পরী পর্ব ১৪
একদিন কাউকে না জানিয়ে আদিল তার বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যায়। ওখান থেকে কয়েকদিন পর ফিরে এলে সবাই তাকে হেনস্তা করে অনেক বকাঝকা দেয়। তাকে কেউ পছন্দ করে না। সবাই তাকে স্বার্থের জন্যই বাসায় রেখেছে। সে বকা শোনার পর রাতে গ্রামের পুকুর পাড়ে এসে বসল। বসে বসে তার এই ডায়েরিতে মনের দুঃখের কথা লিখতে থাকে। একটু পর লেখা অর্ধেকে থেমে গেল, “মাতাল করা ঠান্ডা বাতাস! এই সময় যদি কোনো সুন্দরী এক রমনীকে নিয়ে তার হাত ধরে হাঁটতে পারতাম, তবে কী ভালোই না লাগ…” পৃষ্ঠায় এই পর্যন্তই লেখা আছে। আর লিখেনি। পরবর্তী পেইজে একটি ছবি আছে। তাতে আদিল ডায়েরি নিয়ে লিখছে। তার ডানকাঁধে কোনো এক মেয়ের হাত। এই হাতে সেই কালো ব্যান্ডগুলো আছে যা এখন আমার বামহাতে। ছবির নিচ থেকে লেখা শুরু। “পুকুর পাড়ে যা হয়েছিল সবই কি সত্য ছিল? আমার তো এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না।”
পুকুর ঘাটে কী হয়েছিল তা বর্ণনা দিয়ে লেখা আছে, সে যখন পুকুরপাড়ে বসে ডায়েরিতে তার মনোভাবনা লিখছিল, তখন একটি মেয়ে তার ডানকাঁধে হাত রাখে। আদিল ঘুরে তাকাতেই অবাক হয়ে যায়। তার সামনে অসম্ভব সুন্দরী এক মেয়ে দাঁড়িয়েছিল। মেয়েটি এসে তার হাত ধরে বলল, ‘চল আমরা হাঁটি।’
আদিল তার এই রূপে ঝলসে গিয়ে তার প্রেমে পড়ে যায়। মেয়েটি আদিলকে নিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটার পর বলল, ‘এখন ভালো লাগছে তোমার? তুমি তো চেয়েছিলে এখানে কোনো এক সুন্দরীকে নিয়ে হাঁটতে পারলে তোমার অনেক ভালো লাগবে।’
‘কিন্তু এটা আপনি কী করে জানলেন?’
‘আমি তো সবকিছুই জানি।’
‘সত্যি, আমার খুব ভালো লেগেছে আপনার সাথে হেঁটে। আর আপনি আমার ভাবনার রমনীর চেয়েও অনেক বেশি সুন্দর। প্রেমে পড়ে গেলাম আপনার। কিন্তু আপনি কোথা থেকে এসেছেন? আপনাকে এখনও চিনলাম না।’
‘আসমান থেকে।’
‘মানে?’
‘মানে আমি আসমান থেকে তোমার জন্য এসেছি।’
‘আমার জন্য মানে? কিছুই তো বুঝছি না।’
‘বলছি, এদিকে এসো।’
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।
গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা
◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।
আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share
মেয়েটি আদিলকে বলতে লাগল, সে একটি পরী। আসমান থেকে এখানে এসেছে কাউকে ভালোবাসতে, বিয়ে করতে। পরীর জগতে তার একটা পরিবার আছে। তার আরও ছ’টা বোন আছে। ছ’টা বোনেরই ছ’টা জ্বীনের সাথে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার জন্য কোনো জ্বীন পাওয়া যায় না। তাদের জগতে যে জোড়া জ্বীন-পরীর সূত্র মিলে যায় তাদেরই বিয়ে হয়। প্রতিটা পরীকে তাদের সর্দার দুটি করে ব্যান্ড দেয়। এর মধ্যে একটি তার সঙ্গিকে দিতে হয়। কিন্তু এই পরীর সাথে কোনো জ্বীনেরই সূত্র মিলছিল না। তার মা বাবা অনেক চিন্তিত হয়ে পড়ে। তারা তাদের সর্দারের কাছে যায়। ডায়েরিতে বিস্তারিত আছে, এই সর্দারই পরী জগতের সবকিছুর রক্ষণাবেক্ষণ করেন। কারো কোনো অসুবিধা হলে সর্দারের কাছেই তারা যায়। সর্দারের কিছু আধ্যাত্মিক ক্ষমতার ফলে তিনি ভবিষ্যতও কিছুটা দেখতে পারেন। যাইহোক, পরীকে নিয়ে যাওয়া হলে তিনি কিছুক্ষণ ধ্যান করে বললেন, এই জগতে তার সূত্রী কোনো জ্বীন নেই। তার সঙ্গী পৃথিবীতে। সে একজন মানব। তার জীবনে একটি মানবের প্রেম লেখা আছে। আর মানবটির কপালে পরীর প্রেম। তাকে তোমরা পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করো।
সর্দার ব্যতীত পরীলোকের কেউ এই ভূমিতে আগে আরোহণ করেনি। কারণ তাদের জীবনীর সাথে মানুষের জীবনীর সামান্যটুকুও মিল নেই। পরীদের জগতে তারা সবসময় হাসিখুশী থাকে। মানুষের মতো অহেতুক দুঃখ, যন্ত্রণা কিছুই তাদের সহন করতে হয় না। কোনো ধরনের ভয়, হিংসা কিছুই তারা অহেতুক রাখে না। তাদের মনে কেবল ভালোবাসা নামক অনুভূতিটাই আছে। ব্যথিত হলে তারা সঙ্গির খাতিরেই হয়। তাদের দুটো জিনিসে ভালোবাসা থাকে, নিজ ডানায় ও প্রেমিকে। এও জানলাম, ভালোবাসা ছাড়া তারা অপূর্ণ।
সর্দার পরীকে সবকিছু শিখিয়ে দেন, পৃথিবীতে কীভাবে থাকতে হবে। তার ডানা সবসময় অদৃশ্য রাখতে হবে। কারণ কোনো ঘটনাক্রমে পরীদের কাছ থেকে একবার ডানা আলাদা হয়ে গেলে তারা আর তাদের ডানাগুলো একঘণ্টা পর্যন্ত নিস্তেজ থাকবে। সে সময় তাদের কাছে তেমন কোনো শক্তি থাকবে না। তারা উপরে পানির সংস্পর্শে না থাকায় পানির প্রতি তাদের অনেক দুর্বলতা। সর্দার ডানাগুলোকে যথাসম্ভব পানি থেকে দূরে রাখতে বলেছিলেন। নচেৎ ডানাগুলোর শক্তি কাজ করবে না পানির সংস্পর্শে এসে। সর্বোপরি তাকে অন্যান্য মানুষের মতো করে চলতে হবে। মানুষের গঠন ধারণা করতে হবে। সে তার শক্তি তার সঙ্গি ব্যতীত আর কাউকেই দেখাবে না। তাকে স্টিল জাতীয় জিনিস থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকতে হবে। এইরূপ কিছুর সংস্পর্শে তাদের গা জ্বালা করে, ক্ষত হয়। এসব কিছু শিখিয়ে তাকে সর্দার পৃথিবীতে নামিয়ে দিয়ে চলে যায়। পৃথিবীতে আসার পর কাউকেই তার পছন্দ হলো না। সবার মনে কোনো না কোনো খারাপ কিছু আছেই। তারা চোখ দেখেই মানুষের মনের কথা বুঝে ফেলতে পারে। তাদের জগতেও কোনো ভাষা নেই। চোখ দিয়ে সবকিছু বুঝা হয়। বর্ণিত আছে, পৃথিবীতে এসে সে ভাষা শেখে।
অবশেষে সে ওই পুকুরপাড়ে এসেছে। আদিলকে ডায়েরিতে কিছু একটা লিখতে দেখে তার নজর আদিলের ওপর আটকে যায়। আদিলের ন্যায় সুদর্শন ব্যক্তি সে ওই প্রথম দেখেছে। আদিলের তীক্ষ্ণ চোখ, কুঞ্চিত ভ্রূযুগল, পরিষ্কার রং সবকিছুই তাকে অন্যান্য ছেলেদের কাছ থেকে বিশিষ্ট করে তুলেছে। আদিলের মন পড়ে আদিলকে সে তার মনের মানুষ হিসেবে আবিষ্কার করল। এরপর তার মনের বাসনা পূরণ করতে পাড়ে আসে। কথাগুলো সবই বিশ্বাস করার মতো করে পরী আদিলকে বুঝিয়েছে। পরীর সঙ্গি হওয়ার সৌভাগ্য পেয়ে আদিল তাকে আপন করে নেয়। পরীকে সে একটা নাম দেয়, সাবরিনা। তখন সাবরিনা আদিলকে তার হাতের একটি ব্যান্ড নিয়ে পরিয়ে দেয়।
আদিলকে সাবরিনা জিজ্ঞেস করল, কেন সে ডায়েরিতে লিখছে। উত্তরে আদিল বলল, তার মনের কষ্টগুলো শেয়ার করার মতো কেউ নেই বলেই এতে লিখে। আরও বলল যে, এই ডায়েরিতে সবকিছু লিপিবদ্ধ করার তার প্রবল ইচ্ছা। সাবরিনা বলল, আজ থেকে তার কিছুই লিখতে হবে না। তার সব স্মৃতি স্বয়ং ডায়েরিই ছবি আর লিখিত আকারে লিপিবদ্ধ করবে। সাবরিনা চোখের ইশারায় ডায়েরিকে মায়াবী করে তুলল। এরপর থেকেই এতে আদিলের জীবনে ঘটে যাওয়া সবকিছুই লিপিবদ্ধ হতে থাকে। শুরু হয় তাদের প্রণয় কাহিনি। সাবরিনার প্রবল শক্তি। সে এই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে আদিলকে প্রতিটা খারাপ কিছু থেকে দূরে রাখত। আদিলকে নিয়ে সে রাতের বেলায় কেউ না দেখে মতো পিঠে ছড়িয়ে উড়তো। আদিলও তাকে দৃঢ়ভাবে ভালবেসে ফেলে। সাবরিনা আদিলকে নিয়ে এই পৃথিবীতে সংসার করার স্বপ্ন দেখতে থাকে। তারা ভালোবাসায় এতই ডুবে ছিল যে ডায়েরির কথা তাদের মনেই ছিল না। ডায়েরিতে তাদের প্রতিটি কথোপকথন লিপিবদ্ধ হতে থাকে। তারা বুঝতেই পারেনি একদিন এই ডায়েরিই তাদের নিয়তি পাল্টিয়ে দেবে।
একদিন আদিল সাবরিনাকে তার পরিবারের সামনে নিয়ে যায়। তাকে বিয়ে করার কথা বলে। সাবরিনার অতিরিক্ত রূপবতী হওয়ায় আদিলের ভাইদের মনে লালসা জন্মাতে থাকে। বিশেষ করে আদিলের মেজভাই পারভেজের কাছে। সাবরিনা এসব বুঝেও পরোয়া করল। পরবর্তী সময়ে আদিল ও সাবরিনার বিয়ে হয়। একদিন আদিলের অনুপস্থিতিতে পারভেজ সুযোগ পেয়ে যায় সাবরিনাকে কাছে পাওয়ার। সাবরিনা সে সময় স্নান করছিল। পারভেজ তাকে দেখে ফেলার আগেই সাবরিনা অদৃশ্য হয়ে যায়। কাউকে না দেখে পারভেজ কিঞ্চিত অবাক হয়। অথচ কল থেকে পানি পড়ছে। তার মনে ক্ষীণ সন্দেহ হতে থাকে। সে বাথরুম থেকে বেরিয়ে যায়, পর্দা ঢেকে দিয়ে। সাবরিনা আগের মতো করে গোসল করতে থাকে। পারভেজ ঘর থেকে বেরুনোর সময় এই ডায়েরিটি দেখতে পায়। সাবরিনার ভেবে ডায়েরিটি সে নিয়ে চলে গেল। আদিল এলে পারভেজের কথা সাবরিনা তাকে বলে দেয়। আদিল রাগে ফুঁসতে থাকে। সে অজ্ঞাত নয়, ভাইগুলো একটু খারাপ। কিন্তু এতটা খারাপ হবে যে তার ভাইয়ের বউয়ের দিকে নজর দেবে ছিঃ ছিঃ। আদিল ওখান থেকে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা আঁটে। অপরদিকে পারভেজ ডায়েরিতে যে কয়টা কথোপকথনের লেখা আবদ্ধ হয়েছিল, তা পড়ে বুঝে ফেলতে পারে, এটা কোনো সাধারণ ডায়েরি নয়। আর সাবরিনাও কোনো মানুষ নয়, পরী। সে লোভে আরও কিছু জানার উদ্দেশ্যে ডায়েরিটা পূর্বের জায়গায় রেখে এলো। এরই পর সাবরিনা আদিলকে নিয়ে লুকিয়ে এই জঙ্গলে চলে আসে, যাতে আর কেউ আদিলের জীবন নিয়ে খেলতে না পেরে। ডায়েরিটার কথা তাদের মনেই ছিল না। অথচ পারভেজের ডায়েরি হাতে লাগার ঘটনাও পরবর্তী সময়ে এখানে লিপিবদ্ধ হয়েছিল। তারা কেবল ডায়েরিটা সাথে করেই নিয়ে এসেছে। একরাশ আফসোস, তারা সময় থাকতে ডায়েরিটা খুলে দেখেনি।
সাবরিনা জঙ্গলের এই জায়গায় আদিলকে নিয়ে নিজ হাতে কোনোভাবে থাকার মতো করে টিন দিয়ে বাঁধলো। কারণ তাদের কোনো এক ভালো জায়গায় থাকার মতো অর্থ ছিল না। সাবরিনা চাইলেই তার শক্তি দিয়ে অসাধ্য বহুকিছুই করতে পারত কিন্তু আদিল তাকে করতে দিত না। আদিল কর্মঠ ছিল বটে। সাবরিনার শক্তির অপব্যবহার সে করত না। আর এই কারণেই সাবরিনা তাকে অধিক ভালোবাসতো। আদিল বলতো, প্রয়োজন হলে তুমি কোনো কাজ করো না, বসে থাকো। আমিই সব করে ফেলব। ধীরে ধীরে সাবরিনাও আদিলকে তার কাজে সাহায্য করতে থাকে। তারা একমাস এডজাস্ট করে থাকার পর আদিল কাজে যেতে শুরু করল। সে অর্থ উপার্জন করতে শুরু করলে বাড়ির এই সুন্দর কাঠের রুমগুলো বানাতে শুরু করে। তারা এই বাড়িটি মনের মতো করে সাজায়। এটি জঙ্গলের ভেতরে হওয়ায় শূন্যতায় ভরে ছিল। তাই সাবরিনা কিছু প্রাণীকে বড় বড় চিড়িয়াখানা থেকে গায়েব করে নিয়ে আসে। আদিল শুরুতে খানিকটা ঘাবড়ে যায়। সাবরিনা তাকে বলত, এদেরও মানুষের মতো প্রাণ আছে। এরা বরং মানুষ অপেক্ষা অধিকতর ভালো। আদিল তার কথা মেনে নেয়। এরপর থেকে প্রাণীগুলোও তাদের সাথে সময় কাটাতো। তাদের মাঝে এক মায়ার বাঁধন বেঁধে যায়। তাছাড়া এই বাড়িতে অলৌকিক অনেক কিছুই হতো। যেমন; আদিলের গরম লাগলে তাকে বাতাস দেওয়ার জন্য ওপরের কিছু হাতপাখা নিজ থেকে বাতাস করতো, সে কোনোদিকে বসতে চাইলে আপনা থেকেই চেয়ার, সোফা এসে যেত। সাবরিনা আর আদিলের ইশারায় সবকিছু স্বয়ংক্রিয় হয়ে উঠত। পরবর্তী সময়ে সাবরিনা আশেপাশের জায়গাগুলোকে নজরকাঁড়া সুন্দর করে সজ্জিত করল। মোট কথায়, সে তার ভালোবাসার জন্য তার সাধ্যের সবকিছুই করেছে। এভাবে অনেক স্মৃতি নিয়ে তাদের কয়েকটা বছর কেটে যায়। ডায়েরিতে অঙ্কিত আর লিখিত আকারে সবকিছু লিপিবদ্ধ হতে থাকে। তাদের একটি ফুটফুটে মেয়েও হয়। তাদের দু’জনের নামের সাথে মিলিয়ে তার নাম রাখা হয়, সাবিলা। সে একটি অর্ধমানব, অর্ধপরী সন্তান। তার মাঝে পরীদের মতো সবকিছু চোখ দেখে পড়ে ফেলার শক্তি, গায়েব হওয়ার শক্তি ইত্যাদি শক্তির জাগরণ হতে থাকে। সে তার মায়ের মতো অপরূপ সুন্দরী ও সাহসী। আর বাবার মতোই বুদ্ধিমান ও কর্মঠ হয়ে উঠে। তার মধ্যে সবই ছিল পরীর মতো শুভ ভাবনা। সাবিলা ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। জঙ্গলের প্রাণীগুলোর সাথেই সে খেলতে খেলতে বাড়তে থাকে। একদিন পারভেজ তাদের সন্ধান পেয়ে যায়। তারা প্রায়ই সাবরিনার তৈরি কুয়ার ধারে সময় কাটাত বিধায় তাদের অজান্তে পারভেজ ডায়েরিটা আলমারি থেকে চুরি করে ফেলে। সে এক তান্ত্রিকের সহায়তায় ডায়েরির শর্ত থেকে ক্ষণিকের জন্য বেঁচে যায়। ডায়রিটি সে সম্পূর্ণ পড়ে ফেলে। তবে তান্ত্রিক বলে রাখল, সে এই শর্ত থেকে বেশ কিছুদিনই মুক্ত থাকতে পারবে, এর বেশি নয়। পারভেজ ভাবল, সে একবার পরীকে পেয়ে গেলে তার শক্তি নিয়ে শর্ত থেকে বেঁচে যাবে। তার শক্তি দিয়ে অবিনশ্বর হয়ে উঠবে। পৃথিবীর সব থেকে শক্তিশালী ধনাঢ্য এক ব্যক্তি হবে, যার নিয়ন্ত্রণে থাকবে একটি পরী।
পারভেজ আগের মতোই অতি সাবধানতার সাথে ডায়েরিটি আলমারিতে রেখে আসে। সাবরিনা কিছুদিন পর নিরাপত্তার কথা ভেবে দেয়ালে একটি দরজা তৈরি করে ডায়েরি ভেতরে রেখে দেয়। তার ব্যান্ড থেকে পাতলা করে সুতা নিয়ে তাবিজের আকারে বানিয়ে সে দরজাটায় আটকে রেখে উপর থেকে তাদের ছবি দিয়ে গোপন দরজাটি ঢেকে দেয়।
সাবিলা সেসময় আট বছরে পড়েছিল। তখন পরী জগতের সর্দার সাবরিনার ভবিষ্যতের ঘটনা আঁচ করে ঘাবড়ে যান। তিনি সাবরিনাকে পরী জগতে ফিরে যাওয়ার ইঙ্গিত করতে থাকেন। কিন্তু সাবরিনা তার অতি প্রিয় দুটো মানুষকে ফেলে যেতে মোটেও রাজি ছিল না। সে সর্দারকে অনুনয় করে, তাদের জগতে আদিল আর সাবিলাকে গ্রহণ করে নিলে সে চলে যাবে। সর্দার তার নিরাপত্তার জন্য রাজি হয়ে যায়, কিন্তু তাদের জগতে মানুষেরা বাস করতে পারবে না। তিনি সাবরিনাকে দেখা করতে বললেন। সর্দার তাকে ভিন্ন এক জায়গায় রাখার ব্যবস্থা করে দেবেন। সাবরিনা ভাবে পরদিনই সে পরী জগতের জন্য আকাশ পথে বেরিয়ে পড়বে এবং সর্দারকে এনে বিপদের মোকাবেলা করবে। সাবরিনার কাছে সে রাতে ডায়েরিটির কথা মনে পড়তেই তার পড়ার ইচ্ছা জাগল। আবার সর্দার কোন বিপদের কথা ইঙ্গিত করেছে এই চিন্তায় পড়ে ডায়েরিটি না খুলেই ব্যাগে রেখে সবকিছু গুছিয়ে নেয়। কিন্তু রাতটা ছিল অভিশপ্ত কালরাত।
বৃষ্টি পড়ছিল। তারা ঘুমিয়ে পড়ার পর হঠাৎ আদিল দরজায় টকটক আওয়াজ শুনতে পায়। সাবিলা আর সাবরিনাকে রেখে সে দরজা খুলতে যায়। দরজা খুললে দেখে, তার সামনে তিনজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। সামনের জনের মুখে রুমাল বাঁধা। আদিল কিছু জিজ্ঞেস করতে যাওয়ার সময় তাকে তারা মুখ চেপে ধরে নিয়ে পাশের খালি রুমে বেঁধে রেখে দরজা বন্ধ করে দেয়। অন্যদিকে সাবরিনা ঘুম থেকে উঠে আদিলকে ফিরে আসতে না দেখে চারিদিক খুঁজতে খুঁজতে বাসা থেকে বেরুয়। সে জানত না, আদিল প্রথম রুমেই ছিল। আদিল জানালা দিয়ে সাবরিনাকে দেখল। কিন্তু মুখ বাঁধা থাকার কারণে কিছুই বলতে পারেনি। সাবরিনা চিন্তায় পড়ে গিয়ে আদিলকে খুঁজতে উড়ার জন্য ডানা মেলল। ঠিক তখনই সাবরিনার পেছন থেকে মুখোশধারী ব্যক্তির দুই সঙ্গি তার ডানার অগ্রভাগের সন্ধিতে একটি খঞ্জর দিয়ে পোঁচ দেয়। মুহূর্তেই ডানা আর পরী আলাদা হয়ে পড়ে। বৃষ্টির পানি সাবরিনার রক্তে রঙিন হয়ে যায়। সে ডানা কাটার যন্ত্রণায় অশ্রুবিহীন কাঁদতে থাকে। ডানাগুলো মালিকের কাছ থেকে আলাদা হয়ে কিছুক্ষণ মাটিতে ঝাঁপটা-ঝাঁপটি করল। সাবরিনাকে আর ডানাকে তারা দু’জন নিয়ে জঙ্গলের দিকে চলে যায়।
এইদিকে মুখোশধারী ব্যক্তি আদিলের জন্য একটা গর্ত করে। তাকেও কুপিয়ে হত্যা করে সে গর্তে ফেলে দেয়। আদিলের শেষ নিশ্বাস ত্যাগের পূর্বে এক দমকা হাওয়া বয়ে যায়। সেই হাওয়ায় মুখোশধারী চোখ বন্ধ করে ফেলল। এই সময় আদিলের আর সাবরিনার বামহাতের ব্যান্ডগুলো সাবরিনার ইশারায় হাওয়ায় ভেসে তাদের রুমের জানালায় এসে পড়ল। সাবরিনার শক্তি কিছু কিছু কাজ করছিল বিধায় সে বহু কষ্টে তার শরীরের রক্তগুলো দিয়ে চোখের ইশারায় তাদের রুমের দেয়ালে কিছু লেখা লিখে রাখে। একটু পর সাবরিনাকে রক্তাক্ত অবস্থায় নিয়ে যেতে একটি ভদ্রলোক দেখে ফেলল। সে পথ হারিয়ে ফেলেছিল। লোকটি যেই মানুষ ডাকতে শুরু করল, সেলিম ক্ষেপে গিয়ে তাকে খঞ্জর দিয়ে খুন করে। অপরজন তার লাশ একটি গর্তে ফেলে দিয়ে আসে। পরী কিছুই করতে পারল না। কারণ সে তখন নিস্তেজ ছিল। আদিলের শেষ নিশ্বাস ত্যাগের সময় সাবরিনা জোরে এক আর্তনাদ করল। তার চিৎকারে জঙ্গলের সব গাছপালা একটির সাথে অন্যটি ধাক্কা খেয়ে ওই দমকা হাওয়ার সৃষ্টি করল। এতে সাবিলার ঘুম ভেঙ্গে যায় জানালা খুলে যাওয়ার আওয়াজে। তখন একদিকে আদিলকে গর্তে মাটি চাপা দেওয়া হলে খুনি রুমটিতে তালা লাগিয়ে বেরিয়ে পড়ে। অন্যদিকে সাবিলা দেয়ালের লেখাগুলো পড়ে ব্যাগ গুছিয়ে নেয়। ব্যান্ডগুলো হাতে পরে সে কেউ না দেখে মতো চুপটি করে বেরিয়ে জঙ্গলের আঁধারে মিলিয়ে যায়।
ডায়েরির শর্তের ভয়ানক রূপ এগিয়ে আসে। ঘটনাটার পরদিন সেলিমদের সাথে দেখা করার আগেই পারভেজ বোবা আর পঙ্গু হয়ে যায়।
আদিল ছিল এক পরীর ভালোবাসা। তাই তার মৃত শরীর কখনওই পচবে না, সতেজ থাকবে বরং সুগন্ধ বেরুবে। এটি সাবরিনার গন্ধ। পরে আদিলের অতৃপ্ত আত্মা জাগরিত হয়ে যায়। প্রতিশোধের জন্য সে ফুঁসতে থাকে। কিন্তু সে বাড়ি থেকে বেরুতে পারত না। কারণ সে সাবরিনাকে আজীবন এই বাড়িতেই থাকার কথা দিয়েছিল। পরীদের অনেক প্রার্থনার মধ্যে একটি সত্যতা পেয়ে যায়। তার একটি ছিল, সাবিলার জীবনসঙ্গিও যেন আদিলের অনুরূপ হয়। পরী জানত না, তার এই প্রার্থনা অনেক আগেই ফলিয়ে গেছে, আদিলের বহুরূপী পৃথিবীতে সাবিলার ভালোবাসা হয়ে এসে। সাবিলা সেই রাত ছুটতে ছুটতে অনেক দূরে চলে এলো। দুটো ব্যান্ডই তার কাছে থাকায় পরীর হ্রদস্পন্দন এই ডায়েরিতে আর পৌঁছায়নি। তাই পরী এখন কোথায় ডায়েরিটিও জানে না।
এরপর থেকে ডায়েরিতে সাবিলার মনোভাবনা বর্ণিত হতে থাকে। তাকে তার নিয়তি এক দরবেশের নিকট এনে দেয়। সে দরবেশকে সবকিছু জানাল। এর কিছুদিন পর দরবেশ মরে যাওয়ার উপক্রম হলে, তিনি সাবিলাকে আরেক বিশ্বাসীর হাতে সঁপে দেন। কিন্তু তাঁর পরিবার বড্ড খারাপ ছিল। সাবিলাকে তারা মোটেও পছন্দ করে না। আদিলের জীবন যেমনটি বিষধর ছিল, সাবিলার ক্ষেত্রেও এরূপ ঘটে। সাবিলা সেই পরিবারে বেড়ে উঠতে থাকে। নিয়তির ইশারায় সে চলতে থাকে। আঠারো বছরে পড়তেই সাবিলা আকবর আঙ্কেলের মাধ্যমে নিজ বাড়িতে ফিরে আসে। প্রথমদিন সে তার বাবা মায়ের রুমে থেকেছিল। এই রুমের স্মৃতি তাকে কাঁদিয়ে তুলেছিল। এমন সময় তার সামনে আদিলের আত্মা এসে উপস্থিত হয়। বাবা আর মেয়ে একে অপরকে দেখে আহ্লাদে জড়িয়ে ধরল। আদিল ডায়েরিটি সাবিলাকে বের করতে বলে। সাবিলা তা বের করলে আদিলসহ তাদের স্মৃতিগুলো দেখে দেখে সাবরিনার শোকে দুইজন ব্যথিত হলো। সাবিলা শপথ নেয় তার বাবার আত্মাকে শান্তি দেওয়ার এবং তার মাকে ফিরিয়ে আনার, আর সেই মুখোশধারী এবং তার সঙ্গিদের শাস্তি দেওয়ার।
এরপর সাবিলার জীবনে তার জন্য তৈরি তার জীবনসঙ্গী এলো। সাবিলা তাকে দূর থেকে অনেকক্ষণ মন ভরে দেখে তার প্রেমে পড়ে যায়। কারণ ছেলেটি ছিল তার বাবার মতো স্বচ্ছ মনের এবং সুদর্শন এক ব্যক্তি। সে নিজেকে থামাতে না পেরে নাস্তার অজুহাত করে ছেলেটির নিকট যায়। সাবরিনা প্রথম যেভাবে আদিলের কাঁধে হাত রেখেছিল, সাবিলাও ঠিক সেভাবে ছেলেটির কাঁদে হাত রাখল। ছেলেটি আর কেউ নয়, আমিই ছিলাম। এরপর আমাদের প্রণয়কাহিনি শুরু হয়। আমি যে উদ্দেশ্যে আকবর আঙ্কেলের বাসায় গিয়েছিলাম, সে উদ্দেশ্যটিকে ঘিরে তার সত্যও জড়িয়ে ছিল। তাই সে আমাকে পথ দেখাতে থাকে। সে আকবর আঙ্কেলের মৃত্যুর রাতের কথা আমাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলল, যাতে আমি আসল সত্যে পৌঁছতে পারি।
সেই রাত পার্টির পর সাবিলা আকবর আঙ্কেলকে না দেখে চিন্তিত হয়ে পড়ল। সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর বাইরে সে অদৃশ্য হয়ে পায়চারী করতে থাকে। সজীব আশেপাশে কাউকে না দেখে দৌড়ে বাসায় ঢুকল। সাবিলা তার মনের কথা পড়ার সুযোগ পেল না। গণ্ডগোল কিছু একটা হয়েছে ভেবে সে সারারাত তার বাবা সমতুল্য আকবর আঙ্কেলের অপেক্ষা করতে থাকে। সারারাত কেটে যাওয়ার পর সকালে তাঁর লাশ নিয়ে আসা হয়। সাবিলা তা দেখে ভেঙ্গে পড়ল। হঠাৎ তার মনে হলো কেউ একজন সজোরে চিৎকার করছে। সাবিলার মধ্যে অদ্ভুত শক্তি আছে বিধায় সে ছাড়া কেউই শুনেনি। সে চাকরানির শরীরে প্রবেশ করে স্টোর রুমের দরজা খুলে দেয়। বেরিয়ে আসে রবিন। তার মন পড়ে সে বুঝে ফেলে গতরাত সে রুমটায় বন্দি ছিল। সাবিলা আমাকে যতটুকু বলার দরকার ভেবেছে ততটুকুই বলেছে। বাকিটা সে জানত খুনটা কে করেছে। সে আমার মাধ্যমে তার বাবার এক খুনি লতিফের কাছে পৌঁছল। সেদিন ট্রাকটা সাবিলা তার ইশারায় এনেছিল লতিফ না বাঁচার জন্য। সে তার বাবার খুনিদের কেবল দু’জনকে চিনত। অন্যজনকে তার বাবাও দেখেনি মুখোশ পরে থাকায়। আমাদের বিয়ে হওয়ার পর আমাকে সে সবকিছু বলতে চেয়েছিল। কিন্তু বলার সুযোগ আমিই দিইনি। আমার স্বপ্নে আমি প্রথমে মেজ ভাইয়াকে দেখেছিলাম, সে মুখোশ পরে নেওয়ার সময় তার চেহারা এক বয়স্ক লোকের মতো দেখিয়েছিল। পরে আমি খবরের কাগজ থেকে ওই ব্যক্তিকে পারভেজ হিসেবে শনাক্ত করেছিলাম। তবে সাবিলা আমার স্বপ্নে মেজ ভাইয়াকে দেখার কথাটি বলার সাথে সাথেই বুঝে গিয়েছিল মুখোশের পেছনে আদিলের সৎভাই পারভেজের থাকার কথা। সাবিলা মুখোশধারীর কথা জানতে পেরে আর দেরি করেনি। তার বাবার লাশ আমাদের মাধ্যমে রুম থেকে বের করিয়ে এনে দাফন করাল, যাতে করে সে তার বাবার শরীরে প্রবেশ করে পারভেজকে মৃত্যু দিতে পারে। তার বাবার আত্মা বাড়িটি থেকে যে বেরুতে পারে না! তাই সে নিজেই তার বাবার খুনিকে শাস্তি দেওয়ার কথা ভাবে।
এরপর এতোদিন দুটো ব্যান্ড আমার কাছে থাকায় ডায়েরি কেবল আমার মনের কথাই লিপিবদ্ধ করেছে। সাবিলার হ্রদস্পন্দন ডায়েরিতে পৌঁছায় না বিধায় ডায়েরিতে নেই সে এখন কোথায়।
এতক্ষণ আমাদের ডায়েরি পড়ার কথাও তৎক্ষণাৎ ছবিসহ তাতে লিপিবদ্ধ হলো। সত্যিই ডায়েরিটি মায়াবী। আজ সাবিলা ন্যায়ের পথে লড়ছে তা ডায়েরি থেকেই জানতে পারলাম। মেয়েটি এতদিন তার মনে কতই না দুঃখ নিয়ে ছিল। তার ন্যায় সাহসী এক মেয়েকে পেয়ে আমি ধন্য। ডায়েরি থেকে জানতে পেলাম, সাবরিনা আদিলকে সবকিছু বলেছিল। এমনকি তার শক্তিকে কীভাবে আরেকজন ব্যবহার করতে পারবে, সে অদৃশ্য থাকলে কীভাবে অন্যজন তাকে দৃশ্যমান করতে পারবে তা সবই। তবে তা আমরা ভালোভাবে পড়িনি। এসব কথা ডায়েরিতে শেষের দিকেই বর্ণিত। তাই পারভেজেরও পড়া হয়নি।
(চলবে..)
লেখা: ফারিয়া কাউছার
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।
গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা
◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।
আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share