নীল_ডায়েরির_সেই_মেয়েটি পর্ব-২৫+২৬

0
657

#নীল_ডায়েরির_সেই_মেয়েটি
#আরদ্ধিতা_রুহি
#পর্বঃ ২৫+২৬

🍁

কেটে গেছে বেশ কয়েকদিন,, এরই মধ্যে আরোহী তার বাবার বাসায় গিয়ে ও ঘুরে এসেছে। ঘুরে এসেছে বললে ভুল হবে, আঁধার অনেক হুমকি ধমকি দিয়েই তার বাবা মাকে দিয়ে নিয়ে এসেছে!

যদিও কথা ছিলো বিয়ের এক বছর অব্দি আরোহী তার বাসা থেকেই পড়াশোনা করবে কিন্তু আঁধারের কথা বিয়ে করেছি কি আর বউকে বাবার বাসায় রাখার জন্য! আঁধার জনসম্মুখে যখন এভাবে বলেছিল আরোহীর তখন লজ্জায় মাটি ফাঁক করে ঢুকে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল।

কিন্তু আঁধার আরোহীকে আরও কয়েকগুন লজ্জা দেওয়ার জন্য বলেছিলো,,,” নাহলে ফিউচার প্লানিং করতে দেরি হয়ে যাবে তো!” আঁধারের কথা শুনে তারেক চৌধুরী কেশে উঠেছিল!

আঁকলিমা চৌধুরী চুপচাপ রান্নাঘরে চলে যান, আর আরোহী চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নেয়।

কিন্তু আঁধার তার সিদ্ধান্তে অনড়! তারেক চৌধুরী কি করবেন ভেবে না পেয়ে আরোহীকে জিজ্ঞেস করেন,,,”আরোহী মা তুমি কি চাও বলো তো!”

আরোহী একপলক আঁধারের দিকে তাকিয়ে বলে,,,”আপনারা যেটা বলবেন সেটাই আমি মানবো বাবা।”

“কি বললে তুমি,ওরা যেটা বলবে সেটাই মানবে আর আমি যে তোমার বর সে কথা কি তুমি ভুলে গেছো আরু!”

আঁধার প্রথমে চিৎকার করে কথাগুলো বললেও পরের কথাটা নরম সুরে মায়া মায়া চোখে আরোহীর দিকে তাকিয়ে বলে।

এতে যেনো আরোহীর একটু মায়া হয়, কিন্তু তারেক চৌধুরী তার বড় ছেলের ছেলেমানুষী দেখে বলে,,,”একদম ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করবে না ওকে।”

আঁধার কিছু বলবে তার আগেই তার ফোন বেজে ওঠে, বিরক্ত হয়ে রিসিভ করে বাহিরে চলে যায়। কিন্তু যাওয়ার আগে আরোহীর দিকে একপলক তাকিয়ে চলে যায়।

আরোহী যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচে! তারেক চৌধুরী নিজেও সস্থির নিশ্বাস ছাড়ে।

আর আলিশা বেচারির তো হাসতে হাসতে শুয়ে পড়ার মতো অবস্থা হয়েছিল! আরোহী বিরক্ত হয়ে আঁধারকে মনে মনে গালি দিচ্ছিল,তার মতে আঁধার দিন দিন বেয়াদব হয়ে যাচ্ছে,চরম বেয়াদব!

এরপর আঁধার নিজ দায়িত্বে আরোহীকে তার বাবার বাসায় পৌঁছে দিয়ে এসেছিল ঠিকই তবে তিন,চার দিনের দিন তার বাবা মাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করে আরোহীকে নিয়ে এসেছে।

কিন্তু আরোহীর বাবা শর্ত জুড়ে দিয়েছেন তাদের ধুমধামে বিয়ে দিবেন কিছুদিন পরেই , আঁধার ও বিনাবাক্যে রাজি হয়েছে!

তবে শর্ত হিসেবে সেও বলেছে বিয়ের আগেও তার বউ তার কাছেই থাকবে। কি আর করার সকলে বিরক্ত হলেও মেনে নিয়েছে।

বিকেলে বসে বসে এসব ভাবছিলো আরোহী! আঁধার নেই, বাহিরে গেছে আর যাওয়ার আগে বলে গেছে ফিরতে রাত হবে। আরোহী নিজেও আর কিছু জিজ্ঞেস করে না, তবে মন খারাপ হয়ে আছে তার নীলিমার জন্য।

নীলিমা তার পর থেকেই স্বাভাবিক ব্যাবহার করেছে সকলের সাথে এমনকি আরোহীর সাথেও।

কিন্তু সেদিনের পর থেকেই সে যখনই সময় পায় আঁধারের সাথে চিপকে থাকার চেষ্টা করে, যেটা আরোহীর মোটেও সহ্য হয় না।

আরোহী বুঝতে পারে মেয়েটা আঁধারকে অনেক ভালোবাসে কিন্তু আঁধার বিবাহিত সেটা ভুলে যায় হয়তো। তবে সে আঁধারকে কখনো কিছু বলে নি তাই আঁধার ও আরোহীকে এসব ব্যাপারে ভাবতে বারণ করেছে।

সে নীলিমাকে বন্ধু ছাড়া কিছুই ভাবে না সেটাই বলেছে। কিন্তু আরোহীর কেনো যেনো এখন আর আগের মতো নীলিমাকে সহ্য হয় না। আঁধার যদিও মাঝে মাঝে নীলিমার উপর বিরক্ত হয় কিন্তু কোন এক কারণে কিছু বলতে পারে না।

আরোহীর ইচ্ছে করে নীলিমাকে কয়েকটা কড়া কথা শুনিয়ে দিতে কিন্তু কি করবে সে ও তো একটা মেয়ে! একটা মেয়ে হয়ে আর একটা মেয়েকে কি করে বাজে কথা বলবে সে।

পেছন থেকে কেউ কাঁধে হাত রাখতেই চমকে পেছনে তাকায় আরোহী,আলিশাকে দেখে মলিন হেঁসে বলে,,,

–‘ভয় পেয়ে গেছিলাম! ‘

–‘তুই কি নিয়ে এতো চিন্তা করছিলিস বল তো?’ কয়েকবার ডেকেছি পেছন থেকে শুনতেই পাসনি?

–‘এমনি আপু বস!’

–‘তোর কি হয়েছে আরো,সত্যি করে বল তো?’

আরোহীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে আলিশা।

আলিশাকে সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকাতে দেখে আরোহী একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে সব বলতে শুরু করে। আরোহীর কথা শুনে আলিশার চোয়াল শক্ত হয়ে যায়,নীলিমার প্রতি ক্ষোভ জমে যায় অন্তরে।

–‘চল নীলিমার সাথে দেখা করবো,ওকে সাবধান করতে হবে!’ ও কি করে পারে এমনটা করতে বল তো? ও জানে না আঁধার বিবাহিত।

রাগে চোয়াল শক্ত করেই কথা গুলো বলে আলিশা।আরোহী অবাক হয় না, এই মেয়েটিই কয়েকদিন আগে তাকে আর আঁধারকে আলাদা করার জন্য কতো কি করলো আর আজকে নিজেই এসব বলছে? আসলেই মানুষ যখন বদলে যায় তার সবকিছুই বদলে যায়।

–‘না আপু, আমার মনে হয় না সেটা ঠিক হবে, আবার মনে হচ্ছে দেখা করে কিছু কথা বলা উচিত!’

–‘তুই পাগল আরো কথা বলা উচিত না বলা দরকার, আর আঁধারই বা কিছু বলছে না কেনো বুঝতেছি না?’

–‘বাদ দাও, আর তুমি বলো আমাদের পুঁচু সোনা কেমন আছে? ‘

আরোহীর কথায় লজ্জা পায় আলিশা,,,,

–‘ও তো এখন ভালোই আছে, কিন্তু পুঁচু সোনা তার খালামনির জন্য চিন্তিত! ‘

আলিশার কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে আরোহী। তখনই লিমা এসে বলে,,,

–‘আফা আপনাগো ডাহে, ছোড ভাইজান নিচে!’

আরোহী ও আলিশা একে অপরের দিকে তাকায়, হঠাৎ আদর ডাকছে কেনো? সেটা ও আবার দু’জনকে একসাথে?

–‘কেনো রে লিমা? ‘

আলিশার কথায় লিমা হতাশার সাথে বলে,,,

–‘আঁধার ভাইজানের বন্ধুরা আইছে!’

আঁধারের বন্ধুদের কথা শুনে ভ্রুকুঁচকায় আরোহী।

–‘চল!’

বলেই নিচের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে আসে তারা।

তরী ও নীলিমা এসেছে,আরোহী অবাক হয় বটেই! সকালেই তো এদের সাথে দেখা করে আসলো তাহলে এখন এরা কেনো?আলিশা তীক্ষ্ণ চোখে তাকায়, এদের সে ভালো করেই চেনে নীলিমা ও তরী। কিন্তু এরা হঠাৎ একা কেনো?

আরোহীকে নিচে নামতে দেখে তরী হাসার চেষ্টা করে কিন্তু নীলিমা কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আরোহীর দিকে! আরোহী তরীর দিকে তাকিয়ে হালকা হাসার চেষ্টা করে, তরী নিজেও হাসার চেষ্টা করে বলে,,,

–‘আরোহী ভাবি আমরা তোমার সাথে একটু কথা বলতে এসেছি!’

আরোহী তরীর হঠাৎ ভাবি ডাকার কারণে একটু অবাকই হয় বটে তবে তেমন কিছু বলে না শুধু মাথা নাড়ায়! আলিশা আদরের দিকে তাকায়, আদর সন্দেহের চোখে সবাইকে পর্যবেক্ষণ করছে!

কারণ আঁধার ছাড়া কখনো এরা তাদের বাসায় আসেনি, তাহলে আজকে কেনো?

–‘ভাইয়া কিন্তু বাসায় নেই, তোমরা বসো আমি আম্মুকে ডাকছি!’

আদরের কথায় তরী বলে,,,

–‘আমরা জানি!’ আসলে,,

তরীর কথার মাঝেই নীলিমা বলে,,

–‘আর জানি বলেই তো এসেছি!’

নীলিমার কথাটা শেষ হওয়ার সাথেই আরোহী অবাক চোখে তাকায়,আর আলিশা বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকায়।

তরী মনে মনে ভাবছে,,,”এটা কি করলাম আমি, বাধ্য হয়ে তো এই পাগলের সাথে আসলাম এখন না জানি আরোহীকে কি থেকে কি বলে ফেলে! আঁধারটা ও বাসায় নেই, এতোবার ফোন দিচ্ছি ফোনটা ও ধরছে না। উফফ ভাল লাগে না!”

আর আরোহী ভাবছে,,,” কি এমন দরকার এদের যে আঁধার বাসায় নেই জেনেও আমার সাথে দেখা করতে এসেছে!

–‘আমি কি তোমার সাথে একটু একা কথা বলতে পারি?’

তরীর কথা শুনে আরোহী মাথা নাড়িয়ে সায় জানায়, কিন্তু নীলিমা তরীর হাত চেপে ধরে। তরী একটু হাসার চেষ্টা করে নীলিমার দিকে তাকায়,নীলিমা তরীকে অবাক করে দিয়ে বলে,,

–‘আরোহী আসলে তরী ভুলে নিজের কথা বলে ফেলেছে, আমি একটু একা তোমার সাথে কথা বলতে চাই এটাই বলতে চেয়েছিলো সে।’

আরোহী ভ্রুকুঁচকে তাকায়, আলিশা চোখ মুখ কুচকে তাকায় নীলিমার দিকে তার মনে সন্দেহ হচ্ছে নীলিমাকে নিয়ে? সে একা কেনো আরোহীর সাথে কথা বলতে চাচ্ছে?

তরী অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় এবার নীলিমার দিকে,,,”মনে মনে বলে উল্টা পাল্টা কিছু বলিস না বইন, পরে না জানি তোর সাথে সাথে আঁধার আমাকে ও ডিটার্জেন্ট ছাড়া ধুইয়ে দেয়! ”

তরী মনে মনে খুব করে চাচ্ছে আরোহী যেনো না বলে,নাহলে কেউ একজন এসে বাঁধা দেয়। কিন্তু তরীর ভাবনার মাঝের আরোহী রাজি হয়ে যায়।তরী অসহায় চোখে সবার দিকে তাকায়, আলিশা চোখ মুখ শক্ত করে আরোহীকে বলে,,,,

–‘আরো তুই কি বলছিস এসব?’ তুই….’

–‘আপু প্লিজ! ‘

আরোহী আলিশাকে চোখ দিয়ে কিছু একটা ইশারা করে কথাটি বলে। আলিশাও চুপ হয়ে যায়! আরোহী নীলিমাকে তার সাথে আসতে বলে নিজেও উপরে চলে যায়, নীলিমা আরোহীর পিছু পিছু এগিয়ে যায়।

তরী ধপ করে সোফায় বসে পড়ে! এতে যেনো আলিশা কিছুটা অবাকই হয়, আলিশাকে অবাক করে দিয়ে তরী আলিশাকে বলে,,,

–‘এক গ্লাস পানি হবে!’

আলিশা মাথা নাড়িয়ে পানি আনতে চলে যায়, তরী গালে হাত দিয়ে ভাবতে থাকে কি হতে চলেছে এরপর!

–‘তোমাদের ব্যাপারটা আসলে কি বলো তো তরী আপু?’ তোমরা আসলে করতে চাচ্ছোটা কি? আর নীলিমা আপু আরোহীর সাথে একা কথা বলতে চাচ্ছে কেনো? এভরিথিং ইজ অলরাইট!

আদরের কথা শুনে তরী ভয়াক্রান্ত মন নিয়ে বলে,,,

–‘এতোক্ষণে তো সব ঠিকই ছিলো রে আদর কিন্তু এখন যে আসলেই সব ঠিক থাকবে কি না বলতে পারছি না!’

এরইমধ্যে আলিশা পানির গ্লাস এগিয়ে দেয় তরীর দিকে। তরী গ্লাসটা হাতে নিয়েই এক নিস্বাসে সবটুকু পানি খেয়ে আলিশার দিকে ফাঁকা গ্লাসটা এগিয়ে দেয়।

আদর অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায় তরীর দিকে,কিন্তু তরী সে দিকে পাত্তা না দিয়ে বলে,,,

–‘আঁধারকে ফোন দে তো আমার ফোন ধরছে না, না জানি বালডায় কোথায় আছে! ‘

আদরকে তখনো তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবার বলে উঠে তরী,,,

–‘কি রে,ফোন দে!’

আদর এবার আর কোন কথা না বলে উঠে এসে তীর পাশের সোফায় বসে পড়ে, তারপর আঁধারের নাম্বারে ফোন দেয়।কিন্তু ফোন বন্ধ বলতেই সে তরীর দিকে নিরাশার দৃষ্টিতে তাকায়।

–‘তার মানে ফোন এখন ও বন্ধ, এখন কি হবে রে আদর!’

–‘কি হয়েছে আপু,একটু বললে ভালো হতো!’

আলিশার কথায় তার দিকে তাকায় তরী,একটা হাত দিয়ে আলিশাকে তার পাশে টেনে বসিয়ে দেয়।আদর আঁতকে উঠে বলে,,,

–‘এই আপু এই আস্তে লেগে যাবে ওর, বাবুর ক্ষতি হতে পারে তো!’

আদরের কথায় অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে তরী।

–‘বাবু!’

হঠাৎ তরীর চিৎকারে ভয় পেয়ে যায় আদর আলিশা দু’জনেই!

–‘কি রে বাবু কোথা থেকে আসলো বল? ‘

তরীর কথায় লজ্জা পায় এবার আলিশা, আর আদর মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে,,

–‘না মানে,,,, ‘

–‘থাক আর বলতে হবে না, তবে তুই যে এতো ফাস্ট সেটা তো বুঝতেই পারিনি রে!’ তবে ফাস্ট তো হওয়ারই কথা আঁধারকে টপকে আগে বিয়ে করে নিয়েছিস।

তরীর কথায় হালকা হাসার চেষ্টা করে আদর। আলিশা লজ্জায় মাথা নিচু করে নেয়।

–‘বাদ দাও সেসব এখন, আসল কাহিনি বলো!’

আদরের কথায় তরীর মনে ভয়ের বাসা বাধা শুরু হয়,ভয়ে ভয়ে সে আদর ও আলিশাকে সবকিছু শুরু থেকে বলা শুরু করে। সব শুনে আদরের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মতো অবস্থা।আলিশা তো নির্বাক কারণে তাকে আরোহী আগে থেকেই সব বলেছিল।

–‘নীলিমা আপু তো জানে ভাইয়া বিবাহিত এটা এখন আর সম্ভব নয়, তাহলে তবুও এসবের মানেটা কি বুঝলাম না ভাই!’

আদরের কথা শুনে তরী হতাশার সাথে বলে,,,

–‘বিশ্বাস কর আদর আমি ওকে হাজার বার বুঝিয়েছি কিন্তু সে হ্যা না কিছুই বলে না!’ তবে আঁধারের আসে পাশে থাকার চেষ্টা করে সবসময়। আর আজকে তো আমায় ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করে নিয়ে আসলো।

–‘কি করবো এখন আমরা, সে যদি আরো কে উল্টা পাল্টা কিছু বলে বসে তখন কি করবো আমরা?’

মাথায় হাত দিয়ে বলে আদর!

–‘আঁধার ভাইয়া এই মেয়েটাকে কিছু বলে না কেনো বুঝি না?’

আলিশার কথা শুনে তরী তার দিকে ভ্রুকুঁচকে তাকায়।তরীর দৃষ্টি দেখে আলিশা আমতা আমতা করে বলে,,,

–‘না মানে নীলিমা আপুর কথা বলছিলাম আর কি হে হে! ‘

আলিশাকে এভাবে কথা বলে হাসার চেষ্টা করতে দেখল আদর মুখ চেপে হাসে। তরী এবার স্বাভাবিক হয় বলে,,,

–‘নীলিমার মা নেই, এমন কি তার কেউই নেই তাই আঁধার তাকে কিছু বলতে পারে না!’ আমাদের তো সবকিছু সেয়ার করার মতো মা আছে, বাবা আছে কিন্তু ওর বাবা তে থেকেও নেই। ওকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে কয়েকদিন আগে ওর সৎ মা। মেয়েটা একটু ভালোবাসার পাগল জানো তো আলিশা, হয়তো আঁধারকে এই জন্যই ভালোবেসেছিলো সে।

ধরা গলায় কথাগুলো বলে তরী।আলিশার খারাপ লাগে, মা-বাবা না থাকার কষ্ট তারা বুঝে না ঠিকই তবে এই কয়েকদিনে অনেকটায় বুঝে গেছে আলিশা মা বাবা আসলে কি জিনিস।

–‘বলেন কি বলবেন?’

রুমের ভেতরে ঢুকেই উক্ত কথাটি নীলিমার দিকে ছুঁড়ে দেয় আরোহী।

–‘বসে বলি!’

–‘জ্বি! ‘

সোফায় বসে আরোহী জন্য জায়গা করে দেয় নীলিমা। আরোহী নিজেও বসে পরে নিচের দিকে তাকিয়ে।

–‘আরোহী, উপস সরি আরু! এই নামেই তো ডাকে আঁধার তোমায় তাই না?’

কিছুটা তাচ্ছিল্য সহিত কথাটি বলে নীলিমা। আরোহী এবার চোখ তুলে তাকায়, বাঁকা হেঁসে বলে,,,

–‘হ্যা,তবে আরও অনেক কিছুই বলে ডাকে! ‘

আরোহীর কথায় ভ্রুকুঁচকে বলে নীলিমা,,,

–‘আমি ও আঁধার একে অপরকে অনেক ভালোবাসি সেটা কি তুমি জানো?’ আঁধার বলে নি তোমায়?

–‘আপনি আঁধারকে ভালোবাসেন আর আঁধার শুধু তার একমাত্র বউকে মন প্রাণ উজার করে ভালোবাসে সেটা আমিও জানি।’ আর আমার বর ও এটাই বলেছে আমাকে।

শক্ত কন্ঠে কথাগুলো বলেই শেষ করে আরোহী।নীলিমা নিজেকে স্বাভাবিক করেই বলে উঠে,,,

–‘সবই জানো দেখছি, তাহলে সরে যাচ্ছো না কেনো আমাদের লাইফ থেকে?’ আমার আঁধারকে আমার করে কেনো দিচ্ছে না?

–‘আমি আপনাদের মাঝে নেই এমনকি আপনার লাইফের এক কোণায় ও নেই আমি, আমি শুধু আমার বরের লাইফেই আছি!’ এন্ড মোস্ট ইম্পরট্যান্ট টপিক, সেম কথা তো আমিও আপনাকে বলতে পারি সরে যাচ্ছেন না কেনো আমাদের লাইফ থেকে? আর রইলো কথা আঁধারকে আমার করে দেওয়ার সেটার আর দরকার নেই কারণ আমার বর আমারই।

আরোহীর কাঠকাঠ জবাবে নীলিমার কষ্টটা যেনো একটু বেশিই বেড়ে যায়,মলিন হেঁসে বলে,,,

–‘খুব ভালোবাসো আঁধারকে তাই না?’

নীলিমার কন্ঠে কিছু একটা ছিলো যেটা আরোহীকে নীলিমার প্রতি সহানুভূতি দেখাতে বাধ্য করলো।

–‘হুম, তবে হয়তো আপনার থেকে কম না!’

আরোহীর নরম কন্ঠে এবার যেনো নীলিমা ও একটু নরম হলো।

–‘জানো তো আরোহী আমিও আঁধারকে অনেক ভালোবাসি, তবে আঁধার আমাকে ভালোবাসে না!’ কেনো আরোহী, আমায় কি একটু ও ভালোবাসা যায় না?

আরোহী একটু চেপে বসে নীলিমার কাঁধে হাত দিয়ে বলে,,,

–‘ভালোবাসার জন্য সঠিক মানুষ দরকার হয় আপু আর আপনার ভালোবাসার মানুষটি সঠিক নয় সে অন্য কারো স্বামী!’

এবার নীলিমা আর নিজেকে আটকাতে পারে না হু হু করে কেঁদে দেয়।

আরোহী কি করবে বুঝতে না পেরে নীলিমাকে জড়িয়ে ধরে, এতে যেনো নীলিমার কান্নার বেগ বেড়ে যায়।আরোহীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,,,,

–‘সবাই কেনো আমায় অবহেলা করে আরোহী বলো না, যার কাছেই একটু ভালোবাসার জন্য যাই সেই আমায় দূর ছাই করে তাড়িয়ে দেয়! ‘ আমি,আমি মায়ের ভালোবাসা পাই নি, বাবার ভালোবাসা পাইনি,ছোট মায়ের ভালোবাসা পাইনি, এমনকি আঁধারের ভালোবাসা ও পেলাম না।

নীলিমার জড়িয়ে যাওয়া কথাগুলো আরোহী অনেক কষ্টে বুঝতে পারে,তার ও বুকটা কেঁপে উঠে। এই মেয়েটি যে ছোট বেলা থেকেই অবহেলিত সেটা আজকে সে বুঝতে পারছে। আঁধার কেনো নীলিমার হলো না সেটা ভেবছে আরোহী, কিন্তু পরমুহূর্তেই বুকটা কেঁপে উঠছে,, আঁধার যদি নীলিমার হতো তাহলে আরোহীর কি হতো।

নীলিমার হঠাৎ হুস আসে, আরোহীকে ছাড়িয়ে ঠিক মতো বসে চোখ মুছে নিয়ে বলে,,,

–‘আমি আসছি, ভালো থেকো আর তোমাদের মাঝে আসবে না!’

আরোহীকে কিছু বলতে না দিয়েই এক ছুটে বেরিয়ে যায় নীলিমা।আরোহীর নিজের চোখ দিয়ে ও টপটপ করে পানি পড়ছে।

নীলিমাকে এভাবে নিচে আসতে দেখে সবাই অবাক হয়ে যায়, নীলিমার চোখের পানি দেখেই সকলে আন্দাজ করতে পারে হয়তো ভালো কিছু হয়নি।

চোখ মুছার যতোই চেষ্টা করছে নীলিমা ততোই যেনো বৃষ্টির ফোঁটার ন্যায় তার চোখের পানি পড়ছে। তরীকে আসতে বলে নীলিমা বেরিয়ে যায়,সামনেই আঁধারকে দেখতে পেয়ে তার বুকটা ছ্যাৎ করে উঠে আবার চোখের জ্বলেরা বৃষ্টির মতো ঝড়তে শুরু করে।

আঁধার অবাক হয়ে নীলিমার দিকে তাকায়,কিন্তু নীলিমা তাকে অবাক করে দিয়ে ছুটে চলে যায়।আঁধার পেছন থেকে নীলি নীলি করে ডাকতে ডাকতে এগিয়ে যায় কিন্তু নীলিমা ততোক্ষণে একটা রিকশা নিয়ে উঠে বসে পড়ে।

আঁধার চিন্তিত হয়ে পেছনে ঘুরতেই তরীকে দেখতে পায়।

–‘তোরা এখানে আর নীলি এভাবে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলো কেনো?’

–‘পরে বলবো সব, পারলে তুই আরোহীর কাছে সব শুনে নিস, আর এতোবার ফোন করেছি বন্ধ কেনো?’

আরোহীর কথা শুনেই আঁধারের কপালে চিন্তার ভাজটা আর একটু বেড়ে যায়।হঠাৎ তার ফোনের কথা মনে পড়তে দেখে চট করে পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে বন্ধ হয়ে আছে। আঁধার বিরক্ত হয়ে “সিট ” কথাটা বলেই তরীর দিকে তাকায়।

–‘আচ্ছা থাক, পড়ে কথা হবে এখন আমি যাই!’

আঁধার অবাক চোখে তরীর যাওয়া দেখে,হচ্ছেটা কি সবাই এভাবে চলে যাচ্ছে কেনো? আর আরুর কাছেই বা কি শুনতে বললো! ভেবেই বাড়ির ভেতরে চলে যায় আঁধার

ড্রয়িংরুম সম্পূর্ণ ফাঁকা পড়ে আছে অথচ দরজা খোলা,আঁধার আর কিছু না ভেবেই এক প্রকার দৌড়ে নিজের ঘরের দিকে চলে যায়।

আদর ও আলিশা দু’জনেই আরোহীকে তখন থেকে বলছে কি হয়েছে, কিন্তু আরোহী চুপচাপ মাথা নিচু করে আছে! আলিশা এবার অধৈর্য হয়ে আরোহীর পাশে বসে আরোহীকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়।

আরোহীর চোখে পানি দেখে আরও হতভম্ব হয়ে যায় আলিশা। আদরের কলিজাটা মনে হয় মোচড় দিয়ে উঠে, যতোই মুখে সব কিছু ঠিক করার চেষ্টা করুক না কেনো কিন্তু মনের এক কোণে আরোহীর জন্য হয়তো এখন ও কিছু একটা অনুভব করে। তাই তো আরোহীর চোখের জ্বল দেখে আজ ও কলিজাটা মোচড় দিয়ে উঠছে।

–‘আরো কি হয়েছে বোন বল আমায়,ওই নীলিমা কি তোর সাথে খারাপ ব্যাবহার করেছে? ‘ কি রে চুপ করে আছিস কেনো বল?

আরোহীকে চুপ থেকে দেখে উত্তেজিত হয়ে কথাগুলো বলে আলিশা।কিন্তু আরোহী নিশ্চুপ হয়ে থাকে,আদর এবার আলিশার মাথায় হাত দিয়ে বলে,,

–‘তুমি হাইপার হয়ো না, আরো বলো না কি হয়েছে আমরা সকলে তোমার জন্য চিন্তা করছি তো?’

শেষের কথাটা আরোহীর দিকে তাকিয়ে কিছুটা নরম সুরে বলে আদর। এরই মধ্যে আঁধারকে তড়িঘড়ি করে রুমে ঢুকতে দেখে আদর ও আলিশা অবাক হয়ে যায় কিন্তু আরোহী নির্বাক হয়ে নিচের দিকেই তাকিয়ে আছে।

–‘কি হয়েছে এখানে বল তো নীলি ওভাবে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলো কেনো?’

আদরকে প্রশ্নটা করে আরোহীর দিকে তাকাতেই যেনো আঁধারকে কলিজা কেঁপে উঠে।

–‘এই আরু এই কি হয়েছে তোমার কাঁদছো কেনো?’

আরোহীর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলে আঁধার। আরোহী এবার চোখ তুলে তাকায় আঁধারের দিকে, এতে যেনো আঁধার আরও বিচলিত হয়ে যায়,,,,

–‘আরুপাখি কি হয়েছে জান কাঁদছো কেনো?’ ইসস কাঁদে না।

আরোহীর চোখের পানি মুছে দিয়ে টেনে তার আরুপাখিকে বুকে নিয়ে কথাটি বলে আঁধার। আলিশা উঠে দাড়িয়ে আদরকে চোখের ইশারায় আসতে বলে নিজেও চলে যায়,আর আদর ও এক পলক আরোহী ও আঁধারকে দেখে তার পেছন পেছন চলে যায়।

আরোহীর কান্নার গতি যেনো বেড়ে যায়,তার মনে একটাই প্রশ্ন কেনো নীলিমা কারো ভালোবাসা পেলো না?

কেনো তার এতো কষ্ট? এতোদিন তো আরোহী তাকে সুখী একজন মানুষ মনে করতো কিন্তু আজকে নীলিমার কান্না দেখে নতুন ভাবে সবকিছু আবিষ্কার করছে আরোহী।

ছোট বেলা থেকেই সে অন্যের কষ্ট সহ্য করতে পারে না। আর আজকে তো এতো কাছ থেকে দেখলো কিভাবে সহ্য করবে আরোহী? আসলেই কি সহ্য করার মতো ব্যাপারটা?

আঁধার আরোহীকে নিজের বুকে এভাবে কাঁদতে দেখে বারণ করলো না তবে মাথায় চুমু দিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করছে।

এক ঘন্টা হয়ে গেলো কিন্তু আরোহীর কান্না থামার কোনো নামই নেই। একসময় আরোহী শান্ত হলো ঠিকই তবে আঁধারের খটকা লাগলো ব্যাপারটা, মাথাটা হাত দিয়ে একটু উঁচু করতেই আরোহীকে ঘুমাতে দেখে হেঁসে ফেললো।

একটু আগেও মেয়েটা তাকে আঁকড়ে ধরে বাচ্চাদের মতো কান্নাকাটি করছিলো আর এখন পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে গেলো।আরোহীকে কোলে তুলে আসতে করে বিছানায় শুয়ে দিলো আঁধার!

এক হাত দিয়ে শুকিয়ে যাওয়া চোখের জ্বলগুলো মুছতে চেষ্টা করলো তার প্রেয়শীর কিন্তু শুকিয়ে যাওয়া চোখের জ্বল কি আর মুছিয়ে দেওয়া যায়,উঁহু যায় না তাই আঁধার ও পারলো না।

আরোহীর কপালে সময় নিয়ে একটা চুমু দিয়ে বের হয়ে গেলো সে।তার এখন আলিশা আর আদরের কাছে শুনতে হবে বাড়িতে কি হয়েছে।

করিডর থেকেই ড্রয়িংরুমে আদর ও আলিশাকে বসে থাকতে দেখে সোজা নিচেই আসলো আঁধার।আলিশা অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলো,,,,,

–‘ভাইয়া আরো,,,,,’

–‘ও ঠিক আছে ঘুমিয়ে গেছে, এখন তোমরা বলো তো কি হয়েছে আর আম্মুই বা কোথায়?’

আঁধারের গম্ভীর কন্ঠে মিইয়ে গেলো আলিশা, মিনমিন করে উত্তর দিলো,,,

–‘আম্মু একটা বান্ধবীর বাসায় গেছে! ‘

–‘নীলি কেনো এভাবে চলে গেলো,আর আরুই বা কি হয়েছে সব বলো?’ সব বলতে বুঝো এ টু জেড।

ঝাঁঝালো গলায় কথাগুলো বললো আঁধার। আলিশা ভয় পেয়ো যায়,এমনিতে ও সে আঁধারকে অকারণেই এখন ভয় পায় তার উপর এমন ঝাঁঝালো গলা।আদর আলিশার ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নিজেই শুরু থেকে সবটা বলা শুরু করলে এমনকি তরী যেসব বললো সেসব ও বললো সে।

সবকিছু শুনে আঁধারের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো, নীলিমার প্রতি এই প্রথম তার রাগ হলো! তার পাগলামি দিন দিন বাড়ছে ভেবেই আঁধার মনে মনে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়।

আদর ও আলিশাকে আর কিছু না বলেই উপরের দিকে চলে যেতে গেলেই তার ফোন বেজে ওঠে৷ পকেট থেকে ফোন বের করে কানে দিতেই চমকে যায় আঁধার। অস্থির কন্ঠে বলে,,,,

–‘কি বলছিস নীলি সুইসাইড করেছে, তুই ওকে হাসপাতালে এডমিড করানোর ব্যবস্থা কর আমি আসছি!’

বলেই ওভাবেই দৌড়ে বাড়ির বাহিরে চলে যায় আঁধার। আদর ও আলিশা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে।

#চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে