#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_আগস্ট_২০২০
পরিণামে পরিণয়
আফসানা মিমি
কাজিনকে দেখতে আসা পাত্রপক্ষের মধ্যে পাত্র হিসেবে আদিভানকে দেখে পুরো দুনিয়া যেন চোখের সামনেই টলে উঠলো আরদ্রার। বিস্ময়ে চোখদুটো যেন কোটর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসবে এমন অবস্থা হয়েছে ওর। অথচ আদিভান বেশ স্বাভাবিকভাবেই বসে আছে সবার মাঝে আরদ্রার সামনে। আরদ্রাকে দেখেও কোনো ভাবান্তর হতে না দেখে মনে মনে চরম অবাক হলো সে। আজ প্রায় তিন বছর পর তাকে স্বচক্ষে দেখছে আরদ্রা। তাদের দুজনার মধ্যকার সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ার পর কখনোই দেখা হয়নি একে অপরের সাথে। আজ এতদিন বাদে আদিভানকে এভাবে দেখে বুকের ভিতরটায় কেমন যেন জ্বলছে। এতদিনকার জমিয়ে রাখা কান্নার বাঁধ যেন ভেঙ্গে যেতে চায়ছে আরদ্রার। তাই দ্রুত পায়ে ড্রইংরুম থেকে মেইন ডোর পেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠতে লাগলো দৌড়ে। ততক্ষণে চোখের পানির বাঁধ ভেঙ্গেছে। চিলেকোঠার ঘরের বিপরীত পাশে পানির টাংকির পিছনে দু’হাতে হাঁটু আঁকড়ে ধরে বসে পড়লো। অস্ফুটস্বরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। লোকলজ্জার ভয়ে চিৎকার করে কাঁদতেও পারছে না। চিৎকার করে কাঁদতে পারলে হয়তো ভিতরে গুমোট হয়ে থাকা মনটা কিছুটা হালকা হতো। হাঁটুতে মুখ গুঁজে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগলো। খুব সামান্য একটা ব্যাপারকে কেন্দ্র করে তাদের আড়াই বছরের প্রণয়ের ইতি টেনেছিল আরদ্রা। স্মৃতিপটে ভেসে উঠছে কয়েক বছর আগেকার কয়েকটি ঘটনা।
.
যখন আরদ্রা ইন্টারমিডিয়েটে নতুন ভর্তি হয় তার কিছুদিন পর বেশ অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আদিভানের সাথে ওর দেখা হয়। কলেজ থেকে ফিরতি পথে দেখতে পায় একটা লম্বা মতোন যুবক ছেলে বাইক এক্সিডেন্ট করে রাস্তায় পড়ে কাতরাচ্ছে। কিছু কিছু মানুষ তামাশা দেখছিল, আর কিছু মানুষ মোবাইলে এক্সিডেন্টের ভিডিও ধারণ করছিল। দ্রুত পায়ে ভীড় ঠেলে সেদিকে এগিয়ে গিয়ে কয়েকজনকে বলে একটা সিএনজি ডেকে তাতে আহত ছেলেটাকে তুলে হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিল। ছেলেটাকে দেখেই হসপিটালের সব নার্সরা ছোটাছুটি করে হুলুস্থূল কাণ্ড শুরু করে দিয়েছিল। পরে একজনকে ধরে জানতে পারে ছেলেটা নাকি এই হসপিটালের প্রতিষ্ঠাতার একমাত্র ছেলে। তার বাবা মা এই হসপিটালেই ডাক্তারি করে।
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
ছেলেটাকে যে কেবিনে রাখা হয়েছিল, সে কেবিনের দরজার সামনে সংকুচিত হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে তার অবস্থা জানার জন্য। কী না জানি ভাবে সেই ভেবে ভিতরে যাওয়ার সাহস হয়নি। তখন ভিতরের দিকে উঁকি দিয়ে দেখতে পায় একটা সুন্দর মতোন আভিজাত্যপূর্ণ মহিলা ছেলেটিকে জুস খাওয়াচ্ছে। এটাই বোধহয় তার মা হবে। ঠিক তখনই ছেলেটার নজর পড়ে আরদ্রার ওপর। ছেলেটা একটা নার্সকে ডেকে কী একটা জিজ্ঞাসা করে যা আরদ্রা শুনতে পায় না। নার্স ওর দিকে তাকিয়ে পরে ছেলেটাকে কী যেন বলে। ছেলেটা একটা মুচকি হাসি দেয়। যে হাসি দেখেই জীবনে প্রথমবারের মতো আরদ্রার দম আঁটকে আসে অজানা ভালো লাগায়। টের পায় আচমকা হৃৎপিণ্ড লাফাতে থাকে। লজ্জা পেয়ে দ্রুত সেখান থেকে বের হয়ে বাসায় চলে এসেছিল।
বেশ কয়েকদিন রাস্তাঘাটে চলার সময় ঘুরেফিরে বারংবার সেই ছেলেটার কথা-ই মনে পড়তো আরদ্রার। মাঝে মাঝে দেখতো রাস্তার পাশে ওর দিকে তাকিয়ে আছে অপলক। তবে তা হেলুসিনেশন ভেবে হাওয়ায় উড়িয়ে দিত। কিন্তু একদিন আচমকা ওর পথ আগলে দাঁড়ানোতে ভড়কে যায় আরদ্রা। মুহূর্তের মধ্যেই বুকের রক্ত ছলকে উঠে কেঁপে উঠে ও। হাসি হাসি মুখে একটা চিরকুট ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল ‘এটার উত্তরের আশায় আমি কলেজের ভিতরের পুকুরপাড়ের ঘাটে অপেক্ষা করবো আগামীকাল।’ ওকে অবাক করে দিয়ে আর কিছু না বলেই চলে গিয়েছিল।
বাসায় ফিরে কলেজ ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে বিছানায় গড়িয়ে পড়েছিল চিরকুটটা হাতে নিয়ে। অস্থির হয়ে কাঁপাকাঁপা হাতে চিরকুটটা খোলার পর গুটি গুটি অক্ষরের কয়েকটা লাইন ওর চোখে পড়ে।
“যে আমাকে নতুন জীবন দান করেছিল, সে কী আসবে আমার ছন্নছাড়া জীবনে আশীর্বাদস্বরূপ হয়ে!?
আমার পুরো জীবনের দায়িত্ব নিয়ে এই অধমকে
ধন্য করবে কী!? আমার শূন্য জীবনে পূর্ণতা হয়ে এসে ধরা দেবে হে প্রণয়িনী?”
এক রাশ মুগ্ধতা যেন আরদ্রাকে ছুঁয়ে দিয়ে গিয়েছিল। লজ্জায় রাঙা হয়ে যায়। বারবার লাইনগুলো পড়তে থাকে। রাতে ঘুমানোর সময়ও চিরকুটটা বুকে জড়িয়ে ঘুমায়। পরদিন অস্থিরতায় ঘুম ভেঙ্গে যায় তাড়াতাড়ি। নিজের এমন অবস্থা দেখে খানিকটা অবাকই হয় আরদ্রা। তারপর ভাবে আজ যাবে না সে কলেজে। লজ্জায় হয়তো মরেই যাবে তার সামনে গেলে। এরপর দিন ছিল শুক্রবার। সারাটাদিন এমন অস্থিরতায়ই কাটে রাহার। এক মুহূর্তও যেন শান্তি পাচ্ছে না। এরপর দিন বেশ তাড়াতাড়িই চলে যায় কলেজে। মনটা ছটফট করছে নতুন অনুভূতির চক্করে পড়ে। সময় যেন কাটতেই চায়ছে না। সকাল থেকে সারাদিন বসে থাকে পুকুর ঘাটে। ক্লাস করতে যেতে মন সায় দেয়নি। যদি আবারও ফিরে যায় ওকে না পেয়ে! একসময় অপেক্ষা করতে করতে কান্না করে দেয় আরদ্রা। ওর সেদিন আসা উচিৎ ছিল। ভুল করেছে ও, ভুল করেছে। মুখ ঢেকে কান্না করতে থাকে অবিরত। ততক্ষণে গোধূলি লগ্ন চলে এসেছে। পাখির কিচিরমিচির চারপাশের নিস্তব্ধতাকে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়। সেই মুহূর্তে আরদ্রার অপেক্ষারও অবসান হয়। মাথায় কারো হাতের ছোঁয়ায় চমকে তাকায়। লাল দুটি ফুলে যাওয়া অশ্রুসিক্ত আঁখি মেলে সামনের মানুষটার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে বেশ কয়েকটা ক্ষণ। তারপর আর এক সেকেন্ডও বিলম্ব না করে ঝাপিয়ে পড়ে আকাঙ্ক্ষিত মানুষটার বুকে। তার শূন্য জীবনটা পূর্ণ করতে এই মানুষটাই যথেষ্ট।
তারপরের দিনগুলো কাটে স্বপ্নের মতো। নিজের একলা জীবনে আদিভানকে পেয়ে সকল অপূর্ণতারা বিদায় নিয়েছিল। দিনটা শুরু হতো আদিভানের দুষ্টুমিষ্টি কথার বানে; আর দিনটা শেষও হতো তার ভালবাসা মিশ্রিত অনুশাসনে। কিন্তু কথায় আছে না, সুখের দিন অতি দ্রুতই ফুরিয়ে যায়! তেমনি আরদ্রার সুখের দিনও ফুরিয়ে গিয়েছিল সেদিন, যেদিন ওদের দুজনকে একসাথে আদিভানের মা দেখে ফেলে। আরদ্রার উদ্দেশ্যে বলেছিল ‘আদিভানের সাথে বাসায় এসো একদিন।’ ওর ভিতরের ভয়টা আদিভান হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিল ‘আমার সুখেই উনার সুখ। দেখে নিও তোমাকেও মম মেনে নিবে।’ কিন্তু অজানা দুশ্চিন্তা আরদ্রার পিছু ছাড়েনি। বরংচ ছায়ার মতো লেপ্টে রইলো ওর সাথে।
সেদিনকার অনুভূতির কথা ব্যক্ত করতে পারবে না আরদ্রা। এক বুক আশা আর তার সমপরিমাণ ভয় নিয়ে আদিভানের পিছুপিছু এসিযুক্ত বড় রুমে প্রবেশ করে আরদ্রা। ওকে নিজের মায়ের সাথে বসিয়ে দিয়ে রুম ছেড়ে বের হয়ে গিয়েছিল আদিভান। যাওয়ার আগে আরদ্রাকে আশ্বস্ত করে যায় যাতে ভয় না পায়। কিন্তু আদিভানের মায়ের ঠান্ডা দৃষ্টি দেখে ভয় কমার বদলে বেড়ে গিয়েছিল বহুগুণ। আরদ্রার উদ্দেশ্যে উনার সর্বপ্রথম বাক্য ছিল
—“আমার ভোলাভালা ছেলেটাকে তোমার জ্বালে কীভাবে ফাঁসিয়েছো তা একটু এক্সপ্লেইন করবে?”
এমন কথা শুনে বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল আরদ্রা। ওকে আরেকটু বিস্মিত করতে উনি বলা শুরু করেছিলেন
—“ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন তো ভালোই দেখলে। তুমি ভাবলে কী করে যে তোমার মতো চালচুলোহীন একটা মেয়েকে আমি আমার ছেলের বউ বানাবো!? কী যোগ্যতা আছে আমার ছেলের পাশে দাঁড়ানোর? বাপ-মা নেই। খালার বাসায় আশ্রিতা হয়ে আছো। না আছে কোনো বংশপরিচয়, আর না আছে ধনদৌলত। আমার ছেলে নাহয় না বুঝে তোমার প্রেমে পড়ে গেছে। কিন্তু তুমিও লোভী মেয়ের মতো বড়লোকের ছেলে দেখে তার গলায় ঝুলে পড়লে! এটুকু সেন্স কি তোমার ছিল না যে সম্পর্ক হতে হয় সমানে সমানে!”
কথাগুলো শেলের মতোই বিঁধছিল আরদ্রার বুকে এবং সর্বাঙ্গে। শরীরের চামড়া যেন খসে খসে পড়ছিল এমনতর অপমানে। আরো কিছুক্ষণ এমন কুরুচিপূর্ণ কথাবার্তা শেষে আরদ্রা উঠে আসার আগে শুধু এটুকু বলেছিল
—“টাকা, পয়সা-ই কি জীবনের সব!? ভালবাসার কী তবে কোনো স্থানই নেই মানুষের জীবনে? মানুষের সুখ কি শুধু অর্থ সম্পদেই লুকিয়ে থাকে? তবে টাকা-ই যদি মানুষের সব হয়, তাহলে আপনার ছেলেকেও ধনবান, বিত্তশালী কোনো রাজার মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়েন। সে সুখী না হলেও আশা করি আপনার মনোবাসনা পূরণ হবে। তবে মনে রাখবেন এই টাকা-ই একদিন আপনার কাল হয়ে দাঁড়াবে। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, টাকা দিয়ে সব কিনতে পারলেও ছেলের সুখ কিনতে পারবেন না। আজকের পর থেকে আমাকে আপনার ছেলের ত্রিসীমানায়ও দেখবেন না। ছেলেকে আঁচলের সাথে বেঁধে রাখবেন। বলা তো যায় না যদি আবারও লোভে পড়ে যাই!”
আদিভানের মা’কে বিস্মিত করে দিয়ে উনাকে কোনোকিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসেছিল আরদ্রা। বের হওয়া মাত্রই আদিভানের মুখোমুখি হয়েছিল। ওর হাসিমুখটা দেখে বুকের ভিতরটা ভেঙ্গে খানখান হয়ে যাচ্ছিল আরদ্রার। এ মানুষটার সাথে বোধহয় এ জীবনে আর একসাথে চলার স্বপ্নটা পূরণ হবে না। রাস্তার পাশে আড়াই বছরের সম্পর্কের ইতি টেনেছিল সেদিন আরদ্রা। অনেক জোরাজুরি সত্ত্বেও সত্যিটা বলেনি সে। আদিভান পারে না সেদিন রাস্তায়ই কেঁদে দেয় আরদ্রার আচমকা এমন সিদ্ধান্তে। তবুও আরদ্রার মন একটুও গলেনি। নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকে আদিভানকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। অথচ বিধাতা তো জানেন তার ভিতরে কী টর্নেডো বয়ে যাচ্ছিল আদিভানকে আশাহত করতে!
আদিভানের সামনে পড়ার ভয়ে খালার বাসা ছেড়ে মামার বাড়ি চলে যায়। কিন্তু আদিভানের স্মৃতিরা ওর পিছু ছাড়েনি। অসহনীয় যন্ত্রণায় দিনগুলো পার করছিল ঠিকই; কিন্তু একটা মুহূর্তের জন্যও তাকে ভুলে থাকতে পারেনি আরদ্রা। তার এতদিনকার সঙ্গী ছিল নীরব কান্না। আর আজ এতগুলো দিন বাদে আবারও অতীতের সম্মুখীন হতে হবে কল্পনাও করেনি। নিজের ভালবাসার মানুষটা কিনা অবশেষে তার বোনকে বিয়ে করবে! চোখের সামনে দুজনকে একসাথে দেখে সহ্য করতে পারবে তো সে!
আচমকা কারো কথার আওয়াজ আরদ্রার কানে আসে। কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করে। আদিভান আর তার কাজিন সুরভী কী নিয়ে যেন কথা বলে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। বুকের ভিতর ক্রমান্বয়ে আগুন জ্বলছে। পুড়ছে ভীষণভাবে। এর থেকে পরিত্রাণ পাবে কী করে সে!
.
পাত্রপক্ষের নাকি সুরভীকে বেশ পছন্দ হয়েছে। তাই সেদিনই বিয়ের পাকা কথা বলে গেছেন। দিন পনেরো পরে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করা হয়েছে। বাসায় বিয়ের ধুমধাম লেগে গেছে। এর মধ্যে আত্মীয় স্বজনরাও আসা শুরু করে দিয়েছে। সবাইই বেশ হাসিখুশি। কিন্তু শান্তি নেই আরদ্রার। এটা শোনার পর পুরোপুরিই মুষড়ে পড়েছে সে। সারাদিন বদ্ধ রুমের ভিতর কাটায়। সুরভী ডাকে ওকে সঙ্গ দিতে। কিন্তু সন্তোষজনক কোনো উত্তর পাওয়া যায় না আরদ্রার কাছ থেকে। রাতে খেয়ে যখন ঘুমাতে আসে তখন সুরভীর কথার ফুলঝুরি আরদ্রার কানে বিষের মতো লাগে। ইদানীং সুরভীর হাসিটাও আরদ্রার সহ্য হয় না।
.
এর মধ্যে একদিন ড্রেসিংটেবিলের উপর একটা খুব আকর্ষণীয় ডিজাইনের বিয়ের কার্ড দেখতে পায় আরদ্রা। তারও ইচ্ছে ছিল নিজের বিয়ের সময় এমন জমকালো ডিজাইনের কার্ড বানাতে দিতে। কিন্তু সবার সব ইচ্ছে কী আর পূরণ হয়! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কার্ডটা খুলে তাতে অলসভাবে চোখ বোলায়। সর্বপ্রথমে বরের নামের ওপর চোখ পড়ে। সেখানে আদিভানের নাম দেখেই চোখদুটো আঁটকে যায়। বুকে জ্বালাপোড়া শুরু হয়। সুরভী তার কাজিন সিস্টার হলেও ওর নামটা আদিভানের পাশে দেখে সহ্য করতে পারবে না। তাই শুধু আদিভানের নামটা দেখার পরই কার্ডটা ছিঁড়ে তিন চারটা টুকরো করে ছুঁড়ে ফেলে দেয় ঘরের এক কোণে। চোখে পানি জমে গেছে। বাইরে কারোর পদশব্দে সচকিত হয়ে দ্রুত ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ফ্লোরে বসে হু হু করে কেঁদে দেয়। ওর অদৃষ্টে এটাই বোধহয় লেখা ছিল। তাই তো আজ এভাবে চোখের পানি ফেলতে হচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে সেদিন আদিভানের সাথে দেখা না হলেই বরং ভালো হতো। অন্তত দিনের পর দিন এভাবে বিরহের অদৃশ্য অনলে পুড়তে হতো না।
.
অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ছিল আরদ্রা। তখন মাত্র সন্ধ্যা বিদায় জানিয়ে অন্ধকারের জাল সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছিল। ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোর দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে ছিল সে। সেই সাথে চোখের বর্ষণ তো আছেই। আচমকা মাথায় গাট্টা খেয়ে হুঁশ আসে আরদ্রার। দ্রুত হাতে চোখ মুছে ফিরে তাকিয়ে দেখে সুরভী বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে ওর দিকে চেয়ে আছে। আরদ্রাকে কিছু বলতে না দেখে সুরভী আরেকটা গাট্টা মেরে বললো
—“তোর মতো এমন নিম্নস্তরের ভোম্বল আমি একটাও দেখিনি। খালা তো তোর মতোন এমন গাধী ছিল না। তাহলে তুই এমন হলি কী করে? আর আমার কাছ থেকে তুই কথা লুকাস কী করে? তোর ডায়েরি না পড়লে আমি সত্যিটা কখনও জানতেও পারতাম না; আর এটার সমাধানও করতে পারতাম না। তাহলে সারাজীবনই এভাবে চোখের পানি ফেলে যেতে হতো।”
সুরভীর কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছে না আরদ্রা। ওর ডায়েরি সুরভী কোথায় পেল!? নিশ্চয়ই সবকিছু পড়ে ফেলেছে! ওকে কোনোভাবে ভুল বুঝবে না তো! সুরভীকে পুরো ব্যাপারটা বোঝানোর আগেই ও আবারও বললো
—“আচ্ছা একটা কথা বলতো, বিয়ের কার্ডটা কি তুই দেখে ছিঁড়েছিস; নাকি না দেখেই?”
আরদ্রা তা না শোনার ভান করে বলার চেষ্টা করলো
—“শোন না, আমি আসলে… আদিভান….”
আরদ্রাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে সুরভী বলে
—“আমাকে আসলে নকলে বোঝাতে আসতে হবে না। যাকে বোঝানোর দরকার তাকেই বোঝা গিয়ে।”
সুরভী কথাটা বলতে না বলতেই ব্যালকনির দরজার মুখে আদিভানকে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল আরদ্রা। আদিভানকে চোখ টিপে ‘ট্রিটটা পাওনা রইলো দুলাভাই’ কথাটা বলে সেখান থেকে চলে গেল সুরভী। আর আরদ্রা দাঁড়িয়ে আছে নতমুখে। ঘটনা কোনদিক থেকে কোনদিকে মোড় নিচ্ছে তার বোধগম্য হচ্ছে না। ইঞ্চিখানেক দূরত্বে আদিভানের উষ্ণ নিঃশ্বাসের তোড়ে আরদ্রার চোখমুখ পুড়ে যেতে লাগলো। হাত পা কেঁপে কেঁপে নিঃশ্বাসের গতি ক্রমান্বয়ে ভারি হয়ে আসতে লাগলো। মনে হচ্ছে শরীর বরফের মতো শীতল হয়ে অসাড় হয়ে আসছে। হাঁটু ভেঙ্গে ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়লো আচমকা। আদিভান চমকে গিয়ে আরদ্রার মুখোমুখি বসে তার মুখটা নিজের দু’হাতের আঁজলায় তুলে নিল। তারপর নরমসুরে হুকুম করলো
—“আমার চোখের দিকে তাকাও।”
আরদ্রা সম্মোহিতের মতো আদিভানের চোখে চোখ রাখে। আদিভান বলতে শুরু করে
—“কেন সেদিন সত্যিটা বললে না? তুমি জানতে না তোমাকে ছাড়া কতটা অচল ছিলাম আমি!? তাহলে কীভাবে পারলে আমাকে এভাবে মাঝরাস্তায় একা ফেলে চলে আসতে? আমার ভালবাসার চেয়ে উনার কথাগুলো-ই কি তোমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল? আরে, উনি তো আমার সৎ মা। আমি কিসে ভালো থাকবো না থাকবো উনি কী করে বুঝবেন?! নিজের মা হলে ঠিকই বুঝতো আমি কী চাই, কিসে সুখী হবো আমি! কিন্তু তুমিও আমাকে বুঝলে না!? যে পথ না চিনে হারিয়ে যায় তাকে খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু যে ইচ্ছে করে হারিয়ে যায়, ধরা না দেয় তাকে কী করে খুঁজে পাবে মানুষ? আমার শূন্য জীবনটা তোমাকে পেয়েই পূর্ণ হচ্ছিল। কেন হাতটা ছেড়ে দিয়েছিলে সেদিন, কেন?”
শেষ মুহূর্তে কপালে কপাল ঠেকিয়ে টলমল চোখে কথাগুলো বলে আদিভান। আরদ্রা কিছুই বলতে পারে না। চুপচাপ আদিভানের অভিযোগগুলো শুনে প্রাণ জুড়ায়।