#নীল_ডায়েরির_সেই_মেয়েটি
#আরদ্ধিতা_রুহি
#পর্বঃ২৩
🍁
একটা তিন তলার ফ্লাটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আঁধার ও আরোহী। আঁধার কলিং বেল টিপ দিয়ে নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও আরোহী বিরক্ত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে!
মূলত আঁধার তাকে এক প্রকার টেনে হিচরেই নিয়ে এসেছে এখানে।কিন্তু কেনো নিয়ে এসেছে বা বাসাটা কার সেটাও বলেনি।
আরোহী অনেকবারই জিজ্ঞেস করেছে এই এক প্রশ্ন কিন্তু আঁধার উত্তর দেওয়ার দরকার মনে করেনি আর করার প্রয়োজন ও হয়তো পড়েনি তার।
এরই মধ্যে একটা পিচ্চি মেয়ে দরজা খুলে দেয়,কিন্তু ভালো করে লক্ষ করে দেখে আসলে পিচ্চিটা দরজা খুলেনি একটা বড় মেয়েই দরজাটা খুলে দিয়েছে। কারণ এটুকু একটা বাচ্চা মেয়ে তো আর দরজা খুলতে পারবে না,বয়সই বা কতো হবে তিন কি চার।
আরোহী হা করে তাকায় পিচ্চিটার দিকে! কতো সুন্দর গোলগাল মুখশ্রীর একটা পুতুলের মতো দেখতে মেয়ে। মেয়েটি আরোহীর দিকে বড় বড় চোখ করে তাকায় কিন্তু হয়তো ঠাওর করতে পারে না, যে মেয়েটি কি।
এরইমধ্যে আঁধারকে দেখে পিচ্চিটার মুখে বিশাল আকারের একটা হাসি ফুটে উঠে! আঁধার ও কিছুটা প্রশস্ত হাসে।
–‘কি ব্যাপার তিথিমনি কেমন আছে?’
আঁধারের কথা শুনে পিচ্চি তিথি কোলে উঠার জন্য দুহাত বাড়িয়ে দেয়।বিনা সংকোচে কোলে তুলে নেয় আঁধার!
–‘ভালো নেই বাইয়া, কিন্তু তোমায় দেখে অনেক ভালো হয়ে গেছি!’
আঁধারের গলা জড়িয়ে ধরে বলে ছোট তিথি।আঁধার হেঁসে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে,,,
–‘সবই তো ঠিক আছে কিন্তু ওটা বাইয়া নাহ ভাইয়া হবে তো!’
আরোহী ও আঁধারের পেছন পেছন ভিতরে ঢুকে যায়।
–‘একই তো!’
আঁধারের গালে একটু চুমু দিয়ে বলে তিথি।
–‘আচ্ছা হোক, বাসার বাকি সবাই কোথায়?’
–‘আসলে ভাইজান বাসায় তেমন কেউ নেই, শুধু আমি, তিথি,নীলিমা আপা আর তরী আপাই বাসায়! ‘
বড় মেয়েটা উত্তর দেয়। আরোহী অবাক হয়, তার মানে আঁধার তাকে নীলিমাদের বাসায় নিয়ে এসেছে। কিন্তু এই পিচ্চি বাচ্চাটা আর বড় মেয়েটাই বা কে?
আরোহীর ভাবনার মধ্যেই আঁধার আরোহীর দিকে তাকায়।বড় মেয়েটা মূলত এতোক্ষণ হা করে আরোহীকেই দেখছিলো।আরোহীকে তার কাছে ভাড়ী সুন্দরী মনে হচ্ছে, কতো সুন্দর টানা টানা চোখ, সুন্দর মুখশ্রী, দেখতে ওতোটা ফর্সা না হলেও মোটামুটি ফর্সা।তবে আঁধারের কি হয় সেটা সে বুঝতে পারছে না কারণ এর আগে কখনো আঁধার বা বাকি সবার সাথে দেখেনি তাকে।
আঁধার হয়তো মেয়েটির মনের ভাব বুঝতে পারে, তাই বিনা সংকোচেই বলে,,
–‘সুমি ও হচ্ছে তোর ভাবি, আর আরু ও হচ্ছে সুমি তরীর চাচাতো বোন!’
ভাবি কথাটা শোনার পর পরই সুমির মুখটা অনেকটা উজ্জ্বল হয়ে যায়, আঁধারের বউ মানে তার ভাবিকে ভাবি হিসেবে তার অনেক পছন্দ হয়েছে। এগিয়ে গিয়ে বলে,,,
–‘কেমন আছেন ভাবি?’
–‘আলহামদুলিল্লাহ, আপনি?’
হালকা হেসে বলে আরোহী।
–‘আলহামদুলিল্লাহ, আপনি আমায় তুমি করে বলতে পারেন!’ আমি কিন্তু আপনার পর না।
সুমির কথা শুনে আরোহী মিষ্টি হেসে মাথা নাড়ায়। আঁধার এক পলক ওদের দেখে সুমিকে বলে,,,
–‘তরী আর নীলিকে একটু ডেকে নিয়ে আয় তো যা।’
সুমি “আচ্ছা” বলেই দৌড়ে চলে যায়।
আঁধার আরোহীকে বসতে বলে নিজেও পাশের সোফায় বসে পড়ে। ঠিক তখনই তিথির প্রশ্নে ভড়কে যায়।
–‘বাইয়া ভাবি কি?’
–‘ভাবি মানে ভাইয়ের বউ পিচ্চি! ‘ এই যে ওকে দেখছো না, ও হচ্ছে আমার বউ।
প্রথমের কথাটা তিথির দিকে তাকিয়ে হেসে বললেও শেষেরটা আরোহীকে দেখিয়ে বলে।
–‘বউ কি বাইয়া?’
আঁধার এবার ভেবাচেকা খেয়ে যায়, কি বলবে সে এখন। আরোহী তিথির কথা শুনে ফিঁক করে হেসে দেয়।আঁধার চোখ পাকিয়ে তাকাতেই চুপ হয়ে যায়।কিন্তু তিথি চুপ হয় না সে আবার প্রশ্ন করে,,,
–‘বাইয়া বউ কি?’
–‘বউ হচ্ছে মানুষ, এই যে যেমন ধরো ও আমার বউ!’ তোমার আম্মু তোমার বাবার বউ, তোমার বড়আম্মু তোমার বড় বাবার বউ।
–‘তাহলে আমি কার বউ?’
ভাবুক দৃষ্টিতে আঁধারের দিকে তাকিয়ে বলে তিথি।
আঁধার ও তিথির মতো ভাবুক হয়ে বলে,,
–‘আসলেই তো তুমি কার বউ?’
তিথি ঠোঁট উল্টিয়ে আঁধারের দিকে তাকালে আঁধার বলে,,
–‘আরে আমাদের তিথিমনি তো একটা সুন্দর রাজকুমারের বউ৷’ লাইক সিন্ডারেলার গল্পের মতো।
আঁধারের কথা শুনে তিথি খুশি হয়ে যায়।কিন্তু পাল্টা প্রশ্ন করতে ভুলে না,,,
–‘কিন্তু বউ দিয়ে কি হয় বাইয়া?’
“বউ দিয়ে বংশবিস্তার হয়, বংশবৃদ্ধি হয়,তোকে আর কি বুঝাই আমি বললেই তো বলবি তাহলে তোমার হয়নি কেনো? আরে ভাই আমার সেই সৌভাগ্য হয়নি এখন ও ”
বিরবির করে কথাগুলে বলে আঁধার।
আঁধারকে বিরবির করতে দেখে আরোহী কান খাঁড়া করে শুনতে চেষ্টা করে কিন্তু শুনতে পায় না।
–‘বউ দিয়ে কিছু হয়না আপি, তবে বউ চাইলে আবার অনেক কিছু হয়।’ যেমন তুমি হয়েছো এরপর আমাদের পিচ্চি হবে।
তিথি হয়তো আঁধারের কথা বুঝতে পারে না, কিন্তু বুঝার চেষ্টা করে। আরোহী লজ্জায় মাথা নিচু করে নেয়, আর মনে মনে আঁধারকে বকতে থাকে।
তিথি আর কিছু বলার আগেই হুরমুর করে নিচে নামে তরী,আঁধার চমকে যায় সাথে আরোহী ও৷ সুমি নিজেও অবাক হয়ে যায় তার বোনের এভাবে নামা দেখে, তবে সে স্বাভাবিক ভাবেই নেমে আসে৷ তরী একেবারে আঁধারের সামনে এসে দাঁড়ায়।
–‘এভাবে দৌড়ে আসলি কেনো তুই? ‘
–‘আরে তোরা এসেছিস দৌড়ে আসবো না তা কি,হুর তোর সাথে কথা বলে লাভ নেই। ‘
বলেই তরী আরোহীকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে,,
–‘একি আরোহী কেমন আছো তুমি?’ অবশেষ এ এই গাধাটা তোমায় নিয়ে আসলোই এখানে।
আরোহী আঁধারের দিকে কোণা চোখে তাকিয়ে বলে,,
–‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো আপু তুমি কেমন আছো?’
কিন্তু আঁধার একদম স্বাভাবিক হয়ে আছে, তার হয়তো এসবের অভ্যেস আছে।
–‘আলহামদুলিল্লাহ বসো তুমি, এই সুমি চল তো কিছু রান্নার ব্যবস্থা করি।’
আরোহী কে বসতে বলেই সুমির উদ্দেশ্যে কথাটা বলে তরী।
–‘তরী এসবের কোন দরকার নেই, আমরা একটু পরই চলে যাবো!’ আর নীলি কোথায়?
আঁধারের কথা শুনে তরীর মুখটা ফেকাসে হয়ে যায়।
–‘রুমে আছে! ‘ তুই যা উপরে, আমি এমনি কিছু নাস্তার ব্যাবস্থা করি।
আঁধার মাথা নাড়িয়ে আরোহীর হাত ধরে বলে,,
–‘চলো।’
আরোহী আর কি করবে আঁধারের সাথে সাথে পাঁ মিলিয়ে চলা শুরু করে।
আচ্ছা নীলিমা আপু যদি আমায় দেখে রাগ করে, আমার কি আঁধারের সাথে যাওয়া ঠিক হবে! নাকি আমি তরী আপুর সাথে নিচেই থেকে যাব, না না আঁধার তো আমার বর আর নিজের বরকে কেউ অন্য মেয়ের সাথে একা ছাড়ে নাকি যতোই সে ফ্রেন্ড হোক না কেনো। আমি কি ঠিক করছি নাকি নিচেই থেকে যাবো। আরোহীর এসব ভাবনার মাঝেই আঁধারের কথায় তার ভাবনার সমাপ্তি ঘটে।
–‘কি এতো ভাবছো বলো তো?’
–‘কই কিছু না তো!’
আরোহীকে আমতা আমতা করতে দেখে আঁধার সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায়! আরোহী আঁধারের তাকানো দেখে বলে,,
–‘এইটা কি নীলিমা আপুর ঘর?’
আঁধার এক পলক তাকায়, কিন্তু ভেতর থেকে দরজা বন্ধ দেখে ভ্রুকুঁচকায়।
–‘না তরীর ঘর, নীলি বর্তমানে তরীর বাসায়ই আছে।’
বলেই দরজায় নক করে,,,
–‘কে?’
ভেতর থেকে গলার আওয়াজ পেয়ে, আঁধার আরোহীর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলে,,
–‘দরজাটা খুলে দে।’
আঁধারের গলার আওয়াজ পেয়ে নীলিমার ভেতরটা কেঁপে উঠে, আজকে তিন দিন পর এই কন্ঠটা শুনতে পেলো সে। আগে একদিন আঁধারের গলার স্বর না শুনলে নিজেকে পাগল পাগল লাগতো তার কিন্তু আজকে তিন দিন ধরে সেই পাগলামি মধ্যেই আছে সে।
–‘নীলি!’
এরইমধ্যে আঁধারের মুখে তার নামটি শুনে কলিজা ঠান্ডা হয়ে যায় নীলিমার। চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়তে থাকে,পুরো শরীর অবস হয়ে আছে তার। কি করবে দরজাটা খুলবে, নাকি খুলবে না। খুলে এক পলক দেখার জন্য তার মনটা ছটফট করছে, নিজেকে শান্ত করে চোখের পানি মুছে নেয় নীলিমা।
আয়নার সামনে দাঁড়ায়, নিজের অবস্থা দেখে তাচ্ছিল্য হাসি দেয়। দিয়েই হাসি মুখে দরজাটা খুলে দেয়,কিন্তু দরজা খোলার পর পরই চোখ মুখে বিষাদের হাসি ফুটে উঠে।
আরোহীকে নিয়ে আসার কি খুব দরকার ছিলো আঁধারের, তার তো কষ্ট হচ্ছে! কিন্তু আঁধার কি বুঝবে তার কষ্টটা? না আঁধার বুঝতে পারছে না, আগেও বুঝে নি আজকে ও বুঝছে না হয়তো। আচ্ছা তাকে ভালোবাসলে কি খুব একটা ক্ষতি হয়ে যেতো আঁধারের? সে তো আরোহীর মতোই সুন্দর কিন্তু তবুও আঁধার আরোহীর যায়গায় তাকে মেনে নেয়নি তো?
কি করবে এতো সৌন্দর্য আর রুপ দিয়ে, যেখানে আঁধারের ভালোবাসা পাওয়া তার ভাগ্যে থাকলো না! আচ্ছা ভালোবাসা নাহয় নাই বা পেলাম কিন্তু আঁধারকে পেলে কি খুব একটা ক্ষতি হয়ে যেতো? কতো মানুষ আছে পৃথিবীতে যারা ভালোবাসা ছাড়াই সংসার করে, করে তো? কিন্তু সে তো না পেলো আঁধারের ভালোবাসা আর না পেলো ভালোবাসাহীন আঁধারের সংসার।
একদৃষ্টিতে তাকিয়ে নীলিমা এতোক্ষণ আরোহীর দিকে তাকিয়েই এসব ভাবছিলো। আরোহী নিজেও নীলিমার দিকে কষ্ট ভড়া নয়নে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে কতোটা কষ্টে আছে সে?
এই তিন দিনেই নিজের চেহারার অবস্থা কি করেছে,আগের মতো উজ্জ্বলতা নেই মুখে,নেই কোন প্রশাধনির ব্যাবহার। চোখের নিচের কালো দাগ দেখেই বোঝা যাচ্ছে হয়তো তিন দিনে একবার ও চোখের পাতা এক করতে পারেনি।
নীলিমার ভেতরটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে, কিন্তু তার এই কষ্ট আঁধার নামক পুরুষটির কাছে ছেলেখেলা মাত্র।তাইতো তার জায়গায় আজকে আরোহী,কিন্তু সে তো বন্ধুত্ব নষ্ট হওয়ার ভয়ে কিছু বলেনি কখনো। তবে আঁধারের মনে জায়গায় করে নেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছে সে কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে।
সে ভেবেছিলো আঁধার নামক এই পুরুষটি হয়তো কখনো কেনো মেয়েকে ভালোবাসতেই পারবে না, যেমনটি আগেও পারতো না নাহলে কি আর তাকে গ্রহন করতো না নাকি!
–‘কিরে দাঁড়িয়েই থাকবি নাকি ভেতরে ও যেতে দিবি?’
আঁধারের কথায় নীলিমার ধ্যান ভাঙ্গে। মলিন হেঁসে দরজা থেকে সরে দাড়ায়।
আঁধার আরোহীর হাত ধরেই ভেতরে প্রবেশ করে,,নীলিমা তাদের হাতের দিকে তাকায় কিন্তু তার সহ্য ক্ষমতা লোপ পেয়ে যায়।এক ছুটে বাহিরে চলে যায় সে। আঁধার ভ্রুকুঁচকে তাকায়, আরোহী হতভম্ব হয়ে যায়।
আরোহীর হাত ছেড়ে দিয়ে নীলিমার পেছন পেছন আঁধার চলে যায়, আরোহী নিজেও এগিয়ে যায় কিন্তু ততোক্ষণে নীলিমা অন্য রুমের ভেতর গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।
দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ এতোটাই জোড়ে ছিলো যে নিচ থেকে তরী ও সুমি দৌড়ে চলে এসেছে।
আঁধার দরজায় টোকা দিয়ে নীলিমাকে ডাকে কিন্তু নীলিমা দরজা খুলে না। তরী অস্থির হয়ে যায়, আরোহী কি করবে বুঝতে পারে না।
#চলবে?
#নীল_ডায়েরির_সেই_মেয়েটি
#আরদ্ধিতা_রুহি
#পর্বঃ২৪
🍁
আঁধার দরজায় নক করে, তরী অস্থির হয়ে দরজায় নক করতে থাকে কিন্তু নীলিমা দরজা খুলে না! আরোহী একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে সবটা, তার পাশেই সুমি তিথিকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এরই মাঝে দরজার ওপাশ থেকে আওয়াজ আসে নীলিমার,,,
–‘তরী, আমি একা থাকতে চাই প্লিজ সবাইকে চলে যেতে বল!’
আঁধার হতাশ হয়ে তরীর দিকে তাকায়, তরী চোখ দিয়ে তাকে চিন্তা করতে বারন করতে বলে। আঁধার সরে আসে দরজার কাছ থেকে! সুমি এখন ও কিছু বুঝছে না আসলে হচ্ছেটা কি তাই সে আরোহীর কাছে একটু চেঁপে গিয়ে বলে,,,
–‘কি হয়েছে ভাবি?’ নীলি আপু হঠাৎ এরকম করছে কেনো?’
আরোহী এতোক্ষণ একদৃষ্টিতে আঁধারের দিকে তাকিয়ে ছিলো, সুমির কথায় আঁধারের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সুমির দিকে পূর্ণঙ্গ দৃষ্টিতে তাকায়। মেয়েটি কৌতুহল নিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
আরোহী কি বলবে ভেবে পায় না, কারণ সে তো বুঝতে পারছে নীলিমা তাকে আর আঁধারে একসাথে দেখেই সবটা করছে। তবে নীলিমার দোষ নেই, সে তো ভালোবেসে কাউকে! আর সেই ভালোবাসাটা হয়তো একপক্ষীক ভালোবাসা।
আচ্ছা এই ভালোবাসার পরিনতি কি হবে? নীলিমা ও কি তাকে আর আঁধারকে আলাদা করার জন্য চেষ্টা করবে? নাকি আলাদা করেই ফেলবে? আঁধার কি নীলিমার এসব দেখে নীলিমার প্রতি দূর্বল হয়ে যাবে তাকে কি ছেড়ে দিবে?
আরোহী সুমির দিকে তাকিয়েই এসব ভাবছিলো হঠাৎ সুমির ধাক্কা হকচকিয়ে যায়।
–‘কি হয়েছে আপু?’
–‘তোমার কি হয়েছে ভাবি?’ কি এতো ভাবছিলে কতক্ষণ ধরে জিজ্ঞেস করছি উত্তর দিচ্ছো না?
–‘না না কিছুই না, নীলিমা আপু কি দরজা খুলেছে?’
আরোহীর প্রশ্নে হতাশ হয়ে মাথা নাড়ায় সুমি যার অর্থ না। আরোহী সুমির হতাশ ভরা মুখের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আঁধারের দিকে তাকায়, সে এক দৃষ্টিতে বন্ধ দরজার দিকেই তাকিয়ে আছে।
আর তরী দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, শেষ মেশ নীলিমা দরজা খুলে দেয়।
তরী হতদন্তর করে ঢুকে যায়, সুমি দৌড়ে চলে যায় দেখার জন্য আর আঁধার গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যায়। কিন্তু এগোয় না আরোহী, সে ভাবছে এখন কি আঁধার নীলিমাকে বলবে আমি তোকেও বিয়ে করতে চাই, তোর এসব পাগলামিতে আমার মন গলে গেছে।
এরইমধ্যে ভেতর থেকে নীলিমার ডাক শুনতে পায়, আরোহীর কলিজাটা ধক করে উঠে। তাহলে কি তার ভাবনাটাই ঠিক, সে কারণেই নীলিমা এখন তাকে ডাকছে?আরোহীর হঠাৎ করেই কান্না পায়, চোখ ঝাপসা হয়ে আসে!
গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যায় সে কিন্তু দরজার কাছে গিয়ে আর এগোতে পারে না, নীলিমা তার আগেই তার কাছে চলে এসে মিষ্টি একটা হাসি দেয়। এতে যেনো আরোহীর ভয় আরও কয়েকগুন বেড়ে যায়! আঁধারের দিকে একপলক তাকায় আরোহী, আঁধার তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
–‘আরে কি হলো এসো ভেতরে এসো?’
আরোহীকে টেনে ভেতরে নিয়ে যেতে যেতে কথাটা বলে নীলিমা।আরোহী পুতুলের মতো নীলিমার সাথে ভেতরে ঢুকে ঠিকই তবে আঁধারের থেকে দৃষ্টি সরায় না।
–‘সরি আসলে আমি একটু ডেস্পারেট ছিলাম তাই এমন ব্যাবহার করে ফেলেছি, তুমি কিছু মনে করো না কেমন?’
নীলিমার কথায় সামান্য হাসার চেষ্টা করে বলে আরোহী,,,
–‘সমস্যা নেই আপু আমি কিছু মনে করিনি!’
–‘আচ্ছা তোমরা গল্প করো আমি একটু ফ্রেস হয়ে আসি কি বলো?’
–‘তার দরকার নেই নীলি, আমরা তোর সাথে দেখা করতেই এসেছিলাম কিন্তু এখন আর দেরি করবো না রে!’ এখনই ফিরতে হবে আমাদের।
আঁধার আরোহী দিকে তাকিয়েই কথাটা বলে।
–‘সে কি রে এখনই যাবি কেনো? ‘
–‘একটু কাজ আছে, প্লিজ তোরা আটকানোর চেষ্টা করবি না আশা রাখি!’
নীলিমা চুপ হয়ে যায়।
আরোহী মাথা নিচু করে আছে, আসলে তার নিজেরও এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না! কিন্তু আঁধারকে বলার সাহস পাচ্ছে না, মূলত এখানের পরিবেশটা নীলিমার জন্যই তার কাছে বিরক্ত লাগছে আবার নীলিমার কথা ভেবেও খারাপ লাগছে।
কিন্তু বাঙ্গালি নারী তো, সবকিছুর ভাগ দিতে রাজি শুধু মাত্র স্বামীর ভাগ ছাড়াই।তার ক্ষেত্রে ও সেটার ব্যতিক্রম না, তাইতো এখান থেকে যাওয়ার জন্য তার মনটা ছটফট করছে। ভয় হচ্ছে যদি তার আঁধারকে তার কাছ থেকে কেড়ে নেয়, তখন কি করবে আরোহী৷
আঁধার তরীর দিকে তাকিয়ে বলে,,
–‘আসি রে, পরে আবার আসবো!’
তরী বলার মতো কিছু খুঁজে পায় না, আরোহীর ব্যাপারটা সে নিজেও আন্দাজ করতে পারছে। সে ও তো একটা মেয়ে? মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে,,,
–‘আচ্ছা, তবে আরোহীকে নিয়ে আসবি কিন্তু কেমন!’ আর আরোহী আবার এসো ঠিক আছে?
আরোহী মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলে আঁধারের পেছন পেছন চলে যায়। আর তরী হতাশার সাথে তাকিয়ে থাকে তাদের যাওয়ার দিকে, নীলিমা বিষাদের সাথে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়।কিন্তু তিথি কেঁদে উঠে, আঁধার তাকে যাওয়ার সময় বললো না কেনো এই নিয়ে তার কষ্টের শেষ নেই।
গাড়িতে চুপচাপ বসে আছে আরোহী, আঁধার হয়তো ব্যাপারটা ধরতে পেরেছে কিন্তু কিছু বলছে না। তার নিজেরই নীলিমার কাহিনি দেখে খারাপ লাগছে। তাই আর আরোহীর সাথে কথা বললো না বাসায় গিয়ে বলবে ভেবে নিয়েছে।
চৌধুরী বাড়িতে,,,,
আদর আলিশার দিকে কটমট চাহনি নিয়ে তাকিয়ে আছে, আর আলিশা ইনোসেন্ট ফেইস নিয়ে আদরের দিকে তাকিয়ে আছে। আলিশার উদ্দেশ্য হচ্ছে তার ইনোসেন্ট ফেইস দেখিয়ে আদরের হাত থেকে বাঁচবে কিন্তু আদর সে তো আদরই! বউয়ের ইনোসেন্ট ফেইস দেখে সে গলে গেলো না বরং আরও কঠোর দৃষ্টিতে আলিশার দিকে তাকিয়ে থাকলো।
আলিশা ভরকে গেলো, চুপচাপ একটা ফলের পিস উঠিয়ে মুখে ঢুকিয়ে চোখ বন্ধ করে বিরক্তের সহিত খেয়ে ফেললো। এবার আদর স্বাভাবিক দৃষ্টিতে আলিশার দিকে তাকায়, আলিশাকে ওভাবে খেতে দেখে ফিঁক করে হেঁসে ফেললো।
আলিশা বিরক্ত হয়ে বললো,,
–‘ভুতের মতো যখন তখন হাঁসবে না তো একদম বিরক্ত লাগে!’
আলিশার কথা শুনে আদরের খারাপ লাগলো না বরং সে আলিশার কাছাকাছি গিয়ে বসলো।আলিশা বিরক্ত নিয়ে আবার বললো,,,
–‘কি হলো এভাবে এগিয়ে আসছো কেনো?’ দূরে যাও, একদম কাছে আসার চেষ্টা করবে না বলে দিলাম।
আলিশাকে পাত্তা না দিয়ে আদর এবার আলিশার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লো। আলিশা আর কিছু বলতে পারলো না! এই ছেলেটা কয়েকদিনের মধ্যেই তার মনের অনেকটা জুড়ে জায়গা করে নিয়েছে৷
তাদের সম্পর্কের উন্নতি ও ঘটেছে বটেই। এই যে প্রতিদিন আদরের বুকে মাথা দিয়ে ঘুমানো! যখন তখন তাকে জ্বালানো, রাতের আঁধারে বেলকনিতে বসে আদরের বুকে মাথা দিয়ে চাঁদ দেখা।নিয়ম করে খাইয়ে দেওয়া। আদরের সাথে বসে বসে গল্প করা। আদরের জামা কাপড় নিজ দায়িত্বে গুছিয়ে দেওয়া।
আগের মতো আদর আর তেমন ভার্সিটিতে যায় না, আলিশা হাজার বলেও নিয়ে যেতে পারেনি এমনকি আলিশাকেও যেতে দিবে না সে।
আলিশা রাগ করলে এইভাবেই কোলে মাথা দিয়ে আলিশাকে বলে,,,”তুমি যদি রাস্তায় মাথা ঘুরে পড়ে যাও কিংবা বমি করো তখন কে ধরবে শুনি?”
আলিশা আর কি করবে সে ও তো কেয়ারিং একজনকে চেয়েছিলো, একটা ভালোবাসার মানুষ চেয়েছিলো পেয়েছে যেহেতু তাই আর আদরের কথার অবাধ্য হয়নি। আদরের মনে হয়তো আরোহীর জন্য আগের মতোই ভালোবাসাটা আছে কিন্তু আদর প্রকাশ করে না! আলিশা বুঝতে পারে, তবুও সে চেষ্টা করে যেনো আদর আরোহীকে ভুলে গিয়ে তাকে ভালোবাসতে শুরু করে৷
এরইমধ্যে একটা আপেলের পিস আলিশার মুখের সামনে ধরে আদর, আলিশা এবার আর বাহানা করে না হাঁসি মুখেই খেয়ে নেয়।
–‘এটা কি হলো! এতোক্ষণ তো খাবে না খাবে না করে চেঁচামেচি করছিলে, এখন আবার বিনা বাক্যে খেয়ে নিচ্ছো? ‘
আদরের কথা শুনে আলিশা হাঁসিমুখে বলে,,
–‘কেউ ভালোবেসে কোন কিছু দিলে সেটা গ্রহন করতে হয় জানো না তুমি?’
আদর গম্ভীর স্বরে বলে,,
–‘আচ্ছা তাই নাকি!’ তা সবাই ভালোবেসে দিলে সবার ভালোবাসাই গ্রহন করবে তাহলে?
–‘সবার ভালোবাসা কি আর গ্রহন করা যায়, নির্দিষ্ট কারো ভালোবাসা গ্রহন করতে হয়!’
–‘তাহলে আমি কি তোমার সেই নির্দিষ্ট কেউ? ‘
কৌতুহলের সহিত জিজ্ঞেস করে আদর।
–‘হয়তো!’
–‘তোমার হয়তো মানে আমার হ্যা।’
আদরের কথা শুনে আলিশা হেঁসে ফেলে, এই ছেলেটা একদম অদ্ভুত! না বলতেই অনেক কিছু বুঝে যায়।
–‘আমি ভালোবেসে দিলে তুমি গ্রহন করবে?’
আদরের কথা শুনে আলিশা হেঁসে বলে,,,
–‘তা আপনি কি দিবেন শুনি জনাব?’
–‘আমি আমাকে দিবো!’
দুষ্টুমির স্বরে বলে আদর। আলিশা হাবলার মতো তাকিয়ে থাকে, আলিশাকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আদর বাঁকা হাসি দেয়। তার বউ যে এতো বোকা সে জানতোই না,,,
–‘দেখতে চাও? ‘
আলিশা মাথা নাড়ায়, যার অর্থ হ্যা আমি দেখতে চাই৷ আদর শয়তানি হাসি দিয়ে আলিশার ড্রেসের এক সাইড হাত দিয়ে সরিয়ে দিয়ে তার ফর্সা পেটে পরপর কয়েকটা চুমু দেয়।আলিশা কেঁপে উঠে, কিন্তু আদর থেমে থাকে না।
অন্যরকম অনুভূতির মাঝে আলিশা নিজেকে আবিষ্কার করে। চোখ বন্ধ করে জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস নিতে শুরু করে সে, আদর আলিশার পেটে হাত ছুঁয়ে দিয়ে আলিশার দিকে তাকায়। আলিশাকে চোখ বন্ধ করে জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস নিতে দেখে, হালকা হেঁসে ফিসফিস করে বলে,,,
–‘দেখলে তো?’ নাকি আরও দেখাবো?
আদরের কথা শুনে আলিশা চোখ খুলে আদরকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়, আদর হেঁসে ওঠে। আলিশা একটা বালিশ হাতে নিয়ে মুখ ঢেকে নেয়। আদর যেনো আলিশাকে লজ্জা পেতে দেখে মজা পায়, আবার ধপ করে কোলে শুয়ে পড়ে।
আলিশার লজ্জা যেনো একটু বেড়ে যায়।আদর বালিশটা কেঁড়ে নিয়ে বলে,,
–‘এক বাচ্চার মা হচ্ছো তবুও এতো লজ্জা আসে কোত্থেকে?’
আদর নিজের কথায় নিজেই হতভম্ব হয় কি বললো সে এটা,আলিশার লজ্জা পাওয়া মুখশ্রী মূহুর্তের মধ্যেই কেমন ফেঁকাসে হয়ে যায়।উঠে জড়িয়ে ধরে আলিশাকে,কিন্তু আলিশা নির্বাক। তবে আদর যে ভুল করে বলেছে এটা মনে হতেই আর কিছু বলে না, ওভাবেই পরে থাকে আদরের বুকে।
রাস্তায় আনমনে হাঁটছে রাহি,তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে কোন কিছু নিয়ে হয়তো অনেকটা চিন্তিত সে,তাই তো বেখেয়ালে রাস্তায় হাঁটছে। পেছন থেকে কেউ একজন অনবরত হর্ণ দিচ্ছে কিন্তু তার সেদিকে একদমই মন নেই। শেষ মেশ লোকটা বিরক্ত হয়ে গাড়ি থেকে নেমে রাহিকে কয়েকটা কড়া কথা শুনানোর জন্য এগিয়ে যায়।
–‘এই যে মিস বেখেয়ালি, চোখ কি আকাশে নিয়ে ঘুরেন নাকি?’ আকাশ পথ দিয়ে একটা রাস্তা বানিয়ে নিলেই তো পারেন। আজাইরা লোক জন, এসব কোথা থেকে যে আসে।
কারো কর্কশ কন্ঠে রাহি পেছনে ঘুরে তাকায়, একটা লম্বাটে ফর্সা ছেলেকে দেখে চোখ পিটপিট করে তাকায়।
রাহিকে এভাবে তাকাতে দেখে ছেলেটা ভারী বিরক্ত হয়,,,
–‘এই মেয়ে কথা বুঝতে পারেন না আপনি?’ বোবা নাকি রে ভাই?
রাহিকে আগের মতোই তাকিয়ে থাকতে দেখে, লোকটা কিছু একটা ভাবে তারপর মায়া মায়া চোখে তাকিয়ে বলে,,,
–‘আপনি কিছু মনে করবেন না, একটু রেগে ছিলাম তো তাই এভাবে বলে ফেলেছি!’ আসলে আমি অনেক দুঃখিত, তবে এভাবে রাস্তায় হাঁটবেন না সবাই তো আর আমার মতো ভালো হবে না তাই না।
রাহি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ছেলেটার দিকে,এই ছেলেটাকে সে কোথাও একটা দেখেছে কিন্তু মনে করতে পারছে না!
–‘আমি কিন্তু সাহফিফ আহমেদ, এদিকে একটা আত্মীয়ের বাসায় এসেছিলাম!’
বলেই রাহির হাত ধরে রাস্তার সাইডে নিয়ে দাঁড় করিয়ে বলে,,,
–‘আপনার জন্য আমার অনেক খারাপ লাগছে, এতে সুন্দর একটা মেয়ে কি না কথা বলতে পারে না ভাবতেই খারাপ লাগছে!’
সাহফিফের কথা শুনে রাহির মেজাজটায় খারাপ হয়ে যায় তাকে লোকটা বোবা বললো? কিন্তু তার কিছু বলার আগেই ছেলেটার ফোনে কল বেজে ওঠে, আর ছেলেটা রাহিকে বলে,,,
–‘সাবধানে থাকবেন, দেখে শুনে রাস্তায় চলাচল করবেন কেমন?’
বলেই গাড়িতে বসে চলে যায় সাহফিফ। রাহি হাঁ করে তাকিয়ে আছে, লোকটা তাকে বোবা মনে করে নিশ্চয়ই এসব বলে গেলো।
#চলবে?