#পুকুরের সেই আতঙ্ক
২য় পর্ব
লেখা: #Masud_Rana
শক্ত হাতটা টেনে নিয়ে যেতে থাকে তুলিকে পুকুরের দিকে। সর্বশক্তি দিয়ে সে চেঁচাচ্ছে আর হাত ছাড়াতে চেষ্টা করছে। কিন্তু কোনো লাভই হচ্ছে না। একদম পুকুরের পাড়ে নিয়ে এসেছে ওকে নুপুর। আতঙ্কে চোখ মুখ বিকৃত হয়ে এলো তুলির। হচ্ছেটা কী এসব! চিৎকার জুড়ে দিল সে সাহায্যের জন্য। দূর থেকে হৈচৈ এর শব্দ কানে আসছে। তার চেঁচামেচি শুনে ছুটে আসছে গ্রামের লোকেরা। মুখে ক্রুর হাসি ফুটে উঠল নুপুরের। বলল, ‘চল আমার সাথে তুলি, একসঙ্গে মিলেমিশে খেলবো আমরা।’
তুলি কান্নায় ভেঙে পড়লো। এই মুহূর্তে এই পুকুরের পানির থেকে ভয়ানক কিছু যেন তার কাছে আর নেই। সে জানে এই গভীর রাতে নুপুরের প্রেতাত্মা একবার এই পানিতে তাকে নিয়ে গেলে তার আর বাঁচার সম্ভাবনা নেই। কেউ এখনো এসে পৌঁছাচ্ছে না কেন! হঠাৎ করেই নুপুরের হাত নরম হয়ে এলো। সে ছেড়ে দিল তুলিকে। একাই পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়লো। তুলি ভেবেছিল তাকেও পুকুরে ফেলে দেবে সে। কিন্তু নুপুর একা ঝাঁপিয়ে পড়তে কিছুটা অবাক হলো সে। দেখতে দেখতে পানির নিচে তলিয়ে গেল মেয়েটা। স্তম্ভিত হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলো তুলি। ধীরে ধীরে সেখানে ভেসে উঠলো একটা মাথা। কিন্তু নুপুর কোথায়! এমন বীভৎস, ভয়ঙ্কর চোখ আর মুখ এর আগে কখনো দেখেনি সে। চোখ জোড়া জ্বলজ্বল করে জ্বলছে ওটার তুলির দিকে তাকিয়ে। হিসহিস করে উঠলো ওটা। ওটার মুখ থেকে যেন একটা সাপের মাথা বেরিয়ে এসে আবার ঢুকে গেল ভেতরে। এটা যে ওটার জিহ্বা তা বুঝতে বেশ কিছুটা সময় লাগলো তুলির। হচ্ছেটা কী! ঝাপসা আলোতে পুরোপুরি বোঝা না গেলেও এটা যে কোনো মানুষ নয় এতে তুলির সন্দেহ নেই এখন! ভয়ে কাঁপতে লাগলো তুলি। চিৎকার থেমে গেছে তার অনেক আগেই। এখন শুধু ফোঁপাচ্ছে।
ভয়ঙ্কর ভাবে কাঁপছে পুকুরের পানি। বীভৎস প্রাণীটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও ওটার একটা হাত লম্বা হয়ে এগিয়ে আসছে তুলির দিকে পানির নিচ দিয়ে। মুহূর্ত পরেই তুলি অনুভব করলো শক্ত এক জোড়া হাত চেপে ধরেছে তার দুটি পা। আতঙ্কে গলার সব শক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠল সে। এক মুহূর্ত শুধু তার চিৎকার ভারী করে ফেলল পরিবেশকে। তারপরেই তীব্র টান অনুভব করলো সে পায়ে। পানিতে পড়ে গেল সে। পুকুরের মাঝামাঝি টেনে নিয়ে গেল হাতটা তাকে। মুখোমুখি হলো সে ভয়ঙ্কর বীভৎস প্রাণীটির। চুকচুক শব্দ বেরিয়ে আসছে ওটার মুখ থেকে। চিৎকার করার শক্তি আর যোগাচ্ছে না শরীর। বড় বড় চোখ করে নিজের মৃত্যু মুহূর্ত অনুভব করতে পারলো কিশোরী মেয়েটি। এই মেরেছিল তার খেলার সাথীকে। সত্যিই নুপুরের কাছে চলে যাবে সে। কিন্তু এই অদ্ভুত দেখতে প্রাণীটি কী তাই শুধু বুঝতে পারলো না!
ওটার মুখ বিশাল হা হয়ে গেল। খপ করে তুলির ধড়ের উপর থেকে মাথাটা ঢুকিয়ে নিল নিজের মুখে। এরপর তুলিকে নিয়ে ডুব দিল পুকুরের গভীরে।
টর্চ,লাঠি, হারিকেন হাতে ৫-৬জন লোক ছুটে চলে এলো পুকুরের পাড়ে। একটা মেয়ের আর্তনাদের শব্দ শুনেই তারা ছুটে এসেছে। তারা পুকুরপাড়ে পৌঁছে শুধু দেখল পুকুরের মাঝামাঝি জায়গা থেকে একটা মেয়ে পুকুরের পানির নিচে তলিয়ে গেল। বুদবুদ উঠছে সেখান থেকে! একি! টর্চের আলোয় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না কিছু। তবে মনে হচ্ছে ওইটুকু জায়গা কারও রক্তে লাল হয়ে গেল। ভয় পেয়ে গেল সবাই। পুকুরে নামার সাহস হলো না কারও এই রাতে।
দিনের আলো ফুটলে জানা গেল তুলিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সকলেই অনুমান করলো রাতে যেই মেয়েটাকে পুকুরে তলিয়ে যেতে দেখেছিল কয়েকজন ওটাই তুলি। কিন্তু এত রাতে মেয়েটা পুকুরে কেন নেমেছিল! যেখানে নুপুরের ভয়ংকর মৃত্যুর পর থেকে দিনের বেলাতেই অনেকে এখানে আসতে সাহস করে না! অনেক লোক একত্রে মিলে তল্লাশি চালায় পুকুরে। পুলিশ খবর পেয়ে আবার ভয়ংকর কিছু ঘটতে পারে অনুমান করে বিশেষ ডুবুরি দল দিয়ে সারা পুকুর তল্লাশি করায়। কিন্তু তুলির কোনো অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায় না। আফসারপুর সহ আশেপাশের সব জায়গায় খোঁজ চললো তার।
আফসারপুর গ্রামের মানুষের ভেতর আতঙ্ক বেড়েই চললো। সেই আতঙ্ক মনে গভীর ভাবে গেঁথে ফেলতেই আবার নিখোঁজের তিন দিন পর পুকুরে ভেসে উঠলো মাথাবিহীন একটা কিশোরীর নগ্ন দেহ। অবিকল নুপুরের লাশের মতো পরিণতি ঘটেছে এটার। এটা যে তুলির লাশ তাও বুঝতে অসুবিধা হলো না কারো। গ্রামের সকলকে স্তম্ভিত করে দিল এই দ্বিতীয় অদ্ভুত মৃত্যুটি।
আফসারপুর সহ আশেপাশের সব গ্রামেই পুকুরে এই ভয়ঙ্কর দুটি মৃত্যুর ঘটনা ছড়িয়ে পড়লো। নিত্যদিনের কাজে এই পুকুরের পানি ব্যবহার করতেই হয় সকলকে। তবুও যাদের পক্ষে সম্ভব হলো গ্রামের প্রাচীন এই পুকুরটিকে ত্যাগ করলো। পুলিশ আর গ্রামের মাতবর শ্রেণীর লোকেরা পড়লো বড় বিপদে। সকলেই এই বিপদের সমাধান চাচ্ছে তাদের কাছে। কিন্তু ঘটনার আগা-মাথা কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না তাদেরও।
এরপর পেরিয়ে গেল প্রায় মাস খানেক। পুকুরটাতে এরমধ্যে আর কেউ নিখোঁজ হয়নি। একদিন। গ্রামে গভীর রাত। সেদিন শেষ দুপুরে যে ৬জন কিশোরী পুকুরে গোসল করতে নেমেছিল তাদের আরেকজন আঁখি। এখনো ঠিকমতো রাতে ঘুমাতে পারে না সে। চোখ মুদলেই ভেসে ওঠে নুপুর আর তুলির মাথাবিহীন শরীর দুটো। কী ভয়ঙ্কর অনুভূতি জাগে সারা মনে। ভাবে কেন যে সেদিন পুকুরে গোসল করতে নেমেছিল তারা! আর বড়দের নিষেধ শর্তেও কেন লাশ দুটো লুকিয়ে দেখতে গিয়েছিল!
একটা ঘরেই বাবা-মার সাথে ঘুমায় সে। তার জন্য আলাদা বিছানা রয়েছে। আজও ঘুমিয়ে রয়েছে সে। তার গভীর ঘুম ভেঙে গেল ফিসফিস একটা ডাক শুনে, ‘আখি, এই আখি, এত ঘুমাইস কেন? উঠ বেটি!’ কন্ঠটা আঁখির পরিচিত। সে চমকে উঠে চোখ মেললো। টিনশেড ঘরের খোলা জানলায় গিয়ে চোখ আটকে গেল তার। জোৎস্নার আলোয় তুলির মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মুচকি মুচকি হাসছে মেয়েটা। তুলি আবার বলল, ‘বাইরে আয় আঁখি, তোর সাথে কথা আছে, দেখ, আমার সাথে কে আসছে। জানালার একদিকে সামান্য সরে গেল সে। তারপাশে উদয় হলো আরেকটা মাথা। নুপুর! মিষ্টি হাসি লেগে আছে নুপুরের মুখেও। আঁখিকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘কিরে, এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলি আমাদের, আমরা একসাথে কত খেলা করেছি, কত ঘুরেছি, আর আজ কতদিন দেখা হয় না। বাইরে আয়না হতচ্ছাড়া! আমাদের সাথে চল।’
আঁখি বিভ্রান্ত হয়ে বিছানায় উঠে চোখ ডলতে লাগলো। কী দেখছে সে! বাবা-মার দিকে তাকিয়ে দেখল দুজনেই ঘুমিয়ে আছে। আবার জানলার দিকে তাকালো। নুপুর আর তুলি দুজন হাসিহাসি মুখ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নেমে এগিয়ে গেল জানলার দিকে। যতই সামনে এগোচ্ছে অজানা একটা আতঙ্কে তার বুকের ধকপকানি বেড়েই চলেছে। একেবারে জানলার কাছে চলে এলো আঁখি। মুহূর্তেই উড়ে গেল নুপুর আর তুলির মুখের মিষ্টি হাসি। একে অপরের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকা করে ক্রুর হাসি হাসলো তারা। ভয় পেয়ে গেল সে। এতক্ষণ যেন সে ঘুমের ঘোরে ছিল। হঠাৎ অনুধাবন করতে পারলো নুপুর আর তুলি তো মারা গেছে অনেকদিন আগে। তারা এতরাতে এখানে কী করে আসবে!
কৌতূহলতায় জানলার দিকে আরেকটু ঝুঁকে গেল সে। পিছিয়ে গেল তুলি আর নুপুরের মাথা। একি! শরীর কোথায় ওদের! দুটো কাঁটা মাথা এখন জানালার ওপাশে তার মুখোমুখি। গলার নিচ থেকে শরীরের নিচের অংশ অদৃশ্য ওদের। খিলখিল করে হেসে উঠলো ওরা। আতঙ্কে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললে আঁখি। কণ্ঠের সব শক্তি খরচ করে চিৎকার জুড়ে দিল সে।
বাবা-মা ধড়ফড় করে উঠে তার কাছে চলে এলো। ভয়ে তোতলাচ্ছে আঁখি আর ফুঁপিয়ে কেঁদে কেঁদে জানলার বাইরে দেখাচ্ছে। কিন্তু ওখানে এখন কিছুই নেই। আঁখির কথাগুলোকে গুরুত্বের সাথে নিল না তার বাবা-মা। বলল, সপ্ন দেখেছে সে। দোয়া-দরুদ পড়ে ভরসা দিল তাকে। এত বাস্তব ছিল সব কিছু কী করে এটা স্বপ্ন হয়! সেও কী মারা যাবে তাদের মতো। ভয়ে মুষড়ে পড়লো সে।
এরপর কেটে গেল কয়েকদিন। রাতে ঘুমিয়ে আছে আঁখি। তার শরীরে কারও ঝাকুনিতে ঘুম ভেঙে গেল তার। চোখ মেলেই দেখল একটা মুখ তার মুখের উপর ঝুকে রয়েছে। তার মা! সে বিছানায় উঠে বসলো। মা বলল, ‘চল আঁখি, তোকে একটা জিনিস দেখাই, আয় আমার সাথে বাইরে।’ এই বলেই আঁখির মা ঘরের বাইরে চলে গেলেন। ঘরে আর কেউ নেই। বাবা কোথায় গেল! খোলা জানলা দিয়ে বাইরে তাকাতেই মনে হলো, এখনো রাত। বিভ্রান্ত হয়ে সে বিছানা থেকে নেমে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলো। হ্যা, রাতইতো! চাঁদের আলোয় যদিও পরিবেশ তেমন ঝাপসা নয়। ঐতো বাবা আর মা দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কোথায় যাচ্ছেন তারা! একে অপরের দিকে তাকিয়ে এমন মুচকি মুচকি হাসছেন কেন! হাত ইশারা করে তারা দুজন আঁখিকে ডাকলেন। বিস্মিত হয়ে তাদের অনুসরণ করে চললো সে।
সে যতই দ্রুত হাঁটছে ততই তার বাবা-মা এর চলার গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিছুতেই ধরতে পারছে না তাদের। অনেক ডাকার পরেও পেছনে ফিরে তাকাচ্ছেন না তারা। তুলির সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাটার পুনরাবৃত্তি! একটা সময় পর আঁখি বিস্মিত হয়ে অনুধাবন করল, সে আর তার বাবা-মা সেই ভয়ঙ্কর প্রাচীন পুকুরের কাছাকাছি চলে এসেছে যেখানে নিখোঁজ হয়েছিল তার দুই সাথী। পুকুরের একদম পাড় ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে তার বাবা-মা। সে ভয়ে ভয়ে ডাকতে লাগলো তাদের।
একি! চমকে উঠতে হলো তাকে। ওখানে বাবা-মা কই! তারা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে দাঁড়িয়ে আছে তুলি আর নুপুর। ঘুরে তার দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসছে। পুকুরের মাঝামাঝি কী একটা যেন ভেসে উঠলো। চুক চুক একটা শব্দ ভেসে আসছে তার কানে। ……………………………………..
.
.
. . . . চলবে . . . .
.
.