#পদ্মপাতার জল
#মুন্নি আরা সাফিয়া
#পর্ব_০৫
তার চোখ বরাবর দ্বিতীয় তলায় বিশালকার এক সাইনবোর্ড।আর তাতে বড় বড় করে লেখা __”কাজী অফিস”।
অনিরুদ্ধ মুচকি হাসলো।ফোন বের করে একটা ছোট্ট এসএমএস করলো।
মৃন্ময়ী চুপচাপ অশ্রু বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে।গাড়ি থামতেই বড় বড় করে শ্বাস নিল।হাতের ওড়নাটা ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না।
সে একটা ছেলের পাশে ওড়না ছাড়া বসে আছে ভাবতেই নিজের উপর ঘৃণা হচ্ছে।ভাগ্যিস মাথার চুলগুলো অনিরুদ্ধ ছেড়ে দিয়েছিল!
সে নিচের দিকে তাকিয়ে বলল,
__’হাত খুলে দিন!’
__’লাফালাফি করবে না তো?’
অনিরুদ্ধর শান্ত কন্ঠ।মৃন্ময়ী না চাইতেও তার মুখের দিকে মাথা তুলে তাকালো।হঠাৎ করে মানুষটার মুখটা বড্ড দেখতে ইচ্ছে করছে।কি সুন্দর, মুগ্ধকর কন্ঠ!আচ্ছা, সব ছেলের কন্ঠই কি এত সুন্দর?
ঘুটঘুটে অন্ধকার ছাড়া কিছুই নজরে এলো না।অনিরুদ্ধও এখন তার কাছে শুধুই অন্ধকার!
সে মাথা নিচু করে আবারো বলল,
__’আমি লাফালাফি করলাম কখন?আমাকে নিয়ে বাইরে বের হবেন,সেটা কি আমাকে জিজ্ঞেস করে বের হওয়া উচিত ছিল না?আমার অনুমতির প্রয়োজন ছিল না?নাকি আমি অন্ধ বলে দূর্বল ভাবছেন?সেজন্য যা মন চায় তাই করবেন?’
অনিরুদ্ধ চমকালো।এসব কি বলছে সে?গম্ভীর গলায় বললো,
__’দেখো,মৃন, তোমাকে যদি বলতাম যে চলো বাইরে থেকে ঘুরে আসি।তুমি কি রাজি হতে?পৃথিবী উল্টে গেলেও রাজি হতে না,সেটা আমি ভালো করে জানি।বাদ দাও।একটা শুভ কাজে এসেছি।সেটা সম্পূর্ণ করতে দাও।’
__’ক-কি শুভ কাজ?’
__’সেটা একটু পরেই বুঝবে।চলো।’
অনিরুদ্ধ মৃন্ময়ীর হাতের বাঁধন খুলে দিল।ওড়নাটা ভালো করে পেঁচিয়ে সম্পূর্ণ মাথা ঢেকে দিল।মৃন্ময়ীর পরণে এখন কফি কালারের একটা থ্রি পিস!ফর্সা শরীরে কি দারুণ মানিয়েছে রঙটা!মনে হচ্ছে এই রঙটা সৃষ্টিই হয়েছে তার জন্য।
অনিরুদ্ধর আবারো কফির তৃষ্ণা পেল।ড্রাইভিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে যতবার মৃন্ময়ীর দিকে তাকিয়েছে ততবার তার কফির তৃষ্ণা পেয়েছে।
মৃন্ময়ীকে হাত ধরে নামালো।তারপর আস্তে আস্তে হেঁটে লিফটে উঠে দুতলায় পৌঁছালো।
কাজী অফিসে ঢুকে দেখলো তার ছোটবেলার তিন বন্ধু এসে উপস্থিত।বিদেশে থাকলেও এদের সাথে মাঝে মাঝে যোগাযোগ হতো।আজ গাড়িতে উঠে শর্টে এসএমএসে সব বুঝিয়ে এখানে আসতে বলেছিল।ওদের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো।
মৃন্ময়ীকে একটা চেয়ারে বসালো। কাজীকে বাইরে ডেকে কিছু একটা বুঝালো অনিরুদ্ধ।তারপর রুমে ঢুকে মৃন্ময়ীর পাশের চেয়ারে বসে তার বাম হাতটা নিজের হাতের মধ্যে পুরে নিল।
কাজী সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন।কয়েক লাইন কানে আসতেই মৃন্ময়ী আঁতকে উঠলো।তার মুখ দিয়ে অস্ফুট একটা স্বর বের হলো।
ইতোমধ্যে কাজী সাহেব মৃন্ময়ীকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
__’বল মা,কবুল।’
মৃন্ময়ী কঠিন গলায় বললো,
__’কি?কবুল বলবো কেন?আমি এই বিয়ে করবো না।আর অনিরুদ্ধ ভাই, এসব কোন ধরনের ছেলেমানুষী?আমি এক্ষুনি বাড়ি যাবো!’
মৃন্ময়ী দাঁড়াতে অনিরুদ্ধ হাতে টান মেরে বসিয়ে দিল।বলল,
__’বিয়ে করবো তোমাকে।এক্ষুণি,এই মুহূর্তে! কবুল বলে দাও মৃন।’
__’আমি করবো না বিয়ে।করবো না আপনাকে বিয়ে। শুনতে পাচ্ছেন আপনি?’
মৃন্ময়ী চিল্লিয়ে বলে কান্না শুরু করলো।
অনিরুদ্ধ সবার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো।কাজী সাহবের ইশারায় তাকে উঠিয়ে পাশের রুমে চলে গেল।
দরজার ছিটকিনি লাগানোর শব্দে মৃন্ময়ী ঘাবড়ে গেল।ভীত কন্ঠে বলল,
__’এখন কোথায় নিয়ে আসলেন?আর দরজা, দরজা বন্ধ করছেন কেন?’
অনিরুদ্ধ তার কাছে গিয়ে মুখে একটা ফু দিল।মুচকি হেসে বলল,
__’আমার তো এত তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধের ইচ্ছে ছিল না।কিন্তু কি করবো বলো?তুমি তো বিয়ে করতে রাজি হচ্ছো না!তাই বিয়ের আগে বাসরটা করে নিতে চাই।বাসর শেষ হলে তো নিশ্চয়ই কবুল বলবে, তাই না?’
মৃন্ময়ী রাগে ফেটে পড়ছে।হাত উঠিয়ে মারতে নিতেই অনিরুদ্ধ হাত ধরে ফেলল।এক টানে নিজের কাছে এনে মাথা থেকে ওড়না ফেলে দিল।
মৃন্ময়ী বার বার বলছে,
__’কি করছেস কি?ছাড়ুন।ছাড়ুন বলছি!’
মৃন্ময়ী রীতিমতো কাঁপছে।অনিরুদ্ধ হা করে তাকিয়ে আছে তার দিকে।মৃন্ময়ীর কোনো কথাই তার কানে যাচ্ছে না।সে নেশাভরা চোখে মৃন্ময়ীর ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে আছে।সে,তো একটু ভয় দেখাতে চেয়েছিল মৃন্ময়ীকে।এখন কেন জানি মৃন্ময়ী তাকে চুম্বকের মতো টানছে।তার হার্ট,ব্লাড সব যেনো তড়িৎ গতিতে ছুটে চলেছে।
সে চোখ বন্ধ করে মৃন্ময়ীর মাথাটা চেপে ধরে তার ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ালো।
মৃন্ময়ী কান্নার বেগ বেড়ে গেল।সে বুঝতে পারছে অনিরুদ্ধ ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছে।এক ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বললো,
__’আমি বিয়েতে রাজি!রাজি!’
অনিরুদ্ধ বাঁকা হাসলো।হাতের আঙুল দিয়ে নিজের ঠোঁট মুছে মৃন্ময়ীর মাথায় ভালো করে ওড়না পেঁচিয়ে বাইরে বের হলো।
নির্বিঘ্নে মিটে গেল বিয়ের কাজ।
_______________
অনিরুদ্ধ হাতঘড়ির দিকে তাকালো।বেলা চারটে বাজে।সে ঠিক করেছে সন্ধ্যার পর বাসায় যাবে।
পাশ ফিরে মৃন্ময়ীর দিকে তাকালো।তারা এখন একটা নদীর তীরে বসে আছে।আশপাশে কেন জানি মানুষ নেই।
মৃন্ময়ীর দিকে তাকিয়ে আবারো কথা বলার চেষ্টা করলো অনিরুদ্ধ। কিন্তু সেই সকালবেলা কবুল বলার পর থেকে মৃন্ময়ী তার সাথে একটা কথাও বলেনি।কান্নাকাটিও করেনি।শুধু দুপুরের আযানের পর বলেছে,
__’আমার নামায পড়ারা সময় হয়েছে।’
অনিরুদ্ধ তাকে ওযুর পানি দিয়ে গাড়িতে নামায পড়তে বলে।সে, সেটাই করেছে নিরবে।এমনকি বাড়িও যেতে চাচ্ছে না।
ইতোমধ্যে বাড়িতে ফোন দিয়ে জানিয়েছে যে, মৃন্ময়ীকে নিয়ে ঘুরতে এসেছে সে।বিয়ের কথা এখনো বলেনি।
__’আইসক্রিম খাও!’
অনিরুদ্ধ আইসক্রিম এগিয়ে দিল।মৃন্ময়ী মুখ ঘুরিয়ে নিল।অনিরুদ্ধ হেসে ফেলল।
হাসতে হাসতে বলল,
__’এতটুকু মানুষের এত্ত রাগ!বাবা গো বাবা!আমার সারাটা জীবন তো তোমার রাগ ভাঙাতেই চলে যাবে মায়াপরী।রোমান্স করবো কখন তাহলে!’
মৃন্ময়ী কিছু বলল না।অনিরুদ্ধ এবার তার একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,
__’মৃন,বিয়ে তো আল্লাহর ইচ্ছেতে হয়।তোমার আমার জুটি তিনি সৃষ্টির সময়ই নির্ধারণ করে রেখেছিলেন। সেজন্য আমরা এক হলাম।তুমি আমার উপর রাগ করে থেকো না।
আমি তোমাকে ভালোবাসি।আর আমার ভালোবাসাকে কখনো দুঃখ পেতে দিতে চাই না।বাড়িতে তোমাকে বিয়ে করার কথা বললে কেউ রাজি হতো না সেটা আমি জানি।সেজন্য ওপথে না গিয়ে তোমাকে সরাসরি বিয়ে করে ফেললাম। কারন আমি তোমাকে হারাতে চাই না।কিছুতেই না।
যতদিন বাঁচবো তোমাকে বুকে নিয়ে বাঁচবো।তোমার কোলে মাথা রেখে শেষ নিঃশ্বান ত্যাগ করতে চাই।বলো, আমার চাওয়াটা কি অন্যায়?’
মৃন্ময়ী হু হু করে কেঁদে উঠলো।
অনিরুদ্ধ তাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলো। মৃন্ময়ী বাঁধা দিয়ে সরে গেল।অনিরুদ্ধ আবারো চেপে ধরলো।মৃন্ময়ী নিজেকে সরিয়ে নিল।
অনিরুদ্ধ এবার সামান্য হেসে জোর করে বুকে চেপে ধরে রাখলো।
পার্লারের সামনে গাড়ি থামালো অনিরুদ্ধ।সে আজ উল্টো কাজ করবে।সবাই বিয়ের আগে বর কনে সাজে।তারা আজ বিয়ের পর বর কনে সাজবে।
মৃন্ময়ীকে গাড়ি থেকে নামিয়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে ভেতরে প্রবেশ করলো।মৃন্ময়ীর ড্রেসগুলো ভেতরে দিয়ে সবাইকে বুঝিয়ে সরে আসলো সে।
মৃন্ময়ীর জন্য কফি কালারের ল্যাহেঙ্গা কিনেছে সে।আর নিজের জন্য কফি কালারের পাঞ্জাবি।পার্লার থেকে বেরিয়ে দুকাপ কফি খেলো সে।
তারপর গাড়িতে উঠে নিজের ড্রেস চেঞ্জ করে পাঞ্জাবি পড়লো।গাড়ির আয়নাতে একবার নিজের চেহারা দেখলো।
আজ থেকে তার নতুন জীবন শুরু হলো মৃন্ময়ীকে ঘিরে।সামনের দিনগুলোকে সে জীবনের সেরা মুহূর্ত বানাবে।সামনের প্রতিটা দিন তারা ভালোবাসার নতুন সঙ্গায় পার করবে।
নিজেকে আজ পৃথিবীর সেরা ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। সত্যি নিজের প্রাণপ্রিয়কে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়ার আনন্দ পৃথিবীর আর কোনো কিছুতে নেই।
প্রতিদিন ঘুমাতে যাওয়ার আগে তার মায়াপরীকে বুকে জড়িয়ে ঘুমাবে,আবার ঘুম থেকে উঠে তার মুখটা প্রথমে দেখতে পাবে।ভাবতেই অনিরুদ্ধর বুকের ভেতর প্রশান্তির শিহরণে ভরে গেল।
_________________
ড্রয়িং রুমে সোফায় পাশাপাশি বসে আছে অনিরুদ্ধ আর মৃন্ময়ী।পরিবারের সবাই তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
কারো কারো মুখ হাসি হাসি।কারো কারো আবার দুচোখ ঠিকড়ে বের হচ্ছে যেনো।
মাজেদা বেগম কাবিনের কাগজটা হাতে নিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
__’কাবিন কত করেছিস?এ-এ-এক কোটি সতেরো টাকা?’
(চলবে)