পরিশিষ্ট পর্ব-১৪

0
1289

#গল্পের_নাম: পরিশিষ্ট
#লেখিকা: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_১৪

রোদ্দুর এক পলক উথাল পাথাল করে দেয়া বিস্তর ক্ষমতার মানুষটির দিকে চেয়ে বলে,

—“হাত ধরেছিস মানলাম।এরপর যেন কোলে উঠতে চাইবি না।তা কিন্তু মেনে নিবো না।আগেই বলে রাখলাম।”

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রোদ্দুরের হাতে টান পড়ল।হালকা ঘুরে চেয়ে দেখে অহি আবার নিচে বসে পড়েছে।অবাক হয়ে বলল,

—“আবার বসে পড়লি কেন অজান্তা?আজ কি বাসায় ফেরার ইচ্ছে নেই?”

—“আছে রোদ্দুর ভাই।বাসায় গিয়ে টানা সতেরো ঘন্টা ঘুম দিবো।”

—“তো?হাঁটছিস না কেন?তাড়াতাড়ি উঠ।”

—“আমি আর হাঁটবে পারবো না রোদ্দুর ভাই।আমায় কোলে করে নিয়ে চলুন।”

—“কি সাংঘাতিক!এই ছিলো তোর মনে?”

অতঃপর বিস্ফারিত নয়নে চারপাশে পরখ করলো রোদ্দুর।সন্ধ্যার পর এখানে আরো মানুষের ঢল নেমেছে।জোড়া, জোড়া ছাড়া! সব ধরনের মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে।এত মানুষের সামনে অহিকে কোলে নেওয়া জাস্ট ইম্পসিবল!

সে অহির দিকে চেয়ে অনুরোধের কন্ঠে বলল,

—“অজান্তা লিসেন!এটা বিদেশ নয়,বাংলাদেশ!এত মানুষের মধ্যে তোকে কোলে নিয়ে যাওয়া কেমন দৃষ্টিকটু দেখায়।তুই আর একটু কষ্ট কর।দশ মিনিটের মতো গেলে রিকশা পাব।”

অহি চিন্তিত গলায় বললো,

—“তাই তো!তাহলে রোদ্দুর ভাই, আপনি কথা দিন যে বাসার সামনে গিয়ে মূল ফটক থেকে সদর দরজা পর্যন্ত কোলে করে নিয়ে যাবেন?”

রোদ্দুর হেসে ফেলল।অন্ধকার ছাপিয়ে সে হাসির সুর চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে।অহি কান পেতে শোনে।যেন এই পরিবেশে হাসিটা একদম উপজীব্য!

রোদ্দুর হাসি থামিয়ে বলে,

—“তোর হঠাৎ এত কোলে উঠার শখ জাগলো কেন?”

—“আপনি মনে করিয়ে দিলেন তাই!”

—“এতো দেখছি নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনলাম।আচ্ছা এখন হাঁট!কোলে নিবো তখন!”

বলে রোদ্দুর অহির হাতে টান দিল।কিন্তু অহি তারপরও উঠলো না।সে মন খারাপ করে নিচের দিকে চেয়ে আছে।রোদ্দুর চারপাশ এক নজর দেখে চট করে মাথা নিচু করে অহির ডান গালে গভীর এক চুমু বসিয়ে দেয়!তারপর অহির হাত ছেড়ে হেঁটে সামনে এগিয়ে যায়।

অহির সর্বত্র মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ে।দ্রুত উঠে দৌঁড়ে রোদ্দুরের সমানে সমানে হাঁটতে থাকে!

——————-

বাসার কাছে রিকশা থামতে রোদ্দুর অহির থেকে হাত ছাড়িয়ে নেমে পড়ে।ওয়ালেট বের করে ভাড়া দেয়।রিকশা উল্টো ঘুরে চলে যেতে সে অহিকে বল,

—“চল!বাসার সবাই আজ অনেক বকা দিবে রে!অনেক রাত হয়ে গেছে।”

—“কই রাত হয়েছে?”

রোদ্দুর উত্তর না দিয়ে হাঁটা ধরে।বেশিদূর আগাতে পারে না।অহি তার হাত টেনে ধরে।এদিকটা অন্ধকার!অন্ধকারে রোদ্দুর বিস্মিত চোখে অহির দিকে তাকায়।অহির মুখ স্পষ্ট নয়!তাকে অনেকটা ছায়া মানবীর মতো লাগছে!তাকে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে!গভীর ছোঁয়া!

রোদ্দুর ঢোক গিলে বলে,

—“দাঁ-দাঁড়িয়ে পড়লি কেন অজান্তা?”

অহি উত্তর না দিয়ে দু পা এগিয়ে এসে রোদ্দুরকে জড়িয়ে ধরে।রোদ্দুরের হাত নিজের অজান্তে অহির পিঠে চলে যায়।অহিকে দু হাতে আষ্টেপৃষ্টে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয়!অহি ফিসফিস করে বলে,

—“আপনাকে এক পৃথিবী ধন্যবাদ রোদ্দুর ভাই।”

রোদ্দুর উত্তর দেয় না।সে চোখ বন্ধ করে আছে।ভেতরে অন্য ধরনের অনুভূতি হচ্ছে।কয়েক সেকেন্ড পর অহির মতোই ফিসফিস করে বলে,

—“অজান্তা!আমার এত কাছে আসিস না।প্লিজ!”

অহি আরো শক্ত করে রোদ্দুরকে জড়িয়ে ধরে।কয়েক মিনিট পর অহি হঠাৎ মৃদু শব্দ করে আর্তনাদ করে।রোদ্দুর দ্রুত ছেড়ে দিয়ে চিন্তিত গলায় বলে,

—“কি হলো অজান্তা?ব্যথা ট্যথা পেয়েছিস কোথাও?”

অহি রাগী কন্ঠে বলে,

—“এভাবে কেউ পায়ের উপর ভর দিয়ে জড়িয়ে ধরে?দিলেন তো বুট দিয়ে পায়ের পাতা একদম পিষে!আপনি এত গাধা কেন রোদ্দুর ভাই?”

রোদ্দুর আমতা আমতা করে বলল,

—“ইয়ে মানে স্যরি রে!খেয়ালে ছিল না।বেশি ব্যথা পেয়েছিস?”

—“রোদ্দুর ভাই! আপনার ডান পা এখনো আমার কড়ে আঙুলের উপর!”

রোদ্দুর এক পলক নিচের চেয়ে দ্রুত দু পা পিছিয়ে যায়।মনে মনে নিজেকে জঘন্য একটা গালিও দেয়।পুনরায় আবার এগিয়ে এসে এক ঝটকায় অহিকে কোলে তুলে নিয়ে হাঁটা ধরে।

অহি প্রথমে অবাক হলেও মুহুর্তে খুশি হয়।রোদ্দুর ভাই তাকে কোলে তুলে নিয়েছে যেন বিশ্বাস হতে চায় না!তার কপালে এত সুখ সইবে তো!

সে দুহাতে রোদ্দুরের গলা জড়িয়ে ধরে।এই মানুষটাকে সে কখনো কষ্ট পেতে দিবে না।নিজের সবটা দিয়ে বাকি জীবনটাতে আগলে রাখবে!

সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রোদ্দুর অহিকে নামিয়ে দেয় কোল থেকে।কিন্তু অহি তার গলা ছাড়ে না।দুহাতে আরো শক্ত করে ধরে।রোদ্দুরের মাথাটা নিচু হয়ে আসে।সে ইশারায় গলা ছাড়তে বলে কলিং বেলে চাপ দেয়!

অহির দিকে পুনরায় তাকানোর আগেই অহি নিষিদ্ধ ও ভয়ংকর একটা কাজ করে। রোদ্দুরের সারামুখে এলোপাথাড়ি চুমু খেয়ে ছেড়ে দিয়ে দূরে গিয়ে দাঁড়ায়!রোদ্দুর আর চোখ তুলে অহির দিকে তাকাতে পারে না।সে যেন হাওয়ায় ভাসছে!বুকের ভেতর ধড়ফড় করছে।তার হার্ট অ্যাটাক আজ কেউ আটকাতে পারবে না।কেউ না!

একহাতে বুক চেপে আরেক হাতে অনবরত কলিং বেলে চাপ দেয়!কেউ খুলছে না কেন?

দরজা খুলতেই রোদ্দুর এক দৌঁড়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা আটকে দেয়!ভাগ্যিস ড্রয়িং রুমে তেমন কেউ ছিল না।নইলে তার হঠাৎ এমন আচরণে সবাই আরেক দফা অবাক হতো!

——————-

শাওয়ার নিয়ে অহি মাথার চুল মুড়িয়ে বের হয়।রোদেলা আপু এখনো রুমে আসেনি।কিন্তু রোদেলা আপুর সাথে তার অনেক কথা জমে আছে।অনেক কিছু জিগ্যেসও করতে হবে।সাদিদ স্যারের সাথে সময় কিভাবে কাটলো,কি কি কথা হলো সব!

সে বাসায় ফিরেই শুনেছে রোদেলা আপু নাকি স্ট্যাডি রুমে কিছু একটা দরকারী কাজ করছে।

এ বাসায় একটা ছোট্ট রুম আছে যেটা লাইব্রেরির মতো অনেকটা।প্রচুর বই দিয়ে ভর্তি।সংস্কৃত থেকে শুরু করে মিয়ান সভ্যতার পুরনো সব বই আছে।এই সবকিছু তার খালু সংগ্রহ করেছে।তিনি প্রতি রাতের খানিকটা অংশ লাইব্রেরীতে বই পড়ে কাটিয়ে দেয়!

অহি মাথার চুল ঝেরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে।আয়নায় নিজের প্রতিকৃতির দিকে তাকায়।সে কি অনেক বেশি সুন্দর?কই নাতো!কেমন ফোলা ফোলা গাল,একটু বোঁচা নাক!একপাশের টোল টাও বেশি বোঝা যায় না।রোদ্দুর ভাই তাতেই মুগ্ধ হয়ে গেল?

অহি আর আয়নায় তাকাতে পারে না।তার লজ্জা লাগে।ভীষণ লজ্জা লাগে।এমনিতেই মানুষটার সামনে সে কত নির্লজ্জ কাজ করেছে।এখন মুখ দেখাবে কি করে?

মোবাইলের টুং আওয়াজে ঘোর কাটে অহির।ড্রেসিং টেবিল থেকে উঠে পড়ে।বিছানার উপরে আধ শোয়া হয়ে বালিশের তলা থেকে ফোনটা হাতে নেয়।একটা এসএমএস এসেছে আননোন নাম্বার থেকে!এটা যে রোদ্দুর ভাইয়ের নাম্বার তা অহির বুঝতে বাকি রইলো না।কারণ এই নাম্বার থেকেই তার রোদ্দুর ভাইকে কনফেশনের মেসেজটা পাঠিয়েছিল!

সে মেসেজটা পড়া শুরু করলো।

“নিজেকে ভেঙে চুড়ে,সম্পূর্ণ টুকরো টুকরো করে তোমায় ভালো বেসে ফেলেছি।আমার মন নামক ছোট্ট শহরটা আজ শুধু ‘তুমি’ নামক মানুষটার দখলে।এখন তোমার নৈশব্দিক পদচারণার গুঞ্জনে আমার শহরে অন্ধকার কাটিয়ে ভোর হয়।তোমার প্রসারিত ঠোঁটের একটুখানি হাসি সূর্য হয়ে আলো ছড়ায়!তোমার ভারী নিঃশ্বাসের গন্ধ মেখে আমার শহরের দিন কাটে।

তোমার ঘন পল্লবঘেরা আড়চোখের একটুখানি চাহনি আমার শহরে ফকফকে জোসনা হয়ে ঝরে পড়ে।তোমার বাঁকা ঠোঁটের একটুখানি হাসি,আমার শহর তোলপাড় করে দেয়!তোমার এলোচুলের একটু দোলা,আমার শহরে পাগলা হাওয়া বইয়ে দেয়।তোমার হঠাৎ হঠাৎ লজ্জা মিশ্রিত মুখ,ফাগুনের আগুনে ভাসিয়ে দেয় আমার শহর!

তেমনি তোমার হঠাৎ হঠাৎ কুঁচকানো কপালের গভীরতা মেপেই আমার শহরে বৃষ্টি ঝরে।শেষ বিকেলের চায়ের কাপ হাতে নিয়ে উদাস হয়ে প্রকৃতি পানে তাকিয়ে থাকা তোমার মন খারাপের বিকেল আমার শহর এলোমেলো করে দেয়।বিষণ্ণতার ডাকে ছেয়ে যায় আমার শহর।ফের তুমি যখন মুচকি হাসো, আমার শহর যেন প্রাণ ফিরে পায়।

এভাবেই আমার শহরের নামহীন প্রতিটি স্তরে শুধু ‘তুমি’ নামক মানুষটার বিচরণ!আমার শহরে তোমার নিমন্ত্রণ রইলো।এক সমুদ্র ভালোবাসা নিয়ে দরজায় কড়া নেড়ো।আমি দু হাতে তোমায় বুকে আগলে নিবো।আমার রাজ্যের আমার মায়াপরীকে।ভালোবাসি!ভালোবাসি!ভালোবাসি!”

এইটুকুই লেখা।অহির বুকের ভেতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে।সুখের ঝড়,ভালোবাসার ঝড়!সে ফোনটা বুকের উপর নিয়ে বিড়বিড় করে বলল,

—“আমায় পাগল করে দেবেন না রোদ্দুর ভাই।একদম পাগল করে দিবেন না।আমি পাগলামি শুরু করলে তখন সামলাতে পারবেন না!”

আবার টুং করে মেসেজের আওয়াজ আসলো।সে দ্রুত ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো এবার ‘রোদ্দুর ভাই’ নাম দিয়ে সেইভ করা সেই পুরাতন নাম্বার থেকে এসএমএস এসেছে।বাংলায় লেখা…

“অজান্তা!যেখানেই থাকিস না কেন দুই মিনিটের মধ্যে আমার রুমে আয়।দরজায় টোকা দিতে হবে না।দরজা খোলা!দুই মিনিটের এক সেকেন্ড যেন নড়চড় না হয়।

আদেশক্রমে
রোদ্দুর হিম”

অহি হেসে ফেলল আবারো।মানুষটা তাকে নিয়ে এ কি খেলা শুরু করলো?প্রেম কথোপকথন এক নাম্বার দিয়ে।আর ঝাড়ি দেয় আরেক নাম্বার দিয়ে!

সে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো।

(চলবে)

প্রেমে পড়েছে মন প্রেমে পড়েছে…..(উল্টা সেন্টি ইমোজি)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে