পরিনতি
পর্ব ২
চিঠিতে বড় বড় করে একটা নাম্বার লিখা আর নিচে লিখা
– প্লিজ যেভাবেই পারো আমাকে ফোন দাও অনেক কথা আছে।আমি তোমার নাম্বারে কয়েকবার ফোন দিয়েছি কিন্তূ পাইনি,রিহানের গলা শুনে কোনো কথা না বলে ফোন রেখে দিয়েছি।আর শোনো যদি ফোন করার সুযোগ না পাও,তাহলে সন্ধ্যা সাতটায় বাগানে দেখা করবে যেভাবেই হোক।প্লিজ খুব জরুরি।
ইতি
আরিফ মাহমুদ।
দেখা করার কথা টা পড়ে,বুকের ভিতর কেমন যেনো একটা ঝড় বয়ে গেলো মনে আবির্ভূত হলো পুরনো স্মৃতিচারণ।আরিফের সাথে পরিচয়ের কথা,ওর সাথে কাটানো সময় গুলোর কথা।
কত সুন্দর আর রঙিন ছিলো সেই মুহূর্ত গুলো।আজকের মত এতো জটিল ছিলোনা কিছুই,কিভাবে কি হয়ে গেলো বুঝতেও পারলাম না।চাইলাম কি আর হলো কি!
দুই বছর আগের ঘটনা…
আমি ফারিয়া।গ্রামে থাকি।পরিবারে মা বাবা আর আমরা দুই বোন।আপুর বিয়ে হয়ে গেছে,বর্তমান আমরা তিনজন আছি পরিবারে।আমার কোনো ভাই নেই,ছেলে নেই বলে মা অনেক আফসোস করলেও বাবা মেয়েদের নিয়েই খুশি।বাবা বলেন আমরা নাকি বাবার কলিজার টুকরা।আমার বাবা একজন স্কুল টিচার,মা গৃহিণী।আমাদের ছোট্ট পরিবারে আমরা অনেক সুখী।
আমার দাদী যখন মারা যায়,আপু দুলাভাই এবং তার পরিবারের অনেকেই আসেন দাদীকে শেষবারের মতো দেখার জন্য,মাটি দেওয়ার জন্য।আপুদের পরিবারের সবাইকেই আমি চিনি, কিন্তূ এইবার আপুর সাথে একজন ছেলে এসেছে যাকে আমি চিনিনা ইভেন এর আগে কখনো দেখি ও নাই।ছেলেটা আপুর কি হয় আমি তখনও জানতাম না,জিজ্ঞেস করবো করবো করে সুযোগ ও পাচ্ছিলাম না।যাই হোক ছেলেটা অনেক সুন্দর এবং স্মার্ট।আমি আপুকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম
– আপু তোমাদের সাথে যেই ছেলেটা এসেছে,ঐটা কে?মালটাকে তো আগে কখনো দেখিনি।
– কি!তোর মুখের ভাষা এমন হইছে কেন রে?মাল মানে কি?কথাবার্তার কি ছিরি দেখছো,লেখাপড়া করছিস এইসব শেখার জন্য? ছি! ছি!
– সরি আপু মুখ ফস্কে বের হয়ে গেছে।
– এই যা তো তুই এখান থেকে,তোকে দেখলেই এখন আমার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে।
-আচ্ছা যাচ্ছি, কিন্তূ আপু…
– আবার কি হইছে?
– ওই ছেলেটা কে বললে না তো।
– এই তুই এখান থেকে যাবি নাকি লাথি মাইরা বাইর করবো তোকে?
আমি আর এক মুহূর্ত দেরি না করে দৌড়ে পালালাম ওখান থেকে, কারন আমার বোন যেই চিজ লাথি দিতে তার কোনো শনি মঙ্গলবারের দরকার পরেনা,যখন খুশি মেরে দেন।আমার কোমরে যে কত লাথি খেয়েছি আপুর বিয়ের আগে তার কোনো হিসেব নেই তবে এখন আগের মত লাথি দেয়না শুধু মুখেই বলে,তাও বিশ্বাস করা যায়না কখন আবার মেরে দেয়।
কিছুক্ষন পর আমার কয়েকজন বান্ধবী আসলো,আমাকে দেখতে।আমি কয়েকদিন ধরে স্কুলে যাইনা বলে নাকি তাদের পরান আমার জন্য খাখা করছে,আসলে এই সবই নাটক।একটা ছেলের সাথে বান্ধবী মিলার সম্পর্ক।ওই ছেলের বাড়ি আমাদের বাড়ির পথেই,উনাকে দেখার জন্যই আসে আমার নাম করে,বাড়ি থেকে একটা কিছু বলে তো বের হতে হবে তাইনা!
