#পদ্মপাতার জল
#মুন্নি আরা সাফিয়া
#পর্ব_০৮
সকালবেলা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে মাজেদা বেগমের রুমে প্রবেশ করলো শুভ্রা।এ বাড়িতে আসার পর থেকে সকালের চা টা সে নিজ হাতে করে!
মাজেদা বেগম আধ শোয়া হয়ে তসবিহ পড়ছিল।শুভ্রা চায়ের কাপ সামনে ধরে বলল,
__’মা, আপনার চা!’
মাজেদা বেগম হাত বাড়িয়ে কাপ হাতে নিলেন।তারপর বললেন,
__’তোমার বাবা কি বাড়িতে ফিরেছে?’
__’না,মা।বাবা তো ভোরে হাঁটতে বের হয়েছে।এখনো ফেরেনি।আপনি চিন্তা করবেন না।আমি নিচে আছি।সকালের নাস্তা তৈরি হয়ে গেছে। ‘
মাজেদা বেগম চায়ের কাপে চুমুক দিলেন।কিছুদিন হলো তার ভেতরটা কেমন খচখচ করছে। মনে হচ্ছে, কোনো অঘটন ঘটবে।তার পরিবারের কিছু হবে না তো?
__’মা আমি তাহলে আসি।’
__’শুভ্রা!অন্তিক স্কুলে যাবে কার সাথে? ‘
শুভ্রা চমকালো।তার শ্বাশুড়ি মা যে এত কথা বলার মানুষ নয় তা সে জানে।তাহলে এত কথা বলছে কেন?অসুখ টসুখ হলো না তো?সে তড়িঘড়ি করে মাজেদা বেগমের কপালে হাত রাখলো।
ভীত কন্ঠে বলল
__’মা,আপনি ঠিক আছেন?শরীর খারাপ লাগছে আপনার?প্রেশার লো?’
মাজেদা বেগম হাসলেন।তিনি বেশ বুঝতে পারছেন শুভ্রার এমন অদ্ভুত আচরণের কারণ।কিছুটা কষ্ট পেলেন।তিনি নিজ হাতে এদের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করছেন।এত সহজে হয়তো এ দূরত্ব ঘুচবে না।
তিনি শুভ্রার হাত ধরে পাশে বসালেন।নিজেকে কেন জানি অপরাধী মনে হয় আজ কাল!সে এই অপরাধ বোধ থেকে চিরমুক্তি চায়!
শুভ্রার দিকে তাকিয়ে বলল,
__’শুভ্রা,আমি জানি তুমি অনিরুদ্ধ আর মৃন্ময়ীর বিয়েটা মন থেকে মেনে নিতে পারোনি।আমাদের কি উচিত নয় ওদের মেনে নিয়ে সুখী জীবন যাপনে সহযোগিতা করা?তুমি পারবে না অনিরুদ্ধকে ক্ষমা করতে?’
শুভ্রার চোখ জলে ভরে উঠলো।সত্যি সে আজ অবধি মৃন্ময়ী আর অনিরুদ্ধর বিয়েটা মেনে নিতে পারেনি।
একই বাড়িতে একই ছাদের নিচে খেকেও সবার মাঝে কতটা দূরত্ব!কিন্তু এত দূরত্ব তো সবার মাঝে ছিল না।আর একদিনেও তো সৃষ্টি হয়নি!আস্তে আস্তে, সময় নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে এ দূরত্ব। অতি সহজে কি এ দূরত্ব ঘুচবে?
শুভ্রার চোখের সামনে অতীতের ঘটনাটি ভেসে উঠলো। যা সে এতগুলো দিন আড়ালে রেখেছিল।মৃন্ময়ীর অন্ধত্ব জীবনের অভিশাপ যে অনিরুদ্ধর হাত ধরে এসেছে। তা সে ভুলবে কি করে?
সেদিন অনিরুদ্ধ স্কুলে একটা ছেলের সাথে মারামারি শুরু করে।মারামারি বেগতিক পর্যায়ে গেলে মৃন্ময়ী অনিরুদ্ধকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে।সেই বাঁধাই কাল হয়ে দাঁড়ায় মৃন্ময়ীর জন্য। অনিরুদ্ধ রাগান্বিত মস্তিষ্কে তাকে এমন জোরে ধাক্কা মারে যা ছোট্ট মৃন্ময়ী হজম করতে পারে না।ছিটকে বেঞ্চের সাথে গিয়ে বাড়ি খায়।সেইদিনই ছিল তার পৃথিবী দেখার শেষ দিন!
হসপিটালে নেয়ার পর ডাক্তার জানায় মৃন্ময়ীর চোখের কর্নিয়া মারাত্মক ভাবে আহত হয়েছে।সে আর কখনো দেখতে পাবে না।অপারেশন করলেও দেখতে পাবে না।একমাত্র চক্ষু প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে দেখতে পাবে।তবে সেটা অনেক বড় অপারেশন।মৃত্যুর ঝুঁকি আছে।বড় হওয়ার পর করতে হবে।এত অল্প বয়সে নয়!
মাজেদা বেগম শুভ্রার চোখের পানি মুছে দিলেন।তার মেয়ে নেই। আজ কেন জানি মেয়ে নামক মানুষটার অভাববোধ করছেন।তিনি দুহাতে শুভ্রাকে বুকে জড়ালেন।
শুভ্রাকে তাকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন।
মাজেদা বেগম বললেন,
__’আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না, মা?তোরা দু বোন আমার দু মেয়ে হয়ে বাকিটা জীবন কাটাতে পারবি না?’
__’হ্যাঁ,মা পারবো।’
মাজেদা বেগম শুভ্রার মাথায় হাত রাখলেন।তান বুকের ভেতর শীতল হওয়া শুরু করেছে।
______________________
আজ কার্তিক মাসের ১১ তারিখ।আকাশে মস্ত বড়ো চাঁদ উঠেছে।তার ঝিরঝিরে আলোতে পুরো পৃথিবী স্নান করছে।অনিরুদ্ধ আরেক নজর চাঁদের দিকে তাকিয়ে বেলকনি থেকে রুমে আসলো।
মৃন্ময়ী শোয়ার বন্দোবস্ত করছে।
অনিরুদ্ধ বিছানার দিকে তাকালো। আজও মাঝখানে বিশাল একটা কোলবালিশ। কোলবালিশের দুপাশে দুটো বালিশ রাখা।বেশ কিছুদিন হলো তারা একই বিছানায় ঘুমায়, কিন্তু মাঝে কাঁটাতারের বেড়া!
অনিরুদ্ধর মনটা খারাপ হয়ে গেল।
__’মৃন,আকাশে আজ অনেক বড় চাঁদ উঠেছে।চলো বেলকনিতে গিয়ে বসি!’
মৃন্ময়ী কন্ঠের উৎস বরাবর চোখ তুলে তাকালো। অনিরুদ্ধর কন্ঠে গভীর বিষাদের ছাপ ফুটে উঠেছে।তার এই বিষাদময় কন্ঠ উপেক্ষা করতে পারলো না।গুটিগুটি পায়ে বিছানা ছেড়ে নেমে আসলো।
অনিরুদ্ধ আর মৃন্ময়ী পাশাপাশি বসে আছে। অনিরুদ্ধর দৃষ্টি উদাস।মৃন্ময়ী হাত গ্রিলের ভেতর দিয়ে ভাবলেশহীন ভাবে বসে আছে।
বাইরের শীতল বাতাস ক্ষণে ক্ষণে পরশ ছুঁইয়ে যাচ্ছে।রাতের মতোই নিস্তব্ধ দুজন।যেনো কান পেতে একজন আরেকজনের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনে যাচ্ছে।
অনিরুদ্ধর ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। সে আজ অনেক কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে।বিষয়টা মৃন্ময়ীকে নিয়ে, অথচ সে তাকেই জানায়নি!এই মুহূর্তে জানাতে চাচ্ছে না।কারণ সে জানে মৃন্ময়ী বাঁধ সাধবে।রাজি হবে না!
সবকিছু ঠিকঠাক করার পর এখন অনিরুদ্ধর মনে ভয় ঢুকে গেছে। মৃন্ময়ীকে চিরকালের জন্য হারানোর ভয়!
আবারো সেই দোটানায় পড়ে গেল সে।মৃন্ময়ীর ভালো করতে গিয়ে খারাপ হবে না তো?কিন্তু এখন তো পিছু ফেরার অবকাশ নেই। পেছনের রাস্তা সময়ের সাথে মিলিয়ে গেছে শূন্যে।যা করার সামনের পথকে নিয়ে করতে হবে।
অনিরুদ্ধ সব চিন্তা বাদ দিয়ে মৃন্ময়ীর কোলে মাথা রাখলো।
মৃন্ময়ীর হাত পা কাঁপতে শুরু করলো নতুন এক অনুভূতিতে।তবে এটা বেশ বুঝতে পারলো যে অনিরুদ্ধর মন খারাপ, ভীষণ রকম খারাপ!
সে অনিরুদ্ধর চুলে হাত বুলিয়ে বলল,
__’মন খারাপ?’
__’হু।মৃন,আমাদের মাঝের দূরত্ব নিঃশেষ করে দিতে মন চায় না?কেন জানি তোমাকে হারানোর ভয় হচ্ছে। প্রচন্ডরকম ভয়!মৃন,আমাকে ছেড়ে,একা করে চলে যাবে না তো?’
__’কি বলছেন এসব?ছেড়ে যাবো কেন?’
__’জানো,আমার একটাই ইচ্ছে। তোমার কোলে মাথা রেখে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়া।তুমি আমার আগে যেতে পারবে না, কিছুতেই না!’
অনিরুদ্ধ লাফ দিয়ে উঠে বসলো।মৃন্ময়ীর হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে হু হু করে কেঁদে উঠলো।
মৃন্ময়ী ভীষণ রকম চমকালো।অনিরুদ্ধর হঠাৎ পরিবর্তন তার ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে দিচ্ছে।কিন্তু কিছুই মাথায় ঢুকছে না।
অনিরুদ্ধ হঠাৎ এসে বলছে কেন?সে কোথায় যাবে?তার তো যাওয়ার জায়গা নেই!আর থাকলেও সে যাবে না।এই মানুষটাকে ছেড়ে সে কোথায় যাবে!
অনিরুদ্ধর কান্নার পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। সে দ্বিরুক্তি না করে অনিরুদ্ধর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো।
কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলল,
__’কি হয়েছে আপনার?এমন করছেন কেন?বলুন আমায়।’
অনিরুদ্ধ কিছু বলতে পারলো না।মৃন্ময়ীকে আষ্টেপৃষ্ঠে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল।
রাত গভীর হচ্ছে ধীরে ধীরে। চাঁদ পশ্চিমে হেলে পড়া শুরু করেছে। তার আলো সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ক্ষীণ হওয়া শুরু করেছে।বাতাসে শীতলতার পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে।
মৃন্ময়ীর শীত লাগতেই সে আরো গভীর ভাবে অনিরুদ্ধর বুকে মুখ লুকালো।
অনিরুদ্ধ মুখ তুলে মৃন্ময়ীর কানে কানে বলল,
__’আমার বউকে কি আজ আপন করে পেতে পারি?’
মৃন্ময়ী ভয় পেয়ে মুখ তুলে অনিরুদ্ধর মুখের দিকে তাকালো। পরমুহূর্তে মুচকি হেসে অনিরুদ্ধর গালে ঠোঁট ছোঁয়ালো।
অনিরুদ্ধ এক লাফে তাকে কোলে তুলে নিলো।
(চলবে)