#প্রথম_পর্ব
#পিশাচ_পরিবার
©Tasmima Yeasmin
বড় আপা বিছানার উপর থেকে শাড়িটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে আম্মাকে বললেন তার জন্য ঠিক করা ছেলে তার সাথে বিয়ের আগে শারিরীক সম্পর্ক করতে চেয়েছে৷ আম্মা নির্বিকার ভাবে শাড়িটা তুলে নিয়ে পাশের রুমে চলে গেলেন। বড় আপা হাতের উলটাপিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছে আমাকে বললেন, ” তুই ই বল চারু এই ছেলেকে কি বিয়ে করা যায়? বাবা মা তো আমার কথা শুনছেই না। তুই একটু বুঝিয়ে বল না।”
বড় আপার কথা শুনে আম্মার মত আমিও চুপ করে রইলাম। একবার ইচ্ছা হলো বড় আপাকে বলি যে, “আপা তুই দুনিয়ার সবাইকে মিথ্যে বললেও আমার চোখ ফাঁকি দিতে পারবি না” কিন্তু তাও বড় আপার মুখ চেয়ে চুপ করে রইলাম।
.
.
আমি একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। বড় আপা নীরু, আমি, ছোট বোন নিশু, আব্বা আম্মা আর দাদুকে নিয়ে আমাদের পরিবার। আমার বড় আপা নীরু অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ছে। গায়ের রংটা একটু চাপা হলেও মুখ অবয়ব দারুণ। বিশেষ করে বড় আপার চোখদুটো ভীষণ সুন্দর সেই সাথে কালো লম্বা সিল্কি চুল। সম্ভবত কলেজে ওঠার সময় থেকে বড় আপা নিষাদ নামের এক ছেলেকে ভালোবাসে। বড় আপার এ প্রেমের কথা বাসার কারো অজানা নয় কিন্তু সবাই এমন ভাব করে থাকে যেন কিছুই জানেনা। নিষাদ ভাইয়াকে আব্বা আম্মা পছন্দ করে না । বিশেষ করে আম্মার পছন্দ না। আমাদের পাশের ফ্লাটের ছাদের চিলেকোঠার মতন একটা রুমে সে ভাড়া থাকে। নিষাদ ভাইয়া স্কলারশিপ পাওয়া মেধাবী স্টুডেন্ট ছিলো। হুট করে তার যে কি হলো কেউ জানে না। দুম করে পড়ালেখা বন্ধ করে দিলো। দুয়েকটা টিউশনি করে নিজের খরচ চালিয়ে নেয় আর সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরে তার পরিবার সম্পর্কে কিছু জানিনা আমি। এরকম ছন্নছাড়া কাউকে কি পছন্দ করতাম আমি।
.
.
ছাদের এক কোনে দাঁড়িয়ে কাপড় মেলে দিচ্ছিলাম। তখনি বড় আপা এলেন। আঁচলের তলায় লুকানো একটা বাটি৷ নিশ্চয়ই সেই বাটিতে নিষাদ ভাইয়ার জন্য তরকারি। এটা বড় আপার স্বভাব। বাসায় ভালোমন্দ কিছু রান্না হলে বড় আপা আচঁলের তলায় লুকিয়ে এনে ছাদের কোনায় এসে নিষাদ ভাইয়াকে দিয়ে যায়। আমাদের ছাদ আর নিষাদ ভাইয়াদের বাসার ছাদ একদম কাছাকাছি। চাইলে এক ছাদ দিয়ে অন্য ছাদেও যাওয়া যায়। নিষাদ ভাইয়া ছাদের কার্ণিশে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার চোখে চোখ পড়তেই বড় আপা লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলেন। তরকারির বাটিটা নিষাদ ভাইয়াকে দিয়ে কি মনে করে আমার কাছে এসে বললেন, “চারু নিচে যাবি না?”
” হ্যাঁ আপা তুই যা আমি আসছি।” বড় আপা ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে নিচে চলে গেলেন।
.
.
আজ আপার গায়ে হলুদ। হলুদ শাড়িতে আপাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। বিষণ্ণ মুখে আপা সাদামাটা একটা হলুদের স্টেজে বসে আছেন। চারপাশে আত্মীয় স্বজনের ভীড়। আপা বারবার ভীড়ের দিকে তাকিয়ে কাউকে খুঁজে চলছেন। আমি জানি আপা নিষাদ ভাইয়াকে খুঁজছেন। প্রথমে বড় চাচী আপাকে হলুদ লাগালেন তারপর একেএকে সবাই।
হলুদের অনুষ্ঠান একরকম শেষ হয়ে গেলো। আর দুদিন পরেই বিয়ে। বড় আপা রুম থেকে বের হয় না। আমি চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা দিয়ে কোলের উপর একটা বই নিয়ে আড়চোখে আপার ছটফটানি দেখি। আমার বারবার মনে হতে থাকে আপা নিষাদ ভাইয়ার সাথে পালিয়ে যাবে। কিন্তু আব্বার মানসম্মানের দিকে তাকিয়ে আপা কি পারবে পালিয়ে যেতে। মাঝরাতে আমার ঘুম ভেঙে যায়। আপা বেলকুনির দরজার কাছে বসে আছে। আমি আস্তে আস্তে আপার কাছে গিয়ে মাথায় হাত রেখে বলি আপা তুই নিষাদ ভাইয়ার সাথে পালিয়ে যা। হঠাৎ কি হলো জানি না। আপা ঠাস করে আমার গালে এক চড় মারলেন। আঠারো বছরের জীবনে আপা কখনো আমার গায়ে হাত তুলেনি। গলার স্বর গম্ভীর করে বললেন, “শুতে যা চারু।”
.
.
দুদিন পর আপার বিয়ে হয়ে গেলো। অবাক করা বিষয় হলো দুদিনে আমি একবারো নিষাদ ভাইয়াকে দেখিনি। আপার সাথে আমিও এসেছি আপার শ্বশুরবাড়ি। দুলাভাই বেশ সুন্দর আর নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ কিন্তু কেমন জানো একটু চাপা স্বভাবের। সহজে কারো সাথে তেমন কথা বলেন না। শুধু দুলাভাই না তাদের পরিবারের সবাই একটু বেশিই চুপচাপ। কেউ কোনো দরকার ছাড়া কারো সাথে কথা বলে না। কারো মুখে সহজে হাসিও থাকে না। কেমন একটা কাঠিন্য লেগে থাকে সবসময়। আর সবচেয়ে অবাক করার মত কথা হলো বিয়ে বাড়ি হলেও বাইরের কোনো আত্মীয় স্বজন নেই। তাদের বাড়িটাও কিরকম যেন নিস্তব্ধ। এতবড় বাড়িতে শুধু দুলাভাই, তার মা বাবা আর এক ছোটো ভাই আর একজন কাজের লোক। গ্রামের এত ভিতরে যে পৌঁছাতে পৌঁছাতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। আর তাদের বাড়িটা এত বিশাল যে মনে হয় কোনো রাজবাড়ি। কথায় কথায় আমি আপার শ্বাশুড়ির কাছে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা আপনাদের বাড়িতে কোনো অতিথি নেই কেন?
“আসলে আমাদের খুব একটা আত্মীয় স্বজন নেই। যারা আছেন তারা অনেক দূরে থাকে তাই এখানে আসতে পারে নি।” আপার শ্বাশুড়ি ঠান্ডা গলায় উত্তর দিলেন।
সবাই খাওয়ার পরে আমার রুমটা দেখিয়ে দেয়া হলো। তখন অনেক রাত হয়ে গেছে। আমি দোতালায় উঠে প্রথমে চমকে গেলাম। সবগুলো ঘরের দরজা একই রকম। আমাকে বলেছিলো দোতালায় উঠে চার নম্বর রুমটা আমার। নিজের মাথায় একটা চাটি মেরে বললাম ধুর চারু বাম দিক থেকে নাকি ডান দিক থেকে তাই ই তো তুই জিজ্ঞেস করিসনি। পাশ থেকে কেউ একজন বললো, “এই যে মিস চারুলতা তোমার রুম ঐপাশের টা। এটা আমার।” আমি চমকে ঘুরে তাকিয়ে দেখলাম দুলাভাইয়ের ছোট ভাই দিহান হাসিমুখে তাকিয়ে আছে। গোপনে একটা নিশ্বাস ফেললাম যাক এ বাড়ির একজন মানুষ অন্তত হাঁসতে জানে। আমাকে পাশ কাটিয়ে দিহান তার রুমে ঢুকে গেলো।
.
.
বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমি ভাবছি আপার কথা। আমাদের পরিবারে কথা। হুট করে আব্বা এরকম একটা পরিবারে আপার বিয়ে দিয়ে দিলেন। ভালোকরে খোঁজ খবর ও নিলেন না। তারপর আপাকে একদিন দুলাভাইয়ের সাথে দেখা করতে পাঠালেন আর তার পরের সপ্তাহেই বিয়ে। যদিও দুলাভাইদের অবস্থা আমাদের থেকে ভালো। এতবড় বাড়ি, বাড়িভর্তি সব দামী আসবাবপত্র। অভাব শুধু মানুষের। একসময় নাকি এরা জমিদার ছিলেন। বিছানা ছাড়া নতুন কোথাও ঘুম আসেনা আমার। এপাশ ওপাশ করতে করতে এসবই ভাবছিলাম। তারপর কখন যেন গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। প্রায় শেষরাতে আমার ঘুম ভেঙে গেলো। মনে হলো কেউ একজন আমার পা ধরে টানছে। ধড়মড় করে উঠে বসলাম আমি। এদিকে ইলেক্ট্রিসিটি নেই। মোমবাতি আর দিয়াশলাই আমার মাথার কাছেই ছিলো। বড় একটা মোমবাতি জ্বালালাম। দরজা ভেতর থেকেই বন্ধ আছে। পুরো রুমে কেউ কোথাও নেই। নিজের বোকামির জন্য নিজের বিরক্ত লাগলো। ঘুম আসছিলো না আর। ঘরের জানালাটা খুলে দিলাম। বাইরে চাঁদের আলোয় বাড়ির পেছনটা দেখা যাচ্ছে। পেছনে দীঘীতে শান বাঁধানো বড় ঘাট। দীঘের পানিতে চাঁদের আলো এত চমৎকারভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে যে সবকিছু স্বর্গীয় লাগছে। এদিক ওদিক দেখতে দেখতে আমার চোখ গেলো দীঘির পাশের কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে। তারপর যা দেখলাম নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। হঠাৎ কে যেন পেছন থেকে আমার কাঁধে হাত রাখলো। একটা বরফ শীতল ঠান্ডা হাত আস্তে আস্তে আমার গলার দিকে এগোতে লাগলো।
চলবে…