#নোনাজল
#পর্ব_১
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা
দুপুরের কড়া রোদে ছাদে বসে চাল এর মধ্যে থেকে পাথর আর মরা চাল আলাদা করছে স্বর্ণলতা। এমনিতেই সকাল থেকে মেজাজ বিগড়ে আছে তার। কি ভেবেছিল আর কি হচ্ছে, তার সাথে সেই চিন্তায় সে বিরক্ত। তার মধ্যে আবার এখন শাশুড়ী পাঠিয়েছে চাল ঝাড়তে। মনে মনে শাশুড়ী নামক মহিলার চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করছে সে বকে। কিন্তু মুখে সে কিছুই বলতে পারে না। কেমন যেন ভয় হয় তার তাকে। অনেকটা অসহ্যও লাগে। কিন্তু কি আর করার! শাশুড়ী তো! সহ্য তো করতেই হবে৷ খারাপ হোক আর ভালো। কি দরকার ছিল এখন রোদের মধ্যে তাকে ছাদে পাঠানোর। বিকেলেও তো করতে পারতো। কিংবা বারান্দায় ও তো এখন করা যেতো। নাহ! তা করা যাবে না। রুম নোংরা হবে। অগত্যা, এই ছাদে বসেই চাল ঝাড়ো। ভাবখানা এমন যেন, সে রুম পরিষ্কার করে। দিনে দুবেলা তো স্বর্ণলতাই রুম মোছা দেয়। তার বেলায়? এই যা, আসিফের শার্টই তো ধোওয়া হয় নি। এইদিকে যে রোদ পড়ে যাচ্ছে। পরে তো আর শার্ট শুকাবে না। স্বর্ণলতা তাড়াতাড়ি চাল ঝেড়ে রুমের দিকে ছুটলো। সোফায় অযত্নে ফেলে রাখা শার্টের ওপর হাত দিল সে। ওয়াশরুম এর দিকে পা বাড়াতেই মনে হলো, আসিফ যা মনভোলা, নিশ্চয়ই পকেট এ টাকা বা দরকারি কাগজ রেখে দিয়েছে। সেই ভেবেই পকেট এ হাত ঢুকালো সে। সত্যিই তাই! পুরো হাজার টাকার নোট। ইশশ! এখনই যদি ভেজাতাম, তাহলে আবার আসিফের বকা খেতে হতো। শাশুড়ী মা হয়তো ঠিকই বলে। স্বর্না কোনো কাজই ঠিকমতো করতে পারে না। যাক বাবা! এইবার কোনো ভুল হয়নি। আসিফ অবশ্যই আজকে বকা দিবে না। আনন্দের সাথে সে ওয়াশরুম এ গিয়ে যখন পানিতে ভিজালো, তখন তার মনে হলো, ভিতরের পকেট এও তো কিছু থাকতে পারে। ভয়ে ভয়ে হাত ঢুকিয়ে দিল সে পকেটে। কিন্তু এর পরই সে স্থানুর মতো বসে পড়লো। ভিতরে ভিতরে আফসোস হতে লাগল, কেন সে পকেটে হাত দিল। যদি সে হাত না দিত,তাহলে তো আজ আর এইসব দেখতে হতো না। নিজের স্বামীর বুক পকেটে যখন কোনো নারী অন্য কোনো মেয়ের ছবি দেখে, তখন তার মনের অবস্থা কি হতে পারে, সেটা হয়তো সেই জানে। স্বর্নলতার ইচ্ছে হলো, চিৎকার করে কাঁদা। কিন্তু সে পারছে না। অধিক কষ্টে মানুষ যখন পাথর হয়ে যায়, তখন তার কোনো অনুভূতিই থাকে না। সে চুপচাপ ছবিটি আলাদা করে ধুয়ে শুকাতে দিল। যাক, আজকে আর আসিফ তাকে বকবে না, যদি আজ স্বর্ণা আসিফের পকেটে হাত নাও দিত, তাও সে বকতো না।
স্বর্ণলতা গোসল করে এসে খাটে ধপাস করে বসে পড়লো। বিয়ের মাত্র ৭ মাস হয়েছে তাদের৷ প্রেমের বিয়ে তাদের। আসিফের জন্য সব ছেড়ে এসেছে সে। মা-বাবা, বন্ধু-বান্ধব সবাইকে। স্বর্ণলতার হঠাৎই আরো একজন এর কথা মনে পড়লো। সেও কি এইভাবেই কোনো দিন কষ্ট পাচ্ছিল তার জন্য? নাহ! সে আর তার কথা ভাবতে চায় না। নিজের ভুল আর দোষ কেই বা স্বীকার করতে চায়? অবহেলায় পড়ে থাকা ফোনটার দিকে নজর পড়লো তার। মায়ের সাথে কথা বলতে ভীষণ ইচ্ছে করছে তার। বিয়ের পর অনেকবারই মাকে কল দিয়েছিল সে। কিন্তু মা রিসিভ করে নি। এখন তো ব্লকলিস্ট এ রেখে দিয়েছে। এইটা নিশ্চয়ই তার আদরের ছোট বোনের কাজ। মা কি আর এইসব বুঝে নাকি? কল যাবে না জেনেও একবার কল করলো সে। নাহ! বিজিই বলছে। তারমানে এখন ও ব্লক লিস্টে আছে। কত আশা ছিল তার, একদিন মা বাবার সামনে মাথা উচু করে বলবে, “দেখো, আমার পছন্দ বা সিদ্ধান্ত ভুল ছিল না। আমার আসিফ খারাপ না। খারাপ তো সেই মানুষ টা যার কারণে আসিফ ভালো নেই।”
স্বর্না ভেবেছিল বাবা-মা হয়তো তখন নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে তাদের আপন করে নিবে। কিন্তু এখন? এখন তো মনে হচ্ছে, সে নিজেই ভুল। একসময় তো বুক পকেটে তার ছবি থাকতো৷ এখন অন্য কারো। অনেকদিন পর মেসেঞ্জার এ লগ ইন করলো সে। কাছের বন্ধুদের সাথে একটু কথা বলার উদ্দেশ্যে। কিন্তু সে হতবাক হয়ে গেল, যখন সে দেখলো, তার বেস্ট ফ্রেন্ড নিলা তাকে ব্লক করে দিয়েছে। তার মেসেঞ্জার পুরোই মরুভূমি। হাতে গোনা কিছু বন্ধু আছে তার। ব্লক করার আগে অনেকে অনেক কথাই বলেছে তাকে৷ স্বর্নার ইচ্ছে হলো, মোবাইল আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেলতে৷ কিন্তু সে তা করলো না। এখন তার কাছের মানুষদের মধ্যে কেউ না থাকলেও, কাছের জিনিসটি হচ্ছে এই মোবাইল। একে ভেঙে ফেললে, কাছের আর কিছুই থাকবে না। হঠাৎ বিছানায় যেখানে বসেছে, সেখানে ভেজা ভেজা লাগলো তার। লক্ষ্য করলো, তার চুলের পানিতেই ভিজে গেছে বিছানার চাদর। ধীরে ধীরে আয়নার সামনে গিয়ে দাড়ালো সে। কি কমতি ছিল তার মাঝে? সে কি দেখতে খারাপ? নাকি কোনো দিক থেকে অক্ষম? চুলগুলোতে আলতো করে চিরুনি চালালো সে৷ আসিফ তো তার এই লম্বা চুলের প্রেমেই পড়েছিল। আগে আসিফ বলতো,” আমি যদি হারিয়ে যাই, তাহলে যেন তোমার চুল দিয়ে বেঁধে রেখো আমায়। রুপকথার রাজকন্যা রুপাঞ্জেল এর মতোই আমাকে নিচ থেকে উপরে উঠিয়ে আনবে।”
“বৌমা, বলি ও বৌমা, তোমার শ্বশুরকে খেতে দাও। দুপুর গড়িয়ে যে বিকেল হতে চললো, খাবার দিবে কখন? ” শাশুড়ীর ডাকে হন্তদন্ত হয়ে বের হয় ঘর থেকে স্বর্নলতা। গিয়ে দেখে, শাশুড়ী টিভিতে স্টার জলসায় গুড্ডি সিরিয়াল টা দেখছে। মুহুর্তেই মেজাজ গরম হয়ে যায় তার। কেন? নিজে খেতে দিলে কি হয়? তবুও শান্ত মাথায় শ্বশুরকে খেতে দেয় সে৷ কোনো এক অজানা কারণে শ্বশুর তাকে পছন্দ করে না। সে জানে না কি তার কারণ। শাশুড়ী তো আগে তার নামেই অজ্ঞান ছিল। এখন শাশুড়ীকে দেখলে মনে হয়, অভিনয় করতে করতে সে ক্লান্ত। তাই আর তাকে চাইলেও সহ্য করার নাটক টা চালাতে পারছে না। যাক, অন্ততপক্ষে শ্বশুর তো আর তাদের মা ছেলের মতো ড্রামাবাজ নয়। শ্বশুরকে খেতে দিয়ে সে শাশুড়ীর খাবার টা তার সামনে নিয়ে দিল। তার শাশুড়ী তিন বেলায় ই টিভি দেখে খাবার খান। কালকে রাতেও এই সিরিয়াল টা দেখেছে সে। এখন আবার রিপিট টেলিকাস্ট দেখছে। মেজাজ টা আবার গরম হয়ে যায় তার।
“তুমিও খেয়ে নাও। তা না হলে তো আবার আমার ছেলের কাছে নালিশ করবে যে আমরা তোমাকে খেতে দিই না ঠিকমতো। ”
শাশুড়ীর খোঁচা মারা কথাটা সহ্য করে সে বলে,” মাথা ব্যথা করছে আম্মা। পরে খাবো।”
মুখে এইকথা বললেও সে মনে মনে বলে,” কি করে ভাত খাবো আম্মা? যার স্বামী ঘরে সুন্দরী বউ রেখেও পরনারীতে আসক্ত, সেই স্ত্রীর গলা দিয়ে কিভাবে খাবার নামবে?”
ছাদ থেকে আসিফের শার্টটা এনে ছবিটা আবার সে যত্ন করে বুকপকেটে রেখে দেয়। কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে তার। কেন তার সাথেই এমন হলো? কি দোষ ছিল তার? সে তো শুধু একটু ভালো থাকতে চেয়েছিল। তার ভালোবাসার মানুষটার সাথে। মানুষ টার সুখে দুঃখের সাথী হতে চেয়েছিল। তার জন্য বাবা-মা পরিবার সব ছেড়ে এসেছে। আর তার প্রতিদান কি পেয়েছে? আচমকাই তার মনে হলো, আচ্ছা, এই ঘরেই কি তার কারনেও এমনই ভর সাঝের বেলায় কেউ তার স্বামীর জন্য আকুল নয়নে কেঁদেছে?
চলবে…..