#পুকুরের সেই আতঙ্ক
৬ষ্ঠ পর্ব
লেখা: #Masud_Rana
জালালুদ্দিন মাতবর বিস্ময় নিয়েই রশিদের পিছু নিয়েছিলেন। এতরাতে কোথায় চলেছে ছেলেটা তার রক্ষা কবজগুলো খুলে! চাঁদের মিহি আলো, মধ্যরাতের স্নিগ্ধ বাতাস, গাছ ঢাকা এই পথ শুন-শান নীরবতার মধ্যে দিয়েও যেন এক আতঙ্কের আভাস দিচ্ছে। তন্দ্রাচ্ছন্নের মতো এগিয়ে যাচ্ছে এখনো রশিদ। ভারী কণ্ঠে তাকে কয়েকবার ডেকেও সাড়া পাননি জালালুদ্দিন মাতবর। অথচ রশিদ অতটাও দূরে নয় যে তার ডাক শুনবে না। আবার তিনি যত দ্রুত রশিদের দিকে এগোচ্ছে তত সে বেশি দূরে সরে যাচ্ছে। চিন্তার গাঢ় ছায়া পড়েছে বুড়ো তান্ত্রিকের মনে। তার গায়েও কোনো রক্ষা কবজ নেই। তাড়াহুড়ো করে বের হওয়ায় পরা হয়নি। কী একটা যেন তার অজানায় ঘটে চলেছে! থমকে দাঁড়ালেন তিনি।
হঠাৎ করে হাঁটা থামিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছে রশিদ। ঘুরে তাকালো বুড়ো তান্ত্রিকের দিকে। দূর থেকে দেখেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে কিছু একটা অস্বাভাবিকতা রয়েছে রশিদের চেহারায়। এ যেন ভেলকি! সামান্য সময়ের মধ্যে রশিদের চেহারা বদলে হয়ে গেল একটা কিশোরী মেয়ের শরীর। শূন্য থেকেই যেন মেয়েটার পাশে উদয় হলো আরও ৫জন কিশোরী। এরা যে কারা তা চিনতে সময় লাগলো না তান্ত্রিকের। তার মানে এতক্ষণ তিনি রশিদকে নয় অনুসরণ করছিলেন ভয়ঙ্কর সেই পিশাচটার সৃষ্টি করা ভ্রমকে। তার মনে খটকা লাগছিল আগে থেকেই। তিনি কী কোনো ফাঁদে পড়েছেন! রশিদ কোথায়! সেও নিশ্চই ভ্রমের শিকার হয়েছে। তাদের দুজনের যদি কোনো ক্ষতি করে ওটা, তাহলে ওটার দ্বারা অসম্ভব আর কিছু নেই। এটার ভ্রম সৃষ্টি এবং সম্মোহনী ক্ষমতা অনুভব করেই রশিদকে বলেছিল তাদের এই গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত। এমন আরও কয়েকজন তান্ত্রিককে খবর দেয়া দরকার যাতে তাদের কোনো ক্ষতি হলে আফসারপুরের মানুষদের ওই পিশাচটার হাত থেকে রক্ষা করতে আসে। ওটার লক্ষ্য শুধু ৬জন মেয়ে নয় আরও বড় কিছু তা তিনি অনুমান করতে পেরেছিলেন। কিন্তু আর যাওয়া হলো না বুঝি!
৬টি মেয়েই মুচকি মুচকি হাসছে একে অপরের দিকে তাকিয়ে। বুড়ো তান্ত্রিক খেয়াল করলেন প্রাচীন সেই পুকুরটার দিকেই ভ্রমটা তাকে টেনে এনেছে। আর দুই মিনিট হাঁটলেই হয়তো ওটার পাড়ে পৌঁছে যাবেন তিনি। কিন্তু মেয়েগুলো তাকে পুরো স্বাধীন করে দিয়ে রাস্তার পাশের কয়েক সারি গাছের ফাঁকা অংশ দিয়ে অন্য পথ ধরলো। এটা পুকুরের দিকে যায় না। এই প্রথম এতটা দিশেহারা অনুভব করলেন জালালুদ্দিন। তিনি কী মেম্বার বাড়িতে ফিরে গিয়ে রশিদ আছে কিনা খোঁজ করবেন, নাকি পুকুর পাড়ে যাবেন। নাকি অনুসরণ করবেন কিশোরীর দলটাকে! কিশোরীর দল না বলে ভ্রমও বলা যায় ওদেরকে। কিন্তু ওটাই সবচেয়ে বেশি টানছে তাকে। এ যেন ভ্রমটা তাকে পথ বেছে নেয়ার স্বাধীনতা দিয়ে তার চোখের সামনে কেবল একটি সুন্দর পথ খুলে সেদিকে তাকে চলতে ত্বরান্বিত করছে!
মেয়েগুলোর পিছুই নিলেন তিনি। ওরা হাঁটছে আর বার বার আড়চোখে বুড়ো তান্ত্রিকের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। হাসিটা যেন তার বুকে আঘাত করছে। বিশেষ করে ওদের চোখ গুলোর দিকে তাকাতেই শরীর ঝাড়া দিয়ে ওঠে যেন। কিছু মন্ত্র উচ্চারণ করতে চাইছে তার মনের ঘুমন্ত দিক। কিন্তু জিহ্বা সাহায্য করছে না। পা দুটো শুধু চলছে সামনের দিকে। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ওরা তাকে! একি! মেয়েগুলো কোথায় গেল! তিনি উত্তেজিত হয়ে এদিক সেদিক তাকাতে লাগলেন। না, পুরোই শূন্যে মিলিয়ে গেছে। মুহূর্তেই যেন তার মধ্যে সমস্ত চেতনা ফিরে এলো। কেন তিনি ভয় পাচ্ছেন! কেন ওটাকে নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে দিচ্ছেন!
ছুটতে লাগলেন তিনি সামনের দিকে। তিনি যেই পথ ধরে ছুটে এসেছেন সেই পথ ধরে কোনো ভাবেই পুকুরের কাছে তার পৌঁছনোর কথা না। কিন্তু তিনি স্পষ্ট তার সামনে পুকুরটাকে দেখতে পাচ্ছেন। পুকুরের উল্টো পাশে তিনি আধো অন্ধকারেও একটা লোককে দাড়িয়ে থাকতে দেখতে পাচ্ছেন। রশিদ! পুকুরের পানিতে রশিদের দিকে মুখ ফিরে সেই ৬টি মেয়ে ভেসে রয়েছে। জালালুদ্দিন মাতবরের দৃষ্টি আটকে গেল মেয়েগুলোর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই অদ্ভুত আকৃতির অবয়বটার দিকে। স্বয়ং শয়তান যেন দাঁড়িয়ে আছে। মহা বিপদ অপেক্ষা করছে রশিদের ভাগ্যে। চিৎকার করে রশিদকে ডাকতে যাবেন হঠাৎ পেছনে কারো অস্তিত্ব অনুভব করলেন। শরীর মুচড়ে উঠলো তার। ৬টা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার থেকে বড়জোর ৫ ফুট দূরে। ভন করে ঘুরে পুকুরের দিকে তাকালেন আবার। সেখানেও ৬টি মেয়ে ওই শয়তানটার সাথে রয়েছে। মানে ১২টি মেয়ে কী করে হলো!
তবে মেয়েগুলো আর হাসছে না। কেমন করুন মুখ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। শুধু ওদের চোখগুলোর দিকে তাকাতেই আতঙ্কের শিহরণ অনুভব করলেন তিনি। মেয়েগুলো একসাথে তাদের বাম হাত তুলে বুড়ো তান্ত্রিকের পায়ের দিকে নির্দেশ করলো। জালালুদ্দিন অজানা ভয় নিয়ে নিজের পায়ের দিকে তাকালেন। গতরাতে পানির নিচে তলিয়ে গিয়েছিল যে রক্ষা কবজগুলো ওগুলো তার পায়ের কাছে পড়ে আছে। কী করে! ওরা কী তাকে সাহায্য করতে চাইছে! ভাববার সময় নেই!
দ্রুত ওগুলো নিজের শরীরে জড়িয়ে নিয়ে চেচাতে চেচাতে লাফিয়ে পড়লেন তিনি পুকুরে!
রশিদ অনুভব করলো তার শরীরে কোনো রক্ষা কবজ নেই,মন্ত্র উচ্চারণ করার জন্য জিহ্বা নড়তে রাজি নয়, পাও জেদ ধরেছে একটু এদিক সেদিক। যাবে না। সেই কুৎসিত হাতটা এগিয়ে আসছে ওটার শরীরকে দূরে রেখেই বাহু প্রসারিত করে, মেয়েগুলো যেন তাকে চিবিয়ে খাবার জন্য দাঁত কটমট করছে। কী আছে ওই চোখগুলোতে! একটা শক্ত হাত চেপে ধরলো তার পা। শেষ বুঝি সব! এমন সময় একটা পরিচিত কণ্ঠের চিৎকার ধ্বনি শুনে কলজে লাফিয়ে উঠল তার। ওস্তাদ! পুকুরের ওপার থেকে লাফিয়ে পড়লো পুকুরে কেউ! ঐতো সাঁতরে এদিকে আসছে! হ্যা, তার বুড়ো তান্ত্রিকই। শক্ত হাতটা ছেড়ে দিল তার পা। মেয়েগুলোর হাসিও থেমে গেল। ডুব দিল একসাথে তারা পানিতে। সেই জন্তুটার মুখ শুধু ঘুরে গেছে জালালুদ্দিন মাতবরের দিকে। নিঃশব্দে ওটায় ডুব মারলো পানিতে। বুড়ো তান্ত্রিক সাঁতরে এগিয়ে আসছেন।
ওরা যে তান্ত্রিককে দেখে ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়নি তা স্পষ্ট বুঝতে পারলো রশিদ। গভীর রাতে এই পুকুরের সমস্ত রাজত্বই শয়তান পিশাচটার। ওস্তাদের কপালে ভয়ানক খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে। আর কিছু ভাববার নেই। যেসব মন্ত্র, উপকরণ ছাড়া শরীর রক্ষা করার নিয়ম শিখেছিল সব আওরাল কয়েক মুহূর্ত। এরপর ঝাঁপিয়ে পড়লো পুকুরে সেও। মেঘ চাঁদকে ঢেকে দিয়ে নিজের অলিখিত সীমানা দখল করে নিল সেই মুহূর্তেই। পুরো চারপাশ অন্ধকারের গহ্বরে হারিয়ে গেল। শুধু দুজন লোকের সাঁতার কাটার শব্দ শোনা যাচ্ছে। তাদের চিৎকার আর কথাগুলো অস্পষ্ট!
পাহারাদার হারুন অপলক দৃষ্টিতে সাপটার দিকে তাকিয়ে আছে। কী সাপ এটা! প্রায় রাতেই গোরস্থানের পাশে এটার দেখা পায় সে। কেমন অদ্ভুত দেখতে সাপটা। টর্চের আলো সরাসরি ওটার উপর ফেলল সে। তার বিশ্বাস কোনো একটা কবরের ভেতর ওটার বাসা। বিরক্ত করছে ওটাকে যাতে ওটা ওর আবাসে ফিরে যায় আর সে দেখতে পায় কার কবরে বাসা বেঁধেছে ওটা। হঠাৎ তার গা টা শিরশির করে উঠল। মেঘের আড়ালে চাঁদটা চলে যাওয়ায় হঠাৎ করে চারপাশ অন্ধকারে ডুবে গেল যেন! সাপটা গোরস্থানে ঢুকে পড়েছে। কৌতূহলতা নিয়ে টর্চের আলো ফেলে ওটার পিছু পিছু এগিয়ে চললো হারুন। ঠিকই আন্দাজ করেছিল সে। একটা কবরের উপরে সৃষ্ট হওয়া গর্তে ঢুকে গেল ওটা। কবরটা চিনতে পেরে বুকটা আবার ধক করে উঠল তার। নুপুরের কবর ওটা। ওর মাথাবিহীন লাশটার ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠল। কী বীভৎস! হঠাৎ মনে হলো কবরটা কেঁপে উঠল যেন। না, এত জোরে সাপের পক্ষে মাটি কাঁপানো সম্ভব! আবার কেঁপে উঠল কবরের মাটি। আৎকে উঠে পিছিয়ে গেল সে। ভয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে আর আতংক নিয়ে তাকিয়ে আছে সেদিকে। একটু দূরে আরেকটা কবরের মাটি কেঁপে উঠল। টর্চ দ্রুত সেদিকে ঘোরালো হারুন। ওটা তুলির কবর! নুপুরের পরে ওর মাথাবিহীন লাশই পুকুরে ভেসে উঠেছিল! একি! কবর ফুঁড়ে যেন বেরিয়ে এলো কিছু! একটা হাত!
চিৎকার করে উল্টো ছুটতে গিয়েই পা হড়কে পরে গেল সে। টর্চটা ছিটকে গিয়ে পড়লো কবর দুটির মাঝখানে। সেই আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে নুপুরের কবর ফুঁড়েও বেরিয়ে এসেছে এক জোড়া হাত। তুলির কবর ফুরেও এরমধ্যে বেরিয়ে এসেছে ওপর হাত। দুটো হাত খাবলে সরিয়ে ফেলছে কবরের উপরের মাটি। পাথর হয়ে পড়ে রইলো হারুন যতক্ষণ পর্যন্ত না কবর দুটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো দুটি মাথাবিহীন মেয়ের শরীর। এক ফোটাও পচন ধরেনি ওগুলোয়। কোনোমতে উঠে উল্টো ঘুরে পাগলের মতো ছুটতে থাকলো সে। অনুভব করছে প্রতি মুহূর্তে তার পিছে রয়েছে মাথা বিহীন দুটো মেয়ের কবর ফুঁড়ে ওঠা লাশ! ……………………………………..
………………..
.
.
. . . . চলবে . . . .
.
.