পারবো না ছাড়তে তোকে পর্ব-৪+৫

0
1992

পর্ব ৪+৫
পারবো না ছাড়তে তোকে
পর্ব-০৪
রোকসানা আক্তার

নিলয় ভাইয়া রুম থেকে চলে যাওয়ার পর আমি আয়নার সামনে দাড়িয়ে দাড়িয়ে কানের দুল খুলতে থাকি। খালামণি এসে আমার রুমে নক করেন।
-মিথিলা?মিথিলা?এই মিথিলা??
আমি পেছন দিকে মাথা ঘুরিয়ে হাল চোখে তাকিয়ে বলি,
-জ্বী,খালামণি??
-খালামণিরা চলে যাচ্ছি।তাই তোকে বলতে আসলাম।
-চলে যাবেন মানে?সাবিলা,এন্জিলা সিস্টার,নিলয় ভাইয়া সবাই চলে যাবে??
-হু।তোর আম্মুকেও বলেছি আমাদের সাথে আমাদের বাড়ি যেতে।নিলয়ের এংগেইজমেন্ট ডেট ফাইনাল না হওয়া পর্যন্ত তোর আম্মু যাচ্ছে না।তাই আর-কি,কারো ইচ্ছের উপর জবরদস্তি খাটে না।।তাই আর জোর করিনি।।
-এখনই চলে যাবেন??
-হু।নিলয়ের মাথায় ভূত চেপে ধরছে বাড়ি যাওয়ার।
-কেন,খালামণি?
-জানি না মা।হুট করে এখন আমায় এসে বলে বাড়ি চলে যাবে।এখানে আর এক মুহূর্তও থাকবে না।বুঝো তো,বাচ্চামো স্বভাবটা ওর এখনো গেলো না।

খালামণি এটাকে বাচ্চামো স্বভাব বলে না।এক ধরনের ন্যাকামো বলে।আপনি হয়তো আপনার ছেলের ন্যাঁকায় এখনো অন্ধ!!(মনে মনে)

-তো ডিনারটা করে যান?
-পরে খাওয়ার অনেক সময় পাবো মা।এমনিতে অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে।। আসি…

এ বলে খালামণি আমার কাঁধে হাত বুলিয়ে চলে যান।

আমি প্রায়ই হতবাক।এরকম অবাক কার্বারে।কিছুক্ষণ আগেইতো সব ঠিকঠাক ছিল,এরইমধ্যে তুমুল ঝড়।এই নিলয় পাকনাটা না একদম বেশি করে।।
তারপর আমি আস্তে আস্তে হেঁটে বসার রুমে আসি।
বসার রুমে এসে দেখি, সাবিলা,এন্জিলা সিস্টার এবং সবাই রেডি বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে।আর নিলয় ভাইয়া তাড়াহুড়ো ভাব দেখিয়ে বুচকা-বুচকি গুলো হাতে নিয়েছে।তা দেখে আমার মুখে হাসি চলে আসে।কারণ নবাবজাদা চাকরের কাজে ব্যস্ত এখন। হিহিহিহি…
কিন্তু সবাই যে এভাবে চলে যাচ্ছে আমার কেন জানি ভীষণ খারাপ লাগতে শুরু করে।মুখে কাঁদো কাঁদো ভাবের ছাপ চলে আসে

আমি কিছু না ভেবে দৌড়ে এন্জিলা সিস্টারকে জড়িয়ে ধরি।
-প্লিজজ সিস্টার, আজ অন্তত থেকে যাও,প্লিজজ?
-Again i will come,cuty.Don’t be upset.Plz be silent…
(আমি আবার আসবো,সুন্দরী। আপসেট হয়ো না।দয়াকরে শান্ত হও।)
-Angila sister, hurray up!! So be going late…(Sabila)
(এন্জিলা আপু,তাড়াতাড়ি করুন।অনেক দেরী হয়ে যাচ্ছে ।)
এন্জিলা সিস্টার আমার মাথায় হাত বুলিয়ে নিজ থেকে আমায় ছাড়িয়ে নেন এবং কপালে একটা চুম্বন এঁটে দেন।
-Don’t tension.Be seeing with u Again, ok???
(চিন্তা করোনা।তোমার সাথে আবার দেখা হবে,ওকে??)

আমি আলতো মাথা নাড়ি উনার কথায়।এরফাঁকে নিলয় ভাইয়া এসে বলেন,
-অনেক রংঢং হয়েছে দুজনের।এবার চলো, এন্জিলা?
-Yeh,yeh.Move on Niloy..

আমার প্রচন্ড রাগ হতে থাকে।এই সবকিছু নিলয় ভাইয়ারই চাল।খামোখা সবাইকে এই রাতের বেলায় আমাদের বাড়ি থেকে নিয়ে যাচ্ছেন।লোকটার মধ্যে আসলেই ভেঁজাল আছে!!এত্ত খিটখিটে মেজাজের মানুষ লাইফে প্রথম দেখলাম।এসব ভাবি আর উনাদের দিকে তাকাই।সবাই যখন সদরের দিকে চলে যায় এবং মা,রিধিও উনাদের এগুতে যায়।তখনই নিলয় ভাইয়া আমার দিকে পিছু হটেন।ধীরে ধীরে উল্টো পা ফেলে আমার কানের কাছে এসে বলেন,
-আমি এই বাড়িতে থাকবো কোন অধিকারে??ভালো থেকো,মিথিলা।আর হ্যাঁ,আমার এবং সাবিলার এংগেইজমেন্টের ডেট এই উইকে হয়তো ফাইনাল হয়ে যাবে।আই হোপ,তুমি আসবে।বায়য় বেইবি,বায়য়……

এ বলে উনি শিষ বাজাতে বাজাতে চলে যান।আমি অনেকটা সং-এর মতো দাড়িয়ে থাকি।স্তব্ধতায় গ্রসিত আমার মন এবং পুরো দেহ।আমি যেন এই মুহূর্তে একটা রোবট যার কোনো অনুভূতিই আসছে না।

-এই আপু?সবাইতো চলে গেলো।তুমি এখনো এখানে দাড়িয়ে আছো??
রিধি শরীরে আলতো ঝাঁকানি না দিলে আমার মস্তিষ্ক বিলীনই থাকতো।তারপর ধ্যান আসতেই রিধির দিকে হেসে বলি,
-হ্যাঁ,হ্যাঁ জানি জানি।নাহ মানে এমনিই দাড়িয়ে আছি।
-তোমার মুখ বলে মিথ্যে কথা,কিন্তু তোমার ভেতর বলে অন্য কথা।
-ম-মানে রিধি??
-আপু শুনো?আমি সোজাসাপটা তোমাকে কিছু কথা বলে দিই।আমি জানি,তুমি এই মুহূর্তে কি ভাবছো।নিলয় ভাইয়া সাবিলা আপুকে অনেক ভালোবাসে,তা হয়তো তুমি জানো না।কারণ,আজ উনাদের মাঝে যে ভালোবাসার বন্ধন দেখলাম মনে হয় একে-অপরকে ছাড়া বৃথা।নিলয় ভাইয়া,জাস্ট টাইম পাস করতে লাইক করে উনার চলনবলনই বলে দেয়।কেননা,উনি যেভাবে তোমায় ঘায়েল করলো,কোনো স্বামী তার বউকে এরকম নির্দেশ দেয় না।হুটহাট এধরনের বিহেভ ওসব ছেলেদের পক্ষেই সম্বব যারা মেয়ে পটাতে ভালো জানে, এবং একশো মেয়ের সাথে সম্পর্ক রাখে।আমরা মধ্যবিও ফ্যামিলির সন্তান আপু,আমাদের কাছে আমাদের মান-সম্মানই বড়।ক্রাশ,ভালোবাসা,স্বপ্ন এসব আমাদের মানায় না।কারণ,আমরা সবকিছু হিরে ভাবলেও আসলে তার শেষ পরিণতি ছাই জুটে।।তাই প্লিজজ,সাবিলাকে যদি উনি বিয়ে করতে চান,করলে করুক আপু।আপু আমি তোমার ছোটবোন হয়ে জাস্ট তোমাকে এটুকুই বলবো তোমার কিছু হলে আমিই মরে যাবো।

এসব বলে আর চোখের পানি ফেলে রিধি।আমি অনেকটা অবাক হয়ে যাই এটুকু একটা বাচ্চার কিছু যুক্তিসম্মত মতবাদ দেখে।সবে ক্লাস ৮ম শ্রেনীতে পড়ে। আমার নিজের মাথায়ই তো কখনো এসব ঘুরপাক খায়নি। আমার চোখের পানিগুলোও বড্ড বেমানান। যখন-তখন বাঁধ মানে না।অঝোর ধারায় ঝরতেই থাকে।নিজেকে সামলাতে আর না পেরে রিধির দু’গালে চাপড়ে ধরে ওকে বুকের মধ্যে মিশিয়ে নিই।আর মনে মনে ভাবি,রিধি তুই ঠিক বলছিস বোন।নাহলে,উনি হুটহাট যখন-তখন আমায় স্পর্শ করতে চাইতেন না।আজ অস্পর্শতার ক্ষোভেই আমাদের বাড়ি থেকে চলে গেলেন।সত্যিকারের ভালোবাসা কখনো স্পর্শের মাধ্যমে হয় না,ভালোবাসতে শুধুই দুটো গভীর অনুভূতির মন লাগে।আর আমি উনার কোনোদিক দিয়েই যোগ্য নয়,তাহলে উনি কোন দুঃখে আমায় সত্যিকারের ভালোবাসতে যাবেন!??

আমাদের দু’বোনের এসব মান-অভিমানের মাঝে বাবা অফিস থেকে বাসায় ফিরেন।বাবা একটা কোম্পানিতে এক্সিকিউটিভ পদে কাজ করেন।
-কি হলো,আমার দু’মামুণি ওখানে দাড়িয়ে দাড়িয়ে কি করে??

বাবার কন্ঠস্বর শুনতেই আমি এবং রিধি তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে নিই।রিধি মুঁচকি হেঁসে বাবাকে বলে,
-বাবা,জানো?আজ খালামণিরা এবং মামানিরা যে আমাদের বাসায় এসছেন??

বাবা স্যুটকেসটা টি-টেবিলের উপর রাখেন,আর সোফায় বসতে বসতে বলেন,
-জানি মা জানি।
-বাবা কিভাবে জানো?
-তোমাদের মা-ই আমায় ফোন করে বলেছেন।
-ওহ আচ্ছা।
-বাবা,তুমি বোধহয় ভীষণ ক্লান্ত।একগ্লাস পানি এনে দিই??

বাবা কপালের ঘাম মুছে আমাদের দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দেন।
-লাগবে না মা।তোমাদের মাকে ডাকো।।

আসলে,সত্য কথা বলতে পৃথিবীতে প্রিয় মা-বাবা সন্তানদের কাছে কষ্টের মুহূর্তগুলোকে লুকিয়ে হাসতে জানেন।তারা শত ব্যস্ততার মাঝে ক্লান্তি মনোভাবে সন্তানের প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ করেন।আমরা এই ভালোবাসাটুকুর হয়তো মর্ম বুঝি না।আমরা রঙ্গিন ভালোবাসাকেই স্বর্গ মনে করি।মাতৃত্ব,পিতৃত্বের মতো স্বর্গের উদ্যান এই ধরনীতে দ্বিতীয়টি নেইই।
রিধি মাকে ডাক দিতে মায়ের রুমে চলে যায়।আর আমি আমার রুমে চলে আসি।।

রুমে ঢুকেই বিছানার উপর এলিয়ে শরীরটা ছড়িয়ে দিই।আর মুহূর্তে মুহূর্তে নিলয় ভাইয়ার কথা স্মরণ হতে থাকে।মনে পড়ে উনার ক্ষণিকের কিছু শাসনের ভালোবাসা যে ভালোবাসায় ছিল মুখোশ পরিহিত ক্ষণিকের আবদার মেটানোর আয়েশ।

বিছানার উপর চিৎ হয়ে শুধু এপাশ-ওপাশ ছটফট করতে থাকি।কিছুতেই মনকে মানাতে পারছি না।
বার বার মাথায় স্মৃতি জাগে উনার আদুরে মাখা ভাষা,আর বার বার উনার স্পর্শতায় আমার মনে শিহরণ জাগানোর আকুলতা।
“রাস্তার মধ্যে পরপুরুষদের ধবধবে পিঠটা দেখানোর জন্যে চেইন খুলে রেখেছিস।”
“যতই অজুহাত দেখাস না কেন আজ তোকে শাস্তি পেতেই হবে।”

উফস,আর নিতে পারছি না এসব।দমটা যেন বন্ধ হয়ে আসছে!!তড়িঘড়ি বিছানা থেকে উঠে বসি।আর ঘনঘন নিশ্বাস ফেলতে থাকি।
বিছানা ছেড়ে ধীরগতিতে আয়নার দিকে হাটা ধরি।আয়নার সামনে এসে মাথাটা পেছনের দিকে ঘুরিয়ে জামার চেইনটা খুলে নিই।নিলয় ভাইয়ার প্রসংশনীয় কথায় বার বার পিঠের দিকে চোখ বুলাতে থাকি।

আবার গ্লাসের সাথে হেলান দিয়ে চোখবুঁজে কান্না করতে থাকি।এতটা বছরের একপাক্ষিক ভালোবাসায় আজ সামান্য একটু কেয়ারে মানুষটাকে খুব আপন মনে হলো কেন??মানুষটার ভালোবাসার চিহ্ন আবার সারা অঙ্গতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে গেল!ভুলবো কিভাবে তাকে আমি??সে’তো ক’দিন পর অন্যকাউকে বিয়ে করে সুখে সংসার পাতবে, আর আমি নয়ন জ্বলে ভেসে দিন পার করবো!!
নাহ,নাহ আমি তা সহ্য করতে পারবো না।।

-আপু?আপু?আপু?
রিধি মায়ের ফোন হাতে নিয়ে আমার সামনে এসে হাজির হয়।আমি রিধির আওয়াজে ওর দিকে তাকাই।
-আপু,এই নাও ফোন??
-ফোন মানে??কে কল দিয়েছে??
-আগে ফোনটা কানের পাশে নাও,তারপর বুঝবে।

আমি রিধির কথায় ওর থেকে ফোনটা আমার হাতে নিয়ে কানের পাশে গুঁজতেই খুব সুমধুর একটা কন্ঠে ওপাশ থেকে ভেসে আসে,
-I miss u!!!
তারপর গটগট করে কলটি কেটে যায়।আমি তড়িঘড়ি ডায়াল লিস্টে যাই নাম্বারটি খুঁজতে।নাম্বারের দিকে তাকাতেই চোখগুলো আমার ছানাবড়া!! খুব সুন্দর করে লিখা–“নিলয় বাবা।”

পর্ব-০৫
রোকসানা আক্তার

আমি মোবাইলটি নিচে নামিয়ে রিধির দিকে আড়নয়নে তাকাই।রিধি ভয়ে কাচুমাচু হয়ে এদিক-ওদিক চায়।আমি কিছু বলার আগেই ও বলে উঠে,
-আপু,আমি যখন আম্মুর রুমে যাই তখন আম্মু নিলয় ভাইয়ার সাথে কথা বলতেছিলেন।আর আম্মু আমায় দেখামাএই ফোনটা আমার দিকে এগিয়ে তোমায় দিতে বলেন।নিলয় ভাইয়া নাকি তোমার সাথে কথা বলবে সেজন্যে।

আমি চোখদুটো বুঁজে মুখে একটা বিরক্তিকর ছাপ টেনে বলি,
-আচ্ছা এখন যা তুই।আর সাথে করে মায়ের ফোনটাও নিয়ে যা।
মাথা হেলিয়ে রিধি আমার রুম থেকে প্রস্থান করে।

আমি ধীরপায়ে হেঁটে বেলকনির দিকে অগ্রসর হই।বেলকনির রেলিং-এর উপর দু’হাত আঁকড়ে রেখে নক্ষত্র ঘেরা দূর আকাশটার দিকে চোখ বুলাই।আমার চোখের চাহনির দূরত্বের মাঝে মনের মলিন ধোঁয়াশাগুলোও বাসা বাঁধতে থাকে।আর ক্ষণিকে স্মৃতির পাতা খোলসা হয়।

