পর্ব ১২+১৩
পারবো না ছাড়তে তোকে
পর্ব—১২
রোকসানা আক্তার
আমার মুখের উপর কান্নার প্রলেপ দেখে রিধি কিছুটা আতঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
——-আপু, সামথিং রং??
আমি শূন্যে মুখটা তুলে চোখ-মুখ কুঁচকে ভাব এনে মাথা নাড়ি।রিধি আশঙ্কায় মুখের উপর হাত টানে।
—— খালামণি মে বি ফোনটা নিলয় ভাইয়ার থেকে কেড়ে নিয়েছেন।
——তা বুঝলাম আপু।তবে নিলয় ভাইয়ার সাথে তোমার আর একবার দেখা হলে অনেক ভালো হতো।।
——হুম!!তবে দেখা করার ওয়ে কোথায়,বল?
——হু,সেটাই।
মা ঠাস করে আমাদের রুমের দরজা ধাক্কা দিয়ে বলে উঠেন,
——কি কথাবার্তা হচ্ছে?খাওয়াদাওয়া করা লাগবে না তোদের?!!
রিধি মায়ের ঝংকার আওয়াজে কেঁপে উঠে।আর কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,
—–মা আসছি।
রিধি আমাকে চোখ দিয়ে ইশারা করে ড্রয়িং রুমের দিকে।তৎপর অনেক কষ্টে দু-তিন নালা ভাতের দলা মুখে তুলে কোনোমতে হাতটা ধুঁয়ে চলে আসি।
এভাবে দু’দিন শেষ হয়।তবুও নিলয় ভাইয়াকে একনজর দেখার ভাগ্যটুকু আমার আর হয়ে ওঠেনি।বাসা থেকে বেরুবার অনেক চেষ্টা করি।বেমালুম মায়ের কড়া চোখের নজরদারিতে এ দু’টো দিন কাটাতে হয় আমার।কখনো রুমে এসে বার বার উঁকি দিতেন।রুমে একা একা কি করি,কিভাবে থাকি,কারো সাথে কথা বলি কি না এসব হ্যানত্যান ।।
এখন সন্ধে,
আমি বসে বসে একটা উপন্যাস পড়তেছি।রিধি ক্লাস,প্রাইভেট শেষ করে ক্লান্তিমনে পাশের রুমে নিস্তেজ ঘুমচ্ছে।বাবা অফিসে আর মা বোধহয় নামাজ পড়ার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছেন।আমি জানলা গুলো খুলে পর্দা সরিয়ে দিয়েছি।হালকা হালকা বাতাসে কিছুক্ষণ পর পর পর্দাগুলো দুলে উঠে।আমি একমগ্নে কাহিনির উপাখ্যান মনে করার চেষ্টা করতেছি।হঠাৎ কিছু একটার সুভাস আমার নাক-মুখ চেয়ে যায়।চোখবুঁজে মাতিয়ে নেওয়া সেই সুগন্ধিটার ঘ্রাণ নিতে থাকি।এতটাই মনোমুগ্ধ,এতটাই আকৃষ্ট এই সুভাসের সুগন্ধি।পরে ভালোভাবে পরখ করে বুঝতে পারি হাসনাহেনা ফুলের গন্ধ আসছে বাহিরের ঝাঁ ঝাঁ বাতাসের গতির সঙ্গে।
এখন সেপ্টেম্বর শেষ হয়ে অক্টোবর মাসে পা পড়ছে।তাই হাসনাহেনা ফুলের গন্ধ চারদিকটা ছড়াছড়ির মেলা।দমদম দরজা ঠেলে রিধি ভেতরে ঢুকলে ধ্যানভাঙ্গে আমার।কাচুমাচু মুখ নিয়ে রিধি সামনে এসে দাড়ায়।
ঘুমটা বোধহয় এখনো সম্পূর্ণ হয়নি ওর যা তার চোখমুখের অবয়ব বলছে।ছলাৎ ছলাৎ কন্ঠস্বর টেনে বলে,
——-আপু দ্যাখোতো,হঠাৎ এত্তগুলো লোক আমাদের বাসায় কেন??তাদের শোরগোলের আওয়াজে ঘুমটা আমার ভেঙ্গে গেছে।মাকে কিছু জিজ্ঞেস করার পরও মা আমায় কিছু বলছেন না।
রিধির কথায় আমার মস্তিষ্ক সক্রিয় হয়ে ওঠে,আর শিরা-উপশিরার রন্ধ্রে রন্ধ্রে সন্দেহের দানা বাঁধতে থাকে।একমুহূর্তেও আর দেরী না করে আমি ড্রাইনিং দিকে যাএা করি।ওখানে এসেই চোখগুলো খাঁড়া আর মুখটা থমকালো হয়ে যায় আমার।
মা অতিথি লোকগুলোর সাথে দাঁত কেলিয়ে কথা বলতেছেন যেন কোনো মিষ্টি আলাপণ।এর মাঝে রহিম চাচাকেও দেখতে পাচ্ছি যিনি ঘটকালি করে পেট পুরান। তারমানে বাসায় নিশ্চয়ই কোনো বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে এসছেন আর সাথে পাএ পক্ষদেরও।কিন্তু কার জন্যে এ আয়োজন??মা কেন এতটা আহ্লাদে আটখান!আমার জন্যে??–নাহ,নাহ আমিতো বিবাহিত!নাকি রিধির জন্যে।আর রিধিরতো বিয়ের বয়সই হয়নি।তাহলে….???
এভাবে ভাবতে ভাবতে আমার পুরো শরীর ছমছম করে উঠে।হুট করে পেছন থেকে মা আমার হাতটায় টান মেরে আমার রুমের দিকে নিয়ে আসেন।
মুখে ইতস্ততা ভাব এনে বলেন,
——মা,একটা কাজ করতে পারবি??
আমি থতমত খেয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে মায়ের দিকে সরু দৃষ্টি দিই।মা আমার দিক ইতস্ততার মাঝে হাসির ছাপ এঁটে তাকিয়ে আছেন।আমি কাঁপা কাঁপা স্বরে বলি,
——-ক-ক-কী কাজ,বলো??
——-মায়ের মেরুন কালারের শাড়িটা পড়তে পারবি এখন?আর তুই যদি না পড়তে জানিস তাহলে আমি পড়িয়ে দিব।
সন্দিহান বিষয়টি এখন আমার মাথায় ঢোকে।চোখগুলো আমার ক্ষণিকে লাল হয়ে যায় যেন চোখ থেকে গড়গড় গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে।
——-মা তোমার মাথা ঠিক আছে??এসব কি বলছো তুমি??
মা আমার গালে দুটো থাপ্পড় মেরে কটু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দ্বিধাহীন রেওয়াজ তুলেন।
——কোনটা ঠিক কোনটা বেঠিক ওটা আমি বুঝি।আমাকে তোর বুঝ দিতে হবে না।
আমি বেঁচে থাকতে ওই নিলয়ের বাড়ি তোর পা ফেলতে দিবনা।তোর জন্যে অনেক ছোট হয়েছি উনাদের কাছে।
আর নিলয়ের সাথে তোর বিয়ের ব্যাপারটা সবাই জানাজানির আগেই তোকে অন্য জায়গায় বিয়ে দেওয়াটাই আমাদের জন্যে ভালো হবে।
——-প্লিজজ মা,তুমি একটু যাওতো আমার রুম থেকে??প্লিজজ যাও।
——মিথিলা!!??
——তোমার চিৎকার করা লাগবে না।আমিই চিৎকার করে উনাদের সব বলে দিচ্ছি।
——তুই কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করতেছিস!!
——বাড়াবাড়ির কিছুটিই এখানে হচ্ছে না।তোমার অন্তত এটা মাথায় থাকার দরকার ছিল আমি একজন বিবাহিতা এবং অন্যজনের বউ।তাছাড়া আমি নিলয় ভাইয়াকে কত ভালোবাসি,সেখানে এসে তুমি বামহাত ঢোকাচ্ছ!! হাউ ফান ইট ইজ!!আই এম ম্যাড!??আমাকে পাগল পাইছো তোমরা সবাই যে যখন যা খুশি তা করবা!!?
মা রেগেমেগে এখনই যেন আমার অর্ধেক গর্দান ফেলে দিবেন।নিজেকে সামলে বলেন,
—–ওই নিলয় তোর লাইফের অপোজিট!এটা তোকে বুঝা উচিত।নিলয়ের বাবা এই সম্পর্ক কখনোই মানবে না।উনার যদি প্রাণ ও চলে যায়য়!!সো,এত্ত জায়-ঝামেলার মধ্যে আমি আর নাই বাপু।আত্মীয়তার মাঝে শএুতা হোক তা আমি চাই না ।নিলয়কে ভুলে যেতে না পারলেও ভুলার চেষ্টা করতে হবে।এখন এত্তকিছু বলার সময় নেই।তাড়াতাড়ি এই শাড়িটা পড়ে রেডি হয়ে নে।কুইকলি,,আমি গেলাম।আর রেডি হওয়ার পর রিধিকে দিয়ে আমায় ডাক পাঠাইস।
এ বলে মা হনহন করে রুম ত্যাগ করেন।উফস মন চাচ্ছে এখন সব ভেঙ্গে ফেলি নতুবা নিজেকে শেষ করে দিইই।।আমি দাপিয়ে রুমের দরজাটা বন্ধ করে বিছানার উপর পা গুঁজে বসি পড়ি।চোখের কোটরে কোটরে নিষ্কৃত অশ্রু বেয়ে পড়ছে,সাথে বিন্দু বিন্দু অবাঞ্ছিত ঘামের স্রোত।পাশে পড়ে আছে মায়ের রেখে যাওয়া মেরুন রঙ্গের শাড়ি,চুড়ি, মেকআপ বক্স ইত্যাদি।
এভাবে পাঁচমিনিট শেষ হয়।তারপরও আমি আগের মতো স্থির।আমার মুখে না কোনো সাঁজ নিচ্ছি,না কোনো শাড়ি পড়ছি।
আবারও দরজায় কড়াঘাত পড়ে মায়ের।
——-মিথিলা?মিথিলা?এই মিথিলা??
এভাবে করাঘাত করেই যাচ্ছে তাতে আমার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।একটা মুহূর্ত এসে দরজার ওপাশের ঠক ঠক শব্দ বন্ধ হয়ে যায়।ঠক ঠক যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে মা বোধহয় মাথায় একগাদা বিরক্তি নিয়ে অন্যএে চলে যান।দরজার ওপাশের পরিবেশ বলছে আমাদের এখানে কেউ নেইই।
ওপাশের লোকগুলো কি এখনো আছে নাকি চলে গিয়েছে ওসবে আমার এখন একদম খেয়াল নেই।আমি অনড় হয়ে নিজের ধ্যাণে মগ্ন যেনো কোনো এক বিষণ্নতা আমার চারদিকটা ঘিরে ধরেছে।
ঘড়ির কাঁটা টিক টিক করে চলতেছে,তারপরও সময়টুকু জানার জন্যে আমার আগ্রহ বাড়ছে না।এখন কি অনেক গভীর রাত নাকি সন্ধে রাত তাও পরখ করছি না।
এসব ভাবনা এবার ঘুচিয়ে যায় দরজায় আবারো করাঘাতের শব্দে।ওপাশ থেকে ভেসে আসে,
——মিথি,মা আমার রাগ করে না,মা।বাবা অফিস থেকে চলে এসছি দরজা খোল মা।
আমার চোখ-ঠোঁট -উরু সতেজ পাতার মতো নেচে ওঠে।বিছানা থেকে এক লাফ দিয়ে তড়িঘড়ি দরজাটা খুলে দিই।কোনোকিছু না বলে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকি।
——প্লিজজ,বাবা?তুমি মাকে বারণ করে দাও না যাতে এমনটি না করে!প্লিজজ….আমার আর এসব সহ্য হচ্ছে না।
বাবা কোনো রকম সাড়াশব্দ না করে আমার মাথায় হাত বুলচ্ছেন।এই হাত বুলানোর অনুভূতি ভরসার আভাস। মা কোথা থেকে হনহন হেটে এসে মাজায় হাত রেখে চোখগুলো ছানাবড়া করে রাখেন।খরখর গলায় বলতে শুরু করেন,
——–এই বাদুড়ের মতো ঘাড়ে চেপে বসানোর অভ্যেসটা তোমার আর গেলো না।ও আজ আমার মান – সম্মান সবটা গিলে খেয়েছে।পাএ-পক্ষদের কোনোরকম বুঝিয়েসুঝিয়ে কাল আসার জন্যো বললাম।আর হ্যাঁ,তুমি কাল অফিসে যেওনা।এখনই তোমার স্যারকে কল করে জানিয়ে দাও যে তুমি কাল রিধিকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবে।
বাবা মায়ের কথায় দাঁত কটমট করতে থাকেন,আর বলেন,
——কোম্পানিটি কি তোমার বাপের যে বললাম আর দিয়ে দিলো?!
——-ওমা,সে কেমন কথা বললে?তোমার স্যারতো অনেক ভালো।নিশ্চয়ই তোমার রিকুয়েষ্ট রিজেক্ট করবেন না।
বাবা মায়ের কথায় কোনোরকম শরগোল না বাঁধিয়ে চোখদুটো ধাঁধিয়ে চলে যান।বাবাও মায়ের এসব কর্মকান্ডে বিরক্ত।
আমিও মাথা ঘুরিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালে মা পেছন থেকে বলে উঠেন,
——-আজ যা নাটক দেখালি কাল থেকে এমনটি যেন আর না দেখি!!!
বেখেয়ালি একটা হাসি ফুটে উঠে ঠোঁটের কিণারায়।কারণ নাটক তো আর আমি করছি না,নাটক তো উনারা সবাই আমার সাথে সবে শুরু করলেন। আমাকে বিতাড়িত করে নিলয় ভাইয়াকে মুক্ত করার ফন্দি!!!
——–কি হলো??আমার কথায় কানে গিয়েছে???
মায়ের ঝংকার আওয়াজ কানে পৌঁছাতেই আমি কেঁপে উঠি।সাথে সাথে “ওয়াক ওয়াক” করতে থাকি।বোধহয় বমি আসার উপক্রম।দাড়িয়ে না থেকে বেসিনে চলে আসি।আর গড়গড়িয়ে বমি করতে থাকি।মা এসব কান্ড দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে দেখছেন।বমি করা শেষ হলে মাথাটা আমার ঘুরতে থাকে।কোনোমতে চোখেমুখে পানির ঝাপসা দিয়ে ড্রয়িং রুমে ক্লান্তিমনে বসি।আমার বমির শব্দ শুনে বাবাও,রিধি রুম থেকে বের হয়ে আসে।বাবা আমার কাছে এসে পাশে বসে বলেন,
——–শরীরটা খারাপ হয়েছে রে মা….???
আমি আস্তে মাথানাড়ি।
——–ওয়েট,আমি ডিসপেনসারিতে গিয়ে বমি বন্ধ হওয়ার ওষুধ নিয়ে আসি।
———তা লাগবে না বাবা।।
হুট করে আমাদের সামনে কোনো মানবের উপস্থিতি উপলব্ধি করতে পারি।বাবা আমার থেকে মাথা সরিয়ে সামনে তাঁকিয়ে বলে উঠেন,
——-নিলয় বাবা তুমি??আজ না তোমার সিঙ্গাপুর যাওয়ার কথা???
“নিলয় “ শব্দটি আমার কানে বাঁজতেই আমি হালচোখে নিলয় ভাইয়ার দিকে তাকাই।সত্যি তিনি এখন আমাদের বাসায় এবং আমাদের সামনে দাড়িয়ে আছেন।
নিলয় ভাইয়ার চোখে-মুখে চিন্তার চাপ ভেসে আসছে।তারপর বলেন,
——আ-আ-আঙ্কেল?এত কথা বলার সময় এখন একদম নেই।মিথিলা চলো আমার সাথে…
আমি হা হয়ে যেই “কোথায় “ শব্দটি উচ্চারণ করতে যাবো, কিছু আর না বলতে দিয়ে ওমনি আমার হাতে হ্যাঁচকা টান মেরে সদরের দিকে নিয়ে চলেন।
মা অবাকদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে উঠেন,
——-নিলয়? তুই মিথিলাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস….
নিলয় ভাইয়া কিছুটি আর না বলে আমার হাত চেপে আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন।রাস্তায় এসে শহরের অলিগলির নিয়ন বাতির আলো চোখে পড়ে।আবছা আবছা অন্ধকার চারদিকটায়,লোকজনের ভিড় এখন আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে।পথের কিনার-কানার ঘেঁষে দু’চারজন দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে,কেউবা টঙ চায়ের দোকানে আড্ডা জমিয়েছে।,বাস,গাড়ি এক-দুটো এদিক-ওদিক যাচ্ছে।তবুও চারপাশটা নিস্তব্ধতায় ঘেরা।মনের মাঝে এক কাঁপুনি ধরে।নিলয় ভাইয়া কোনোরকম টু শব্দ না করে বার বার বাস আসার দিকে তাকাচ্ছেন।আমি হালকা স্বর টেনে বলি,
——-আচ্ছা,এখন ক’টা বাঁজে??
উনি ঘড়িতে তাঁকিয়ে বলেন,
——-এই ১০ঃ৪০ মিনিট।
——-আচ্ছা আমর এখন কোথায় যাচ্ছি।
এ কথায় উনি আমার দিকে আড়নয়নে তাঁকান,আর দম ছেড়ে বলেন,
——–গেলেই বুঝবে।
আমি আর কিছু না বলে মাথা হেলি।তারপর মাথায় সাদা ওড়নাটি টেনে দিই।আমাদের সামনে একটা বাস থামে নিলয় ভাইয়ার হাতের ইশারায়।
নিলয় ভাইয়া সেই বাসে আমার হাত ধরে উঠিয়ে তুলেন।তারপর আমরা সিটে গিয়ে বসি।।
আমার মন বলে, নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে।নাহলে নিলয় ভাইয়া সিঙ্গাপুর যাওয়া ক্যান্সেল করছেন,তাও এত্ত রাতের বেলায় আমায় নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন।।
এসব ভাবনার মাঝে নিলয় ভাইয়া আমার হাতদুটো চেপে ধরে বলেন
—–রাতে কিছু খেয়েছিস??
আমি দু’পাশে মাথা নাড়ি।
উনি কিছু আর না বলে আমাকে বাহু দিয়ে উনার দিকে জড়িয়ে ধরেন।আর বাস চলছে নিজ গন্তব্যে।আর আমরা কোন গন্তব্যে যাচ্ছি তা এখনো আমার কাছে অজানা।
আরেকটা পর্ব দিলাম……
পারবো না ছাড়তে তোকে
পর্ব-১৩
রোকসানা আক্তার
নিলয় ভাইয়া উনার পকেট থেকে ফোনটি বের করেন।কাউকে কল দেওয়ার জন্যে মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে নাম্বার খুঁজতে থাকেন।তারপর কল দেন।ওপাশ থেকে কলটি রিসিভ হতেই ভাইয়া ব্যস্তমনে বলে উঠেন,
——-হ্যালো,জেরিন??বাসটির নাম কি যেন বললি?
—- —–
——ওহ,ইউনিক।হ্যাঁ হ্যাঁ এখন মনে পড়ছে।
—– —— —–
—হু।তুই একদম টেনশন নিবি না।কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা যাএাবাড়ি এসে পৌঁছে যাবো।আর তুই এক্টিভ থাকিস। ফোন যেন ব্যস্ত না বাতায়।আজ বফের সাথে অন্তত আমাদের জন্যে একটু কথা কম বলিস।
—-
—–ওকে,বায়য়য়
লাউডস্পিকার লো ছিল তাই আমি ওপাশের রিসিভারের ভয়েস শুনতে পাইনি।নিলয় ভাইয়ার জেরিন নামের কোনো বান্ধবী আছে কি’না ভাবতে থাকি।
হঠাৎ বাহিরে দমকা বাতাস বইতে থাকে,হয়তো মেঘ করবে ভীষণ।নিলয় ভাইয়া আমাকে আঁকড়ে ধরে উনার দিকে আরো বেশি মিশিয়ে নিচ্ছেন।যেন বাহিরের হিংস্র প্রাণী আমার দিকে না ঝুঁকে পড়ে।আমাকে এতটাই রক্ষিতার ন্যায় সেইফ রাখছেন।
মলিনমাখা রাতের আধারে বাহিরের দিকে দৃষ্টি রেখে ভাইয়া আমায় উদ্দেশ্য করে বলে উঠেন,
——-মিথি?আমরা এখন সিলেট যাচ্ছি আমার ফ্রেন্ডের বাসায়।চিন্তা করো না সিলেট গেলে কেউ আমাদের কেউউ খুঁজে পাবে না।
——–স-সি-লেট??আমার খুব শঙ্কা লাগছে।সবাই আবার আমাদের পিছু নেয় নি তো!
——ওই সুযোগ আর হয়নি।সবাই গাড়িতে উঠার আগেই পিছন থেকে পালিয়ে চলে আসি।সিমকার্ড দোকানে ঢুকেই একটা নতুন সিম কিনে নিই।আর একটা সি.এন.জি ভাড়া করে তোমাদের বাড়ির দিকে চলে আসি।
——আপনার নাকি কিডনি প্রবলেম এটা কি সত্য?
——নাহহ মিথ্যে।সব সাঁজানো নাটক যাতে সবাই তোমার থেকে আমাকে আলাদা করে দিতে পারে।
পরক্ষণে আমার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়গড়িয়ে পড়ে।কাঁদো মুখে নিলয় ভাইয়াকে মনখুলে বলা শুরু করি,
——আপনি জানেন?আজ যে আমায় দেখতে এসছে?কতটা খারাপ লেগেছিল আমার!আমিতো ভাবলাম সুসাইডই করবো।
——এসব বলে না, মিথি তুই শুধুই আমার।বললাম না এই দেহে যতদিন শ্বাস,ততদিন তুই আমার নিঃশ্বাস। তোকে ছাড়া আমি অন্ধ,বেহুশ,পাগল…
——হয়েছে, হয়েছে একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু…!!
আমার কথায় উনি কটমট হেসে দেন।
——নাহহ সত্যি বলছি।
——হু, ছাই!!ঢং যত্তসব!!!
আমাদের বাস যাএাবাড়ি এসে পৌঁছে যায়।ভাইয়া আমার হাত শক্ত করে ধরে বাস থেকে নামান আর চারদিক তাকিয়ে রিক্সা খুঁজতে থাকেন।অতঃপর একটা রিক্সা পেয়ে যাই আমরা।তারপর আমরা রিক্সায় উঠি।
এরফাঁকে আমি আবারও ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করি,
—–আচ্ছা এখন ক’টা বাঁজে ভাইয়া?
আমার কথাশুনে উনি আমার দিকে কটু দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন।আমি থতমত খেয়ে এদিক-ওদিক তাকাই।আহা,বিড়াল ফাঁদে ধরা খাইছি,ক্যান যে উনারে ভাইয়া ডাকতে গেলাম!দাৎ মনেই ছিল না। উনি আমার হাবভাব বুঝতে পেরে একটা মুঁচকি হাসি দেন।তারপর টাইমটা বলেন।আমি অবাক হয়ে চোখগুলো বের করে বলি,
——কী!!এত্ত রাত হয়ে গেল!?
——সবে তো ১১ঃ৩০। বেশি রাত কই?
আমি আর কিছু না বলে চুপ হয়ে থাকি।জানি এ মানুষটার সাথে কথা বলে আর পেরে উঠতে আর পারবো না।কাজেই চুপচাপ ইজ রিয়েল।
হুট করে একটু হোঁচক খাই–আআআআআআআ”
—ব্যথা পেয়েছ মিথি??এই যে মামা একটু আস্তে চালাও।রিক্সা যেভাবে চলছে মনে হয় নিচে পড়ে হা-পা সব ভাঙ্গবে।
——আহা,এগিন কইয়া আর লাব নাইরে বাবা।দেখবারই তো পারছো রাস্তার যে অবস্থা ভাইঙ্গা-চুইরা সব শেষ।তবুও কাহো চোহে পড়স্যা না।আমাদের চালাইতে কত কষ্ট হইতাছে..যাএী বেথা পাইলে আমগো চালানোর দোষ।।
——-আচ্ছা চাচা যাই হোক—তারপরও একটু ধীরে ধীরে চালান।
আমরা ঢাকা টু সিলেট ইউনিক বাস কাউন্টারের সামনে চলে আসি।নিলয় ভাইয়া রিক্সাওয়ালাকে ভাড়া দিয়ে বিদেয় করেন।আমার হাত ধরে কাউন্টার অফিসের সামনে এসে দুটো টিকেট কিনে নেন।বাস ছাড়তে এখনো ২০ মিনিট লেট হবে।।
নিলয় ভাইয়া আমাকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকেন।ওখান থেকে দুটো কাচ্চি বিরিয়ানি অর্ডার করেন।আমি তেমন খেতে পারি নি।কারণ,সেই যে বাসা থেকে বের হলাম তখন থেকেই মাথাটা ঘুরঘুর,আর এখন সবটা খেতে গিলতে গেলে উল্টো বমি করতে হবে।নিলয় ভাইয়াকে কোনোমতে বুঝিয়ে হালকা খেয়ে হাত ধুয়ে নিয়ে এবং টিস্যুপেপার দিয়ে হাতটা মুছে নিই..।
উনার খাওয়া এখনো শেষ হয়নি।আমি থুতনির নিচে হাতগুঁজে উনার খাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি।বাহ উনার চিরল দু’ঠোঁটে খাবার ঢুকানো যেন কোনো আর্ট,এতটাই নিঁখুুত এ মাবুষটির সবকিছু।আমি একমগ্নে তাকিয়ে থেকে উনার স্বপ্নতে যেন ডুবে গেছি।উনার কথার স্বরে টনক নেড়ে উঠে আমার।
——এভাবে তাকিয়ে আছো কেন??
আমি লজ্জা পেয়ে কাচুমাচু করতে থাকি।উনি কিছু ভাবলেন না তো আমি যে এতক্ষণ এভাবে তাকিয়ে ছিলাম?উফস….কেন যে ঘায়েল হতে হয়, দাৎ….
——ন-না মানে…
উনি মুঁচকি হেসে আবার প্লেটের দিকে তাকিয়ে খাওয়াটা শেষ করেন।
দু’জন দুটো বোরহানি খেয়ে আমাদের বাসের সামনে এসে দাড়াই।
বাসে খুব সুন্দর করে লেখা–”ঢাকা টু সিলেট।”
“সিলেট “ শব্দটা শোনা মানেই জাফলং,জুগিরকান্দি মায়াবন,সংগ্রামপুন্জি জলপ্রপাত,লালখাল,মালিনীছড়া চা বাগান ইত্যাদি।পর্যটন স্থানগুলোর নাম এতদিন বইপএে পড়তে থেঁতলে গেছি,আর এখন সেই সিলেটই যাচ্ছি।ইয়াহু… ত-তবে ঘুরা হবে??হু হু মনে হয় না।কারণ,পালিয়ে এসেছি,সো লুকিয়ে থাকতে হবে।হায়রে মিথি তোর কপালটা বড্ড খারাপ।এই প্রথম সিলেট এসেও বুঝি এই ছন্নছাড়া কপাল নিয়ে আর ঘুরা হলো না।
আকাশটা ভীষণ ভার গয়ে আছে।যাএীরা সব বাসের সামনে লাইন ধরে দাড়িয়ে আছে।আমরা সবার পেছনে এসে দাড়াই।
সবাই এক এক করে বাসের মধ্যে ঢুকছে।অতঃপর আমরাও ঢুকে পড়ি।আমাদের সিটটা খুঁজে পেতে আর কষ্ট হয়নি,সবাই আমাদের আগে নিজেদের সিটে খুঁজে নেওয়াতে।
বাস স্টার্ট হয়ে যায়। বাস চলার একটু পরই দমদম বৃষ্টির ছাটা পড়ে।নিলয় ভাইয়া গ্লাসটা টেনে দেন।আমার হালকা শীত শীত অনুভূতি হতে থাকে।উনি আমার কাঁপুনির অনুভূতি বুঝতে পেরে উনার গা থেকে জ্যাকেটটি খুলে আমার হাতে দেন।
—–মিথি,এই জ্যাকেটটি পড়ে নাওও জলদি। সিলেটের গন্তব্যে যত ফিরবো ততবেশি শীত শীত লাগবে।ঠান্ডা লেগে যাবে তোমার।।
আমি ভালোভাবে পরখ করে দেখি উনার গায়ে একটি টি-গেন্জি ছাড়া আর কিছুই নেই।শীত আমার আগেই উনাকে আঁকড়ে ধরবে।।
—–ন-নাহ নাহ আমার লাগবে না।আপনি পড়েন।
—–মিথি??বেশি কথা বলো না।পড়তে বলছি পড়ে নাওও।আমার কথা ভেবো না।
উনার ঝংকার আওয়াজে থতমত খেয়ে বাধ্য মেয়ের মতো জ্যাকেট শরীরের উপর এঁটে দিই।
সকাল ৬ টায় আমরা সিলেট শহরে এসে পৌঁছাই।নিলয় ভাইয়া আমার হাতটা শক্ত ধরে রেখেছেন।।আমিও নিলয় ভাইয়ার হাতটা জোরে আঁকড়ে ধরে আড়নয়নে চারপাশটা তাকাতে থাকি।কারণ,অচেনা এই শহরে যদি চেনা মুখের ফাঁদে পড়ি তাহলে নিস্তার নেইই।বুকের মাঝে হার্টবিটটা দ্বিগুণ বাড়তে থাকে।।
আমরা এখন স্টেশন সাইডে জেরিন আপুর জন্যে ওয়েট করতেছি।উনি আমাদের এসে রিসিভ করবেনন।
নিলয় ভাইয়া জেরিন আপুকে একের পর এক কল করে যাচ্ছেন আর যাচ্ছেন…..।
হুট করে পেছন থেকে কেউ এসে নিলয় ভাইয়ার মাথার উপর একটা টোকা মারে।আমরা হকচকিয়ে পেছন ফেরে তাকাতেই জেরিন আপুকে দেখতে পাই।উনি অনেক হাংলা-পাতলা চিকন,গায়ের রং শ্যাম-উজ্জ্বল,ছোট ছোট চুলগুলো সিল্ক করা,পায়ে হিল কেডস,পড়নে একটা টপস এবং জিন্স।
—–কিরে নীল??এত্ত কল দেওয়ার কি আছে?তোর বান্ধবী তোকে সাত সমুদ্রের মাঝেও খুঁজে বের করতে পারবো,বুঝলি?
—-তোর চোখ যে সিসি ক্যামেরা তা এই নিলয় খান ভালো করেই জানে।
—-হু,,হাড্ডিসার, তুই তো আগ থেকে অনেক কিউটের ডিব্বা হয়ে গেছিস রে!
—-আগে কি দেখতে মন্দ ছিলাম?
—-য়ু-হু তা’না।লাল টুকটুকে চুলগুলোর মাঝে মুখ খানা যেন হিরের টুকরা।
—-হয়েছে,হয়েছে অন্যের স্বামীর দিকে এভাবে নজর দিতে নেই।তাহলে,এই যে পাশের বউকে দেখতে পাচ্ছিস না?এ-ই আমাকে মুরানি দেবে…।
চোখটিপ মেরে কথাগুলো বলে নিলয় ভাইয়া।আমার খুব হাসি চলে আসে।আমি মাথানিচু করে হাসতে থাকি।
—–ওহ-রে দোস্ত,এতক্ষণে এই টুকটুকে বধু যে তোর পাশে দাঁড়িয়ে আছে আমারতো খেয়ালই ছিলনা।
—–থাকবে কি করে?কখন যে আমায় পঁচাবি সেই ভাবনাই তোর মাথায় ঘুরঘুর ।
—–ভাবী,তুমি বলো, আমি কি ওর দুর্নাম করেছি?আমিতো জাস্ট প্রসংশা করছি।বাহ কেমন দুনিয়া মানুষের প্রশংসা করাটাও দোষ।।
—–এত্ত কথা না বলে এই যে আমাদের দাড় করিয়ে রাখছিস,আমাদের রতের গাড়ি এখন ড্যামেজ।
—-ওহ,দোস্ত চল চল।উফ স্যরি।আমি সাথে করে গাড়ি নিয়ে আসছি।
আচ্ছা চল।
তারপর আমরা গাড়িতে উঠে বসি জেরিন আপুদের বাড়িতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
চলবে….