#পিশাচ_পরিবার
#২য়_পর্ব
©Tasmima Yeasmin
.
.
একটা বরফ শীতল ঠান্ডা হাত আস্তে আস্তে আমার গলার দিকে এগোতে লাগলো। আমি নড়ার শক্তিও হারিয়ে ফেললাম। নিজের হৃদপিন্ডের ধুকপুক শব্দ শুনতে পাচ্ছি। এই জ্যোৎস্না, এই স্বর্গীয় অনুভূতি এক মুহূর্তে আমার কাছে নরক যন্ত্রনার মত মনে হলো। মনে হল মৃত্যু দূত আমার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। নিজের মনে সাহস সঞ্চয় করে এক ঝটকায় পেছনে ফিরে তাকালাম। না কেউ ই নেই রুমে। কিন্তু মনে হচ্ছে অশরীরী কেউ আমার ঘরে আছে। আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ঘাড়ের কাছটা এখনো শিরশির করছে। আমার সাথে কি যে হচ্ছে আমি নিজেই বুঝতে পারছি না। ভংয়কর কোনো মুহূর্তে সবার আগে যা করতে হয় তা হলো সাহস হারাতে হয় না। আমিও নিজের মনকে শক্ত করে নিচ্ছি। ঠিক করলাম নিচে গিয়ে দিঘিটার কাছ থেকে ঘুরে আসবো। মোমটা হাতে শক্ত করে ধরে ধীর পায়ে হেঁটে রুম থেকে বের হলাম। দিয়াশলাইয়ের বক্সটাও নিয়ে নিলাম যাতে মোম নিভে গেলে জ্বালাতে পারি। দরজার বাইরে বের হয়ে দেখি দিহানের রুমের দরজা খোলা। একবার ইচ্ছা হলো ভিতরে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি কি করছে। কিন্তু ওর ঘরে না গিয়ে আমি সোজা সিড়ি দিয়ে নিচে নামলাম।
.
.
সদর দরজা পর্যন্ত ঠিকঠাক এলাম। এটা ভেবে অবাক হলাম যে সদর দরজাটা আটকানো না শুধুমাত্র চেপে রাখা হয়েছে। সদর দরজা ঠেলে বের হতেই মোমের আলোর জন্য তৈরি হওয়া আমার ছায়ার দিকে চোখ গেলো। মনে হলো একটা ছায়া যেন একটা আমার পেছন থেকে সরে গেলো। দিঘির পাশে যে কৃষ্ণচূড়া গাছটা ওখানে আমি দুলাভাইয়ের মত কাউকে একটা দেখেছিলাম। ঐদিকেই হাঁটতে লাগলাম আমি। চারপাশে ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে। দিঘির জল চাঁদের আলোতে টলমল করছে। চারদিক থেকে বকুলের ঘ্রাণ আসছে। এই প্রথম আমি খেয়াল করলাম এখানে একটা বকুল গাছও রয়েছে। চারদিকে গা ছমছমে পরিবেশ অথচ কি সুন্দর। একেই বোধহয় বলে ভয়ংকর সুন্দর। মাথার উপর থেকে ডানা ঝাপটানোর শব্দ করে কিছু একটা উড়ে গেল। হয়তো পেঁচা হবে। হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া এসে হাতের মোমটা নিভিয়ে দিলো। বাতাসের শো শো আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছে কেউ একজন গুমরে কান্না করছে। মেঘ এসে যেন চাঁদটাও ঢেকে দিলো। আমি অন্ধকারে দিয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু হাত ফসকে বক্সটা নিচে পরে গেল। এতক্ষণে অন্ধকারে চোখ সয়ে এসেছে। আসলে অন্ধকারে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পরে সবকিছু আবছা আবছা দেখা যায়। আমি উবু হয়ে এদিক ওদিক দেয়াশলাইয়ের বক্সটা খুজঁছি হঠাৎ কেউ একজন কানের কাছে ফিসফিস করে বলে উঠলো, “কি খুঁজছিস?”
কি ভয়ংকর ঠান্ডা সেই গলার স্বর। আমি ছিটকে দু হাত দূরে সরে এলাম। কেউ একজন আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আর বাতাসে তার চুল উড়ছে। কয়েক পা পেছনে এগিয়ে আসতেই এক নাম না জানা বিরাট গাছে পিঠ ঠেকল। পেছন থেকে কড়কড় শব্দে কিছু একটা চাবানোর শব্দ আসছে। ভয়ে ভয়ে গাছের পেছন দিকে উঁকি দিলাম। কেউ একজন উবু হয়ে কিছু চাবাচ্ছে। তার সামনে রাখা সাদা কাপড়ে মোড়ানো একটা লাশ। লাশটার এক চোখ খোলা আরেক চোখ নেই। সাদা কাপড়ের যায়গায় যায়গায় লাল রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। উবু হওয়া মানুষটা এবার আমার দিকে ধীরে ধীরে মাথা উঠিয়ে তাকাল। চমকে গেলাম আমি। উনি হচ্ছে আপাদের বাড়ির কাজের লোক বোরহান চাচা। কি ভয়ার্ত শীতল ঠান্ডা চাহনি। চোখদুটো গাঢ় সবুজ। আমার চোখের সামনে বোরহান চাচা মৃতদেহ থেকে বাকি চোখটা হাত দিয়ে তুলে ফেললো আর তারপর কচকচ করে চাবাতে লাগলো। আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে এতকিছু হচ্ছে আমার সামনে আর আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। তক্ষুনি পেছন থেকে সেই মহিলা অবয়বটা আবার বলতে লাগলো, “এখানে কেন এসেছিস তুই মেয়ে? কেন তুই ঘর থেকে শেষরাতে বেরিয়েছিস। যদি জানের মায়া থাকে তো চলে যা। চলে যা এখান থেকে।” এই কথা বলে বিশ্রীভাবে হাসতে লাগলো। আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। ধপ করে নিচে পরে গেলাম। গলা থেকে একটা শব্দও বের হচ্ছে না আমার। এটা হয়তো বকুল তলা তাই মাটিতে বকুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। আমার গালে, গায়ে মাটিতে লেপ্টে থাকা থাকা বকুল আর ধুলো লেগে গেলো। স্নিগ্ধ বকুলের গন্ধ নিয়ে এই ভয়ংকর জায়গায় আমি জ্ঞান হারালাম।
.
.
চোখ মেলে দেখি একটা মুখ আমার মুখের উপর ঝুঁকে আছে। আর কেউ নয় দিহান। আমি তাড়াহুড়ো করে উঠে বসলাম। দিহান একটু দূরে সরে গেলো। বড় আপা রুমে পায়চারি করছিলেন। আমি উঠে বসতেই আমার পাশে এসে বসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আপার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে রয়েছে। আমার নিজের বিশ্বাস হচ্ছিল না যে এখনো বেঁচে আছি আর আমাকে রুমে কে নিয়ে আসলো। আপা কিছু বলার আগেই দিহান বললো, “তা মিস চারুলতা সকাল সকাল দিঘির পাড়ে হাঁটতে গিয়ে ঘুমিয়ে পরলেন কিভাবে? এত ডাকলাম উঠলেনই না। তো শেষমেশ কোলে তুলে ঘরে আনতে হলো। তো ঘুম ভাঙল কি এখন নাকি আরো ঘুমাবেন?”
আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না তাই চুপ করে রইলাম। বড় আপা বললেন, “দিহান তুমি যাও চারু একটু বিশ্রাম করুক।”
দিহান মুখে চাপা হাসি নিয়ে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। আমি আপার কাছে চেপে বসে বললাম, “আপা জানিস কাল রাতে ঠিক কি কি হয়েছে আমার সাথে? এই বাড়িটা ভালো না আপা। এখানে অশরীরী আত্মা আছে আর তোদের বাসার ঐ বুড়ো বোরহান চাচা উনি নিজে তো একটা পিচাশ। আমি দেখেছি আপা কাল রাতে কি ভয়ংকর ভাবে একটা লাশ থেকে চোখ তুলে খাচ্ছিলেন। আপা আব্বা এ তোকে কোথায় বিয়ে দিলো। এত নির্জন একটা এলাকা। চারপাশে বোধহয় কোনো ঘরবাড়িও নেই। আর না আছে এদের কোনো আত্মীয় স্বজন। ”
আপা আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, “চুপ কর চারু। এখন একটু বিশ্রাম নে। তারপর না হয় বের হয়ে দেখিস আশেপাশে কোনো বাড়ি আছে কিনা।”
তারপর আপা ফিসফিস করে বললেন, “চারু আমি তোকে কিছু বলতে চাই।”
আমি জিজ্ঞাসা সূচক দৃষ্টিতে আপার দিকে তাকালাম।
আপা ভয়ার্ত গলায় বললেন, “চারু এবাড়ির কেউ মানুষ…।” পুরো কথাটা শেষ করার আগেই আমার রুমে দুলাভাই ঢুকলেন আর আপার দিকে রাগী চোখে তাকালেন। তার পিছুপিছু ঢুকলেন তার মা। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, “তুমি নাকি দিঘির ঘাটে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে? জ্ঞান ফিরেছে শুনে দেখতে এলাম। আহা মেয়ে এত সকালে দিঘির ঘাটে গিয়েছিলে কেন?”
“আসলে কি হয়েছিলো আমার ঠিক মনে নেই।” এই কথা ছাড়া আমার বলারও কিছু ছিলো না।
“মনে করতে হবে না তুমি খেয়ে নাও তো।” উনি নাস্তার ট্রে টা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন।
আপা নরম গলায় বললেন, “মা চারু বলছিলো যে এত সুন্দর গ্রাম ও একটু আশেপাশে ঘুরে দেখতে চায়।”
আপার শ্বাশুড়ি প্রথমে কঠিন গলায় না করে দিলেন। তারপর কি ভেবে বললেন যে,”ঠিকাছে খেয়ে নিয়ে দিহানের সাথে যেতে বলো।”
.
.
খেয়ে আমি দিহানের সাথে বের হলাম। কাল রাত হয়ে যাওয়ায় কোন রাস্তা দিয়ে এসেছিলাম তাও দেখিনি। একটু দূর থেকে বাড়িটাকে একদম রাজপ্রাসাদের মত লাগে। আমি দিহানের দিকে তাকিয়ে বললাম, এটা কোনো গ্রাম হল? তারথেকে তো জঙ্গল বলাই ভালো। আর আশেপাশে কোনো বাড়ি নেই কেন?”
দিহান বললো, ” উত্তর তো আপনার প্রশ্নের মধ্যেই আছে মিস চারুলতা।”
আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম, “বুঝলাম না ঠিক।”
“ঐ যে জঙ্গল তাই।” দিহান শান্তভাবে বললো।
“তা আপনারা এই জঙ্গলে থাকেন কেন?”
“শান্ত পরিবেশ ভালো লাগে তাই। কেন আপনার ভালো লাগে না বুঝি?”
“হুম সুন্দর।” বলে আমি চুপ করে গেলাম। কালকের মত ভয় লাগছেনা আমার। চারদিক থেকে ভেসে আসা পাখির ডাক, সুন্দর জংলি ফুল এসব দেখে আসলেই ভালো লাগছে। কিন্তু মনে মনে বললাম, ” এ কোথায় ফেঁসে গেলাম আমরা দুই দিন। আচ্ছা আব্বা কি আমাদের নিতে আসবে। হিসেবমতে তো তার আজকেই আসার কথা।” এসব ভাবছিলাম আর একমনে হাঁটছিলাম। হঠাৎ কেউ একজন বলে উঠলো, “কিরে মেয়ে একা একা তুই কি করছিস এ জঙ্গলে? মরতে এসেছিস নাকি?”
সামনে তাকিয়ে দেখি পাগল মতন দেখতে এক লোক। ছেড়া পাঞ্জাবি আর ময়লা একটা পায়জামা পরা। গায়ে একটা শাল জড়ানো। চোখদুটো লাল।
আমি পাশে তাকিয়ে দেখলাম দিহান নেই। লোকটাকে আমার কেমন ভয় করতে লাগলো ভীষন। দিহান, দিহান বলে দুই তিনবার ডাক দিলাম কিন্তু দিহানের কোনো পাত্তা নেই। আমার সামনে লাল চোখের এক পাগল দাঁড়িয়ে আছে আর এই জঙ্গলে আমি একা। আমার আপার কথা মনে পড়লো। তাহলে কি আপা বলতে চেয়েছিলো এ বাড়ির কেউ মানুষ নয়। আমি দুহাতে মুখ চেপে বসে পরলাম আর লোকটা ধীরে ধীরে আমার দিকে এগোতে লাগলো।
চলবে…