কি রে মিতু, ব্যস্ত নাকি?
– না বল। এই মাত্র অফিস থেকে এলাম। তোর কি খবর?
খবর তো সব এখন তোর। নতুন ফ্লাট কিনেছিস, গাড়ি নিয়েছিস, শুনলাম এবারের বইমেলায় নাকি তোর বই বের হয়েছে; তোর তো এখন যাকে বলে একাদশে বৃহস্পতি। একেবারে সাধারণ মানুষ থেকে সেলেব্রেটি হয়ে গেলি। তুই লেখালেখি করিস তাইতো জানতামনা। আমার অবশ্য বই পড়াতে তেমন একটা ইন্টারেস্ট নেই। আর এখন তো মেলা ভর্তি হাবিজাবি লেখকের বই।
– তোর কি গলায় কোন সমস্যা হয়েছে, সিনথি?
না তো কেন?
– না কেমন যেন গলার টোনটা শোনালো। তাই ভাবলাম। আচ্ছা শোন আমি তোকে পরে ফ্রি হয়ে ফোন দিচ্ছি।
তা তো বটেই, এখন তোর ব্যস্ততা বেশী। কথা বলার সময় কোথায়?
ফোনটা রেখে দিয়েই গায়ে কেমন যে এক জ্বালা ধরে। কেন আমি লোকের মুখের ওপরে কিছু বলে দিতে পারিনা? কেন উচিত কথা সবসময় মাথায় এসেও মুখে আসেনা? খামোখা নিজে নিজে যত ফোঁসফাস। দারুন একটা হাসিখুশী ভাব নিয়ে অফিস থেকে এসেছিলাম। মেজাজটা একদম যা ইচ্ছে তাই হয়ে গেলো।
সিনথির সাথে আমার বন্ধুত্ব সেই ভার্সিটি জীবনের পর থেকে। বিসিএস দিতে গিয়ে পরিচয়। তারপর কখন যে গল্পে গল্পে সুখ দুঃখের আলোচনায় একটু একটু করে বন্ধু হয়েছি তা নিজেরাও বুঝতে পারিনি। সিনথির সাংসারিক যাবতীয় দুঃখের কথা শোনার মানুষ ছিলাম আমি। আমার কাছে মনে হতো ও বলে যদি একটু হাল্কা হয় তবে হোক না। কখনোই তাকে উস্কে দেয়া বা সংসার ভাঙ্গার পরামর্শ তো দেইনি বরং চেষ্টা করেছি সবসময় যেন সে হাসিখুশি থেকে সময়টা উতরে যেতে পারে।
অথচ ওর মনের ভেতর অন্যরকম একটা মানুষের ছবি লুকিয়ে ছিল তা টের পাই ওর বিসিএস হওয়ার পরে। ছোটবেলা থেকে একটা কথা আমার মা সবসময় বলতো, যে কোন কাছের মানুষের আসল রূপ বোঝা যায় তার অবস্থার উন্নতির সাথে সাথে। বিসিএসের ভাইভাতে আমার হলোনা আর সিনথির হয়ে গেলো এডুকেশনে। এই ভাইভা হওয়া আর না হওয়া যেন আমাদের মধ্যে গড়ে দিল যোজন যোজন দূরত্ব। সিনথির গলার স্বর পাল্টে গেলো, কমিয়ে দিলো আমার সাথেও কথাবার্তা। যেন ঐ একটা পরীক্ষা আমাদের মধ্যে টেনে দিলো ভালো আর খারাপ ছাত্রীর সুস্পষ্ট ব্যবধান। সময়ে অসময়ে ও অবশ্য ফোন দিত তবে ঐ কলগুলো থাকতো শুধু ওর আর কি কি ভালো হলো সেসব গল্প দিয়ে ভরা। আমার কিভাবে দিন যাচ্ছে বা কেমন আছি সেসবও থাকতো কথায় তবে তা শুধু আহা উহু করে গলায় সান্ত্বনা ঢালার শব্দ করে তার নিজের প্রশান্তির জন্যই বোধ করি।
নিজেই তাই ওর সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দেই। লেগে থাকার স্বভাব আমার সেই ছোটবেলা থেকেই। পরেরবারের বিসিএসে না হলেও তার পরের বার আমার ঠিক ঠিক ভাগ্য খুলে যায়। পেয়ে যাই ফরেন ক্যাডারে চান্স। পুলিশ আর রেফারেন্স চেক সংক্রান্ত কিছু তথ্য জানতে ফোন দিয়েছিলাম সিনথিকে। সে কিছু জানেনা বলে সাথে সাথেই এড়িয়ে যায়। সাথে বলতে ভোলেনা, ‘তুই কিভাবে ফরেন ক্যাডারে চান্স পেলি? ফরেন ক্যাডার তো বেশী ভালোনা। আমি ইচ্ছে করেই নেইনি। সংসার ফেলে এদেশ ওদেশ ঘুরে বেড়ানো। ওসব আমার দ্বারা হবেনা।’
সে থেকেই দেখছি সুযোগ পেলেই এর ওর কাছে আমার নামে নিন্দা করতে সে ছাড়েনা। সরাসরি না বললেও ঘুরিয়ে বলে, ওর সাহায্য ছাড়া নাকি আমি এতোদূর আসতেই পারতামনা। ও কত দয়ালু কত ভালো এসব কথা অন্যদের কাছে শুনে মাঝে মাঝেই ইচ্ছে করতো ফোন করে দুটো কথা বলি। না পারিনি বলতে। মনে হয়েছে খামোখা কথা বাড়িয়েও কি লাভ?
লেখালেখির নেশাটা আমার সেই ছোটবেলা থেকেই। ওর সাথে একসাথে বিসিএসের প্রস্তুতি পড়ার সময় ও প্রায়ই বলতো তোর লেখার হাত এতো ভালো তোর তো রিটেন নিয়ে কোন চিন্তাই নেই। অথচ আজ কি অবলীলায় বলে দিল সে জানতোই না আমার এমন কোন কোয়ালিটি আছে।
মন ভালো করতেই মুখবইয়ের পাতায় চোখ রাখি। আমার এক পরিচিত আপারও এ বছরই নতুন বই বেরিয়েছে। উনি আবার সিনথির এডুকেশন সেক্টরেই একটু উঁচু লেভেলে আছেন। অনেকেই শুভেচ্ছা বার্তা দিয়েছে। নিজেও শুভেচ্ছা জানাবো বলতে কমেন্ট বক্সে তাকাতেই চোখে পড়ে সিনথির কমেন্ট।
‘আপু আপনার লেখা তো সে লেভেলের অসাধারণ। আমি সবসময় আপনার লেখা ফলো করি। আপনার বইয়ের এক কপি আপনার অটোগ্রাফসহ নিতে চাই। এখন তো কেউ একটু দুই লাইন লিখতে পারলেই বই বের করে ফেলে। আপনি সেদিক থেকে একদমই ব্যতিক্রম। কত বছর লেখালেখির পর বই আসলো আপনার।’
রাগ কমার বদলে এবার দারুন রকম হাসি পেয়ে গেলো। নিজের ওয়ালে একটা স্ট্যাটাস লেখার জন্য মনটা অস্থির হয়ে ওঠে। মুখে না বলতে পারলেও যে বোঝার সে যদি পড়ে বুঝে নেয় এই যা সান্ত্বনা।
‘নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভালো
যুগ জনমের বন্ধু আমার আঁধার ঘরের আলো।
কিছু মানুষের সংস্পর্শে না এলে এই জীবনে জানাই হতোনা আমার আসলে দিনে দিনে প্রভূত উন্নতি হচ্ছে। ভালবাসা রইলো আমার সেসব বন্ধুদের জন্য।’
খুব ইচ্ছে করছিলো সিনথিকে ট্যাগ দিয়ে দেই স্ট্যাটাসে। পরে মনে হলো সেটা বুঝি একটু বেশীই হয়ে যায়।
#ডা_জান্নাতুল_ফেরদৌস