#পিশাচ_পুরুষ
১১তম এবং শেষ পর্ব
বর্তমান সময়। সকিনাদের পুরো গ্রামে এক ভয়ানক চঞ্চলতা সৃষ্টি হয়েছে। গত কয়েক মাসে শুধু তাদের গ্রামেরই ৩০জন নারী নিখোঁজ হয়েছে। গ্রামের কারো মনেই সন্দেহ নেই যে ঐ জঙ্গলে গিয়েই নিখোঁজ হয়েছে ওরা। দিনের আলোতে নিখোঁজ নারীদের খুঁজতে গিয়ে বন্য জন্তুর হামলার শিকার হয়ে মারা গিয়েছে আরও ২০ জনের উপর যুবক। কেউই সেই বিকট গাছটি খুঁজে পায়নি যেটার কথা নারীরা বলে বেড়ায়। যার খোঁজ শুধু নারীরা পায় এবং রাতে। যা তাদের সব ইচ্ছা পূরণ করে। যুবকদের লাশগুলো পাওয়া গেলেও নিখোঁজ নারীদের কোনো খবরই পাওয়া যাচ্ছে না। আশেপাশের গ্রাম গুলোতেও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। তাদেরও অনেক নারী নিখোঁজ হয়েছে এই কয়মাসে। সবাই উন্মাদের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছে নিখোঁজ মেয়েগুলোকে। সবখানে ওরা প্রচার করতে লাগলো আর যাতে লোভে পড়ে কেউ জঙ্গলে না যায়। এটা বুঝতে কারো অসুবিধা হলো না কোনো এক অদ্ভুত শক্তি মেয়েগুলোকে রাতের আধারে টেনে নিয়ে যায় জঙ্গলে।
সবাই তাই ঘরের নারীদের পাহারা দিতে লাগলো। জঙ্গলের কিনারে দল বেঁধে অবস্থান করতে লাগলো সন্ধ্যার পর থেকে। কোনো নারীকে জঙ্গলের দিকে আসতে দেখলেই জোর করে ধরে বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছে।
সেই যে শিকড় নিয়ে ফিরে এসেছিল সেই দিনের পর সকিনা আর একবারের জন্যও জঙ্গলে যায়নি। প্রথম কয়েকদিন অচেনা রূপবান যুবকের জন্য মনটা তার কেমন করে থাকতো। আশা করতো হয়তো হঠাৎ যুবকটা এসে তাকে দেখা দেবে। কিন্তু দিন বয়ে চলল, গ্রামের নারীরা গোপনে উদগ্রীব হয়ে উঠল নিজেদের মনোবাসনা গাছটার কাছে প্রার্থনা করে পূরণ করে নিতে। সফলও হতে লাগলো অনায়াসে। কিন্তু এরমধ্যেই নিখোঁজ নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে লাগলো। সকিনার মনে কেমন একটা অনুশোচনা বোধ জন্মাতে লাগলো। তার জন্যইতো গ্রামের মহিলারা গাছটার কথা জানতে পারলো। যুবকটা কী কোনো অসৎ উদ্দেশ্য পূরণ করার লক্ষ্যে তাকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করেছে! হয়তো তার বাবা ভালো হয়ে উঠেছে, কিন্তু এর বিনিময়ে বিপদে পড়েছে পুরো গ্রাম।
তাছাড়া সেরাতে জঙ্গলের ভেতর জন্তুটা চলে যেতেই যুবকটার আবির্ভাব। যুবকের চলে যাওয়ার পরেই বিশাল সাদা জন্তুটার আগমন। সে গ্রামের মানুষের কাছে ভয়ঙ্কর একটা জন্তুর বর্ণনা শুনেছে যা তাদের পোষা প্রাণীগুলোকে হত্যা করতে রাতে এই গ্রামে প্রবেশ করতো। ওটার সাথেও তার দেখা জন্তুটার মিল রয়েছে! তবে কী ওই যুবকটাই বহুরূপী! কখনো জন্তু হয়ে যায় আবার কখনো পুরুষ! এও কী সম্ভব!
গ্রামের লোকেরাও আজকাল মনে করে তাদের সব ভোগান্তির পেছনে দায়ী সকিনা। তারা তাই তাকে তিরস্কার করতে প্রায়ই হোসেন মিয়ার বাড়িতে আসে। বিশেষ করে গ্রামের বয়স্করা। তাকে ডাইনি, প্রেত পূজারী বলে গালি দিতে থাকে। সকিনার কান্না পেয়ে যায়। সে বোঝে না, এর উত্তর কিভাবে দেয়া যায়!
অন্ধকার রাত্রি। জঙ্গলের মাঝামাঝি জায়গায়। এক মধ্যবয়স্ক নারীর ধড় কামড়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে একটা সাদা বিকট জন্তু। জন্তুটার হিংস্র দৃষ্টি হতে বিচ্ছুরিত দ্যুতিতেই সে এগিয়ে গেল বিশাল আকৃতি বৃক্ষের মোটা শিকড়ের পাশের কোটরের ভেতর। বাইরে থেকে দেখে কারো আন্দাজ করবার সাধ্য নেই এর ভেতরটা কত বড় আর কত গভীর। নারীর লাশটা আরও ৯৮টি লাশের স্তুপের দিকে ছুড়ে দিল সে। দ্রুত কোটর থেকে বেরিয়ে এসেই বিকট একটা হুংকার ছাড়লো সে। এই হুংকার আনন্দের, গর্বের।
তখনই জঙ্গলের সমস্ত মাটি কম্পিত হয়ে উঠলো। আকাশ ফুঁড়ে কিছু আলো বিচ্ছুরিত হতে লাগলো জঙ্গলের এই অংশে। সেই আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বিকট প্রাণহীন পাতাহীন বৃক্ষটি কেঁপে কেঁপে উঠছে। তার বিকট ছাল খসে পড়লো শরীর থেকে। কিলবিল করতে করতে ওখান থেকে বেরিয়ে এলো অসংখ্য কোষ। অগুলো ফুঁড়ে বের হচ্ছে অসংখ্য ছোট চিকন লম্বা কালো পোকা। সেখানে থেকে বেরিয়ে এলো দুটি ছোট চোখ এবং একটি বৃহৎ আকৃতির মুখ। চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। বিশাল একটা চিৎকার করলো সেটা, কম্পিত হলো পুরো জঙ্গল। এরপর তাকালো তার সামনে ঝুকে থাকা এক ক্ষুদ্র সৃষ্টি সাদা জন্তুটার দিকে। গমগম করে উঠলো ভারী কন্ঠটা। ‘তুমি দারুন খেল দেখিয়েছ পুত্র! আমি যখন সর্ব শক্তি আবার ফিরে পাবো তুমি হবে আমার সবচেয়ে ক্ষমতাবান সন্তান।’
আবার হুঙ্কার ছাড়লো ওটা। সাথে সাথেই আশেপাশে থাকা আরো কিছু মোটা, পাতা, প্রাণবিহীন বিকট গাছ কেঁপে উঠলো। ওরাও কিছু বলতে চায়।
‘তুমি ৯৯টি নারীর শরীর ওখানে জমা করেছ, আর প্রয়োজন একটা।’
এবার জন্তুটার সারা শরীর কাঁপতে লাগলো। শরীরে লোম, তীক্ষ্ণ নখ অদৃশ্য হলো। ওটা পরিণত হলো একজন সুদর্শন যুবকে। হাটুমুরে বসে পড়লো আবার। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বিকট গাছটিকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘প্রভু, মহান শক্তিধর! আমি সব রকম চেষ্টা করেছি। এত বিলম্ব হওয়ার জন্য ক্ষমা চাই। কিন্তু গ্রামের লোকেরা এখন বেশ সতর্ক। এখানে কাউকেই ঢুকতে দিচ্ছে না। আপনার আদেশে আমি সরাসরি তাদের বাঁধাও দিতে পারি না। এমন কী নিজের ক্ষুধাকেও বিসর্জন দিয়েছি। লোকালয়ে হামলা চালাইনি আর! কিন্তু মানুষ বড়ই লোভী! তারা কোনো না কোনো পথ বের করেই নেয় জঙ্গলে ঢুকতে। তাই আপনার উৎসর্গের জন্য নারীর কমতি পড়বে না। যদিও সময় লাগবে! কিন্তু আর একজন নারী হলেই সম্পূর্ণ হবে।’
‘হ্যা! কিন্তু আমি জঙ্গলের পথটা বন্ধ করে দিয়েছি। আর কোনো নারী জঙ্গলে প্রবেশ করলেও আমার কাছে পৌঁছাতে পারবে না। তোমারও এর শিকার করে আনতে হবে না কাউকে জন্তুর বেশে!’
‘মানে, প্রভু! বাকি একজন নারী!’
‘এখানে ৯৯টি লাশ রয়েছে! কিন্তু এদের একজনও কিশোরী নয়! শেষ নারী আমাদের একজন কিশোরী লাগবে। তুমিই তাকে নিয়ে আসবে লোকালয় থেকে।’
যুবকের মুখ একদম শুকিয়ে গেল। সে বুঝতে পারলো কার কথা বলছে। সে চুপসে সেভাবেই ঝুকে রইলো। দেখতে দেখতে ছাল আবার বিকট বৃক্ষটাকে ঢেকে ফেলল। ওটা পরিণত হলো একটি মরা গাছে। যুবক কয়েক মুহূর্ত স্থির, দ্বন্দ্বে দুলে থাকা মন নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। এরপরেই ক্রোধে চিৎকার করে উঠলো। মুহূর্ত সময় নিয়ে পরিণত হলো সাদা জন্তুতে। ছুটতে লাগলো লোকালয়ে। সকিনার বাড়িতে তাকে যেতেই হবে। আদেশ লঙ্ঘণ করবে না সে এই শেষ মুহূর্তে।
গ্রামে মধ্যরাত। সকিনা চমকে ঘুম থেকে উঠলো কোনো একজনের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে।এই রাতে কে এল, ভাবল সে। দরজা খুলতেই চমকে উঠে পিছিয়ে গেল কয়েক পা। স্বপ্ন দেখছে নাকি সে! সেই যুবকটি দাঁড়িয়ে আছে যার মোহে একদিন পাগল হয়েছিল সে। পুনরায় তাকে দেখে আবার স্বীকার করতে হলো তাকে, এমন সুদর্শন পুরুষ দুনিয়াতে ২য়টি নেই। কী মায়া এই মুখে, এরচেয়ে পবিত্র আর কে হতে পারে! যুবক ইশারা করলো তাকে তার সঙ্গে যেতে। সকিনা সন্তর্পনে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। একটু দূরে গিয়েই আড়াল হলো যুবক। কিশোরী সকিনা তার পাশে।
যুবক এগিয়ে গিয়ে আলতো করে সকিনার চিবুক স্পর্শ করলো। বলল, ‘আমাকে ক্ষমা করো, আমি এতদিন আসতে পারিনি। কিন্তু এখন তোমাকে আমার সাথে জঙ্গলে যেতে হবে। এক ভয়ানক খেলা শুরু করেছি আমরা দুজনে, এর শেষ আমাদেরই করতে হবে। যত জন নারী নিখোঁজ হয়েছে এই অঞ্চলে এর জন্য দায়ী ওই বিকট গাছটিই। একটি সাদা জন্তু ওটার সহায়তা করেছে। আরেকটা নারীকে ওরা আটক করতে পারলেই ওদের উদ্দেশ্য পূরণ হবে। জঙ্গলে পিশাচ শক্তি ফিরে পাবে তাদের পূর্ণ ক্ষমতা। তখন শুধু ধ্বংস আর ধ্বংস।’
‘তোমার কথার কিছুই আমি বুঝতে পারছি না!’ বিভ্রান্ত দেখাল সকিনাকে।
‘কিছুই বুঝতে হবে না, তুমি শুধু বিশ্বাস করো আমাকে। আমার সঙ্গে চলো। তুমিই পারবে এই গ্রাম সহ এই অঞ্চলের সবাইকে পিশাচের থেকে রক্ষা করতে।’
সকিনা দ্বন্দ্বে পড়ে গেল। তার কী উচিত হবে লোকটাকে আবার বিশ্বাস করা! কিন্তু এটিও সত্যি যে সে অনুভব করতে পারছে গ্রামে কোনো বড় বিপদ আসতে যাচ্ছে। তাছাড়া এই যুবকের মধ্যে এমন কিছু একটা আছে যা না করা যায় না। সে যেতে রাজি হলো। যুবক নিঃশব্দে তাকে নিয়ে গ্রামের শেষ মাথায় চলে এলো। এরপর জঙ্গল যেদিকে তার উল্টো দিকের পথ ধরে হাটতে লাগলো। সকিনা অবাক হয়ে জানতে চাইল, ‘কোথায় নিয়ে যাচ্ছ আমাকে এদিকে তো জঙ্গল নয়!’
‘এই পথ দিয়ে জঙ্গলে যাওয়া উচিত হবে না আমাদের। আমরা খালের পাড়ে যাব। ওখান থেকে নৌকা করে একটা নদীতে পড়বো, সেই নদী নিয়ে যাবে একটা বড় নদীতে, ওই নদী ঘুরে পৌঁছাব জঙ্গলে। আর কোনো প্রশ্ন করো না। আমি সবার ভালোই চাই।’
যুবক আবার চলতে লাগলো, সকিনা তার পিছু পিছু চলছে।
জঙ্গলের শেষ মাথায় গ্রামের শুরুতে এসে হাজির হলো বড় সাদা জন্তুটা। নিজের শরীরটাকে যুবকের শরীরে রূপান্তরিত করলো। কয়েকজন লোক আড়াল থেকে এই পথ পাহারা দিচ্ছিল। তাদের চোখের অলক্ষ্যে সে গ্রামে প্রবেশ করলো। সকিনা মেয়েটির প্রতি সে সামান্য মায়া অনুভব করেছিল ঠিক। কিন্তু তা এতটাও গাঢ় নয় যে এত দিনের সব পরিশ্রম বৃথা করে দেবে। মেয়েটাকে কিছু একটা বলে ভুলিয়ে জঙ্গলে নিয়ে যেতে হবে তাকে।
নিস্তব্ধ রাত। সকিনার ঘরের সামনে এসে হাজির হলো সে। অবাক হয়ে দেখল দরজা খোলা। ধীরও পায়ে ঘরের ভেতর ঢুকলো, কোথাও সকিনা নেই! এক ঘরে শুধু তার পিতা ঘুমিয়ে রয়েছে। কোথায় গেল সে এত রাতে? বাড়ির আশেপাশের সব জায়গায় খুঁজেও পেল না তাকে। তার ভেতর জন্তুর ক্ষমতা রয়েছে। সে সকিনার ব্যবহৃত একটি জামা শুকলো। এরপর ঝুকে মাটির দিকে তাকালো। এইতো পায়ের ছাপ পেয়েছে সে। ঐদিকে চলে গেছে ছাপগুলো। কিছুদূর এগোতেই অবাক হয়ে দেখল, দুজন মানুষের পায়ের ছাপ। একজন সকিনা, আরেকজন কে! ওপর পায়ের ছাপটা খুব পরিচিত মনে হচ্ছে।
পায়ের ছাপ অনুসরণ করে দ্রুত ছুটতে লাগলো সে। জন্তুর শরীরে ফিরে গেলে বিপদ হবে তাই মানুষ হয়েই ছুটছে সে। ছুটতে ছুটতে একটা খালের কিনারে এসে হাজির হলো যুবক। ঐতো কিছুটা দূরে একটা নৌকা দেখা যাচ্ছে, নৌকায় উঠছে দুজন নর-নারী। আড়াল থেকে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে যা দেখল তাতে পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে গেল সে।
সকিনার সাথে একটা যুবক নৌকা। সেই যুবক আর কেউ নয়। সে নিজেই! হ্যা, তার মতো অবিকল দেখতে একটা যুবক সকিনার সাথে নৌকায় বসে আছে। এ কী করে সম্ভব! পিশাচ পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বী এই জঙ্গলে আর কে আছে যে তার পুত্রের রূপ ধরে এসে তার শিকারকেই কেড়ে নিয়ে যাবে ছলনা করে! নাকি তার উপর ভরসা নেই দেখে তার পিতা পিশাচ পুরুষ তার মতোই হুবহু আরেকটা মানুষ তৈরি করেছে! কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। নৌকার দিকে দৃষ্টি রাখলো সে।
নৌকার যুবকটা এবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সকিনাকে, সকিনা কিছু বুঝে ওঠার আগেই। জোরে চেপে ধরলো নিজের বুকের সাথে। জ্ঞান হারালো সকিনা। তাকে নৌকায় শুইয়ে দিয়ে বৈঠা হাতে তুলে নিল যুবক।
দূর থেকে যুবকটা ছুটে গেল খালের পাড়ে। নৌকায় বসে থাকা যুবকটাও বিস্মিত হয়ে পাড়ের দিকে তাকালো। সে চেচিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কে তুমি? আমার রূপ ধরেছ কেন? সকিনাকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছ? কে তোমার প্রভু?’
নৌকায় বসে থাকা একই চেহারার যুবক হাহা করে হেসে উঠল, বলল, ‘দেরি করে ফেলেছ বন্ধু, তোমার পিশাচ পিতাকে বলো তোমাদের ধ্বংস আবার হবে, ফিরে এসেছে জঙ্গলের মহান পবিত্র শক্তির সন্তান। বিদায়, ধ্বংসের জন্য প্রস্তুতি নাও।’ এই বলেই ছুটিয়ে দিল সে নৌকা। পাড়ে দাঁড়িয়ে ছটফট করতে লাগলো ওপর যুবক। পানিতে নামতে তার এত ভয় হচ্ছে কেন বুঝতে পারছে না। ক্রোধে আর্তনাদ করে উঠলো সে। পরিণত হলো সেই হিংস্র বিকট সাদা জন্তুতে।
দেখতে দেখতে নৌকায় বসে থাকা তার মতো যুবকটা একটা নারীতে রূপান্তরিত হলো। অপরূপ রূপবতী নারী যা দেখে জন্তুটাও বিস্মিত হয়ে গেল। এটা কী সেই ছলনা যার কারণে এত বছর ধরে অভিশপ্ত হয়ে আছে তার পিশাচ প্রভু! সে না অভিশপ্ত গাছ হয়ে গিয়েছিল! মুক্তি পেল কী করে! নিশ্চই তার প্রভু যেভাবে ধীরে ধীরে অভিশাপ থেকে মুক্ত হচ্ছিল ছলনাও একই ভাবে শতবর্ষে অভিশাপ মুক্ত হয়েছে।
নৌকা চলছে তার গতিতে। খালের কিনার দিয়ে ওটাকে অনুসরণ করে ছুটছে জন্তুটা। খাল পেরিয়ে ছোট নদীতে পড়লো নৌকা। এক মুহূর্তের জন্যও জন্তুটার চোখের আড়াল হয়নি নৌকা। নৌকাটি এবার এসে পড়লো খরতর বড় নদীটিতে। নদীটা জঙ্গলের দিকে গিয়েছে। জন্তুটা অবাক হলো নৌকার মেয়েটি সকিনাকে নিয়ে একবারও জন্তুটার আড়ালে যাওয়ার চেষ্টা করেনি। পাড় থেকে শুধু দূরত্ব রেখে চলছে নৌকাটা যেন জন্তুটা লাফিয়ে ওটার উপর উঠতে না পারে। সকিনার জ্ঞান এখনো ফেরেনি। বৈঠা হাতের মেয়েটা আড়চোখে মাঝেমধ্যে জন্তুটার দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপ ভরা মুচকি হাসি হাসছে যা জন্তুটার ক্রোধ আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।
হঠাৎ করে জন্তুটা খেয়াল করলো সামনে নদীর আরেকটা বাক। যার ফলে সে নৌকাটাকে আর অনুসরণ করতে পারবে না। নৌকাটার সমানে আসতে হলে তাকে ঘুরে অন্য পথ দিয়ে বাকটা পাড় হতে হবে। পানিতে নামা অসম্ভব! তবে এতে নৌকাটা চোখের আড়াল হয়ে যাবে কিছুক্ষণের জন্য। সে সর্বশক্তি দিয়ে ডান দিকে নদীর বাক বরাবর পুরোটা ছুটে, বাক শেষের কিনার বরাবর সোজা ছুটে আবার বামে ঘুরে বাক বরাবর ছুটতে ছুটতে নদীর কিনারায় পৌঁছাল। হতাশ হয়ে চারদিকে চাইল। কোথায় গেল নৌকাটা! সে ছুটতে লাগলো সামনের দিকে বিরাম হীন ভাবে। ওটা লুকিয়ে থাকলে ওটাকে খোঁজা তার সাধ্যের বাইরে।
সকিনাকে নিয়ে ওটা কী করবে! তার পিশাচ প্রভুই কেন বা সকিনাকে শেষ নারী হিসেবে বিসর্জন দেয়ার জন্য তাকে চাপ দিল! বিরক্ত হচ্ছে সে। কিন্তু আর কিছুদূর গিয়েই প্রাণ ফিরে পেল যেন, ঐতো নৌকাটা দেখা যাচ্ছে। ছুটতে ছুটতে ওখানে গিয়ে হাজির হলো সে। নৌকায় পড়ে আছে সকিনা। ওই মেয়েটা নেই। কোথায় গেল সকিনাকে ফেলে সে! ধীরে ধীরে সে মানুষ রূপে ফিরে এলো। নৌকায় পৌঁছাতে হলে পানি দিয়ে সাঁতরে যেতে হবে ওকে। কিন্তু পানিতে নামবে না সে। সে ডাক দিতে লাগলো সকিনাকে। কয়েকবার ডাকতেই জ্ঞান ফিরে এলো মেয়েটার। তন্দ্রা মতো দৃষ্টিতে যুবকের দিকে তাকালো। বলল, ‘আমি কী ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম? আমার সারা শরীর ব্যথা করছে কেন! আমি নড়তে পারছি না! কোথায় নিয়ে এলে আমায়! পাড়ে নামাও!’
যুবক ব্যাকুল হয়ে উঠলো! বুঝল নৌকায় ওঠার পর থেকে আর কিছু মনে নেই সকিনার। কী একটা বিপদের গন্ধ নাকে আসছে। সে সকিনাকে বলল, ‘তুমি বৈঠা টা একটু ঐদিকে ঠেল! পাড়ে চলে আসবে নৌকা!’ সকিনা উঠতে গিয়ে গুঙিয়ে উঠল, অনেক কষ্টে বৈঠার নাগাল পেল। ওটা ঠেলতেই একদম পাড় ঘেষে চলে এলো নৌকা। যুবক লাফ দিয়ে নৌকায় উঠে বসলো। সকিনাকে ধরে উঠাতে গেল। সকিনার মুখটা একমুহূর্তে শক্ত হয়ে গেল। চোখে-মুখে অমানুষিক ক্রোধ। শক্ত করে যুবকের হাত চেপে ধরে তার সাথে নৌকায় বসিয়ে ফেলল।
যুবক ভড়কে গেল। কিছু বোঝার আগেই সকিনা নৌকাটার বৈঠা জোরে ধাক্কা দিল। এক ধাক্কাতেই নৌকাটা পাড় হতে অনেকটা দূরে নদীর পানিতে চলে এলো। চারদিকে পানি দেখে বুকটা কেঁপে উঠলো যুবকের। বুঝলো শরীরে এক ফোটাও শক্তি নেই তার। সকিনা এখনো শক্ত করে তার হাত ধরে আছে। এত শক্তি মেয়েটার হাতে! সকিনা তার চোখে চোখ রেখে বলল, ‘আমি সকিনা নই! ঐ যে সকিনা!’ যুবক আঙ্গুল লক্ষ করে একটা গাছের দিকে তাকালো, ঐতো নদীর পাড়েরই একটা ঝোপের আড়ালে অচেতন হয়ে পড়ে আছে সকিনা। তাহলে এ কে!
মুহূর্তেই সকিনার কিশোরী শরীর বদলে এক প্রাপ্ত বয়স্ক যুবতীর শরীরে রূপান্তরিত হলো। চেহারাও বদলে গেল। এই সেই মেয়ে যে সকিনাকে তার রূপ ধরে নৌকায় তুলে এখানে নিয়ে এসেছে। মেয়েটা বলল, ‘আমি ছলনা। মহান পবিত্র শক্তির শিষ্য। সকিনা মেয়েটা একটা ছল মাত্র। আমার উদ্দেশ্য ছিল তোমাকে এখানে নিয়ে আসা। তুমি সেই হিংস্র পিশাচের পুত্র। তুমি ৯৯জন নিরীহ নারী সহ অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী। পিশাচটা চতুরতা করেই তোমাকে জন্তু এবং মানুষের মিশ্রনে তৈরি করেছে। কেননা এই দুই শ্রেণীকে সরাসরি মহান পবিত্র শক্তি অভিশাপ দিতে পারে না। এই জগতে তুমি সৃষ্টি করেছ মহা বিশৃঙ্খলা। তাও তাই তোমাকে কিছু করা হয়নি। যদিও সবটাই করেছ পিশাচটার আদেশে! কিন্তু ওটা সরাসরি কিছু করেনি বলে ওটাকে অভিশাপ দেয়া যায় না। শুধু এই কিশোরী মেয়েটাকে যদি তুমি কোটরে ঢুকাও তবেই পিশাচ ফিরে পাবে আবার সব শক্তি।
এটা আমি কী করে হতে দেই! মহান শক্তি আমাকে এই কারণে অভিশাপ মুক্ত করেছে। না, সকিনা কোনো বিশেষ নারী নয়! তার বদলে যে কাউকে কোটরে আটকালেও সে শক্তিই পেত। কিন্তু সে তোমার আনুগত্য পরীক্ষা করতে সকিনাকেই শেষ নারী হিসেবে ঠিক করলো। আর এতেই তোমাকে ফাঁদে ফেলতে আমার সুবিধা হলো।
তুমি তার পুত্র। তুমি যদি এখন মারা যাও তবেই সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। ৯৯টি খুনের অভিযোগ যাবে সেই পিশাচ বৃক্ষের এবং তার বৃক্ষ সন্তানদের উপর। মহান পবিত্র শক্তির অভিশাপে ধ্বংস হয়ে যাবে সমস্ত পিশাচ শক্তি। হয়তো অনন্তকালের জন্য নয়, তবে দীর্ঘ একটা সময়ের জন্য। হ্যা আমিও আবার অভিশপ্ত হবো তোমাকে হত্যার অভিযোগে!’
চিৎকার করে উঠলো যুবক। তার চেহারা বদলাতে লাগলো জন্তুর মতো। কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গেল। মেয়েটি লাফিয়ে নেমে শক্ত করে চেপে ধরলো নৌকার কিনার। একমুহূর্তে উল্টে গেল নৌকা। যুবকের মনে হলো তার পুরো শরীরে আগুন ধরে গেছে। নৌকা সহ দুজনেই তলিয়ে গেল পানিতে। ওখানকার পানি ঘুরতে লাগলো চক্রাকারে। সৃষ্ট হলো মহা গহ্বর।
জঙ্গল থেকে একই সময়ে ভেসে এলো মহা হুঙ্কার। আর্তনাদ করে কেঁদে উঠলো পুরো জঙ্গল যেন। নদীর মধ্যে সৃষ্ট গহ্বর থেকেও বেরিয়ে এলো আর্তনাদ। ভূমিকম্পে কেঁপে উঠলো চারপাশ। সকিনার জ্ঞান ফিরলো। এমন অদ্ভুত হুংকার, ঝড়ের বেগ, ঢেউয়ের গর্জন শুনে চমকে উঠলো সে। ভয়ে ছুটতে লাগলো অন্ধের মতো।
আকাশ ফেটে পড়তে লাগলো বজ্রপাত। বিশাল আকৃতির পাতা আর প্রাণবিহীন বৃক্ষে আঘাত করে ওটাকে করে ফেলল টুকরো টুকরো। তার আশেপাশের এরূপ ৬টি গাছ বজ্রপাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে আগুন ধরে গেল। বড় গাছটার বিশাল অগ্নিকুণ্ডে পুড়ে ছাই হয়ে গেল কোটরে থাকা ৯৯টি নারীর লাশ। যতক্ষণ না বৃষ্টি এলো পুড়তে থাকলো জঙ্গল।
ছুটতে ছুটতে গ্রামের ভেতর আসতে পারলো শুধু সকিনা। কিন্তু জঙ্গলে যে ভয়াবহ কাণ্ড ঘটে গেল তার কতটাই তার মাথায় রইলো, কতটাই বা যার ভবিষ্যত প্রজন্ম জানতে পারবে!
• * * * * সমাপ্ত * * * * *
লেখা: #Masud_Rana
আরে লেখক ভাই, কি গল্প লিখলেন এইটা,,,,,,,বাপ রে,,,,,,😨😨😨