পরী পর্ব ১০..

0
1059

পরী পর্ব ১০..

‘যেমন কর্ম তেমন ফল।’ ভাইয়া বলল, ‘সে আর তার সঙ্গী কতজনের উপরই না অত্যাচার করেছে! সে এরই শাস্তি পেয়েছে। যাক, এতদিনে গিয়ে কেসটা সলভ হলো।’
‘না, কেবল জাকির স্যারের দেওয়া কাজটা সম্পন্ন হয়েছে। আরও দুটো খুনি এখনও উন্মুক্ত ঘুরছে। তারা না জানি আর কতজনকে খুন করেছে। তাদেরও শাস্তি পেতে হবে। যদিও বা এটা কেসের আওতায় পড়ে না, তবু আমি তাদের শাস্তি দিতে চাই।’
‘আমিও তোর সাথে আছি। কিন্তু তুই কীভাবে জেনেছিস যে, লতিফের সাথে আকবর সাহেবের আপা এসবে মিলে আছে?’
‘আজাদ আঙ্কেল বলেছিলেন, তাঁদের দ্বিতীয়বার যখন লতিফের সাথে দেখা হয়, তখন তাঁদের আপাকে নিয়ে ডাক্তার কাছে গিয়েছিলেন। লতিফ তাঁদেরকে তার বাসায় নিয়ে যায়। তার মানে তাঁদের মাঝে সেদিন যেসব কথা হয়, তা কিছুটা তাঁদের আপাও জানেন। আর আজকে আমরা যখন আজাদ সাহেবের সাথে কথা বলছিলাম, তখন কেউ একজন দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে কানপেতে আমাদের সব কথা শুনছিল। আমাদের এখানে আসার কথা লতিফকে তিনি ছাড়া আর কেউ নেই জানানোর মতো নেই। আর আমি আগে থেকেই পরিকল্পনা এঁটে রেখেছিলাম, লতিফের পাপ স্বীকার করানোর জন্য ডায়েরির লোভ দেখিয়ে সত্য উগলাবো। প্ল্যান কাজ করেছে। কিন্তু জানতাম না, লতিফের ক্ষমতার কথা। আন্দাজ করিনি সে সিকিউরিটি প্রটেক্টেড থাকতো।’
‘এখন আমরা বাকি খুনিদের কোথায় পাব?’
‘লাগছে ওই বাড়িটির সাথে সবার কোনো না কোনো সম্পর্ক আছে।’
‘আমি ভাবতাম জঙ্গলটা আর বাড়িটা অনেক অদ্ভুত। কিন্তু এর পেছনে এতগুলো কাহিনি আছে তা আগে ধারণাই করিনি। আর যে কঙ্কালটা আমাদের মারতে চেয়েছিল, আমার মনে হচ্ছে ওটা সেরাতে সেলিমের হাতে খুন হওয়া লোকটির ছিল। বেচারা পরীকে বাঁচানোর জন্য মানুষ ডাকতে গিয়ে মারা পড়ল।’
‘ওসব খুনিকে আমি শাস্তি দেবই।’
আমরা আজাদ আঙ্কেলের বাসায় চলে এলাম। সারা পথ সাবিলার সাথে একটুও কথা বলিনি। কীভাবেই বা কথা বলি? আজ যদি ওর কিছু হয়ে যেত? আমি যদি ওকে না নিতাম, তবে লতিফ ওকে ধরারও সুযোগ পেত না। ভাইয়া অনেক আগেই জাকির স্যারকে খুনির কথা বলে দিয়েছে। তিনি আজাদ আঙ্কেলের বাসায় চলে এসেছেন। আমরা তাঁর সাথে হ্যান্ডশ্যাক করলাম। ভাইয়াকে আর আমাকে তিনি অনেক সাবাসি দিলেন, তাঁর বন্ধুর আসল কালপ্রিটকে ধরতে পারার জন্য। সবশেষে আমরা আবার জঙ্গলের বাড়িতে ফিরে এলাম।
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।

গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা

◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।

আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share

বাড়িতে আসার কিছুক্ষণ পর আমি সবাইকে নিয়ে কুয়োর ধারে যাই সময় কাটানোর জন্য। ভাইয়া আর ভাবী, সজীব আর নাঈমা, একে অপরের সাথে বসেছে। আর আমি এক কোণায় গাছের সাথে হেলান দিয়ে একা দাঁড়িয়ে। ভাবান্তে আমার পাশে সাবিলা এসে দাঁড়াল। সে বলল, ‘কী হলো? মন খারাপ কেন? আজকে তোমরা এতো বড় একটা মিশন কমপ্লিট করলে। তোমার তো খুশি হওয়ার কথা ! এখন তো তোমরা এই বাড়িটি ছেড়ে চলে যাবে। আর হয়তো এখানে আসবে না। আমি এই বাড়িটিসহ তোমাদেরকে অনেক মিস করব। কী হলো? কিছু বলছ না কেন?’
‘আজকে আমি যদি তোমাকে সাথে নিয়ে না যেতাম, তবে লতিফ তোমাকে মারতে চেষ্টা করতো না।’
‘এসবে তো তোমার কোনো দোষ নেই। আসলে তোমার সাথে সময় কাটাতে আমার অনেক ভালো লাগে বলে গিয়েছিলাম।’
‘সত্যি?’
‘হুঁ’
সাবিলা নিশ্চুপ হয়ে আমার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল, যেন সে মনোযোগ সহকারে আমার চোখের ভাষা পড়ছে। পরক্ষণে তার চোখের কোণে জল দেখলাম। সে বলল, ‘আমার জন্য এতো চিন্তা তোমার? এতোটা ভালবাসো? আমি আজ পর্যন্ত কাউকে আমার জন্য এতটুকু ভাবতে দেখিনি।’
সে আমার মনের কথা জানায় ভ্যাবাচ্যাকায় পড়ে গেলাম। হয়তো আমার চোখের নমনীয়তা দেখেই জেনেছে। কী বলব কিছুই বুঝতে পারছি না। ভাইয়া এসে কানের পাশে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘আবির, বলে ফেল তোর মনের কথা।’
আমার জবাবের প্রত্যাশায় সাবিলা এখনও আমার দিকে চেয়ে আছে। বাকিরাও ইতোমধ্যে আমাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সাহস জুগিয়ে চোখ বন্ধ করে গড়গড় করে বলেই ফেললাম, ‘হ্যাঁ সাবিলা, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। সারাজীবন তোমাকে আমার পাশে রাখতে চাই।’
তালির আওয়াজে চোখ খুললাম। সাবিলা হাসছে। যাইহোক, আমি বলে দেখাতে পেরেছি! সাবিলা নির্বাক। তার বামহাতের একটি তাবিজ খুলে সে আমার বামহাতে পরিয়ে বলল, ‘বাবা বলেছিলেন, যে আমার অসহায় মুখ দেখেও আমায় আপন করে নেবে তাকেই যেন এখানের একটি দিই। আজ তোমায় দিলাম। কারণ আমার মতো অনাথাকে বাবা যাওয়ার পর থেকে কেউ একটুও মায়ার দৃষ্টিতে দেখেনি, তুমি ব্যতীত। তোমাকেই জীবনসঙ্গী করতে চাই।’
পাশ থেকে ভাইয়া শিষ বাজিয়ে উঠল। আর ভাবী বলল, ‘চল আবির, কাজি অফিসে চল। আজ তোর বিয়ে দেখব। এভাবে বিয়ে করার মজাই হয়তো আলাদা।’
বলাই হয়নি। নাদিয়া অনেকটা চঞ্চল। সে সবসময় উদ্ভট সব কাজই করতে চায়। সবাই ওকে সমর্থন করে আমাদের সিদ্ধান্ত না নিয়েই আনন্দে মেতে উঠে বেরিয়ে পড়ল। আমরাও বাধ্য হয়ে তাদের সাথে গেলাম। মা’কে ভাইয়া ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে। প্রথমে সাবিলার বাড়ি গিয়ে তার বাবার সাথে দেখা করে তাঁকে সাথে করে নিয়ে কাজি অফিসে গেলাম। অবশেষে ভাইয়া, ভাবী এবং সাবিলার বাবাকে সাক্ষী রেখে বিয়েটা করেই ফেললাম। বিয়ের পর সাবিলা আমাকে কী যেন বলতে চেয়েছিল। আমি তাকে বলতে না দিয়ে বাসায় চলে এলাম। মা-বাবা কালই এখানে আসবে আমাদের আশীর্বাদ করতে।
সারাদিনের দখল শেষে বাসায় এসে সবাই সোফায় বসে পড়লাম। এখানে আসার পর কী কী হয়েছে তা সবই ভাইয়া বাকিদের বলছে। বামহাতের তাবিজটির ওপর আমার নজর পড়ল। এটি স্বপ্নের মধ্যে আমার হাত থেকে উড়ে যাওয়া তাবিজটির মতোই। আশেপাশে আবার সেই পরিচিত সুগন্ধ ছড়িয়েছে। সোফায় ভাইয়ার পাশে নিচু হয়ে আছে। আত্মাটি এসে বসেছে। আমি সবার উদ্দেশ্যে বললাম, ‘আমাদের কাজ এখনও শেষ হয়নি। লতিফ তো মারা গেছে। বাকি দুটো খুনি এখনও উন্মুক্ত। ওদের শাস্তি পেতেই হবে। আর পরীকেও আমাদের মুক্ত করতে হবে। সেলিম আর পারভেজকে তো আমি চিনিই। কেবল ওদের কাছে পৌঁছার দেরি।’
সাবিলা আর ভাইয়া আমার দিকে বজ্রনয়নে দৃষ্টিপাত করল। ভাইয়া বলে উঠল, ‘তুই ওদের আবার কোথায় দেখেছিস?’
আমি এক রহস্যময় হাসি হাসলাম। তারপর তাদেরকে আমার কালকের রাতের স্বপ্নের বিবরণ দিই। এবং বললাম, ‘স্বপ্নটা যে সত্য ছিল তার প্রমাণ আজকে লতিফকে দেখার পর আমি স্বচক্ষে পেয়েছি। সেই হিসেবে লতিফের সাথে মিলে যে ছেলেটি পরীকে নিয়ে গিয়েছিল, সেই হয়তো সেলিম। আর মুখোশ পরিহিত ব্যক্তিটিই হয়তো পারভেজ, তাদের লিডার। এখন সে বোবা ও পঙ্গু হয়ে আছে।’
সাবিলার চোখ তীক্ষ্ণ হয়ে গিয়েছে। সে সোফার দিকে তাকিয়ে হঠাৎই দৌড়ে বাসায় ঢুকতেই যে তালাবন্ধ রুমটি আছে, তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সেই সাথে আমরাও ছুটে গেলাম। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সাবিলা বলল, ‘আবির, স্বপ্নে তোমাকে কি এই রুমটিতেই বেঁধে রাখা হয়েছিল?’
‘হ্যাঁ।’
‘তাহলে এই দরজাটি খুলো। এখানে কিছু না কিছু পেয়েই যাবে।’
‘কথাটা তো ঠিক।’
‘কিন্তু এখানে আমাকে গতবার..’, ভাইয়া বলতে গিয়ে সহসা থেমে গেল।
আমার মনে পড়ল, একদা আমাকে আত্মাটি বলেছিল, আমি তোমাদের কিছুই করব না। মনে পড়ার পর আমি তালাটা ভাঙতে লাগলাম। ভাইয়া বলে উঠল, ‘আবির, কী করছিস? এটা খুলিস না।’
ভাইয়ার নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও আমি তালাটা ভেঙে ঢুকে পড়লাম। বাকিরাও ঢুকল। ভাইয়া ঠিকই বলেছিল, এই রুমে কিছু বালির বস্তা, ইট-কাঠ ছাড়া আর কিছুই নেই। আমি সবাইকে রুমের চারিদিকে তালাশ করতে বলে চারিদিকে তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগলাম। কেউ কিছু পেল না। রুমটি দেখে লাগছে বাড়ি তৈরির সময় যা অবশিষ্ট রয়ে গিয়েছিল, তাই এখানে রেখেছে। একসময় সবাই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়লাম। ভাইয়া বলল, ‘আবির, এই রুমটিতে তো কিছুই নেই। তবে এটাতে তালা কেন লাগানো হলো?’
‘তাই তো বুঝছি না।’
আমার নজর মেঝেতে পড়ল, যেখানে আমাকে স্বপ্নে পুতে ফেলা হয়েছিল। চোখ যেন ওইদিকেই দাউদাউ করছে। ভাইয়া আর সজীবকে উদ্দেশ্য করে বললাম, ‘এই জায়গাটি আমাদের খোঁড়া উচিত।’
সবাই আমার দিকে হা করে চেয়ে রইল। তাদের কিছু না বলে পাশ থেকে শাবল নিয়ে আমি কাজে লেগে পড়লাম। পরে সজীব এবং ভাইয়াও হাত লাগাল। বেশ কিছুক্ষণ মাটি তোলার পর একটি ছেলের ঘড়ি পেলাম। এটি অনেক পুরাতন ডিজাইনের। আমি স্পষ্ট বুঝেছি, এটি কার ঘড়ি। আমার উত্তেজনা প্রবলভাবে বাড়তে লাগল। আরও কিছুক্ষণ মাটি কাটার পর কাপড় সদৃশ কিছু একটা দেখে উত্তেজিত হয়ে তাড়াতাড়ি শাবল রেখে আমরা হাত দিয়ে মাটি কাটা শুরু করলাম। একটু পর বেরিয়ে এলো একটি লাশ। তার পেটে একটি খঞ্জর গাঁথানো। আতঙ্কিত হয়ে আমরা সাথে সাথে পিছিয়ে গেলাম। নাদিয়া আর নাঈমা চিৎকার করে উঠল। আর সাবিলার মুখে প্রতিবারের ন্যায় কোনো প্রতিক্রিয়াই নেই। ভয় নামের কিছু নেই মেয়েটির কাছে।
স্বপ্নের মতো হুবহু এমন হবে তা কল্পণাই করিনি। লাশের সারা গায়ে মাটি লেগে আছে। চেনা যাচ্ছে না লাশকে। আমরা ওটাকে বাইরে নিয়ে গেলাম। সজীব গর্তটা ভরিয়ে দিয়ে এলো। নলকূপ থেকে সাবিলা কিছু পানি নিয়ে এলে আমরা লাশটা ধুতে লাগলাম। বিস্ময়ের ব্যাপার, লাশ থেকে সেই পরিচিত সুগন্ধ বেরুচ্ছে। পাশ থেকে ভাইয়া বলে উঠল, ‘আশ্চর্য! এই বাড়িতে একটি লাশ আছে বলে ধারণাই করিনি। আর আমরা এতদিন যাবৎ এখানে যে থেকেছি, লাশটা তো পচে যাওয়ার কথা!’
‘ঠিক বলেছিস। আর সবই আমার স্বপ্নের অনুরূপই ঘটেছে। সেই পরীর ঘটনা, সেই খুনি, সেই খঞ্জর। খঞ্জরটাও হুবহু দেখেছি স্বপ্নে।’ বলে আমি লাশের মুখ ধুতে লাগলাম।
ধোয়ার সময় লাশের চেহারা খেয়াল করতেই আতংক জড়িত কণ্ঠে চিৎকার দিয়ে উঠলাম। নিজেকে সামলাতে না পেরে আমি মাটিতে এসে পড়ে যাই। বাকিরা আমাকে টেনে তুলল। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতে লাগল। আমার বিস্ময় এখনও কাটছে না, লাশের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম। বিস্মিত অবস্থায় লাশের মুখের দিকে তাকাতে সবাইকে ইশারা করলাম। সবাই ওদিকে তাকাতেই ভয়ে গুঙিয়ে উঠল। একটু পর সবার মাঝ থেকে সজীব ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে লাশের পাশে দাঁড়াল।
সজীবের কণ্ঠে বিস্ময় স্পষ্ট, ‘এ যে সম্পূর্ণই আবিরের ডুপ্লিকেট!’
আমি এখনও আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। বাকিরা কিছুক্ষণ লাশকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে, আর কিছুক্ষণ আমাকে। তাদেরও যেন বিস্ময় কাটছে না। লাশের চেহারা যে হুবহু আমার মতো!
আমরা ছেলেরা বিলম্ব না করে জঙ্গলের বাইরের মসজিদে গিয়ে জানাজা পড়িয়ে লাশটিকে মসজিদের পাশের কবরস্থানে দাফন করিয়ে এলাম।
(চলবে…)
লেখা: ফারিয়া কাউছার