পরিণতি পর্ব – ১১ + শেষ পর্ব।

0
1340

পরিণতি
পর্ব – ১১ + শেষ পর্ব।

রিহানের সাথে এক ছাদের নিচে আর থাকতে ইচ্ছে করছেনা,ওর এমন কথায় ঘৃণা হচ্ছে আমার।ভাবছি বাড়ী চলে যাই কিন্তূ বাড়িতে গেলেই কি আমি শান্তি পাবো!অনেক বড়ো মুখ করে বাড়ী থেকে পালিয়ে এসেছিলাম,এখন যদি ফেরত যাই মা, বাবার কাছে নিজেকে, রিহান কে ছোটো করা হবে।বাবা হয়তো‌ আমাকে বাড়ীতে উঠতেই দিবেন না,বাবা যে বর্তমান আমার উপর ভিশন ভাবে রেগে আছেন।কি করবো আমি, কোথায় যাবো?যদি নিজের একটা বাড়ী থাকতো,যদি নিজের একটা সঠিক ঠিকানা থাকতো,তাহলে এই যন্ত্রণার জীবন থেকে বেরিয়ে নিজের মতো করে একটু বাঁচতাম।কেনো আমাদের মেয়েদের একটা নিজস্ব বাড়ি হয়না?কেনো সারাজীবন অন্যের বাড়ীতে,অন্যের ভরসায় বাঁচতে হয়?কেনো বাবার রাগ,সমাজের ভয়, স্বামীর অবহেলা মুখ বুঝে সহ্য করে থাকতে হয়?
আজ যদি আমার নিজের মাথা গুজার একটা ঠাই থাকতো,তাহলে সত্যি বলছি সব ছেড়ে চলে যেতাম। কিন্তূ নেই,আমার কোনো নিজস্ব ঠিকানা নেই,তাই কোথাও যেতেও পারবোনা।রিহানের এতো অপমান লাঞ্ছনা বঞ্চনা সহ্য করেই সংসার করে যেতে হবে আমাকে।এছাড়া আর কিই বা করতে পারি আমি?

এই সব হলো আমার ভুলের শাস্তি, ভুল যখন করেছি তার মাশুল তো গুনতে হবেই।
রিহানের বলা কথা গুলো,বার বার ধারালো অস্ত্রের মতো বুকে আঘাত করছে।যতবার মনে পরছে,নিজেকে অনেক নিচু একজন মানুষ মনে হচ্ছ।আমি রিহানের মুখে এমন কিছু শুনবো কখনো আশা করিনি,অবশ্য রিহান ও আমার কাছে অন্য কিছুই আশা করেছিলো, কিন্তূ বিনিময়ে কষ্ট পেয়ে এখন আমাকে ওর কথার আঘাতে,আঘাত করতে চাইছে।যদিও রিহান ক্ষমা চেয়েছে, কিন্তূ রিহান কে ক্ষমা করতে পারলেও,যতদিন বেঁচে থাকবো ওর এই নোংরা কথাটা ভুলতে পারবোনা।মেনে নিলাম ওর সব অপমান।
সংসার বাঁচাতে নিরব শ্রোতার মতো,ওর কথাগুলো এক কান দিয়ে শুনে,অন্য কান দিয়ে বের করে দিলাম।রিহানের সব অপমান ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করবো।আপু তো বলেছিলো,সংসার বাঁচাতে হলে মেয়েদের অনেক কিছুই করতে হয়,আমিও না হয় সংসার বাঁচাতে রিহানের সব অপমান মেনে নিলাম।

******
সংসারটা কোনো মতো টিকে থাকলেও,সংসারে প্রাণ নেই বললেই চলে।খুব প্রয়োজন ছাড়া দুজনের মধ্যে কোনো কথা হয়না।রিহান সকালে অফিসে চলে যায়,রাতে আসে।আগে দুপুরে বাসায় আসতো,খাওয়া দাওয়া করে,রেস্ট নিয়ে পরে আবার অফিসে যেতো।ইদানিং দুপুরেও বাসায় আসেনা,রাতেও দেরি করে আসে।খেতে দিলে খায়না,বলে বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি।রিহান খায়না বলে সারাদিনে একবার রান্না করি,মেয়ে আর আমি খাই।মাঝে মাঝে রান্নার আলসেমিতে রাতে না খেয়েই ঘুমিয়ে যাই।আগে মন খারাপ হলে রিহানের সাথে বক বক করে মন ভালো করতাম,এখন মন খারাপ হলে ফারহানার কাছে গিয়ে কান্না করি।ফারহানা আমাকে খুব বুঝায়,আর বলে
– দেখবে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে,ধর্য ধরো।আর আমার কাছে এভাবে না‌ কেঁদে আল্লাহর কাছে কাঁদো।আমি তোমাকে শান্তনা ছাড়া কিছুই দিতে পারবো না, কিন্তূ আল্লাহ উনি সব ক্ষমতার মালিক।তার কাছে চাইলে তিনি তোমাকে অবশ্যই সাহায্য করবেন।
ফারহানার কথায় আমি সত্যিই আশ্বস্ত হতাম।এই বিপদের সময় যদি ফারহানা আমার পাশে না থাকতো তাহলে হয়তো আমি দম বন্ধ হয়ে মরেই যেতাম।সবসময় নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতাম।সারারাত ঘুম হতো না বলে,নামাজ পড়ে কাটাতাম।আর মনে একটা আশা নিয়ে থাকতাম,একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।

সকাল থেকেই শরীরটা কেমন খারাপ লাগছে,বিছানা থেকে উঠতে পারছিনা।মেয়ে বার বার কিছু খেতে চাইছে, কিন্তূ বিছানা থেকে উঠতে নিলেই মনে হয় মাথা ঘুরে পড়ে যাবো।তাও রাইমার ডাকে না উঠে পারছিনা।যেই বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম,মাথা ঘুরিয়ে অজ্ঞান হয়ে পরলাম।যখন চোখ খুললাম মাথার কাছে রিহান,ফারহানা,রাইমা আর ডাক্তার কে দেখতে পেলাম।ডাক্তার আমাকে বললেন
– আপনি মনে হয় ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করেন না,প্রেসার অনেক লো হয়ে গেছে।
– খাওয়ার জন্য না,এই বাচ্চাটা পেটে আসার পর থেকেই আমার মাথা ঘোরানো রোগ টা হয়েছে।
– বাচ্চা আসার জন্য এই সমস্যা হয়নি আসলে আপনার শরীর প্রচুর দুর্বল।এই সময় একটু বেশি বেশি খেতে হবে,অন্য সময়ের তুলনায় খাবার ও রেস্ট বেশি নিতে হবে,টেনশন করা যাবেনা। ঘুম কম হলে,টেনশন করলে প্রেসার বেড়ে যাবে,প্রেসার বেড়ে গেলে হাত পায়ে পানি আসে,যা গর্ভবতী মায়ের জন্য বিপদজনক।
আর আপনি তো দ্বিতীয় মা,এই ব্যাপারে তো আপনার যথেষ্ট জ্ঞান থাকার কথা।
– রিহান বললো,ডাক্তার ওষুধ কি আপনার কাছেই আছে,নাকি বাইরে থেকে কিনে আনতে হবে?
– কিছু ভিটামিন,ক্যাসিয়াম, আইরন লিখে দিয়েছি,ফার্মেসি থেকে এনে নিবেন।আর শুনুন,শুধু ওষুধ খেলেই হবেনা।তিন বেলা ভাত আর দুই বেলা পুষ্টিকর নাস্তা খেতে হবে।দুপুরের পর অন্তত দুই ঘণ্টা রেস্ট নিতে হবে।বাসায় কি আপনারা ছাড়া আর কেও থাকেনা?
– জী না।
– তাহলে তো স্বামী হিসেবে আপনাকেই এই দায়িত্ব নিতে হবে।এই সময় মায়েরা ঠিক মতো খেতে চায়না, কিন্তূ জোর করে খাওয়াতে হয়।যদি ঠিক মতো না খায়,ঠিক মতো পরিচর্যা না করে তাহলে মা এবং শিশু দুজনেই ঝুঁকির সম্মুখীন হবে।আপনি আপনার বাচ্চার কথা মাথায় রেখে,ওনার একটু যত্ন নিন।তারপর ডাক্তার চলে গেলেন,রিহান ও অফিসে চলে গেলেন।ফারহানা বললো
– তোমার জ্ঞান হারানো দেখে তো আমি ভয় ই পেয়ে গিয়েছিলাম,তাই রিহান ভাই কে ফোন দিয়েছি,পরে উনি ডাক্তার নিয়ে বাসায় এসেছেন।
– তুমি কিভাবে জানলে আমি জ্ঞান হারিয়েছি?
– তোমার মেয়ে চিৎকার করে কাঁদছিলো,ওর কান্না শুনেই আমি এসেছি।আচ্ছা এখন রেস্ট নাও,আমি পরে আসবো।
– আচ্ছা।

*****

কলিংবেল বাজতেই দরজা খুলে দেখলাম রিহান এসেছে।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম দশটা বাজে।আজ খুব তাড়াতাড়িই এসে পড়েছে।ঘরে ঢুকেই বলছে
– তাড়াতাড়ি ভাত দাও,ক্ষুধা লেগেছে।
– আমি ওর কথায় অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম।প্রায় তিনমাস পর রিহান আমার কাছে ভাত চাইছে।
– কি হলো হা করে তাকিয়ে না থেকে টেবিলে খাবার দাও,দুপুরেও কিছু খাইনি আজকে।
– আমি চুপ।
– কি হলো কথা বুঝতে পারোনি?ভাত দাও।
– কিন্তূ ভাত তো নেই।সেই সকালে রান্না করেছিলাম শেষ হয়ে গেছে।
– রাতে রান্না করো নাই?
– তুমি খাওনা বলে রান্না করিনা।
– এটা কোনো কথা হলো,আমি খাইনা বলে কি রান্না করবে না?রাইমা কি খেয়েছে রাতে?
– সকালের ভাত ছিলো খাইয়ে দিয়েছি।
– আর তুমি?
– আমিও।
– এভাবে অনিয়ম করে খাও বলেই তো অসুস্থ হয়ে পরেছো।
– আচ্ছা তুমি ফ্রেশ হও,আমি চুলায় ভাত বসিয়ে দিচ্ছি।
– থাক এতো রাতে আর রান্না করতে হবেনা
– কালকে থেকে রোজ তিনবার রান্না করবে,এখন থেকে আমি বাসাতেই খাবো।
এই বলে রিহান বাইরে চলে গেলো।দশ মিনিট পর চারটা ডিম সিদ্ধ, পাউরুটি আর কলা নিয়ে বাসায় ঢুকলো। আমাকে টেবিলে ডেকে নিয়ে গিয়ে দুই টা ডিম,একটা কলা আর পাউরুটি খেতে দিলো।আমি বললাম
– তুমি খাও,তোমার ক্ষিধে লেগেছে।
– শুধু আমি খেলেই হবে,তোমাকে খেতে হবেনা?
– আমি তো ভাত খেয়েছি।
– খেয়েছো তো কি হয়েছে,এখন আমার সামনে এগুলো খাও।
– আমি রিহান কে বার বার তাকিয়ে দেখছিলাম।
– কি হলো খাচ্ছো না কেনো?আচ্ছা ওয়েট আমি খাইয়ে দিচ্ছি।
রিহান আমাকে ডিম সিদ্ধ খাইয়ে দিচ্ছিলো,আর আমার চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে পানি পড়ে যাচ্ছে।রিহানের চোখেও পানি টলমল করছে।
– ডাক্তার কি বলেছে মনে আছে তো?কম পক্ষে দিনে পাঁচবার খেতে হবে।তিন বেলা ভাত আর দুই বেলা হালকা নাস্তা।
– হুম।
– শুধু হুম করলে হবেনা,সব নিয়ম পালন ও করতে হবে, সুস্থ থাকার জন্য,আমাদের বাচ্চার জন্য।

খাওয়ার পর সব কিছু গুছিয়ে,লাইট ফ্যান অফ্ করে প্রতিদিনের মতো রাইমার পাশে গিয়ে শুয়ে পরলাম।রিহান পাশে এসে বসলো।আমি জিজ্ঞেস করলাম ঘুমাবে না?
– ঘুম আসছে না।তোমার ঘুম না আসলে একটা কথা বলতাম।
– কি কথা?
– ফারিয়া আমি জানি একটা তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তোমাকে খুব বেশিই কষ্ট দিয়ে ফেলেছি,আমাকে কি মাফ করা যায়না?
– রিহান আমি সব কিছু অনেক আগেই ভুলে গেছি।
– তাহলে বলো,তুমি আমাকে ক্ষমা করেছো।
– রিহান তুমি তো কোনো ভুল করোনি
তাহলে তুমি মাফ চাইছো কেনো?
– আসলে ভুলটা হয়তো আমাদের দুজনের ই,তবে আমরা একে অপরের প্রতি একটু বেশিই কঠোর হয়ে গিয়েছিলাম।ফারিয়া এসোনা আমরা সব কিছু ভুলে,আবার নতুন করে সব কিছু শুরু করি,এভাবে বাঁচা যায়না।
– আমি কাঁদতে লাগলাম।
– রিহান আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,আমি কি তোমার পাশে শুতে পারি?
– আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যা বললাম।
– রিহান আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
– আমিও রিহানের ভালোবাসা পাবার লোভে,আর মানা করতে পারলাম না।

তারপর থেকে আস্তে আস্তে সব কিছু ঠিক হতে শুরু করলো।রিহান এখন সময় মতো বাসায় আসে,দুপুরেও বাসায় এসে রেস্ট নেয়।এখন রিহান আমার অনেক যত্ন করে,অনেক রকমের গল্পও করে।সারাদিন কি কি করলো,কোথায় গিয়েছিলো, কেনো গিয়েছিলো,সব রকমের গল্পই করে।আগে আমি বক বক করতাম এখন রিহান ই বক বক করে।তবে আমার একটুও বিরক্ত লাগেনা,বরং মনের ভেতর আনন্দ অনুভব করি।কোনো কিছু হারিয়ে পাওয়ার সুখ যে এতোটা মধুর,এই খারাপ সময় গুলো জীবনে এসেছিলো বলেই বুঝতে পারছি।

দেখতে দেখতে ডেলিভারির ডেট চলে আসলো।আমি একজন ছেলে সন্তান জন্ম দিলাম।বাবা আমার উপর রেগে থাকলেও, নাতির কথা শুনে আর রাগ করে থাকতে পারলেন না।মা কে নিয়ে বাবা ঢাকায় চলে আসলেন।শ্বশুর বাড়ির লোকজন ও অনেকে আসলেন।মেজো জা আমার কাছে ক্ষমা চাইলেন।আমি বললাম
– আপু আমি আপনাকে অনেক আগেই ক্ষমা করে দিয়েছি,তবে আপনাকে মন থেকে কখনো সম্মান করতে পারবোনা।আপনি চাইলে ব্যাপারটা গোপন রাখতে পারতেন, কিন্তূ ফাঁস করে দিয়ে বেশি ভালো করেছেন।কারণ স্বামীর কাছে একটু নত হয়ে থাকা যায়, কিন্তূ আতঙ্ক নিয়ে বাঁচা যায়না। আতঙ্কিত জীবন অনেক কষ্টের হয়।এখন আমার কোনো আতঙ্কও নেই,নিজেকে স্বাধীন মনে হয়।
আসলে জীবনে কিছু খারাপ সময় আসা দরকার,তাহলে ভালো সময় টা কে উপভোগ করা যায়।যখনই খারাপ সময় আসে,আমি আল্লাহর উপর ভরসা রাখি,কারণ আমি জানি এই খারাপ সময়ের পরে একটা ভালো সময় আসবেই।

সেদিন চিঠির কথাটা ফাঁস হয়েছিলো বলে,আল্লাহর কাছে অনেক অভিযোগ করেছিলাম, কিন্তূ এখন মনে হচ্ছে ফাঁস হওয়াটাই ঠিক হয়েছে, মিথ্যে নিয়ে ভয়ে বাঁচার চেয়ে ,সত্য নিয়ে স্বাধীন ভাবে বেচেঁ থাকবো। হ্যা মাঝখানে কিছু সময় খুব খারাপ কেটেছে,তবে পরিণতি টা কিন্তূ সুখের ই হয়েছে।

এই জন্যই কথায় আছে
আল্লাহ যা করে,ভালোর জন্যই করে।
এটা আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি।আমাদের সাথে কোনো কিছু খারাপ হলে,আমরা সহজেই ভেঙে পরি,ভাবি আল্লাহ কেনো আমাদের এমন বিপদের মুখে ফেললেন।খারাপ সময়ের পরে যখন ভালো সময়টা আসে তখন আমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে বুঝতে পারি❤️

সমাপ্ত।
সালমা আক্তার।

আসলে এই গল্পটা শুধু গল্পঃ নয়,অনেক বাস্তব কাহিনী মিশে আছ এই গল্পে।তাই অন্য গল্পের মতো খুব বেশি সাজাতে হয়তো পারিনি।ভুল ক্রুটি ক্ষমা করবেন।পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে