#পিশাচ_পুরুষ
১০ম পর্ব
পিশাচ পূজারী গোষ্ঠীর প্রধান আমন হঠাৎ তার কুঠিরে উপস্থিত হওয়া অপরূপ রূপবতী নারীর প্রতি এতটাই আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল কয়েক মুহূর্তে যে, তার এখন কোনো হিতাহিত জ্ঞান নেই। সে যে কী ভয়ানক একটা কাজ করতে যাচ্ছে তা সে নিজেও জানে না। সে হারিকেনের আলোতে অনেকক্ষণ পথ চলে হাজির হলো তাদের উপাসনের জায়গায়। ঐতো ৭টি মূর্তি রয়েছে ওখানে। আশেপাশে আবার ভালো করে তাকিয়ে দেখল কেউ নেই। এই প্রথম তার পুরো শরীর কেঁপে উঠল। অনুধাবন করতে পারছে অজানা এক শক্তির ক্ষমতা পরীক্ষা করার জন্য কত বড় ঝুঁকি নিতে যাচ্ছে সে।
যে পিশাচ দেবতারা এতদিন তাদের উপকার করেছে, ক্ষমতা দান করেছে। তাদেরই একজনকে বিসর্জন দিতে যাচ্ছে সে। এমন ক্ষমতাবান পিশাচের সন্তানকে বিসর্জন দেয়ায় তাদের উপর কিরূপ শাস্তি, অভিশাপ নেমে আসতে পারে ভেবেই শরীরের রক্ত বরফ হয়ে যাচ্ছে। পা এগোতে অনিহা করছে। একবার নিজের গলার মালাটার দিকে তাকালো যেটা মেয়েটা পরিয়ে দিয়েছিল। মন শক্ত হলো তার। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল মূর্তিগুলোর কাছে। সবচেয়ে ছোট মুর্তিটাও প্রায় তার অর্ধেক সমান। সে জানে এটা কত ওজন! তবুও ভয়ে ভয়ে ওটাকে জড়িয়ে ধরে উঁচু করতে গেল সে। আশ্চর্য্যজনক ভাবে ওটাকে তার কাছে একটা শেয়ালের বাচ্চার মতো ওজন মনে হচ্ছে। কোনো বেগই পেতে হলো না উঁচু করতে। হারিকেন ফেলে দিয়ে দুই হাতে জড়িয়ে ধরলো মূর্তিটা। চারিদিকে নিঃসঙ্গ আধার।
হঠাৎই আলো বিচ্ছুরিত হতে লাগলো তার গলার মালা থেকে। পথ চলার জন্য তাই যথেষ্ট। সে ছুটতে ছুটতে চলে এলো নদীর পাড়ে। গোষ্ঠীর সবাই এখনো ঘুমিয়ে। নদীর কাছে আসতেই হৃদকম্পন আবার বেড়ে গেল তার। দ্বন্দ্বে ভুগছে কাজটা সে করবে কিনা! এমন সময়েই পেছন থেকে তার স্ত্রীর কণ্ঠ ভেসে এলো, ‘করছেন কী আই? থামুন!’ অন্তঃসত্ত্বা হওয়ায় ছুটতে অসুবিধা হচ্ছে তার। তবুও দ্রুতই আমনের কাছে চলে এলো। ‘ওটা, যেখান থেকে এনেছিলেন ওখানে রেখে আসুন। কী ভয়ানক বিপদ ডেকে আনছেন আপনি!’
‘তুমি কিছুই জানো না, বোকা মেয়ে! এই পিশাচগুলোর সাহায্যের কোনো প্রয়োজন নেই এখন আমাদের। এরচেয়ে মহাশক্তির খোঁজ পেয়ে গিয়েছি আমি। সেই শক্তিই আমাদের রক্ষা করবে।’ খেঁকিয়ে উঠে আমিন।
‘তুমি ছলনার কবলে পড়েছ। তুমি নিশ্চই সেই মেয়েটার কথায় এসব কাজ করছো! সে নিশ্চই ছলনা, কোনো নারীর রূপ ধরে আমাদের পথভ্রষ্ট করছে। সবাই আমরা বিপদে পড়বো!’
তাদের চেঁচামেচি এর সাথে হঠাৎ ঝড় হাওয়া বইতে লাগলো। আকাশে মেঘ ডাকছে। বৃষ্টির মৌসুম এটা নয়। গোষ্ঠীর লোকেরা ধীরে ধীরে বের হয়ে আসতে লাগলো কুঠির থেকে। নদীর ধারের কথাবার্তা কানে গেল। হারিকেন হাতে সকলে ছুটে গেল সেদিকে। গোষ্ঠী প্রধান কী করতে চলেছে বুঝতে পেরে আর্তনাদ করে উঠলো ওরা। বারবার অনুনয় করতে লাগলো মুর্তিটাকে পানিতে না ফেলতে।
আমনের শরীরে তখন অদ্ভুত এক অনুভূতি। একবার নিজের কুটিরের দিকে তাকালো। তার অদৃশ্য চোখ বলছে অপরূপ রূপবতী মেয়েটি তার অপেক্ষা করছে। মুর্তিটাকে বিসর্জন দিলেই ওর সঙ্গে তার মিলন ঘটবে। এই অঞ্চলের সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষ হবে সে। ধীরে ধীরে নদীর পানির দুই হাত কাছে চলে এসেছে সে। গোষ্ঠীর লোকেরা তাকে বাধা দিতে ছুটে আসছে। এক মুহূর্তে ঘুরে তাকালো নদীর দিকে। আর কোনো ভাবনা নয়! ছুড়ে ফেলল মুর্তিটাকে পানির মাঝে। এক মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গেল সবাই। শ্বাস নিতে ভুলে গেছে মানুষগুলো। সবাই একসাথে আর্তনাদ করে উঠলো, ‘হায়! হায়! আই! আই!’
মেঘের গর্জন আর বাতাস থেমে গেছে। নদীর যেখানটায় মূর্তিটা পড়েছে জায়গাটার পানি অস্বাভাবিক ভাবে নড়ছে। আমনকে কী একটা শক্তি টেনে নিতে চাচ্ছে। আমনের হুস হলো। সে গলার মালাটা একটানে ছিড়ে পানিতে ফেলে দিল।। তারপর দৌড়ে উঠে এলো তীরে। বিস্মিত হয়ে দেখছে নদীর কিনারের সেই জায়গাটার পানি চক্রাকারে ঘুরছে। ঘুরতে ঘুরতে ঐখানের পানি গুলো সরে গিয়ে সৃষ্টি হলো বিশাল এক গহ্বর।
আকাশ থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে আলো। এরমধ্যেই জঙ্গলের ভেতর থেকে ভেসে এলো ভয়ানক এক হুঙ্কার। পিশাচ গুলো জেগে উঠেছে নাকি! আবার ভেসে এলো হুংকার। নদীতে সৃষ্টি হওয়া গহ্বর থেকেও যেন প্রতিউত্তর হিসেবে বেরিয়ে এলো অদ্ভুত হুংকার! হচ্ছেটা কী! ভয়ানক ঝড় শুরু হয়ে গেল। ক্রোধে যেন ফুঁসছে প্রকৃতি।
সবাই ছুটে পালাতে লাগলো যার যার কুটিরের দিকে। আমনও তার স্ত্রীকে নিয়ে ছুটতে ছুটতে নিজের কুটিরে গিয়ে হাজির হলো। কুটিরের ভেতর ঢুকে দেখল সেই মেয়েটি নেই! কিন্তু একি! ঘরের ভেতর গুজো হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি মোটা খাটো মৃত গাছ! তার কুটিরে এই গাছ কোথা থেকে এলো! হারিকেনের ঝাপসা আলোয় আমন আর তার স্ত্রী দুজনেই বিস্মিত হয়ে গাছটার দিকে তাকিয়ে রইলো। হঠাৎ খেয়াল করলো গাছটার ছালের একটা অংশ কাঁপছে। সেখান থেকে ফুটো হয়ে বেরিয়ে এলো দুটি চোখ, তার একটু নিচেই বেরিয়ে এলো একটি বিকট মুখ। ভয়ে চিৎকার করে জ্ঞান হারালো আমনের স্ত্রী।
আমন ভয়ে মাটিতে বসে পড়লো। গাছের মুখ থেকে একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর বেরিয়ে এলো, ‘আমন! তুমি একজন খারাপ মানুষ! তবে আজ তুমি যে কাজ করেছ তার জন্য কখনো অনুতপ্ত হয়ো না। তুমি পুরো অঞ্চলকে রক্ষা করেছ ওই পিশাচটিকে বিসর্জন করে। তোমাদের উৎসর্গে পিশাচ গুলোর শক্তি ক্রমে ক্রমে বেড়ে যাচ্ছিল। আর কিছুদিন তোমরা এই পিশাচগুলোকে নতুন নতুন মানুষের রক্ত উৎসর্গ করে উপাসনা করতে থাকলে তারা তাদের হারানো সব শক্তি ফিরে পেত যা কিনা জঙ্গলের মহান শক্তি তাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিল। ক্ষমতা পেয়ে গেলে সব অঞ্চলেই নিজেদের ক্ষমতা আর শক্তি বিস্তার করবে তারা। সবখানে ছড়িয়ে দিত হিংস্রা, ক্রোধ আর রক্তারক্তি খেলা। আমি ছলনা। কোনো নারী কিংবা পুরুষ নই আমি, নেই কোনো নির্দিষ্ট আকৃতি। মহান শক্তি আমাকে তৈরি করেছে আমি যেকোনো রূপ ধরে যাতে মানুষকে পথভ্রষ্ট করতে পারি ধোকা আর মিথ্যে দিয়ে।
দীর্ঘদিন আমি এই জঙ্গলে, নদীতে কত মানুষকে ভুল পথ দেখিয়ে এই অঞ্চলে আসা থেকে আটকেছি। ওই মূর্তি গুলো থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছি। শুধু ব্যার্থ হয়েছি তোমাদের গোষ্ঠীর লোকদের আটকাতে গিয়ে। তোমরা ওই পিশাচের শক্তি অনেক বাড়িয়ে দিয়েছ এতদিন পুজো করে। অনেক চেষ্টা করে ‘আমন’ তোমার সাথে আমি ছল করতে পেরেছি। না! তুমি মহান শক্তির ক্ষমতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করো না! কিন্তু তোমরা যা শুরু করেছ তা তোমাদেরই শেষ করতে হবে। ৭টি পিশাচের একটিকে বিসর্জন দিয়ে তুমি এবং তোমার গোষ্ঠীর লোকেরা ওদের ক্রোধের মুখে পড়লে। কারণ ওদের যেটা তুমি ফেললে নদীতে ওটা পিশাচ শক্তিরই সন্তান।
এখন ওই পিশাচ শক্তি ক্রোধে তোমাকে , তোমার স্ত্রীর গর্ভে থাকা সন্তান, স্ত্রী সহ গোষ্ঠীর সবাইকে পৈশাচিক শক্তির বলে ধ্বংস করবে, অভিশপ্ত করবে। আর সৃষ্টি হবে মহা বিশৃঙ্খলা। তখনই আবির্ভাব হবে আমার প্রভু, জঙ্গলের মহান পবিত্র শক্তির। সে তখন পুনরায় অভিশপ্ত করে দেবে ওই পিশাচ গুলোকে। আমি তোমাকে এই কাজ করতে আদেশ করেছি তাই আমিও অভিশাপের কবলে পড়েছি। এখন থেকে আমৃত্যু পর্যন্ত একটা গাছ হয়েই থাকতে হবে আমাকে। তোমাদেরকেও!’
এতটুকু কথা বলেই ওটার চোখ-মুখ আবার অদৃশ্য হয়ে গেল। চারদিকে ভয়ানক ভূমিকম্প হচ্ছে অনুভব করছে আমন। তার সাথে সমানে ঝড় বয়ে চলেছে, নদীর দিক থেকে আসছে তীব্র ঢেউ আর পানির শব্দ। জঙ্গলের ভেতর থেকে আসছে ভয়ানক রক্ত হীম করা হুংকার। আর গোষ্ঠীর লোকেদের আর্তনাদ আর গোঙানি শোনাতো যাচ্ছেই। কী ভয়ানক পরিণতি হতে চলেছে তাদের বুঝতে বাকি রইলো না আমনের। তার স্ত্রী এখনো অচেতন হয়ে পড়ে রয়েছে মেঝেতে। হঠাৎ কেঁপে উঠল সে। তার পেট ভয়ানক ভাবে কাঁপছে। জ্ঞান ফিরছে তার স্ত্রীর! ওকি! মেয়েটার পেট ছিদ্র করে বেরিয়ে এলো। কয়েকটি শিকড়! চিৎকার করে পিছিয়ে গেল আমন!
দেখতে দেখতে তার স্ত্রীর শরীরের সমস্ত চামড়া কালো হয়ে গেল,মাথা ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো ডাল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ঘরের চাল ফুটো করে একটা মোটা গাছে রূপান্তরিত হলো মেয়েটা। তারপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে আরেকটা ছোট গাছ। আমন অনুভব করলো তার শরীর গুলিয়ে উঠছে। তার পেটের ভেতর, গলায়, শরীরে, রক্তে, শিরায় শিরায় যেন ছুটে বেড়াচ্ছে হাজার হাজার পোকা! ভয়ানক ব্যথায় গুঙিয়ে উঠছে সে। ফুলে যাচ্ছে তার শরীর। জ্ঞান,দৃষ্টি শক্তি, বাক শক্তি হারালো সে। লম্বা,মোটা প্রাণহীন একটা গাছে পরিণত হলো সে।
পিশাচের অভিশাপে গোষ্ঠীর বাকি লোকেদের অনেকেই তৎক্ষণাৎ গাছে পরিণত হয়, কেউ কেউ ভয়ানক অসুখে আক্রান্ত হয়। শরীরের ভেতর বড় হতে থাকে তাদের মাংস খেকো পোকা। যা শরীরের ভেতর থেকে সব অঙ্গ-প্রতঙ্গ খেতে খেতে বাইরে বেরিয়ে আসে। মারা যায় তারা। বাকিরা নদী থেকে উঠে আসা ভয়ানক স্রোতের টানে ভেসে যায়। তাদের মধ্যে কয়েকজন হয়তো বেঁচে ছিল। দূর গ্রামে ভাসিয়ে নিয়ে যায় নদীর স্রোত।
এভাবেই ধ্বংস হয় পিশাচ পূজারী গোষ্ঠী। সরাসরি নিজেদের শক্তি, ক্রোধ মানুষের উপর ব্যবহার করায় পিশাচ হারায় তার ক্ষমতা। জঙ্গলের মহাশক্তি তখন অভিশাপ দিয়ে পিশাচ এবং তার ৬ পুত্রকে জঙ্গলের গভীর এক স্থানে এনে বৃক্ষে রূপান্তর করে। এরপর কেটে যায় শ’য়ের কাছাকাছি বছর। পিশাচ গুলো ধীরে ধীরে আবার ক্ষমতা ফিরে পেতে থাকে। জন্ম দেয় এক পিশাচ পুরুষ। যে কিনা সকিনাকে বোকা বানিয়ে পুরো গ্রামের সবাইকে ফাঁদে ফেলে এবং পিশাচ শক্তিকে মুক্ত করতে বিকট বৃক্ষের কোটরে জমা করে বেড়াচ্ছে শ’খানেক মৃত নারীর লাশ!……
………………………………………….
.
.
. . . . চলবে . . . .
.
.
লেখা: #Masud_Rana