#নীড় #চতুর্দশ_পর্ব
#সুহা
সুপ্রিয় দর্শক মন্ডলী এবার আমরা এই বছরের সেরা উদ্যোক্তা পুরস্কার ঘোষণা করতে যাচ্ছি। টানা ৫ম বারের মত এই পুরস্কারটি পাচ্ছেন “নীড় টেক্সটাইলস” এর প্রতিষ্ঠাতা আনিক মাহমুদ। আমি আনিক মাহমুদ সাহেবকে মঞ্চে আসতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।
মুহূর্তেই চারিদিক করতালিতে মুখর হয়ে পরে। ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন ব্যক্তিকে স্টেজ এ উঠতে দেখা গেলো। লোকটা সম্পূর্ণ খাঁটি বাঙালিয়ানা সাজে আছে। বেশ স্নিগ্ধ তার মুখ চোখ গুলো যেমন তার মায়ার প্রকাশ করছে তেমনি তার তীক্ষ্ণ মেধারও প্রতিফলন ঘটাচ্ছে। লোকটি স্টেজ এ উঠে পুরস্কারটি গ্রহণ করলো। উপস্থিত সবাই আনিক মাহমুদকে চিনে আর যারা চিনতো না তাদেরও চিনতে বেশ বেগ পেতে হলো না। ভিড়ের মাঝে থেকে দুইজন ছেলে-মেয়ে সমস্বরে চিল্লিয়ে বলে উঠলো-
কংগ্রাচুলেশন আব্বু! কংগ্রাচুলেশন নীড় টেক্সটাইলস!
উপস্থিত প্রায় সবার নজরই তাদের উপর স্থির হলো। দুইজনকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে এরা যমজ ভাই-বোন, পিছন থেকে একজন নারীকে তাদের দুজনকে শাসাতে দেখা যাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে এরা আনিক মাহমুদ এর স্ত্রী-সন্তান। লোকটি মুচকি হেসে মাইক হাতে নিয়ে বললো-
আস্সালামুআলাইকুম, আশা রাখছি আপনারা সবাই ভালো আছেন। আমি আনিক মাহমুদ, নীড় টেক্সটাইলস এর প্রতিষ্ঠাতা। আজকে আমি এখানে আমার সফলতার পুরস্কার নিতে এসেছি কিন্তু আমার এই সফলতা যে আমার একার না। এই সফলতার ভাগিদার আমার পরিবার আমার সকল কর্মচারী ভাই-বোনেরও তাই এই পুরস্কাটাও তাদের সবার। আপাতত এখানে আমার কর্মচারী ভাই-বোনেরা উপস্থিত নেই কিন্তু আমার পরিবার উপস্থিত আছে তাই আমি তাদেরকে মঞ্চে এসে আমার সাথে এই পুরস্কারটি অর্জনের আনন্দ প্রকাশ করতে অর্জি জানাচ্ছি।
আনিকের কথা শুনে সেই যমজ ভাইবোন দ্রুত স্টেজ এ উঠে এলো এবং তাদের পিছন পিছন সেই নারীটিও স্টেজ এ এলো। আনিক এবার তাদের পরিচয় করিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্য বললো-
ইনি হলো আমার স্ত্রী নাইমা আর এরা আমার দুই সন্তান অন্তিকা আর অন্তিক।
সবাই করতালির সাথে তাদের স্বাগতম জানালো। অতঃপর আনিক পুরস্কারটা তাদের হাতে দিলে ক্যামেরাম্যান এই সুন্দর মুহুর্তগুলোকে ক্যামেরায় বন্দি করে নিলো।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
এত্ত বছর হয়ে গেলো পঙ্গু হয়ে বিছানায় পরে আছে তাও মরে না! বিরক্ত হয়ে গেলাম রে বাবা!
আরও নানান কথা বলতে বলতে রুমের থেকে নার্সটি বেরিয়ে গেলো।
আর এসব শুনেও নীরবে বিছানায় পরে রইলো আবির। গত ৮টা বছর ধরেই তো নীরবে সব সইতে হচ্ছে তার করবেই বা কি সে! সে যে আজ নিরুপায়………। তাঁরই পাপের ফল যে আজ তাকে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।
বলা বাহুল্য ঐদিন এক্সিডেন্টটা সম্পূর্ণই আবির আর মৌমিতার সাজানো চক্রান্ত ছিলো। তাদের পরিকল্পনা মাফিক অনিমার মৃত্যু হলেও আবিরের পায়েও অতিরিক্ত আঘাত লাগে যার ফলে তার পাদুটো অচল হয়ে পরে। কিন্তু মৌমিতার মধ্যে কোনো ভাবান্তর হয়নি। সে তখনও আবিরকে ইনশুরেন্স এর টাকাটা নেয়ার জন্য জোর করতে থাকে।এমনকি আবিরের বাইরে চিকিৎসার কথা তুলে ধরে সে। আবিরও ইনশুরেন্স এর টাকাটা তুলার জন্য আবেদন করলে অনিমার মৃত্যুর কারণে টাকাটা অতি সহজেই পেয়ে যায়। আবির টাকাটা তুলতে দেরি হয় মৌমিতার আসল মুখোশ উন্মোচন হতে দেরি হয়নি। ওই রাতেই আবিরের অফিস হতে তাকে ইস্তফা দেয়া হয় এবং তার নামে অফিসের কাজে কারসাজি এবং নারী কর্মীদের সাথে অনৈতিক কর্মের ফলে মামলা দায় করা হয়। আর এসব তথ্য ফাঁসকারী আর কেউ না বরং মৌমিতা। আবিরের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পরে সে কিছু বুঝার পূর্বেই তাকে পুলিশি হেফাজত এ নেয়া হয়। পরবর্তীতে সে জানতে পারে তার অগোচোরেই তার সকল সম্পত্তি মৌমিতা অতি চালাকির সহিত নিজের নামে করে নিয়েছে তার নামে আপাতত কিছুই নেই। এসব শোনার পর আবির পুরোই ভেঙে পরে তার মামলার শুনানি তেও তার পক্ষে কোনো আইনজীবী উপস্থিত না হলে তাকে যাবৎজ্জীবন দেয়া হয়। এক সাথে এতগুলো ধাক্কা আবির সামলাতে পারে না যার ফলে সে ষ্টোক করে। এরপর থেকেই পুলিশ এর নজরদারিতে একটি সরকারি হাসপাতালের কক্ষে পরে আছে সে। অবহেলা আর অনাদর এই তার জীবন কাটছে। পঙ্গু অবস্থায় এই বিছানায় পড়ার পর থেকে আবির বুঝতে পারছে পরিবার আসলে ঠিক কি!তার কড়া সকল অন্যায় এখন তার বিবেক কে নারা দেয় সে আজ অনুতাপ। কিন্তু আফসোস! এখন যে কোনোই লাভ নেই! এসব ভেবেই আবিরের চোখ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়লো।কবে যে মিলবে এই অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি!
অপরদিকে অনিমার লাশটা তদন্তের কারণে হস্তান্তর এ দেরি হয় আর পরও আবিরের অনুপুস্থিতিতে পরিবারের কেউ লাশটা নিতে আসে নি এমনকি তার সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী নাতাশাও না। কেউ না আশায় তাকে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন দেওয়া হয়।
আর মৌমিতার খবর কেউ জানে না হঠাৎ করেই সে গায়েব হয়ে যায় পরে তার খবর আর কেউ পায় নি।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
এয়ারপোর্ট এ দাঁড়িয়ে আছে আনিক নাইমা, অপেক্ষা তাদের অঙ্কিতা আর রবির। দীর্ঘ ৮ বছর পরে অঙ্কিতা দেশে আসছে তার সাথে রবি তাই তাদের স্বাগতম জানাতেই আনিক আর নাইমা এসেছে। ক্ষণকাল অতিবাহিত হতেই অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অঙ্কিতা আর রবি এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে আসে। রবির কোলে তাদের ছেলে অঙ্কন। তারা বেরিয়ে এলেই আনিক আর নাইমা তাদের কাছে গিয়ে কুশলাদি বিনিময় করে বাড়ির পথে পা বাড়ায়। চলার তালেই আনিক ধীর স্বরে অঙ্কিতাকে বলে-
মরীচিকার মোহ ছেড়ে আসল স্বর্ণ খুঁজে বের করতে পাড়ায় তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
অঙ্কিতা আনিকের এই কথা শুনে মৃদু হাসির রেখা টেনে গাড়িতে চড়ে বসে। আনিকও সেটা দেখে একটা হাসি দেয়।অতঃপর বাড়ির পথে তার যাত্রা শুরু হয়।
এভাবেই জীবনের এই পথে কেউ নীড়ের পাখি হয়ে থাকে আর কেউ নীরহারা পাখি হয়ে ঘুরে বেড়ায়।
~সমাপ্ত~