পরিণতি পর্ব – ৮+৯

0
960

পরিণতি
পর্ব – ৮+৯

বাহ্ কতো সহজেই ওনারা ডিভোর্সের ডেট ঠিক করে ফেললেন,একবার আমার কি মত, জানারও প্রয়োজন মনে করলেন না।আমি তো ডিভোর্স চাইনা।আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে,রিহান ও চায়না।এই একটা ভুলের কারনে ও আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে,এটা মেনে নিতে পারছিনা।ওর ভালোবাসা,আমার প্রতি ওর যত্নশিলতা,সব কি এই একটা চিঠির কাছে,একটা ফেলে আসা অতীতের কাছে মিথ্যে হয়ে যাবে?
বাবা,মা কেনো বুঝেন না,আমার কষ্টটা।এইসবের মাঝে আমি নিজেকে কিভাবে সামলাচ্ছি একবারও কি তারা জানতে চেয়েছে,নাকি বুঝার চেষ্টা করেছে,করেননি।বরং তাদের সিদ্ধান্ত আমার উপরে চাপিয়ে দিচ্ছেন।অবশ্য রিহান চাইলেই সব কিছুর সমাধান এখনও হতে পারে,হয়তো রিহান ই চায়না আমাদের সম্পর্ক টা টিকে থাকুক,যদি চাইতো একবার হলেও ফোন দিতো।ও যখন চায়না,তাহলে আমারও, ও কে জোর করার দরকার নেই।আমাকে ছাড়া যদি ও ভালো থাকতে পারে থাকুক।আমি রিহান কে দোষ দেইনা,কিভাবে দোষ দিবো দোষ তো ওর না, দোষ টা তো আমার ই, আর আমি এই ভয়টাই এতোদিন পাচ্ছিলাম।

সকাল দশটার সময়,শ্বশুর বাড়ী থেকে কয়েকজন মানুষ আসলেন।মা আমাকে ঘরে এসে বলে গেলেন,আমি যেনো ওনাদের সামনে না যাই,যা বলার বাবা বলবেন।আর যদি আমি তাদের কথার বিরোধিতা করি,তাহলে আর কখনো,কোনো সময় আমি বাবাকে পাশে পাবোনা।এই বলে মা ঘর থেকে চলে গেলেন।
আমি ওনাদের সামনে যাইনি কিন্তূ এই ঘর থেকে তাদের সব কথা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম। কারা কারা এসেছেন, না দেখলেও, কণ্ঠ শুনে চিনতে পারছিলাম।তাদের মধ্যে কথা চলছিলো।

বাবা : কি ব্যাপার আপনারা আবার কি ভেবে?

শ্বশুর: কিছু কথা বলার জন্য এসেছি।

বাবা : যা কথাবার্তা তা তো আগেই হয়ে গেছে,আমার আর এই বিষয়ে কোনো কথা বলার নেই।

বড়ো ভাশুর : তালোই আপনি আরেকবার সব কিছু ভালো করে ভেবে দেখেন।ডিভোর্স হলেই কি সব কিছুর সমাধান হয়ে যাবে?আপনার মেয়ে কি ডিভোর্স চায়?

বাবা :অবশ্যই।আমি যেটা চাইবো আমার মেয়ে সেটাই করবে।

– মেজো ভাশুর: হয়তো আপনার মেয়ে আপনার কথা মেনে নিয়ে কাজটা করবে, কিন্তূ আপনি কি একবারও জানার চেষ্টা করেছেন,তার মনের কথা?

বাবা: ফারিয়ার মনের কথা যাই থাকুক না কেনো,আমি আর আপনাদের বাড়ীতে ফারিয়া কে দিবো না।যেই বাড়ীতে আমার মেয়ের কোনো সম্মান নেই,যেই বাড়ীতে আপনারা থাকতে,আমার মেয়ে কে আপনাদের বাড়ীর আরেক বৌ মারতে পারে, নিজের স্বামীর ঘরে ঢুকতে বাঁধা দেয়,সেই বাড়ীতে মেয়ে কে সারাজীবন অপমান হতে পাঠাবো না।তারপরও আমি সব ভুলে যেতাম,যদি রিহান এর প্রতিবাদ করতো, কিন্তূ যখন রিহান কে আমার বড়ো মেয়ে সবটা জানালো,তখন ও এমন ভাবে কথা বললো,যেনো আপনার বাড়ীর মেজো বৌ আমার মেয়ের সাথে ঠিক কাজটাই করেছে।এটা আমি মেনে নিতে পারছিনা।

শ্বশুর: দেখুন বেয়াই, সবটাই একটা দুর্ঘটনা মাত্র।এখানে রিহানের কোনো দোষ নেই। ছোটো বৌমা আর রিহানের মধ্যে একটা ব্যাপার নিয়ে ঝামেলা চলছে।আমরা ওদের ঝামেলা মিটানোর চেষ্টা না করে,নিজেদের মধ্যে আরো ঝামেলা বাড়িয়ে ফেলছি।মেজো বৌ মা কে,আমরা যথেষ্ট শাসন করেছি এর জন্য।শুনেছি চিঠিটা ফাঁস করার পেছনে মেজো বৌমার হাত আছে।আমার মেজো ছেলে তো রাগ করে বৌ কে বাপের বাড়ী পাঠিয়ে দিয়েছে।

বাবা: বাপের বাড়ি পাঠিয়েছে,আবার নিয়ে আসবে, কিন্তূ আমার মেয়ে কে যে মারলো,তার কি হবে?

শ্বশুর: ওইটা আমরা পরে দেখবো।বেয়াই বলছি কি,আপনারাও তো আরিফের সাথে বৌমার সম্পর্কের ব্যাপারটা গোপন করেছেন,তাও আমরা সবটা মেনে নিচ্ছি, কারন এগুলো অনেক আগের কথা। কিন্তুু আমার ছেলে হঠাৎ এইসব জেনে খুব কষ্ট পেয়েছে।

বাবা: আমরা গোপন করেছি মানে?আপনার কি মনে হয় আমরা এসব জানতাম?

বড়ো ভাশুর: আচ্ছা তালোই বাদ দিন।
যাইহোক এগুলো ওদের মধ্যেকার ব্যাপার।আর যা কিছু ঘটেছে,এসব তো আর বাইরের মানুষ জানে না,সব কিছু আমাদের মধ্যেই আছে।তাই আমরা সব কিছু ভুলে একটা মীমাংসায় আসি।আমরা ফারিয়া কে নিতে এসেছি।

বাবা: মাফ করবেন,আমি জেনেশুনে আমার মেয়ে কে ওই বাড়ীতে মাইর খেতে পাঠাতে পারবোনা।আমি আমার মেয়ে কে ভার্সিটিতে ভর্তি করবো,ও লেখাপড়া করবে,চাকরি করবে।পরে ও কে ভালো ঘর দেখে বিয়ে দিবো।

শ্বশুর: দেখুন আমরা কিন্তূ আপনার মেয়েকে কখনো পড়াশুনা করতে নিষেধ করিনি,বরং আপনার মেয়েই ই আর পড়াশুনা করতে চায়নি।আর আপনিই তো বলছেন,মেয়েকে আবার বিয়ে দিবেন,তাহলে দ্বিতীয় বিয়ের চেয়ে,আমাদের সমঝোতা কি সঠিক পথ নয়?

বাবা: যাই বলুন না কেনো,আমি আমার মেয়ে কে আর ওই বাড়ীতে পাঠাবো না।কালকে ডিভোর্সের পর,আপনারা আপনাদের মেয়েকে নিয়ে চলে যাবেন,আমাদের মেয়ে আমাদের কাছেই থাকবে।

বড়ো ভাশুর:তাহলে ফারিয়া কে দিবেন না?

বাবা: না।

শ্বশুর: ঠিক আছে।তাহলে কালকে আমার নাতনি কে আমরা নিয়ে যাবো।

এই বলে তারা চলে গেলেন।ওনাদের কথকপোন শুনে,আমার বুকের ভিতর সব চুরমার হয়ে যাচ্ছিলো।রাইমা কে বুকে জড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলাম।বাবা কেনো এমন করছে আমি বুঝতে পারছিনা,যেখানে আসল দোষ টা তার মেয়ের।

*******
নাহ্,ঘুমাতে পারছি না,খুব কষ্ট হচ্ছে।বুকের ভিতরটা ভেঙে চুরে,চুরমার হয়ে যাচ্ছে।যতবার মেয়ের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকাচ্ছি,ততবারই কলিজা ছেদ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হচ্ছে। কি করবো ভেবে পাচ্ছিনা।আমি সব পারলেও,রাইমা কে ছাড়া থাকতে পারবোনা।খুব কষ্ট হচ্ছে,ইচ্ছে করছে জীবন বিসর্জন দিয়ে দেই।এই রাতের অন্ধকারে যখন সবাই ঘুমাচ্ছে,আমি তখন অঝোরে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছি।একবার ভাবলাম,সত্যি সত্যিই আত্মহত্যা করে ফেলি, কারন মেয়েকে ছাড়া বাঁচার চেয়ে,আমার জন্য মৃত্যুই শ্রেয়। কিন্তূ পারলাম না,আত্মহত্যা করার সাহস আমার হলো না।মনের যত কষ্ট,অস্থিরতা সব যেনো গলার মধ্যে এসে আটকে গেছে,কেমন যেনো গলা শুকিয়ে,বুকের ভিতর চিন চিন করছে।নিঃশ্বাস যেনো বন্ধ হয়ে আসছে।কোনো কিছুতেই শান্তি না পেয়ে,অজু করে নামাজে দাড়ালাম। কারন আমাকে যদি কেও এই কষ্ট থেকে বের করতে পারে,সেটা একমাত্র আমার আল্লাহ।
নামাজ শেষে মোনাজাত ধরে অনেক কান্নাকাটি করে,একটা দুআ ই করলাম।
হে আল্লাহ!আপনি তো সব কিছু জানেন,এবং বুঝেন। দয়া করে আমার স্বামী এবং আমার সংসার আমাকে ফিরিয়ে দিন।আমি যেনো আবার স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে সংসার করতে পারি,সেই তৌফিক দান করুন।আমাকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করুন।হে আল্লাহ!আর কেও না জানুক,আপনি তো জানেন আমার মনের ভিতর কি চলছে,আপনি ছাড়া এই কষ্ট থেকে আমাকে আর কেও মুক্তি দিতে পারবে না। দয়া করুন,আল্লাহ দয়া করুন।এইসব বলে যখন অঝোরে কাঁদছিলাম,মেয়েটা এসে পাশে বসলো। আমাকে এসে জিজ্ঞেস করলো
– কি হয়েছে মা,কান্না করছো কেনো?নানু কি তোমাকে মেরেছে?
– আমি চোখের পানি মুছতে মুছতে মাথা নাড়িয়ে না জানালাম।
– তাহলে কি বাবার কথা মনে পরছে?
– তুমি ঘুম থেকে উঠে পরেছো কেনো বাবু?
– তোমাকে পাশে না পেয়ে আমার ভয় লাগছিলো,তাই এখানে এসে পরেছি।
– চলো বাবু এখন আমরা ঘুমাবো।
– আচ্ছা মা,বাবা কবে আসবে?
– আর আসবেনা মা,তুমি কালকে তোমার বাবার কাছে চলে যাবে।
– তুমি যাবেনা?
– না।
– তাহলে আমিও যাবো না।তোমাকে ছাড়া আমি একা একা থাকতে পারবো না।মা চলোনা আমরা বাবার কাছে চলে যাই।
– না মা,তোমার নানা,নানু যেতে দিবে না।
– তাহলে চলো মা,আমরা এখন পালিয়ে যাই,তাহলে ওরা আমাদের কে দেখতে পাবেনা।
মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে,আমি আবারও জোরে জোরে কাঁদতে লাগলাম।

মেয়ের মাথায় বিলি কাটছিলাম আর কাঁদছিলাম।এমন সময় ফোন টা বেজে উঠলো।মোবাইলটা হাতে নিতেই দেখলাম,রিহানের ফোন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম,রাত তিনটা বাজে। এতো রাতে রিহানের ফোন তাও আজ তেরোদিন পরে।আমি দেরি না করে, সাথে সাথে ফোন রিসিভ করলাম
– হ্যালো রিহান!কেমন আছো?
– যেমন থাকার কথা ছিলো।
– রিহান,তুমি আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও,আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবোনা। আমি জানি আমার উপর তোমার রাগ হয়েছে,রাগ হওয়ার ই কথা,তার জন্য তুমি আমাকে ইচ্ছে মতো বকো, মারো কিন্তূ এভাবে আমার হাত ছেড়ে দিয়োনা প্লিজ।

– কেনো তোমরা আমার সাথে এমন করলে?তুমি জানো আমার আসল কষ্টটা কোথায়?আমার আসল কষ্ট হলো,তোমরা দুজনেই আমার ভালোবাসার মানুষ।আরিফ,যে আমার সব চেয়ে ভালো বন্ধু। যার সাথে ছোটো থেকে একসাথে বড়ো হয়েছি,শৈশব,কিশোর বয়স আমরা একসাথে কাটিয়েছি।এক স্কুলে পড়েছি,কলেজ লাইফটাও একসাথে কাটিয়েছি। আরিফ শুধু আমার বন্ধু নয়,প্রাণের বন্ধু।সেই বন্ধুর থেকে আমি এমন টা আশা করিনি।ওর তোমাকে পছন্দ ছিলো সেটা আমাকে বলতে পারতো,আমি হেল্প করতাম। কিন্তূ আরিফ তা না করে,ওর প্রেমিকা কে আমার বৌ হিসেবে পছন্দ করলো।কেনো,এটা করার কি দরকার ছিলো?
– আমি চুপ করে শুধু রিহানের কথা শুনছিলাম আর কেঁদে যাচ্ছিলাম।
– আমি তো তোমাকে না দেখেই বিয়ের জন্যে রাজি হয়েছিলাম,শুধু মাত্র আরিফের কথায়।ও বলেছিলো,তুমি অনেক সুন্দরী,পড়াশুনায় ভালো,আরো অনেক কিছু।ওর কথা শুনে আমি তোমাকে দেখার প্রয়োজনও মনে করিনি।আমার পরিবারের ও তোমাকে পছন্দ হয়েছে তাই আপত্তিও করিনি।একজন বন্ধু কে কতোটা বিশ্বাস করলে,তার কথায় বিয়ের জন্য মেয়ে না দেখেই রাজি হতে পারে,তুমি বুঝতে পারছো?
– আরিফের করা কার্যকলাপের দায়ভার কি আমার?
– না,আমি সেটা বলছিনা কিন্তূ তুমিও এই নাটকে অংশগ্রহণ করেছিলে।তোমাকে আরিফ বলেছিলো,তোমার এখানে বিয়ে হলে তোমাদের দেখাদেখি চলবে, মানে বিয়ের পর ও তোমাদের প্রেমের সম্পর্ক থেকেই যাবে।আমাকে ঢাল বানিয়ে তোমরা তোমাদের প্রেম চালিয়ে যাবে,এটাই তোমাদের উদ্দেশ্য ছিলো।
তুমি আরিফের সাথে সম্পর্ক চালিয়ে যাওয়ার নেশায়, আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলে।আর আমার সাথে বিয়ের আগে এমন অভিনয় করলে যে,আমিই তোমার জীবনের প্রথম প্রেম।আর আমিও বোকার মতো আমাদের বিয়েটা কে,এক রকম প্রেমের বিয়ে ভেবে নিলাম।
– রিহান আমাকে মাফ করে দাও।
– তোমরা কেনো এই নোংরা খেলাটা আমার সাথে খেললে?কি ভেবে ছিলে,দুই নৌকায় পা দিয়ে চলবে?
– না রিহান,তুমি আমাকে ভুল বুঝছো।তুমি সব কিছু যতোটা নোংরা ভাবে দেখছো,ব্যাপারটা এতোটাও নোংরা ছিলো না।

– আমার ঘরে থেকে আমার বৌ তার প্রাক্তন এর সাথে সম্পর্ক চালিয়ে যাবে,এটা আমি স্বামী হয়ে কিভাবে মেনে নিবো বলতে পারো?
– রিহান একটু মাথা ঠাণ্ডা করে আমার কথাটা শুনবে?
– তোমার আর কি বলার আছে,নিজের নোংরামি লুকাতে আর কতো মিথ্যে বলবে?
বিয়ের রাতে পালিয়ে যাওয়ার প্ল্যান,আজীবন প্রেমিকের সাথে প্রেম চালিয়ে যাওয়ার প্ল্যান,আর কি কি প্ল্যান ছিলো তোমাদের একটু বলবে?আর এখনও যে তোমাদের সম্পর্ক নেই,এটা আমি কিভাবে বিশ্বাস করবো।
– না রিহান,আরিফের সাথে বর্তমান আমার কোনো সম্পর্ক নেই।সব কিছু সেই ছয় বছর আগেই শেষ হয়ে গেছে
– কেনো নেই? যার জন্য এতো কিছু করলে,তার সাথে এখন কোনো রকম সম্পর্ক নেই,এটা বললেই কি মেনে নেওয়া যায়?
– তুমি মেনে না নিলেও এটাই সত্যি।
– তুমি কেনো আমার রাতের ঘুম কেড়ে নিলে? কেনো ভালোবাসার প্রতিদান হিসেবে,অসহ্য কষ্টকর একটা জীবন উপহার দিলে।তুমি জানো,আমি এখন রাতে ঘুমাতে পারিনা।ঠিক মতো খেতে পারিনা।যেই মানুষটা কখনো সিগারেট হাতে নিয়ে দেখিনি,সেই মানুষটাই এখন গাঁজা খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করি।অনেকেই বলে,গাঁজা খেলে মরার মতো ঘুম হয় কিন্তূ কই,আমার তো তাও ঘুম হয়না।
– রিহান প্লিজ তুমি এইসব নেশা করে নিজের জীবন ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়োনা।
– ধ্বংস তো আমি হয়েই গেছি তোমার প্রেমে!আমরা কতো সুখী ছিলাম তাইনা?সারাদিন কাজ শেষে,বাসায় এসে যখন,তোমার হাসি মুখটা দেখতাম,নিজেকে পৃথিবীর সব চেয়ে সুখী মানুষ মনে হতো।মেয়েকে যখন বুকে জড়িয়ে ধরতাম,মনে হতো এর চাইতে বড়ো সুখ দুনিয়াতে আর কিছুই হতে পারেনা।তখন তোমার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতো,মনে হতো এই সুখ আমি তোমার কাছ থেকেই পেয়েছি।নিজেকে একজন সার্থক পুরুষ মনে হতো, কিন্তূ বুঝতে পারিনি যে আমি যাকে এতোটা ভালোবাসি, সে আমাকে কখনো ভালোই বাসেনি।
– না রিহান তুমি ভুল,আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।
– কেনো মিথ্যে বলছো,এখন আর মিথ্যে বলতে হবেনা,আমার কাছে এখন সবটা জলের মতো পরিষ্কার।কেনো করলে তুমি এমন?

– রিহান,প্লিজ একটু বুঝার চেষ্টা করো,ওইগুলো অতীত।আমি যখন পালাতে চেয়ে ছিলাম,তখন তুমি আমার জীবনে ছিলে না আর যখন তুমি আমার জীবনে এসেছো,আরিফ পালাতে চাওয়া সত্বেও আমি কিন্তূ পালিয়ে যাইনি।
– পালিয়ে না গিয়েও যখন দুজনে কাছাকাছি থাকতে পারছো,তাই পালানোর প্রয়োজন মনে করো নি।
– না রিহান,আমি তোমার সাথে সুন্দর ভাবে,নতুন করে বাঁচতে চাওয়ার আশায় পালাইনি।আমি চেয়েছিলাম সব কিছু ভুলে,তোমার সাথে বাঁচতে,তোমার সাথে সুখে সংসার করতে এবং তাই করছিলাম। কিন্তূ হঠাৎ সবকিছু কেমন উলোট পালোট হয়ে গেলো।
– ফারিয়া সত্যি কখনো লুকানো থাকেনা,আর এমন সত্য গুলো তো একদম ই না।যাইহোক আর কথা বাড়িয়ে কি লাভ,কালকে আমরা চিরজীবনের জন্য আলাদা হয়েই যাচ্ছি যখন।
– রিহান আমি তোমার থেকে আলাদা হতে চাইনা।
– আমিও চাইনা।আলাদা হয়ে হয়তো তুমি,আমি এক সময় সব ভুলে নতুন ভাবে সব কিছু শুরু করতে পারবো। কিন্তূ আমার মেয়েটা?ওর জীবন থেকে কখনো অন্ধকার সরবে না।সবাই ও কে ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে বলে গালি দিবে।ভালো একটা বিয়ে দিতে চাইলেও পারবোনা।মেয়ের কথা ভেবে অনেক কষ্ট হচ্ছে।

– আর আমার কথা?আমাকে ছাড়তে কি তোমার একটুও কষ্ট হচ্ছেনা?
– ফারিয়া,তোমার ভালোবাসাটা মিথ্যে থাকলেও,আমার ভালোবাসায় কিন্তূ কোনো খাদ ছিলো না।আমি কিন্তূ তোমাকে সত্যিই ভালোবেসে ছিলাম,এখনও ভালোবাসি। কিন্তূ তুমি তো আমাকে কখনোই মন থেকে ভালবাসনি।
– রিহান আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসি,একদম মন থেকে ভালোবাসি।
– যদি ভালোই বাসতে,তাহলে সকালে যখন বাবা,আর বড়ো ভাইদের পাঠিয়েছিলাম,তখন তুমি ওদের সাথে চলে আসতে।
– বাবা আমাকে যেতে দেয়নি।
– ওইতো বললাম না,ভালোবাসা থাকলে ঠিকই চলে আসতে।
– বাবা আর বড়ো ভাইকে তুমি পাঠিয়েছিলে?
– তাহলে তোমার কি মনে হয়,আমার কথা ছাড়াই তারা তোমাকে আনতে গেছেন?
– রিহান আমরা কি পারিনা,সব কিছু ভুলে নতুন ভাবে জীবন টা শুরু করতে?
– রিহান চুপ করে আছে।
– দেখো আমরা এ কয়েকদিন আলাদা থেকে বুঝতে পেরেছি,আমরা একজন আরেকজনকে কতোটা ভালোবাসি।আমরা যে কেউ কাউকে ছাড়া ভালো থাকতে পারবেনা,এটা বুঝে গেছি। এতো ভালোবাসার পরেও আমরা কেনো,আলাদা হতে চাইছি?
– আমি বা আমার পরিবার তো এমনটা চাইনি,আলাদা হওয়ার ডিসিশন টা তোমাদের ই।

– আমাদের বলতে,আমার নয়,শুধু বাবার ডিসিশন এটা।
– তোমার বাবা নিজের মেয়ের সংসার টা কেনো ভাঙতে চাইছেন?
– দেখো রিহান,বাবা এমন করার পেছনে যথেষ্ট কারন আছে।
– মেজো ভাবি তোমাকে চর মেরেছে,তার জন্যই তো তাইনা?
– না শুধু তার জন্য না।বাবার আসল রাগ হলো তোমার উপর।তুমি তোমার বাড়ীর মানুষ কে বলেছো,আমাকে যেনো ওই বাড়ীতে জায়গা না দেয়।আর তোমার ভাবি আমাকে ঘরে ঢুকতে বাধা দেয় এবং গায়ে হাত তুলে,অবশ্য আমিও সেদিন তার সাথে অনেক তর্ক করেছিলাম। কিন্তূ তাই বলে সে আমার গায়ে হাত তুলতে পারেনা।এই ঘটনা যখন আপু তোমাকে বললো,তুমি প্রতিবাদ না করে, উল্টা বলেছো,তোমার ভাবি হওয়ার অধিকারে সে আমার সাথে এমনটা করেছে।বাবার আসল রাগটাই হলো এখানে।
– হ্যা,আমি বলেছিলাম।যেদিন তুমি ঢাকা থেকে তোমার বাবার সাথে বাড়ি গেলে,আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাদের বাড়ীতে গিয়ে উঠবে,আর সেদিন আমার তোমার উপর অনেক রাগ ছিলো।ওই ঘটনা জানার পর থেকে নিজেকে সামলানোর কঠিন হয়ে পরছিলো।তাই মা কে ফোন করে জাস্ট এটাই বলেছিলাম যে,ফারিয়া যেনো আমাদের বাড়িতে না উঠে।তারপর মা আমাকে অনেকবার কারন জিজ্ঞেস করার পর ও,আমি কিছু বলিনি।
– তুমি না বললে তারা ব্যাপারটা জানলো কিভাবে?
– মেজো ভাবি নাকি বলেছে।
– তোমার মেজো ভাবি জানলো কিভাবে?
– আমি কি জানি,আমি তো ভেবেছি তোমরাই বলেছো।
– না রিহান আমরা কেউ বলিনি,আর উনার কাছে আমরা এটা কেনো বলতে যাবো?আসলে উনি আগের থেকেই সব জানতেন।
– আগের থেকেই জানে বলতে?
– আরিফের ওই চিঠিটা আমার হাতে পাইনি কখনো, ওইটা তোমার ভাবির কাছেই ছিলো।
– তার হাতে গেলো কিভাবে?
– সেটা আমি জানিনা।
– তাহলে মেজো ভাবি এতোদিন কেনো আমার কাছ থেকে লুকালেন,যেখানে তার সব কিছু বলার ই ছিলো।
– সেটা তাকেই জিজ্ঞেস করে জেনে নিও।
– তাহলে কি তোমার সেদিন রাতে তোমার আরিফের সাথে দেখা হয়নি?
– দেখা হয়েছিলো,আর সেদিন ই আমি আরিফের সাথে সব কিছু শেষ করে দিয়ে এসেছিলাম,শুধু তোমার সাথে সংসার করার জন্য।
রিহান প্লিজ বুঝতে চেষ্টা করো,আরিফ শুধু আমার একটা অতীত।তুমি ওই অতীত কে টেনে বর্তমান টা নষ্ট করোনা প্লিজ।
– আমার মেয়ে কেমন আছে?
– তোমাকে খুব মিস করে।
– আমিও ও কে খুব মিস করি।
– আর আমাকে?
– জানিনা।
দুজনেই কাঁদতে ‌লাগলাম।এক সময় ফোনটা কেটে গেলো,মনে হয় ব্যালেন্স শেষ।

ভাবতে লাগলাম কি করা যায়।আজকে কোর্টে রিহান আর আমার ডিভোর্স হওয়ার কথা।কালকে রাতে রিহানের সাথে কথা বলার পর অনেক টা হালকা লাগছে।ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মেয়ের বলা রাতের কথাটা মনে পড়ে গেলো।রাতে মেয়ে বলেছিলো,চলো মা আমরা এখান থেকে পালিয়ে যাই।এখন আমারও মনে হচ্ছে এখান থেকে পালানো উচিৎ,তাহলেই রিহান আর আমার ডিভোর্স টা থামাতে পারবো।আমি মায়ের আলমারি খুলে,পাঁচ শত টাকা নিলাম,মেয়ে কে ঘুম থেকে ডেকে তুলে,পরনে যা ছিলো তা পরেই রওনা হলাম,ঢাকার উদ্দেশ্যে।কাউকে না বলে,পালিয়ে যাচ্ছি নিজের সংসার বাঁচাতে…

চলবে…
সালমা আক্তার

পরিণতি
পর্ব – ৯

দশ মিনিটের পথ হেঁটে গিয়ে,একটা অটো তে উঠলাম।খুব দ্রুত পায়ে হাঁটছি,যদি কেউ দেখে ফেলে,তাহলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।হাতে থাকা ফোনটা অফ করে ফেললাম।একবার মনে হলো,রিহান কে ফোন দেই,আবার ভাবলাম,এখন ফোন দিলে হয়তো রিহান ঢাকা যেতে নিষেধ করতে পারে,এই ভয়ে আর ফোন দিলাম না।
বাস স্টেশনে নেমে,আগে এনা কাউন্টারে গিয়ে,টিকিট কেটে নিলাম।তারপর মেয়ে কে নিয়ে জানালার পাশের সিট টা তে বসে পরলাম। কিছুক্ষন পর আমার পাশের সিটে একজন বয়স্ক মহিলা এসে বসলেন,আমি খালি সিট থেকে মেয়েকে কোলে নিয়ে তাকে বসতে দিলাম।।প্রায় আট মিনিট পর বাস ছাড়লো। বাসের দেয়ালে টাঙানো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম,দশটা বাজে।সকালে খাওয়া হয়নি,মেয়ের খাওয়ার সময় পার হয়ে যাচ্ছে,প্রতিদিন নয়টার মধ্যে ওর নাস্তা কমপ্লিট হয়ে যায়,আজ একটু দেরি হয়ে গেলো।রাইমা কে জিজ্ঞেস করলাম
– ক্ষুধা লেগেছে বাবু?
– হ্যা আম্মু,অনেক ক্ষুধা লেগেছে।
– রাইমার মুখে কথাটা শুনে,নিজেকে বড় অপরাধী মনে হচ্ছে।আমার আগেই মেয়েকে খাইয়ে তারপর বাসে উঠা উচিৎ ছিলো,তাড়াহুড়ায় কিভাবে আমি ছোট্ট বাচ্চার ক্ষিধের কথাটা ভুলে গেলাম।রাইমার ক্ষুধার কষ্টটা আমার কলিজায় গিয়ে আঘাত করছে।জানালা দিয়ে বাইরে খাবারের খোঁজে তাকিয়ে ছিলাম,চোখের সামনে চিপস ওয়ালা কে দেখে,মেয়েকে চিপস কিনে খাইয়ে দিলাম।যদিও এতে পেট ভরার কথা না,তবুও কিছুটা হলেও তো ক্ষিধে নিবারণ হবে।

দুপুর একটা বাজে।গাড়িটা রাস্তার এক সাইডে ব্রেক করলেন।আমি হেল্পার কে জিজ্ঞেস করলাম
– কি হয়েছে,আমরা কি ঢাকায় পৌচে গেছি?
– আরেহ না আপা, লাঞ্চের ব্রেক দেওয়া হয়েছে।
– ওহ।কতক্ষনের জন্য এই ব্রেক?
– পনেরো, বিশ মিনিটের মতো।আপনাদের যদি খাবার বা বাথরুমে যাওয়ার প্রয়োজন থাকে,তাহলে তাড়াতাড়ি শেষ করে গাড়িতে এসে বসবেন।যদি লেট করেন পরে কিন্তূ গাড়ি ছেড়ে দিবে।
– ঠিক আছে।
বাস থেকে নেমে রাইমা কে একটা হোটেলের সামনে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম
– কি খাবে বাবু?
– ভাত খাবো আম্মু,খুব ক্ষুধা লেগেছে।
খেতে বসে দেখলাম,টেবিলের পাশে দেয়ালে খাবারের মেনু চার্ট ঝুলানো। ওইখানে সব কিছুর দাম দেওয়া আছে।আমি দেখে দেখে সব চেয়ে কম দামের যেই খাবারটা,সেটাই বেছে নিলাম।ডিম ভুনা আর এক প্লেট ভাত অর্ডার করলাম।রাইমা খাচ্ছে আর আমাকে জিজ্ঞেস করছে
– আম্মু তুমি খাবেনা?
– না মা,তুমি খাও আমার ক্ষুধা নেই।
ছোট্ট মেয়েটা আমার কথা বিশ্বাস করে,চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে।
আমার যে একদম ক্ষুধা লাগেনি,এটা মিথ্যে।কয়েকদিন দিন ধরে, পেটে ক্ষুধা থাকলেও কেনো জানি খেতে পারিনা,আর আজকে টাকাও কম।সব কিছু মাথায় রেখেই পেটে ক্ষুধা থাকা সত্বেও খাচ্ছিনা। অটো আর বাস ভাড়া চলে গেছে, সাড়ে তিনশো টাকার মতো,খাবারের বিল,আর তখন চিপস কিনতে চল্লিশ টাকার মতো লেগেছে। হাতে আছে আর একশো,দশ টাকার মতো।এখন যদি আমি খেতে যাই,তাহলে বাসা পর্যন্ত যাওয়ার ভাড়া থাকবেনা।তাই না খেয়েই আবার বাসে উঠার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম কিন্তূ বাস পর্যন্ত যাওয়ার সৌভাগ্য আর হলোনা।মাথাটা কেমন যেনো করে উঠলো,শরীরটা অবশ হয়ে আসলো।তারপর আর কিছু জানিনা।

কিছুক্ষন পর নিজেকে রাস্তায় অনেক মানুষের ভিড়ে আবিষ্কার করলাম।চোখ খুলতেই দেখি,মেয়েটা আমার পাশে বসে কাঁদছে।আমি বুঝতে পারলাম,আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম।পাশের সিটে থাকা বয়স্ক মহিলা টা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন
– এখন কেমন লাগছে?
– ভালো।
– চলো তাহলে বাসে গিয়ে বসি।এতক্ষনে বাস ছেড়ে দিতো,তোমার কারনেই এখনও ছাড়েনি।
আমি উঠার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তূ শরীরে একটুও জোর পাচ্ছিলাম না।সবাই আমাকে ধরাধরি করে বাসে উঠালেন।
– হেল্পার ফ্যান ছেড়ে দিয়ে বললেন
– আপু আপনার কি হয়েছিলো,ওভাবে মাথা ঘুরিয়ে পরে গেলেন কিভাবে?
– আমি তার প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে,চোখ বন্ধ করে চুপচাপ সিটে মাথা এলিয়ে শুয়ে রইলাম।মনে মনে ভাবছিলাম,কেনো হঠাৎ এমন হলো।অবশ্য রিহানের সাথে গন্ডগোল হওয়ার পর থেকেই,আমার খাওয়ার কোনো ঠিক নেই।তাই হয়তো প্রেসার লো হয়ে গেছে।জানালার ঠান্ডা বাতাসে এখন একটু ভালো লাগছে।জানালা দিয়ে যখন বাইরের দৃশ্য দেখছিলাম,পাশে থাকা বয়স্ক ভদ্র মহিলাটা জিজ্ঞেস করলেন
– তুমি কি সন্তান সম্ভবা?
– তার এমন কথায় আমি অবাক না হয়ে পারলাম না।কিছুক্ষন চুপ থাকার পর বললাম,কেনো?
– তোমার চোখ দেখে মনে হলো,তাই জিজ্ঞেস করলাম।
– কেউ সন্তান সম্ভবা থাকলে,আপনি চোখ দেখেই বলে দিতে পারেন?
– সব সময় চোখ দেখে বললে যে ঠিক হবে এমনটা নয়,তোমার মাথা ঘুরিয়ে পরে যাওয়া,চোখ গুলো সাদা ঝাপসা দেখাচ্ছে তাই আর কি।
– আমি মনে মনে ভাবছিলাম,মহিলার কথা ঠিক ও হতে পারে। এতো ঝামেলার মধ্যে থেকে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে,আমি ডেট মিস করেছি। ডেট মিস করলেই যে,প্রেগনেন্ট হতে হবে এমনটাও নয়, কারন মাঝে মাঝেই এমন হয়।তারপরও সিওর না হলেও,সম্ভাবনা তো থেকেই যায়।আমি মহিলা কে জিজ্ঞেস করলাম
– আপনি কি কবিরাজ?
– হাহাহা,এসব জানার জন্য কবিরাজ হওয়া লাগেনা,বয়সের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারি।
– তাহলে কি আপনার ফ্যামিলির কেও ডাক্তার?
– না,তবে অনেকদিন ব্র্যাকের স্বাস্থ্যকর্মীদের সাথে,মাঠ কর্মী হিসেবে কাজ করেছি।অনেক গর্ভবতীদের চেকআপ করতাম।আমাদের ট্রেনিং হতো,সেখানে বলে দেওয়া হতো,প্রাথমিক ভাবে নারীকে দেখে গর্ভবতীদের চিহ্নিত করার উপায়।
– ওহ।আপনার কি আমাকে দেখে গর্ভবতী মনে হচ্ছে?
– সিওর বলতে পারবো না,তবে মনে হচ্ছে।আর তুমি কনসিভ করেছো কি না,সেটা আমার থেকে তুমিই ভালো বলতে পারবে।
– আপনি কোথায় নামবেন?
– এইতো গাজীপুরে।তুমি?
– মহাখালীতে।
– ও।
কিছুক্ষন পর মহিলা বাস থেকে নেমে গেলেন।

সব কিছু কেমন যেনো লাগছে।কখনো এভাবে বাড়ী থেকে পালাবো, কল্পনাও করিনি।ঢাকা শহর ও আমার বেশিদিনের চেনা নয়,একরকম অচেনা পথেই পাড়ি দিচ্ছি।আজ পর্যন্ত একা কোথাও যাইনি,আজ একা একা কতো দূরের পথে জার্নি করছি।আবারও সিটে মাথা এলিয়ে শুয়ে রইলাম,কখন যে ঘুমিয়ে পরেছিলাম বুঝিনি। হেল্পারের ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো।
– আপা কই নামবেন?
– মহাখালী বাস স্টেশন।
হেল্পার আর কিছু না বলে,গেটের সামনে গিয়ে বলতে লাগলো
– এই মহাখালী কাচা বাজার,নামেন,নামেন।
বাস থেকে সব মানুষ নেমে গেলেন।আমিও সবার দেখাদেখি নেমে যাচ্ছিলাম, হেল্পার আমাকে নেমে যেতে দেখে বললেন
– কি গো আপু,আপনি না স্টেশনে নামবেন?
– কিন্তূ সবাই যে এখানেই নেমে যাচ্ছে?
– সবার গন্তব্য এই পর্যন্ত তাই নেমে যাচ্ছে,আপনি এই সামনের সিট টা তে বসুন,আমি আপনাকে স্টেশন পর্যন্ত নামিয়ে দিবো।
– হেল্পারের কথায় থেমে গেলেও,মনে মনে খুব ভয় পাচ্ছিলাম। বাসে আর কোনো যাত্রী নেই।দুই জন হেল্পার আর একজন ড্রাইভার ছাড়া আর কাউকেই দেখতে পাচ্ছিনা।ভয়ে কেমন যেনো গায়ে কাটা দিয়ে উঠছিলো,আজকাল যা চলছে,কাউকে বিশ্বাস করা যায়না।কিছুক্ষন পর, হেল্পার ছেলেটা জিজ্ঞেস করলো
– আপু আপনার বাড়ী কই?
– কিশোরগঞ্জ।
– ওহ,আমার বাড়ী ময়মনসিংহ সদরে।
এই হেল্পারের সাথে কথা বলতে বিরক্ত লাগছে,একটা ভয় ও কাজ করছে মনে।

ছেলেটা একটু পর পর আর চোখে আমাকে দেখছে,অনেক্ষন পর নিরবতা ভেঙে জিজ্ঞেস করলো
– আপু আপনি কি কোনো কারনে ভয় পাচ্ছেন?
– আমি ছেলেটার প্রশ্ন এড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম,আর কতক্ষন লাগবে পৌচতে?
– এইতো আপু আর পনেরো, বিশ মিনিট।
– ওহ।
– আপু জানেন,আপনার মতোই দেখতে আমার একজন বোন আছে।ছবি‌ দেখবেন?এই বলে ছেলেটা মোবাইল ঘেটে,তার বোনের দুই টা ছবি আমাকে দেখালেন।
– আমি ছবি গুলো দেখে, জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম,আপনার বোন অনেক সুন্দর দেখতে।
– আমার বোনের একজন মেয়েও আছে,আপনার মেয়ের মতোই।আপনার মেয়ের নাম কি?
– রাইমা।
– আমার ভাগ্নির নাম শিল্পী।আমার নামের সাথে মিলিয়েই নাম রেখেছে।আমার নাম সিহাব।
– ছেলেটা কে দেখে অনেক ভদ্র মনে হচ্ছে,কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে শিক্ষিত ও হবে, বাট শিক্ষিত মানুষ কি বাসের হেল্পার গিরি করে?
– ছেলেটার ব্যাপারে একটু জানার আগ্রহ হলো।জিজ্ঞেস করলাম,আপনি কি পড়াশুনা করেন?
– হ্যা আপু। ডিগ্রীতে পড়ছি।
– ডিগ্রীতে পড়ে,বাসের হেলপারি করছেন?
– কি করবো আপু,অভাবের সংসার।বাবা খরচ দিতে পারেন না,তাই নিজেরটা নিজেই জোগাড় করে নেই।লেখাপড়াও চালাই, বাড়ীতেও কিছু টাকা পাঠাতে পারি।
ছেলেটার, মানে সিহাবের এমন কথা শুনে ওর প্রতি আলাদা একটা শ্রদ্ধাবোধ জেগে উঠলো।

বাস স্টেশনে এসে থেমে গেলো,আমি বাস থেকে নেমে যাচ্ছিলাম, সিহাব বললো
– আপু যেতে পারবেন নাকি গাড়িতে তুলে দিয়ে আসবো?
– না যেতে পারবো।আপনি শুধু একটু বলে দিন,কোথায় গিয়ে গাবতলীর বাসে উঠতে হয়?
– বাসে কেন আপু?আপনার শরীর তো এমনেই খারাপ,সি এন জি তে আরাম করে চলে যান।এই বলে সিহাব এক সি এন জি ড্রাইভার কে বললেন
– ভাই উনাকে একটু গাবতলী দিয়ে আসেন।
– আড়াইশো টাকা ভাড়া লাগবে।
– কি বলেন মিয়া? দুইশো টাকার ভাড়া,আড়াইশো চাইছেন!
– আমি সিহাবের কথার মাঝে সি এন জি ড্রাইভার কে বললাম,ভাই একশো দশ টাকায় যাবেন না?
– সিহাব বললো,আপু সত্যি কারের ভাড়া হলো দুইশো,একশো দশ টাকায় কিভাবে যাবে?
– এই জন্যই তো আমি বাসে যেতে চাচ্ছি,আমার কাছে একশো দশ টাকা ছাড়া আর কোনো টাকা নেই।
– সিহাব নির্বাক চোখে কিছুক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে রইলো,তারপর দৌড়ে ড্রাইভারের কাছে গিয়ে বললো
– ওস্তাদ আমাকে দুইশো টাকা দেন তো,রাতে বেতন থেকে কেটে রাইখেন।এইবলে সিহাব সিনজি ড্রাইভারের হাতে টাকাটা দিয়ে বললেন, ওনাকে ঠিক মতো পৌচে দিয়েন।
– আমি বললাম,আমার এটা লাগবেনা।
– আপু আমি আপনার ভাইয়ের মতো,ভাই হিসেবেই দিলাম।
– ঠিক আছে বাট একশো দিন,আর একশো আমার কাছে আছে।
– থাক,ওই টাকা দিয়ে আমার ভাগ্নি কে কিছু কিনে দিয়েন আপু।
– আপনার বিকাশ নাম্বার থাকলে দিন,আমি পরে একসময় আপনার টাকা টা ফেরত দিবো।
– বললাম তো আপু লাগবেনা,আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি কোনো ভদ্র ঘরের মেয়ে,অথবা বৌ হবেন।হয়তো কোনো কারনে আজকে আপনার হাত খালি,বিপদেই তো কাউকে সাহায্য করতে হয় তাইনা?
– আমি আপনার এই উপকার কখনোই ভুলবোনা।
– আপু আমি আজকে আপনাকে সাহায্য করেছি, কেউ হয়তো আমার বোনের বিপদেও এভাবে হাত বাড়িয়ে দিবে।ভালো থাকবেন আপু।
– আমি সিহাবের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম,এমন মানুষ ও আছে দুনিয়ায় জানা ছিলো না।আমি সত্যিই সিহাবের উপকার কখনো ভুলবোনা।

বাসায় এসে দেখি দরজায় তালা ঝুলছে।আমার কাছে তো চাবি নেই,খুলবো কি করে!গেটের সামনে দাড়িয়ে ফারহানা কে ডাকতে লাগলাম।আমার ডাক শুনে ফারহানা বাইরে বেরিয়ে আসলো।
– কি ব্যাপার আপনি এসে পড়লেন যে?
– হ্যা আসলাম।
– রিহান ভাই যে বললো,আপনি আর আসবেন না।
– রিহান আপনাকে এটা বলেছে?
– হ্যা,ওইদিন ওনাকে বারান্দায় বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে,রাইমার মা কবে আসবে।উনি বললেন,রাইমার মা আর আসবেনা।
– ও।
– আপনার সারা শরীর এমন কাদা মাটিতে মাখানো কেনো?
– আসলে রাস্তায় মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম।
– কি বলেন,তারপর?
– তারপর আর কি,অনেকেই মাথায় পানি দিয়ে হুশ করেছেন।আচ্ছা,আপনার কাছে কি রিহান চাবি দিয়ে গেছে বাসার?
– না তো।কেনো আপনার কাছে চাবি নেই?
– না।
– তাহলে তালা ভেঙে ফেলুন।দাড়ান আমি ভাঙ্গার ব্যাবস্থা করছি।
ফারহানা এসে তালা ভেঙে আমাকে ঘরে ঢুকতে সাহায্য করলেন।ফারহানা জিজ্ঞেস করলেন
– রাইমার মা,আপনি কিছু খেয়েছেন?
– আমি চুপ করে রইলাম।
– মনে হচ্ছে সারা রাস্তায় কিছু খাওয়া হয়নি,আমিও যখন বাড়ী থেকে ঢাকা আসি,কিছুই খেতে পারিনা।এই বলে ফারহানা আমার বাসা থেকে চলে গেলেন।আমি ঘরের সব জিনিস গুলো ছুয়ে দেখছিলাম।এই জিনিস গুলোর প্রতি কেমন যেনো একটা মায়া জন্মে গেছে। সবটা জিনিস নিজের পছন্দে,নিজের হাতে কেনা।রিহানের সাথে যদি ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়,এই জিনিস গুলোর সাথেও ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে।এই সংসার টা আর আমার থাকবেনা।

কিছুক্ষন পর ফারহানা ভাত আর মাছের তরকারি নিয়ে আসলেন।বললেন
– আগে মা আর মেয়ে খেয়ে নিন,পরে রেস্ট নিয়ে ঘরের কাজ করবেন।
– আপনার এইসব আনার কি দরকার ছিলো?
– দরকার আছে। এতো দূরের রাস্তা জার্নি করে এসে,এখন রান্না করবেন নাকি!
– থ্যাংকস।
– থ্যাংকস দিতে হবেনা,আপনারা খান আমি পরে আসবো।
– আচ্ছা।
আমি মেয়ে কে খাইয়ে দিয়ে যখন নিজে খেতে গেলাম,কষ্টে আমার কলিজা ফেটে যাচ্ছিলো।এই ঘরে এখন পর্যন্ত রাতের খাবার একা খাইনি,আজ ওই মানুষটা কই?
যেই মানুষটা ঘরে একটা ময়লা সহ্য করতে পারেনা,সেই মানুষটা পুরো ঘর টা কেমন এলোমেলো করে রেখেছে।রিহান তুমি কই,তোমাকে বড্ড মিস করছি।কান্নায় আমার চোখ মুখ ভিজে একাকার হয়ে গিয়েছে।
ঘরে ফারহানার আগমেনে,চোখের পানি লুকাতে চাইলাম কিন্তূ পারলাম না।
– কি হলো রাইমার মা,খাচ্ছেন না যে?
– আমি কোনো কথা না বলে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম।ফারহানা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে সান্তনা দিচ্ছিলো।কাদবেন না,যদি আপনাদের মাঝে কোনো প্রবলেম হয়ে থাকে,আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন,সব ঠিক হয়ে যাবে।
ফারহানা কে কিছু না বললেও,ঠিক ই বুঝে গেছে আমাদের মাঝে কোনো ঝামেলা হয়েছে।

মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে,মোবাইল টা অন করলাম।সারাদিন বন্ধ করে রেখেছিলাম ফোন।খোলার সাথে সাথেই মায়ের ফোন।আমি ভয় পাচ্ছিলাম,এভাবে না বলে চলে আসাতে মা আমাকে অনেক বকবে,আর টাকাও নিয়ে এসেছি মায়ের ব্যাগ থেকে,না বলে।চারবার রিং হওয়ার পর ফোন ধরলাম
মা কেঁদে কেঁদে বলতে লাগলো
– কি রে মা,কই চলে গেছিস?বলে যাসনি,মোবাইলটাও বন্ধ।সারাদিন কতবার ফোন দিয়েছি তোকে,আমার কি চিন্তা হয়না?
– চিন্তা করো না মা,আমি ঢাকায় চলে এসেছি।
– ঢাকায় কেনো, কার কাছে?
– রিহানের কাছে।
– কিন্তূ রিহান তো বাড়িতে এসেছে।
– রিহান বাড়ী গেছে?
– হ্যা,তোকে খুঁজে না পেয়ে,ওই বাড়ীতে ফোন দিয়েছিলাম,তখন জানতে পারলাম।
– আমি এটা জানতাম না।
– মা রে পাঁচশো টাকা দিয়ে কি তুই ঢাকা পর্যন্ত যেতে পেরেছিস?তোর বাবার কাছে শুনেছিলাম,বাসা পর্যন্ত যেতে নাকি ছয়শো টাকার মতো লাগে।
– আসতে পেরেছি মা,একজন আমাকে রাস্তায় হেল্প করেছে।
– ব্যাগ থেকে যখন টাকা নিয়েছিস,আর পাঁচশো নিলে কি কোনো সমস্যা হতো?
– আমি ভেবেছিলাম,তুমি আমাকে টাকার নেওয়ার কারনে বকবে।
– আমি কি শুধু তোকে বকি,ভালোবাসি না?
– ভালোবাসো মা,তুমি আমাকে অনেক ভালোবাসো।
– তাহলে কেনো এভাবে না বলে চলে গেলি?
– নিজের সংসার বাঁচাতে মা।বাবা আমার সংসার টা ভেঙ্গে দিতে চাইছে, কিন্তূ আমি সেটা জোড়া লাগাতে এসেছি।
– জোড়া লাগবে তো?
– চেষ্টা করে তো দেখতে পারি।
আচ্ছা মা এখন ফোন রাখো,আমি পরে তোমাকে ফোন দিবো।

মায়ের ফোন রাখতেই আপুর ফোন আসলো।

চলবে…
সালমা আক্তার

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে