়াঃ এই দুটোই।আর কিছু লাগবে না।

—- Thanks ম্যাম।আপনারা একটু অপেক্ষা করেন। আমি নিয়ে আসছি।

শুদ্ধ বাংলার মনোমুগ্ধকর উচ্চারণ শুনে চট করে ওয়েটারের দিকে তাকালো সাহিয়া।তাকিয়ে আরেক দফা অবাক।এটা তো তার পুতুল ছেলেটি। নিজের অজান্তেই মুখে হাসি ফুটে উঠলো সাহিয়ার।তার বিনিময়ে নীলাভ মুচকি হাসি দিয়ে অন্য দিকে চলে গেল। শুক্রবারের এই একটা দিন এই কফি হাউসে কাজ করে নীলাভ।সাপ্তাহিক ছুটির দিন থাকায় প্রচুর মানুষের আনাগোনা থাকে এই কফি হাউসে। তাই মালিক শুধু একদিনের জন্য কতগুলো ওয়েটার আলাদা রেখেছে। তাদের মধ্যে নীলাভও আছে।

💗💗💗

নিজ বাড়ির উঠোনে বসে চিন্তায় আছে হাবিবুর রহমান। বিকালে পড়ন্ত রোদ উঠোনের পাশে থাকা আমগাছের পাতায় চিকচিক করছে।এক ধ্যানে সেদিকে তাকিয়ে আছেন তিনি।নিজের জীবনের ওপর বিতৃষ্ণা সৃষ্টি হচ্ছে তার।বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না আজকাল।প্রচুর পেরেশানি তাকে ঘিরে ধরেছে। পাশেই এসে বসলো মিনারা খাতুন। আজও তার সাথে পানের বাটা নিয়ে বসেছে।

মিনারাঃ কি হয়েছে আপনের মাহিমের আব্বা? আমারে কিছু কন না কে?আপনে সারাদিন কি এমন চিন্তা করেন?

হাবিবুরঃ আমার পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়ে গেছে মাহিমের মা।খুব শীঘ্রই তা ধ্বংস হইবো।সারাজীবন অন্যের সম্পদ মাইরা খাইছি।অন্যের জিনিস জোর-জবরদস্তি কইরা নিজের নাম করছি।এবার সেগুলোর বিচার হইবো আমার।টাকার গন্ধে, অন্ধ হইয়া গেছিলাম আমি।টাকার নেশা আমরে এতটা ধরছিলো যে আমি হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে গেছিলাম।কোনটা ভালো কোনটা মন্দ তা বিচার করি নাই।মনে করছি আমি যা করছি তাই ঠিক।কিন্তু এখন দেখতাছি কত অন্যায় করছি আমি এই গ্রামের মানুষের লগে।

মিনারাঃ আমার কথা তো হুনেন(শুনেন) নাই।কত কইছি এগুলা কইরেন না।মাইনষের বদদোয়া কামাইয়েন না।মজলুমের (অত্যাচারিত) বদদোয়া আল্লাহ কবুল করে। কিন্তু আপনে আমার কথা কানেই দেন নাই।উল্টা আমারেই তালাক দেওনের ডর দেহাইছেন।আমি সেই ভয়ে চুপ কইরা রইছি।কিন্তু ঐ যে ওপরে একজন আল্লাহ আছে।সে কিন্তু কারো লগে অবিচার করে না।কারণ তার কাছে সব বান্দাই সমান।এখন শেষ বয়সে আইয়া আফসোস করলে কি হইবো?

হাবিবুরঃ তখন আমার রাস্তায় বাধা দিতে আইছে তারে মারতেও আমার বুক কাপে নাই।কিন্তু এখন তো কলিজা শুইদ্দা কাঁপতাছে।সরকারের থিকা গ্রামের মানুষের লিগা যে ত্রাণ আইতো তার ১০ ভাগ বিলাইতাম।আর বাকি ৯০ ভাগ নিজের গোডাউনে ঢুকাইতাম।তারপর সেগুলো আবার চড়া দামে হাটে বিক্রি করতাম।কত টাকা মাইরা খাইছি তার কোন হিসাব নাই।ফ্যাক্টরীতে কাম করনের লোকগুলোরে ঠিক মতো বেতন দিতাম না।তাগো লগে ভালো ব্যবহার করতাম না।ফ্যাক্টরীতে দুই নাম্বার জিনিসপত্র বানাইতাম।আজ ভাইবা দেখি কি ভুল করছি জীবনে। ঐ পুতুল ছেলেটি আমার বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় করে ভালোই করছে।আমার তো ফাঁসি হওনের দরকার।ছেলেটা মনে হয় অনেক ভালো।তাই তো এখনো আমার কোন অপরাধ ফাঁস করে নাই।

মিনারাঃ হয়তো পোলাডায় আপনেরে ভালো হওয়ার একটা সুযোগ দিছে।আপনি এগুলো ছাইরা ভালো হইয়া যান।আর ঐ পোলার পেছনে লোক লাগাইয়েন না।ওরে ওর মতো থাকতে দেন।আপনে এবার ভালো পথে আইসা পরেন।গ্রামের হক্কল মানুষের থিকা মাফ চাইয়া তাগোর লিগা ভালো কাজ করেন।দেখবেন সবাই আপনেরে ভালোবাসবো।আপনিও নতুন কইরা বাঁচার আনন্দ পাইবেন।ভালো মানুষ হইয়া বাঁচার আনন্দই আলাদা।

হাবিবুরঃ হো তুমি ঠিক কথা কইছো মাহিমের মা।আমি সকলের থিকা মাফ চামু।তারপর সবার জন্য ভালো কাজ করমু।এটাই একমাত্র আমার মনের শান্তি দিতে পারবো।আমি এখুনিই রবিনরে কল কইরা কইতাছি। ঐ পুতুল ছেলেটির কোন খোঁজ না লাগাইতে।যদি ওরে কখনো পায় তাহলে আমাদের বাড়িতে দাওয়াত কইরা আইনা ভালো-মন্দ খাওয়ামু।ঐ ছেলেই আমার চোখ খুলে দিছে।আর ওরে যদি সেই খুশিতে একদিন দাওয়াত করে না খাওয়াই।তাহলে আমি মইরাও শান্তি পামু না।

হাবিবুর রহমান খুশিমনে নিজের রুমে চলে গেল। রবিনকে কল করে বলতে হবে তো। ঐ পুতুল ছেলেটি কে আর না খুঁজতে। যদি খুঁজে পায় তাহলে দাওয়াত করে আসতে।মিনারা খাতুন খুশি মনে পান সাজিয়ে তা মুখে পুরলো।আজ তার ভেতরেও একটা অন্যরকম প্রশান্তি অনুভব করছে।

💗💗💗

নীলাভ কফি দিয়ে খালি ট্রে হাতে ভেতরে ঢুকতে নিলেই দরজার আড়াল থেকে একজোড়া হাত এসে ওকে টেনে অন্যদিকে নিয়ে গেল।নীলাভ অনেকটা ভয় পেয়ে গেলো।সামনে তাকিয়ে দেখে সাহিয়া অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। নীলাভের মুখে মাস্ক,চোখে সানগ্লাস না থাকায় সাহিয়ার ওকে চিনতে বেগ পায়নি।মাথায় কালো ক্যাপটা উল্টো করে রাখা।নীলাভ ওর হাত সরিয়ে কাজে মনোযোগ দিলো।

সাহিয়াঃ ও হ্যালো এমন একটা ভাব নিচ্ছো।মনে হচ্ছে আমাকে চিনোই না।জীবনেও দেখোনি।ভাব কম নেও।এই ভাবগুলো অন্য কারো সাথে দেখিয়ো।আমার সাথে নয়।

নীলাভ ভ্রু কুঁচকে নিজের কাজে মন দেওয়ার চেষ্টা করলো।সাহিয়া এবার ওর সামনে এসে দুই হাত কোমড়ে রেখে বললো।

সাহিয়াঃ এই যে বলে রাখছি তোমাকে।কান খুলে শুনে রাখো।এই পুতুল ছেলে,পুতুল ছেলে।তুমি আমার সাথে এরকম ভাব নিয়ে থাকবে না বলে দিচ্ছি। তোমার এই ভাব আমার একটুও ভালো লাগে না।

নীলাভঃ ম্যাম আমি কাজ করছি।আমাকে ডিস্টার্ব না করলে ভালো হয়।আপনার কিছু লাগলে অর্ডার করুন।আমি নিজে গিয়ে দিয়ে আসবো।

নীলাভের কথা শুনে সাহিয়ার মাথা গরম হয়ে গেল।আর নীলাভ মনে মনে ভাবছে, মেয়েটা কতটা এক্সপার্ট। সেদিন দেখা হলো আর আজ তুমি তে নেমে গেছে। কিন্তু ওর মুখে তুমি ডাক শুনতে খারাপ লাগছে না।বরং ভালো লাগা সারা হৃদয়ে ছেয়ে গেছে। কিন্তু বাইরের একটা মেয়ের সাথে নীলাভকে মালিক দেখলে তার মনে খারাপ ধারণা সৃষ্টি হতে পারে। তাই সাহিয়াকে ইগনোর করছে সে।

সাহিয়াঃ একদম ঢং করবে না।তোমাকে তুলে নিয়ে পালাবো বলে দিলাম।

বাচ্চাদের মতো ঠোঁট ফুলিয়ে কথাটা বললো সাহিয়া।তা দেখে নীলাভের হাসি এসে পরলো।কিন্তু সেটা আটকে রেখে গম্ভীর মুখে বললো।

নীলাভঃ আপনার মতো বাচ্চা মেয়ে আমাকে তুলে নিয়ে পালাবে?হাসালেন মিস।

সাহিয়াঃ এই এই তুমি কিন্তু আমাকে একটুও বাচ্চা মেয়ে বলবে না। আমার ২৩ বছর বয়স।আমি এবার অনার্স ২য় বর্ষে পড়ি।সবাই বাচ্চা মেয়ে বললেও তোমার মুখ থেকে বাচ্চা ডাক শুনতে চাই না।

নীলাভঃ ২৩ বছর বয়সে অনার্স ২য় বর্ষে কি করে পড়ে?২০ কিংবা ২১ বছরে অনার্স ২য় বর্ষে পড়ার কথা।(চোখ দুটো ছোট ছোট করে)

সাহিয়াঃ সেই কথা আর বলো না।আমি ছোট থাকতে আরো বেশি বাচ্চা দেখতে লাগতো।আমার যখন ৫ বছর বয়স।তখন স্কুলে ভর্তি হতে গেছি।তখন স্কলের টিচাররা কিছুতেই বিশ্বাস করেনি যে আমার বয়স ৫ বছর।আমাকে নাকি আরো কম বয়সের দেখা যায়।কি আর করার সেখানে এক বছর গ্যাপ।৬ বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি হলাম।যখন ক্লাশ ফাইভে পরীক্ষা দিবো।তখন হেড স্যার বাবাকে ডেকে বলে,আপনার মেয়েকে তো দেখে অনেক ছোট লাগে।ও এতো চাপ নিতে পারবে না। তাই ক্লাশ ফাইভে দুই বছর রেখে দেই।পরেরবার পরীক্ষা দিবে।আবারো আরেক বছর গ্যাপ।এই হলো দুই বছর গ্যাপের কাহিনি। এবার বলো আমি কেন ২৩ বছরে অনার্স ২য় বর্ষে পড়বো না।

সাহিয়ার কথা শুনে নীলাভের হাসি পাচ্ছে। কারণ সে তো এতদিন জানতো এই মেয়েটা একটা বাচ্চা মেয়ে। সাহিয়া হঠাৎ চিৎকার করে বললো।

সাহিয়াঃ পুতুল ছেলে ও পুতুল ছেলে। তোমার নাম কি বলো না?আমার নামও তো তুমি জানো না। আমার নাম হলো সাহিয়া আনজুম। তোমার নাম??

নীলাভঃ সাহিয়া আনজুম!!! খুব সুন্দর নাম।আমার নাম নীলাভ সফওয়াত।

সাহিয়াঃ মাশাআল্লাহ, কত সুন্দর নাম।তোমার চোখের রঙের সাথে তোমার নামটা পুরো মিলে যায়।তুমি কি বাংলাদেশী?

নীলাভঃ জ্বি ম্যাম, আমি বাংলাদেশী।জন্ম অন্য দেশে।কিন্তু এখন আমি বাংলাদেশের নাগরিক।

এর মধ্যেই সাজিয়া তার বোন সাহিয়াকে ডেকে উঠলো।সাহিয়া, নীলাভকে বিদায় জানিয়ে যাওয়ার পথে উদ্যত হলো।কিন্তু কিছু দূর গিয়ে আবার ফিরে আসলো।এগিয়ে এসে কাঁপা কাঁপা হাতে নীলাভের গাল স্পর্শ করলো।আরেক হাতে আরেক গাল স্পর্শ করতে গেলে নীলাভ দুই হাত ধরে ফেললো।সাহিয়া নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। তারপর নীলাভের হাত টেনে নিয়ে তার উল্টো পিঠে আলতো করে চুমু খেলো।নীলাভের চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। সাহিয়া এক চোখ মেরে দৌড়ে সেখান থেকে চলে গেল। আর নীলাভের এখন হার্ট অ্যাটাক করার অবস্থা। মেয়েটা সত্যি বাচ্চা। নয়তো এরকম বাচ্চামো কেউ করে।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে