নীড়
#সূচনা_পর্ব
#সুহা
তোমার ভাইয়ের কী নূন্যতম চক্ষুলজ্জাও নেই এমন প্রতিদিন আমাদের ফ্রীজটা ব্যবহার করছে! বলি ফ্রীজটা আমার বাপের বাড়ি থেকে আমায় দিয়েছে আমার সংসারে ব্যবহার এর জন্য তোমার ভাই এর জন্য নয়। তারপরেও নিত্যদিন ছোটলোকের মতো এসে পরে কিছু না কিছু রাখতে ফ্রীজ টায়। আর রমজানের সময় তোহ কথাই নেই রোজ পানি রাখবে আর নিয়ে যাবে। যত্তসব ফকিন্নির দল! আর সহ্য হয় না এদের!(অনিমা)
আহা এমন করছো কেন? আমি বুঝি সেধে তাদের নিয়ে এসেছি! এমন নির্লজ্জের মতো মতো প্রতিবার আসে তোহ কী আর করার। ছোটোলোক আর কী!পড়াশোনা কিছু করেছে নাকি যে এইসব জ্ঞানবোধ থাকবে?(আবির)
হমম না জানি কতদিন এইসব ছোটোলোকেদের সহ্য করতে হয়! তার উপর থাকেও এক টিনের ঘরে! আমাদের দোতালা বিল্ডিং এর সব সৌন্দর্য টাই নষ্ট করে দেয় ওই ফকিন্নি মার্কা টিনের ঘর!(অনিমা)
আরে আর দিন দুয়েক সহ্য করো।দলিলের কাজগ বানিয়ে ফেলেছি।একবার শুধু দলিলে ওই মূর্খের সাইন করাই পরে ঘাড় ধরে বের করবো এই বাড়ি থেকে।পরে ওই টিনের ঘর সরিয়ে ওখানে একটা সুন্দর একটা ছোট ঘর বানাবো তোমার আর আমার সুন্দর মুহুর্ত কাটাতে।(আবির)
আর কিছুই শুনতে পারলো না আনিক মস্তিষ্ক তার ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। নিজের ছোট ভাই এ তার স্ত্রীর মুখ থেকে তার প্রতি এহেন মন্তব্য শুনে স্তব্ধ সে।এসেছিলো ভাইয়ের ঘরের ফ্রীজে কিছু মাছ রাখতে কিন্তু এহেন কথায় আর আগানোর সাহস পায়নি সে। চুপচাপ নতমস্তকে নিজের ঘরে চলে আসলো।
কিগো মাছের পোটলাটা নিয়েই চলে আসলা যে!আবির আর অনিমা বুঝি ঘরে নাই?(নাইমা)
আরে ওরা আর কই যাবে ঘরেই আছে তোহ। আর আমার না আজকে একটু বেশিই মাছ খাইতে মন চাইতেসে। তুমি পুরাটাই রান্না করো তোহ। এক্কেবারে ঝোল ঝোল করে রাঁধবা কেমন। আজকে এক্কেবারে কব্জি ডুবায় খামু। (আনিক)
স্বামীর মুখের কথাটা কেন জানি বিশ্বাস হলো না নাইমার। দীর্ঘ ৫ বছরের সংসার জীবন তাদের। কই কখনো তোহ দেখেনি তাকে এমন আচরণ করতে। নিজের ভাবনাকে নিজের মাঝেই চেপে রাখলো সে, হাসিমুখে স্বামীর কথায় সায় জানিয়ে রান্নাঘরের দিকে অগ্রসর হলো সে।
এতক্ষন নিজের মুখে মিথ্যা হাসির প্রলেপ টেনে রাখলেও এখন আর সম্ভব হলো না। নিকষ কালো আঁধারে মুখটা ঢেকে গেলো আনিকের। পুরুষ মানুষের নাকি কাঁদতে নেই কিন্তু আজকে তার কাঁদতে মন চাচ্ছে। আজ যদি সে না কাঁদে হয়তো ভেতরের কষ্ট গুলোর চাপায় তার মৃত্যু হবে। দৌড়ে বাথরুমে গিয়ে পানি ছেড়ে মুখ চেপে কান্না করতে লাগলো সে। নিজের আদরের ছোট ভাই যাকে কিনা নিজের সন্তানের মতো আগলে রাখলো সেই কিনা তাকে নিয়ে এমন খেলায় মাতলো। আজ নিজেকে ব্যার্থ এক সৈনিক মনে হচ্ছে। এই কী ছিলো তার নিঃস্বার্থ ভালোবাসার প্রতিদান!
বাবা-মা আর ছোট ভাই আবিরকে নিয়েই ছিলো আনিকের পৃথিবী। বেশ সুখেরই ছিলো এই পরিবার কিন্ত ঘন এক কালবৈশাখীর তান্ডবে যেন লন্ডভন্ড করে দেয় তাদের এই পরিবার।
যেদিন নিজের মাধ্যমিক পরীক্ষার উত্তীর্নর ফলাফল নিয়ে বাড়ির উঠানে আসতেই বাবার নিথর দেহটি নজরে আসে ওদিনই যেন তার সব আনন্দ হারিয়ে যায় । বাবার মৃত্যুর মাস ঘুরতে না ঘুরতেই মাও তাঁদের ফাঁকি দিয়ে চলে যায় না ফেরার দেশে। কিন্তু দিয়ে যায় এক গুরুদায়িত্ব, নিজের ছোটো ভাইয়ের দায়িত্ব।তারপর থেকেই নিজের ছোট ভাইয়ের বটবৃক্ষ হয়েই জীবন কাটতে লাগলো তার। কিন্ত এতে আফসোস কখনোই হয়নি তার। নিজের শখ আল্হাদকে বিসর্জন দিয়ে নেমে পরে উপার্জনের পথে। দিনের পর দিন খেটে ভাইকে সুশিক্ষিত করে সে। ভাইয়ের সকল চাহিদাকে পূর্ণ করতে থাকে সে।আজ তার ভাই বিশাল কোম্পানিতে জব করে নিজের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করেছে। আনিক ভেবেছিলো এই বুঝি তার পরিবার এর সকল যন্ত্রনা শেষ।তার নীড় আবার পূর্ণ হলো। কিন্ত হায় আজ সে জানতে পারলো সেই যে তার পরিবারের যন্ত্রনা! আর ভাবতে পারছে না সে ভিতরটা তার দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।
কী হইসে তোমার? চোখগুলো এমন লাল কেন? শরীর খারাপ?(নাইমা)
নাইমার কথার ঠিক কী জবাব দিবে তা জানে না আনিক। কোন মুখে বলবে সে যেই ভাইকে নিজের সর্বস্ব উজাড় করে প্রতিষ্ঠিত করলো সেই আজ তাদের বোঝা ভাবে! কিভাবে সহ্য করবে নাইমা!সেও তোহ কম করেনি! হাসিমুখে স্বামীর সাথে নিজেও সব শখ আল্হাদ কে মাটি চাপা দিয়েছে সে।
আরে নাহ তেমন কিছুই না চোখে কী জানি পড়সিলো তাই আর কী। তুমি এত চিন্তা করিও না। আসো খেতে বসো।(আনিক)
নাইমাও পাতে ভাত বেড়ে খেতে বসবে এমন সময় ঘরে প্রবেশ করে আবির ও অনিমা। তাদের এমন আকস্মিক আগমনে আনন্দে আটখানা হয়ে পরে নাইমা, কতদিন পর ভাইটা তাদের ঘরে এলো! সে উৎফুল্লতার সাথেই তাদের স্বাগতম জানাতে লাগলো –
আরে ছোট ভাই আর অনি আয় আয় বস। একদম সঠিক সময়ে এসেছিস তোরা খেতে বসে পর। গরম ভাতের সাথে মাছ ভুনা আয় বসে পর।(নাইমা)
এদিকে অনিমা শুধু চারিদিকে তাকাচ্ছে আর মুখ মোচড়াচ্ছে যেন সে কোনো ময়লার স্তপে দাঁড়িয়ে আছে। নাইমা খেয়াল না করলেও আনিক তা ঠিকই খেয়াল করেছে আর তার ভাই আজ কেন তার ঘরে পা রেখেছে তাও সে ভালো করেই জানে।
না না ভাবি আজ না অন্য দিন। আজ একটু দরকারি কাজে ভাইয়ের কাছে আসছি ওটা করাটা বেশি দরকার।(আবির)
তোহ কী হইসে? কাজ কাজের জায়গায় এতে খাবারের কী? আয় খেতে বস!(নাইমা)
আহা নাইমা ওরা যখন খেতে চাচ্ছে না কেন জোর করছো? বল আবির কী কাজ?(আনিক)
যদিও সে জানে ঠিক কী কাজে তার ভাই আজ তার দুয়ারে এসেছে তাও একবার তার মুখ থেকে শুনতে চায় সে।
ভাই হইসে কী আজকাল তোহ সবই ডিজিটাল চলে তাই ভাবতেসি আমাদের জমিটার সকল দলিলগুলোও ডিজিটাল করে দিবো। তাই আর কী তোমার সাইন লাগবে। আমি সব করে ফেলসি তুমি শুধু সাইন টা করে দাও তাহলেই হয়।(আবির)
আনিক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলো।তারই আপন ভাই তাকে নিঃস্ব করতে কী সুন্দর পরিকল্পনা টাই না করলো! পরমুহূর্তেই একটা হাসি দিলো যাতে হাজারো চাপা কষ্ট লুকিয়ে ছিলো।অতঃপর কাজগটা হাতে নিয়ে পড়তে লাগলো যদিও সে জানে আবির বা অনিমা তাকে পড়তে দিবে না। হলোও তাই! যেই না সে কাজগটা পড়তে শুরু করলো অমনি অনিমা ফোড়ন কেটে বলে উঠলো –
কী ভাইয়া নিজের ছোট ভাইয়ের উপর দেখি আপনার রত্তি পরিমান ভরসাও নেই!
আনিক শুধু একবার চোখ তুলে তাকালো নিজের ভাই ও তার বৌয়ের দিকে পরে চুপচাপ সাইন করে দিলো দলিলে।
দলিলে সাইন পেয়ে তোহ আবির আর অনিমা আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে গেছে। তারা খুশিমনে কাগজ নিয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো। আর সেদিকে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আনিক। এতটা ছলনা! একটাবার বললে কী হতোনা সে তোহ দিয়েই দিতো। নিজের জীবনটাই যেখানে ভাইয়ের প্রতি উৎসর্গ করে দিয়েছে সেখানে এইটুকুন জমি আর কী!বুক ভরা কষ্ট নিয়ে একটু ঘুমানোর চেষ্টা আনিক যদিও ঘুম আসবার নয়।
উফফ আমার ভাবতেই আনন্দ লাগছে এতদিনের মনোবাসোনা এইবার পূর্ণ হলো। শুধু আজকের রাত আগামীকাল আমাদের বাড়ি ওই আবর্জনা মুক্ত।(অনিমা)
তা যা বলেছো অনিমা। এই ভালোমানুষির নাটক আর দেখাতে পারছি না। বিরক্ত হয়ে পড়েছি। শুধু সকাল হওয়াটাই বাকি তারপরেই ……….(আবির)
দুজন মিলে উচ্চস্বরে হাসতে লাগলো।
কিগো আজ তুমি নিজেই নামাজ পড়তে উঠে পড়লে যে রোজ তোহ আমায় দেকে দিতে হয়।(নাইমা)
নাইমার কথায় আনিক একটু মুচকি হেসে বললো –
কখনো আমাগো জীবনে এমন কিছু হয় যা আমরা ভাবিও না। (আনিক)
নাইমা বোকার মতো আনিকের দিকে তাকিয়ে থাকলো। আর আনিক বেরিয়ে পড়লো নামাজ পড়বার উদ্দেশ্য। কী বলবে সে? তার যে কিছুই বলার নেই! ভাগ্যর নির্মম পরিহাসে আজ সে নিস্তব্ধ!
চলবে …………..