সবাই দুপুরে একসাথে খাওয়া দাওয়া করলাম,অনেক্ষন আড্ডা দিলাম।বিকেল হয়ে গেছে বান্ধবীরা এখন চলে যেতে চাইছে তাই আমি ওদের কে এগিয়ে দেওয়ার জন্য যেইনা বাড়ি থেকে বের হলাম,অমনি আপুর সাথে আসা ছেলেটা একদম আমার মুখোমুখি থমকে দাড়ালো।আমি বামে যাইতো সেই ও বামে, ডানে গেলে সেও ডানে।তাই আমিই চুপ করে দাড়িয়ে বললাম,
– আপনিই আগে যান।
– থ্যাংকস ।
এই বলে ছেলেটা বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলো।
মিলি জিজ্ঞেস করলো
– ছেলেটা কে রে?
– জানিনা।আপুদের সাথে কালকে এসেছে।
– ছেলেটা দেখতে কিন্তূ অনেক স্মার্ট।
– হুমমম।
– তুই তোর আপুকে জিজ্ঞেস করিস নাই ছেলেটার ব্যাপারে?
– করেছিলাম,বিনিময়ে লাথি দিতে চেয়েছে তাই আর..
– তোর বোন তো একটা আজব মানুষ,এটা জানতে চাইলে কেও লাথি দিতে চায়!
– হরে, আমার বইন একটা সইতানের হাড্ডি।
– আচ্ছা তাহলে তুই ছেলেটাকেই সরাসরি জিজ্ঞেস করে নে না,তাহলেই তো হয়।
– গুড আইডিয়া,তাহলে তাই করবো।
বান্ধবীদের বিদায় দিয়ে যখন বাড়িতে ফিরে আসলাম,দেখলাম ছেলেটা বসে বসে আনমনে মোবাইল টিপছে।এই তো সুযোগ ছেলেটার পরিচয় জানার,যাই একটু জেনে আসি তার ব্যাপারে।কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম
– হাই,আপনি কে?
– ছেলেটা ভ্রু কুচকে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,আমি কে সেটা আপনার জেনে কি হবে?আপনি কে সেটা বলুন।
– আমি ঐযে মারিয়া আপু আছে না,ওর বোন ফারিয়া।
– দেখে কিন্তূ মনে হয় না।
– কেনো?
-দেখতে একদম ফকিন্নির মতো লাগে তাই।
– এইযে মিস্টার আমি ফকিন্নি হতে যাবো কেন, আমি তো এই বাড়ির মালকিন বুঝলেন?
– তাই নাকি! কিন্তূ আমি যে আপনাকে ফকিন্নি ছাড়া আর কোনো উপাধি দিতে পারছিনা।
– আপনি তো মিয়া ভারী বেআদব মানুষ।
– আপনি নিজে যেমন সবাইকে তেমনি ভাববেন তাইনা?
– ধুর! আপনার মতো মানুষের সাথে কোনো কথা বলার ইচ্ছা আমার নাই।
– তো আপনাকে ডেকেছে কেও কথা বলার জন্য?
– ধুর! কেনো যে এসেছিলাম আপনার সাথে কথা বলতে। আপনি একটা সইতান বুঝছেন?
– হুমম,নিজে যেমন সে সবাইকে তেমনই মনে করবে এটাই স্বাভাবিক।
আমি আর ওই ছেলের সাথে কথা বাড়ালাম না,এই ছেলের মধ্যে যেই পেচ,এর সাথে কথা বললে আমি নিজেই বিপদে পরে যাবো,অসহ্য একটা।
*********
সকালে মা বললো,
– ঘর থেকে পাঁচটা ডিম লইয়া আয়,ভাইজা দেই।আর আটা লইয়া আয় রুটি বানামু।আর শোন কোথাও যাবিনা অনেক কাজ আছে,আমার লগে নাস্তা বানাতে সাহায্য করবি।
আমি মায়ের কথা মত ঘর থেকে ডিম আর আটার ডিব্বা নিয়ে রান্না ঘরে যেতে লাগলাম কিনতু ডিম আর আটার ডিব্বা একসাথে নেওয়ার কারণে দুটোই হাত থেকে পড়ে গেলো।ডিব্বা ও ভাঙলো,আর পাঁচটা ডিম ও।মা শব্দ শুনে দৌড়ে ঘরে এসে এই অবস্থা দেখে, ঝাটা নিয়ে তেরে আসে আমাকে মারতে,আমি কি আর ঐখানে থাকি,এক দৌরে পালিয়ে আসলাম ওখান থেকে কিন্তূ শেষ রক্ষা আর হলোনা।এক জমের কাছ থেকে বেঁচে এসে আরেক সইতানের সাথে ধাক্কা খেলাম।আমি বললাম
– সরি।
– এই মেয়ে তোমার সমস্যা কি?বার বার চোখের সামনে ঘুর ঘুর করো।কখনো সামনে এসে প্রশ্ন করতে থাকো,আবার ধাক্কা খাও,সুন্দর ছেলেদের দেখলে মনে লাড্ডু ফুটে নাকি?
– এইযে মিস্টার আপনি কাকে কি বলছেন?নিজেকে খুব সুন্দর ভাবেন তাইনা?
– ভাবতে যাবো কেন,আমি তো আসলেই সুন্দর।
-ইস রে,তাহলে আমি কম কিসে?আমি কি দেখতে খারাপ নাকি?আপনি জানেন এই গ্রামের সবাই আমাকে সুন্দরী বলে ডাকে।
– হাহাহা,সো ফানি।
– এখানে ফানির কি দেখলেন?আপনি জানেন স্কুলে আমি প্রতিদিনই চার পাঁচটা করে প্রেমের অফার পাই!ওইদিন তো চেয়ারম্যান এর ছেলে আমাকে প্রপোজ করেছে, কিন্তূ আমি পাত্তা দেইনি।
– ওমা!তাই নাকি? তো কেনো পাত্তা দেননি জানতে পারি?
– আরে ধুর!আমি কি গ্রামের এই মফিজ মার্কা ছেলেদের সাথে প্রেম করবো নাকি!আমি তো প্রেম করবো শহরের সব চেয়ে সুন্দর,স্মার্ট,ধনী ছেলেটার সাথে।
– আহারে এই অজপাড়া গায়ে কোন নায়ক যে আপনার প্রেমে মরতে আসবে,ভালো করেই জানা আছে আমার।
– আসবে আসবে,একদিন ঠিকই আসবে।দেখেন না সিনেমার মধ্যে নায়ক রা কিভাবে নায়িকাদের খুঁজে বের করে।
– এইযে মিসেস আপনি কোনো নায়িকা নন আর জীবন টাও কোনো সিনেমা নয় সো বাস্তবে ফিরে আসুন। হুহ! নিজেকে সিনেমার নায়িকা ভাবছে।
– সিনেমার নায়িকা ভাবতে যাবো কেন,তাছাড়া সিনেমার নায়িকা না হলাম একদিন না একদিন তো কারো জীবনের নায়িকা হব ইই।
– জী না নায়িকা তো দূরের কথা,কামের ছেরি ও হতে পারবেন না।কে বিয়ে করবে আপনার মত ফকিন্নি কে!
– কে বিয়ে করবে সেটা নিয়ে আপনাকে ভাবতে বলিনি আমি, যান নিজের কাজ করুন, যত্তসব!
– আমি তো নিজের কাজই করছিলাম আপনিই তো এসে বেঘাত ঘটালেন।
– হইছে হইছে আর কথা বইলেন না।আসলে আমার কপাল খারাপ নাকি আমিই খারাপ বুঝতাছি না।
– আপনিই খারাপ,হাহাহা।
– আবার আপনি কথা বলছেন,এইবার কিন্তূ সত্যি এক বাড়ি দিয়ে আপনার মাথা ফাটিয়ে দিবো।
ছেলেটা আর ঐখানে দাড়ালো না,কোথায় যেনো চলে গেলো।কুত্তা,বিলাই,হনুমান,বির বির করে আরো কত রকমের গালি দিয়েছিলাম সেদিন তার কোনো হিসাব নেই।
সকালে এখনও খাওয়া হয়নি,খুদায় পেট চুচু করছে,তবুও নিজের থেকে খেতে যাবো না। দেখি কেউ আমাকে খাওয়ার জন্য ডাকে কি না।মন খারাপ করে যখন উঠানে বসে ছিলাম।মা আদর করে ডাকছে
– কি রে ওখানে মূর্তির মতো বইসা আছোছ কেন?খাইতে আয়।
– না খামুনা,তোমার দৌড়ানি খাইয়া পেট ভইরা গেছে।
– বাবা বললো,কেন মারিয়ার মা,তুমি ওরে দৌড়ানি দিছো কেন?
– দৌড়ানি দিমুনা তো কি করমু,পাঁচটা ডিম ভাইঙ্গা ফালাইছে,আটার ডিব্বা শুদ্দা সব আটা নষ্ট করছে।আবার নতুন কইরা দুকান থাইকা সব আইন্যা পরে নাস্তা বানাইছি,তাই তো আস আইজকা নাস্তা এতো দেরি।
– আটা কি আমি ইচ্ছা কইরা ফালাইছি নাকি?
– ইচ্ছা কইরা ফালাছ নাই বুঝলাম কিন্তূ একটু দেইখ্যা হুইনা কাম করবি তো,দিন দিন তো বড় হইতাছোছ,বিয়া দিয়ন লাগবো।শ্বশুর বাড়ি যাইয়া যদি এমন উল্টা পাল্টা কাম করোছ,তাইলে তখন তো মায়ের দোষ হইবো।মাইনষে কইবো মাইয়ারে কিছুই শিখায় নাই।আইচ্ছা এহন এইসব বাদ দিয়া খাইতে আয়।
আসলে আমরা যখন নিজেরা নিজেরা কথা বলি,একদম নিজের গ্রাম্য ভাষায় কথা বলি,কিন্তু অন্যদের সাথে শুদ্ধ ভাষাতেই কথা বলি।যাইহোক মায়ের আদরের ডাক শুনে না খেতে যেয়ে পারলাম না।সব চেয়ে বড় কথা পেট আর মানছেনা।সব রাগ ভুলে খেতে গেলাম।
শুধু মা বাদে সবাই এক সাথেই খেতে বসলাম,ওই সইতান ছেলেটাও আছে ঐখানে। আমি হাত ধুয়ে যেই খেতে বসলাম ওমনি ওই ছেলেটা বলতে লাগলো
– আন্টি আপনি না বলেছিলেন,ফারিয়াকে আজকে খেতে দিবেন না,তাহলে এখন খেতে দিচ্ছেন যে,ও কে আজকে না খাইয়ে শাস্তি দেওয়ার দরকার ছিলো।
এই কথাটা শুনেই পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গেলো, এমনেই পেটে খুদা থাকলে আমার মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়,তার উপর এই বেআদব ছেলেটার কথা একদমই হজম হলোনা।খাওয়া রেখে তার সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম
– এই মিয়া আপনার সমস্যা কোথায়?আমার সব কিছুতে আপনাকে নাক গলাতে কে বলছে?মেহমান মেহমানের মতোই থাকবেন এতো কথা বলার প্রয়োজন কি আপনার?
আপু পাশে থেকে আমাকে ধমকাচ্ছে
– ফারিয়া এভাবে কথা বলছিস কেনো তুই?কিভাবে একজন মানুষের সাথে কথা বলতে হয় সেটাও কি তুই জানিস না,চুপ কর বলছি।
– কেনো চুপ করবো,তুমিতো ওনাকে কিছু বললে না,অপরাধ করলো উনি তুমি উল্টা আমাকেই বকছো।
– কি এমন বলেছে ও,তুই কি মজা ও বুঝিস না?
– কিসের মজা,উনি আমাকে কথায় কথায় অপমান করে সেটা তুমি জানো না।
– আমি সবই জানি।এখন কি তুই চুপ করবি নাকি চর দিয়ে দাঁত ফেলেদিবো?
– হ্যা মারো আমাকে, কিছু হলে তো শুধু এটাই পারো।
কথা শেষ করার আগেই আপু ঠাস করে একটা চর মারলো আমার গালে।আমি তখন রাগ করে আমার খাবার প্লেট টা ছুড়ে মারলাম মাটিতে, ওমনিই আপু আমাকে হাতের কাছে স্টিলের স্কেল পেয়ে পিঠে মারতে গিয়ে দুর্ভাগ্যবশত মাথায় লেগে গেলো।
টুপ টুপ করে রক্ত পরতে লাগলো,আমি ব্যাথা পাইনি তেমন কিন্তূ রক্ত দেখার পর শরীরটা কেমন যেনো খারাপ করে ফেললো।সবাই আমাকে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পরলো,আপু তো হাওমাও করে কান্না জুড়ে দিলো,আপুকে এভাবে কাদতে দেখে আমিও কাদতে লাগলাম।অনেকক্ষন মাথায় পানি ঢালার পর যখন একটু সুস্থতা অনুভব করছিলাম,মা কে বললাম আমি একটু বিছানায় শুতে চাই।আপু কোলে করে নিয়ে আমাকে বিছানায় শুইয়ে দিলেন।আপু আমার কপালে, গালে চুমু খেতে খেতে বললেন
– বোন মাফ করে দে আমাকে,আমি বুঝিনাই এমন হবে,আমি তো তোর পিঠে মারতে চেয়েছিলাম কিন্তু বিশ্বাস কর ভুল করে মাথায় লেগে গেছে। আমাকে প্লিজ মাফ করে দে বোন।আর কখনো এমন হবেনা।
– আপু এভাবে বলো না,আমি জানি তুমি ইচ্ছা করে এমনটা করোনি।
– আমি খুব খারাপ তাইনা রে?
– না আপু তুমি অনেক ভালো,আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।
– আমিও তোকে অনেক ভালোবাসি।শুধু একটু শাসন করি,ভালোবাসি বলেই শাসন করি।সামনে তোর এসএসসি পরীক্ষা কিন্তু এমন সব কাণ্ড করিস যেনো তুই ছোটো বাচ্চা।
– সরি আপু আর করবোনা।
– আমার লক্ষী বোন।আমার জান।তোকে শাসন করি বলে ভাবিস না ভালোবাসি না,তোকে আমি অনেক অনেক ভালোবাসি।
– আমিও আপু।
দুই বোনের কান্নায় পরিবেশটা কেমন যেনো ভারী হয়ে উঠেছিলো তখন।
রাতে আপু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো
– বোন একটা কথা রাখবি?
– কি কথা বলো।
– তুই আরিফ কে গিয়ে সরি বলবি?
– আরিফ কে?
– আরিফ কে তুই এখনও জানিস না বুঝি!মজা করিস?
– আপু সত্যি বলছি,আরিফ কে আমি চিনিনা।
– আমাদের সাথে যে ছেলেটা এসেছে ওর নামই আরিফ।
– ওহ। কিন্তূ আপু আমি ওনাকে সরি বলতে যাবো কেন,আমি এটা পারবো না।উনি খুব বেআদব একটা ছেলে।
– এভাবে বলেনা বোন।তুই জানিস ওর কত কষ্ট?
– কিসের কষ্ট?আর উনি তোমাদের কে হয়?
– আমার বড়ো ভাসুর আছেনা,ওনার ছেলে।তবে আসল ছেলে না,শুনেছি আরিফ কে নাকি রাস্তার ধারে কে ফেলে রেখে গিয়েছিলো,তারপর আমার ভাসুর দুই জন সন্তান থাকার পর ও আরিফের লালন পালনের দায়িত্ব নেন।
– আরিফ কি এই ব্যাপারে জানে?
– হুমমম জানে,যদিও বাসার কেও কখনো বলেনি,বাইরের মানুষের কাছ থেকে শুনেছে।
– বাইরের মানুষের কি দরকার ছিলো ওনাকে এই বিষয়ে বলার?
– সেইটা যারা বলেছে,তারাই ভালো বলতে পারবে।
– বুঝলাম কিন্তূ আরিফ কে, কি তোমাদের বাসার কেউ অবহেলা করে?
– না রে সবাই ওর প্রতি আরো বেশি যত্নশীল।ওদের মতে আরিফ ঘরে আসার পর থেকেই সংসারে উন্নতি হওয়া শুরু হয়েছে।আমার ভাসুর তো আসল সন্তানের চেয়ে আরিফ কে বেশি ভালোবাসে।
– তাহলে তুমি যে বললে,উনার অনেক কষ্ট। এতো ভালোবাসা পাওয়ার পর তো ওনার কোনও কষ্ট থাকার কথা না।
– আছে রে আছে,এমন কিছু চাপা কষ্ট থাকে যা খালি চোখে দেখা যায়না।কত মানুষ আরিফ কে জারত ছেলে বলে গালি দেয়,এটা কি কষ্ট না?এমনিতে ছেলে হিসেবে আরিফ অনেক ভালো।ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং করছে।
– মনে মনে বললাম,ভালো না ছাই,সইতান একটা।আচ্ছা আপু এর আগে তো উনাকে কখনো দেখিনি।
– দেখবি কিভাবে ও তো ঢাকায় থাকে।
– উনি ঢাকায় থাকেন?
– হুমম।
– তার জন্যই উনি এতো ঝকঝকে, তকতকে সুন্দর।
– হাহাহা,কি বলিস তুই এটা।তুই আসলেই একটা পাগলী।আচ্ছা এখন ঘুমা।কালকে কিন্তূ দাদীর সাতদিনের কাজ,দুইশত মানুষকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে,অনেক কাজ আছে কালকে।তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পর,সকাল সকাল উঠতে হবে,কালকে কিন্তূ সবাই মিলে একসাথে কাজ করবো কেমন?
– আচ্ছা।
– আর শোন,আমি যে আরিফের ব্যাপারে এইসব বলেছি তোকে ও যেনো না জানে,তাহলে কষ্ট পাবে।
– আচ্ছা।
*******
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি সবাই কাজে ব্যাস্ত।গ্রামের একটা রীতি আছে,কোনো বাড়িতে বিয়ে বা কোনো অনুষ্ঠান হলে,আসে পাশের সব কাকিরা,জেঠি রা সবাই সাহায্য করে।
আজকেও অনেক কাকী,আপু রা এসেছে,মায়ের সাথে সাথে কাজে সাহায্য করছে।আমাকে দেখে মা বললো
– জমিদারের মাইয়া উঠছেন তাইলে, আপনের ঘুম ভাঙলো ?
– তুমি আমারে ডাক দেও নাই কেন মা?
– ডাকতে চাইছিলাম মারিয়া মানা করলো,তাই ডাকি নাই।আইচ্ছা হুন,তোর কাম হইলো ঘর,উঠান সব কিছু সুন্দর কইরা পরিষ্কার করবি।আর দুপুরের পর থালাবাসন ধোয়ার কাম তোরে দেওয়া হইলো,লোকজনের খাওয়া শেষে ঐগুলা তুই পরিষ্কার করবি। এহন যা তাড়াতাড়ি ঘর দোর পরিষ্কার কর।
আমি এমনিতেই কামচোরা মা এসব জেনেও আমাকে কত গুলো কাজের দায়িত্ব দিলেন।তবে আজকে কাজ করতে আনন্দই লাগছে,সবাই কে কাজ করতে দেখে আমারও কাজ করার উৎসাহ বেড়েছে।
দুপুরে লোকজন সবাই খাওয়া শেষে চলে গেলেন।এখন আমার থালাবাটি ধোয়ার পালা।কল পারে থালা বাসন দেখে,আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো।
এত্ত থালাবাসন,এই গুলা ধুতে ধুতে তো রাত হয়ে যাবে।ভয় পেয়ে কোনো লাভ নেই, আমাকেই যখন করতে হবে দেরি করার দরকার কি,লেগে গেলাম কাজে।সব গুলা আগে মেজে নিলাম কিন্তূ একা একা কল চেপে ধুতে পারছিলাম না,বার বার মাকে ডাকছিলাম
– মা একটু আইসা কল টা চাপ দেওনা,একা একা পারতাছিনা তো।
– দারা আসতাছি।
যতবার মা কে ডাকি ততবারই এই এক কথাই বলে, কিন্তূ আসার কোনো নাম গন্ধই নাই।আবার যখন চিৎকার করে মা কে ডাকলাম,তখন আরিফ এসে কল চাপতে লাগলো।আমি বললাম
– আপনার চাপা লাগবেনা,আমি পারবো।
– পারবে যখন তাহলে চিৎকার করে তোমার মা কে ডাকছো কেনো?
– আমার মা,আমি ডাকবো,তাতে আপনার কোনো সমস্যা?
– আমার সমস্যা না, কিন্তূ উনি কাজ করছেন,তাই আসতে পারছেন না।কেনো আমি কল চেপে দিলে কি কোনো সমস্যা?
– আমি আর কিছু বললাম না। এমনেই সন্ধ্যা হয়ে আসছে,মা ও ব্যাস্ত,আমিও একা একা পারছিনা,কোনো উপায় না পেয়ে বদমাইশ ছেলেটার সাহায্যই নিলাম।
চাঁদনী রাত সবাই উঠানে বসে আড্ডা দিচ্ছে।কাকা, কাকী, জেঠা,বাবা,মা আপু, দুলাভাই আরো অনেকেই।অনেক রকমের আলাপ হচ্ছে সেখানে,কে কে আসলো,কয়জন খেলো রান্না কেমন হলো ইত্যাদি ইত্যাদি।এইসব আলাপ শুনতে বিরক্ত লাগছিলো,তাই ওখান থেকে একটু দূরে গিয়ে বসলাম।আপুর ফোন টা নিয়ে গান শুনছিলাম। হঠাৎ দেখি আরিফ পাশে এসে বসলো।আমি একটু অবাক হলাম,আরিফ আমাকে জিজ্ঞেস করলো
– মাথার ব্যাথা কি কমেছে?
– আমি আপনাকে কখন বললাম যে আমার মাথা ব্যাথা?
– কালকে যে মাথা ফেটে রক্ত বের হয়ে ছিলো,সেটার কথা বলছি।
– ওহ, ওইটার কথা তো আমি কালকেই ভুলে গেছি,ব্যাথা থাকলে নিশ্চই মনে থাকতো?
– সরি,কালকের ব্যাপারটার জন্য,আমি আসলে মজা করেই ওইটা বলেছিলাম,বুঝিনাই ব্যাপারটা এতটা সিরিয়াস হয়ে যাবে।
– আপনি কেনো সরি বলছেন,সরি তো আমার বলা উচিৎ আমিই আসলে ওভার রিএক্ট করে ফেলেছি।
– আচ্ছা যা হইছে, হইছে।এখন কি আমরা ভালো ফ্রেন্ড হতে পারি?
– হতেই পারি বাট আপনি কি আমার মত ফকিন্নির সাথে ফ্রেন্ডশিপ করবেন?
– আরেহ ওইগুলা আমি জাস্ট তোমাকে রাগানোর জন্য বলেছি।
– আমাকে রাগিয়ে আপনার লাভ?
– মজা লাগে তোমাকে রাগাতে।তোমাকে দেখি সবাই অনেক চেতায় আর তুমিও বোকার মত রেগে যাও,তাই আমিও একটু…
– ভালো।
– তুমি বলেছিলে না,গ্রামের সবাই তোমাকে সুন্দরী বলে ডাকে,তুমি আসলেই অনেক সুন্দর আর মিষ্টি।একটু রাগী বাট অনেক ভালো।
– এই গুলো কি মন থেকে বলছেন নাকি ফান করছেন?
– ফান না,একদম ভেতর থেকে বলছি।
– আচ্ছা,তাহলে আজ থেকে আমরা ভালো বন্ধু ওকে?
– ওকে।
সেদিন থেকেই শুরু হলো আমাদের বন্ধুত্ব।
চলবে…..
সালমা আক্তার।