সেই ছোটবেলায় যখন ভাইয়াদের বাসায় যেতাম, ভাইয়া আমায় আচ্ছামত ললিপপ কিনে খাওয়াতেন।কখনো বাচ্চামো কান্নায় বিভোর হলে বুকে জড়িয়ে নিতেন।আবার সন্ধের পর আমার বামহাতটা ধরে ছাদে নিয়ে যেতেন।
আর বিন্দু বিন্দু আকাশের মিটিমিটি তারাগুলো গোনতে থাকতেন। অনবরত রুদ্ধশ্বাসে গোনতে গোনতে উনি হাঁপিয়ে উঠতেন, তা দেখে আমার মুখে হাসি চলে আসতো।আমার খিলখিল হাসির প্রতিধ্বনি উনার চুম্বন আমার কপালে এঁটে দিতেন। এই চুম্বনটা একরাশ মায়ার চাদরে মুড়ানো,যেই মায়ার আবেশে মনের কোণে ভালোবাসা নামক শব্দের জন্ম হয়।মনের অজান্তেই ভাইয়ার প্রতি আমার ভালোলাগা কাজ করতে থাকে,হয়তো ভালোলাগার কারণ আজ অব্দিও অস্পষ্ট।এখনো সেই লালিত ভালোবাসাটুকু আমার হৃদয়ে হৃদয়ঙ্গম,আর চিরচেনা সেই ভালোবাসার মানুষ অচেনা প্রান্তরে উদীয়মান।
সত্যি এটাই ভাগ্যের পরিহাস।।

আকাশের ওই তারাগুলোকে সাক্ষ্য দিতে আজ খুব ইচ্ছে হয়।নিলয় ভাইয়া সত্যিই কি আমার আর হবে না?নাকি বৃথা স্বপ্নের বুননে এখনো নিজেকে বিহ্বল রেখেছি।স্বপ্ন অচিরেই প্রাচীর দেয়ালে ঢাকা পড়বে??

এসব ভাবনার ছেদ ঘটে কাঁধে মায়ের হাতের স্পর্শ ছোঁয়ায়।চোখের পানি মুছে ফের মায়ের দিকে তাকাই।মুখে একটা চাপা হাসি টেনে মাকে বলি,
-মা?সাবিলার সাথে নিলয় ভাইয়ার ম্যারিজ আগ থেকেই কি ঠিক করা ছিল??

মা ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাঁকান।আর বলেন,
-হ্যাঁ।কেন?তুই জানিস না??
-ন-না মা,আমি জানি না।ক-কে ঠিক করেছেন??
-নিলয়ের দাদাই।তোরা যখন ছোট ছিলি,তখন নিলয়ের দাদার খুব ইচ্ছে ছিল সাবিলার সাথে নিলয়ের বিয়ে হোক।এমনকি উনি মৃত্যুর পথযাএায়ও তোর আঙ্কেলকে(নিলয় ভাইয়ার বাবা) প্রতিশ্রুতি দিয়ে গিয়েছিলেন নিলয়ের হাতে সাবিলাকে তুলে দিতে।তাই,আমরা সবাই তারপর থেকেই এই সিদ্ধান্তে অটল।

মায়ের কথাশুনে আমি জোরে একটা দম ছাড়ি।আর চোখগুলো নিমিষেই স্তম্ভিত হয়ে আসে আমার।এই কথাগুলো শুনার পর আমার ঠোঁট কিঞ্চিৎ নড়তেও কম্পিত বোধ করেনি ।কারণ এখন আমার মনের সাথে মনের সংঘর্ষ বেঁধে গেছে। তাই এখন কিছু বলতে যেয়েও গলা অব্দি কথা আঁটকে আসছে।সে কারণে এখন আমি চুপসে।

-মিথিলা,অনেক রাত হয়ে গেছে।চল মা ডিনারটা করে নিই সবাই।
আমি মায়ের দিকে সরু দৃষ্টিতে তাকাই,আর গম্ভীরস্বরে বলি,
-মা,আজ যখন ঘুরতে গিয়েছিলাম তখন পেটপুরে খেয়ে নিয়েছিলাম।বিশ্বাস করো এখন পেটে এককোণও জায়গা নেই।এখন যদি রাতের খাবার খাই,তাহলে খাবার আমার গলা অব্দি পৌঁছে যাবে।হিহিহিহি…

মা-ও আমার ভ্রান্তিকথা বিশ্বাস করে আমার সাথে হেসে উঠেন।আর মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে চলে যান।।
আমি ক্লান্তিবোধ নিয়ে নিথর গা বিছানার উপর ছড়িয়ে দিই।

রাতটা হয়তো তন্দ্রায়ও কেটেছে।
ভোর সকালে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ি।ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িং রুমে আসতেই মায়ের চা-নাস্তা তৈরীর করার ছড়াছড়ি।সকাল হলেই মা ছুটে যান রান্নাঘরে।কারণ,সকাল ৭ঃ৩০ মিনিটের মধ্যে বাবার অফিসে যাওয়ার তাড়া।সে কারণে মায়ের ব্যস্ততা দ্বিগুণ বেড়ে যায় বাবাকে অফিসের জন্যে রেডি করতে।

মা নাস্তার প্লেট টেবিলে সাজাচ্ছেন,আর কপালে জমা হওয়া অজস্র ঘাম কাপড়ের আঁচল টেনে বারবার মুছছেন।
কিছুক্ষণ অব্দি হাঁক ছেড়ে বাবাকে ডাকছেন ঘুম থেকে উঠার জন্যে।এর ফাঁকে, আমি ড্রাইনিং এ এসে প্লেট টেনে ডিমের অমলেট,আর দুটো রুটি নিয়ে একটা চেয়ার টেনে তড়িঘড়ি বসে পড়ি।ডিমের অমলেটের সহিত রুটির টুকরো গদগদ মুখের মধ্যে ঢুকাতে থাকি।তা দেখে মায়ের চোখগুলো ছানাবড়া। কারণ,কখনো মায়ের ডাক না পড়া পর্যন্ত আমি ড্রাইনিং-এর ধারেকাছেও ঘেঁষি না।কিন্তু আজ
ইচ্ছাকৃত টেবিলে এভাবে এসে খাওয়াটাও মায়ের চোখ কপালে উঠার কথা।বোধহয় তা-ই হয়েছে।
মা আমার আরো কাছে এসে বলেন,
-ভীষণ ক্ষিধে পেয়েছে, না?কাল রাত কত্তবার বললাম ডিনারটা করতে,তুই শুনলি আমার কথা?রাত না জানি ক্ষিধে কতটা কষ্ট পেয়েছিস।আচ্ছা,আর একটা রুটি নে।

আমি সড়াৎ সড়াৎ গিলতেছি,আর দু’পাশে মাথা নাড়তেছি।
-আর লাগবে না, মা।
তারপর,বেসিন থেকে দু’হাত ধুঁয়ে নিজরুমে চলে আসি।রুমে এসে নতুন ড্রেস ওয়ারড্রব থেকে নামিয়ে নিই।কারণ,আজ মনস্থির করেছি ভার্সিটি যাবো।বাসায় পড়ে থাকলে বিষণ্ন মনে স্মৃতিরা মাথায় ঘুরপাক খাবে।কষ্টের জ্বালা নিবারণে বন্ধুদের সাথে সময় কাটানোটাই শ্রেয়।অন্তত কিছু সময়ের জন্যে নিজেকে একটু ভালো রাখতে পারবো

সেইভেবে পরিপাটি হয়ে ন’টার দিকে বাসা থেকে বের হই এবং ভার্সিটি রওনা করি।ভার্সিটিতে আসার পর বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে মোটামোটি মেশতে শুরু করি।আমি আগে কখনো কারো সাথে তেমন কথা বলতাম না,কিন্তু এখন তার উল্টো। সবার সাথে খোলা মনে হাসাহাসি, মজামাস্তি,কাউকে ছ্যাঁতানো ইত্যাদি,আমার লাইফটা যেন এখন অন্যদিকে মুভ হচ্ছে।আর এ সবকিছুর পেছনে আমার একটাই কারণ,তা হলো নিলয় ভাইয়াকে ভুলা।ওই মানুষটিকে আমার যে করেই হোক ভুলতে হবে।

এভাবে অনেক দিন পার হয়।তার কিছুদিন পর মা আমার রুমে এসে বলেন,
-মিথিলা,পরসু আমরা নিলয়দের বাসায় ব্যাক করছি।নিলয়ের এংগেইজমেন্ট এরেন্জ আগামী ৭ তারিখে।

মায়ের কথায় আমি অনেকটা ইতস্ততাবোধ করে ঢোক গিলতে থাকি।
-ও-ওহ আ-আচ্ছা।আমার তো ভার্সিটি আছে মা।আর মাএ ক’দিন পর আমার সেমিস্টার।মনে হয় না যেতে পারবো।
-সে কেমন কথা!একদিনের জন্যে ভার্সিটি মিস দিতে পারবি না?ও’কদিন যে সপ্তাহখানেক ভার্সিটি মিস দিলি তখন প্রবলেম হয়নি!!!

মাথাটা নিচু করে আমি চুপ হয়ে থাকি।
-যাইহোক,কাল বাদে পরসু।যাওয়ার সময়ই ডিসাইড করিস যেতে পারবি কি না।আমি গেলাম।
এ বলে মা চলে যান।

পরের দিন দুপুরে ,ভার্সিটি ক্লাস শেষে আমি রিক্সার জন্যে দাড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকি।হুট করে কেউ একজন পেছন থেকে এসে আমার চোখ-মুখ চেপে ধরে আমাকে একটা গাড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে নেয়।আর একটা বদ্ধ অন্ধকার রুমে নিয়ে আসে।

এখন আমার হাত-পা দড়ি দিয়ে চেয়ারের সাথে বাঁধা,চোখে পাতলা একটা ত্যানা দিয়ে চোখগুলো ঢাকা যার জন্যে আমি সামনের কোনোকিছুই প্রত্যাখ্যান করতে পারছি না।আর চিৎকার দিয়ে বলতে থাকি,
-কে আপনি??আমায় এখানে কেন নিয়ে আসছেন??আমি আপনার কি ক্ষতি করেছি।বলুন??প্লিজজ আমায় যেতে দিন।

এসব বলছি আর অনবরত চোখের পানি ফেলছি।
আমার জন্যে লোকটির বোধহয় ভীষণ মায়া হয়,সে কারণে আমার চোখের উপর থেকে ত্যানাটা এক টানে খুলে ফেলে।
আমি ঘোর ঘোর চোখগুলো ভালোভাবে কচলে নিই।যখন চোখের সামনে সব স্পষ্ট হতে থাকে তখন সামনে থাকা লোকটির দিকে তাকাই।
লোকটির দিকে তাকাতেই ভয়ার্ত এবং কাঁপা স্বরে বলে উঠি,
-ভা-ভাইয়া,আপনি??
-হু আমি।

নিলয় ভাইয়া একটা চেয়ার টেনে হাটু গেড়ে আমার কাছে এসে বসেন।আর মায়াবী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অনেকক্ষণ যাবৎ আমার দিকে তাঁকিয়ে থাকেন।আমি অপ্রস্তুতবোধ করে বলি,
-আমাকে এখানে কেন নিয়ে এসছেন এবং কি উদ্দেশ্যে??

-উদ্দেশ্যটা তোর না জানাই ভালো।আর কেন নিয়ে আসছি তাহলে শোন…
তুই আমার সাথে আগামী একসপ্তাহের মধ্যে ইংল্যান্ড ব্যাক করবি।আমি তোর ভিসা,কাগজ-পএ সব ওকে করে রেখেছি।
-ম-মানে??এসব কি বলছেন আপনি??মাথা ঠিক আছে আপনার???
-হু,আমার সব ঠিক আছে।শুধু তোর ঠিক নেই!!আর কোনো নো এক্সকিউজ! আমি যা বলছি,তা-ই করবি।ওকে???
-ন-না…
-স্টপ,মিথিলা!!আমার মুখের উপর কথা বলবি না।
এ বলে উনি আমায় বদ্ধ রুমে রেখে চলে যান।আর আমি সমুদ্রের স্রোতে চোখের জল ফেলতে থাকি।আকাশের দিকে তাকিয়ে শুধু বিধাতাকে বলতে ইচ্ছে হয়,
-হে বিধাতা,কেন আমায় এত্ত কষ্ট দিলে,বলো???

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে