নীল_ডায়েরির_সেই_মেয়েটি পর্ব-৪৬+৪৭

0
667

#নীল_ডায়েরির_সেই_মেয়েটি
#আরদ্ধিতা_রুহি
#পর্বঃ৪৬

🍁

সেদিন এক্সিডেন্টের পর কিছু মানুষ ধরাধরি করে আরোহী ও আঁধারকে পাশের একটা হাসপাতালে নিয়ে যায়।

ততোক্ষণে শিহাবদের কাছেও খবর পৌঁছে যায়,ওরা পৌঁছানোর আগেই আঁধার ও আরোহীর ট্রিটমেন্ট শুরু করে দেন ডাক্তাররা!

সাধারণ অন্যান্য ডাক্তাররা যেখানে এক্সিডেন্ট কেইস পেলেই পুলিশ আশা অব্দি অপেক্ষা করেন,সেখানে এই হাসপাতালের ডাক্তাররা আগে রোগীর ট্রিটমেন্টের ব্যাবস্থা করেছেন!

আরোহী যেহেতু প্রেগন্যান্ট ছিলো ও তার লেবার পেইন আগেই উঠেছিল তাই ডাক্তারদের কাছে কেইসটা অনেক ক্রিটিকাল হয়ে যায়।

অনেক ভাবার পর তারা সিদ্ধান্ত নেয় আরোহীর ট্রিটমেন্টের পাশাপাশি বাচ্চা বের করার জন্য অপারেশন করতে হবে!

কারণ এই মুহুর্তে সিজার ছাড়া উপায় নেই, তবে আরোহীর ট্রিটমেন্ট আগে।তারা বাচ্চার পজিশন আগে দেখে নেয়,তারপর আরোহীর ট্রিটমেন্ট করা অবস্থায় সিজার শুরু করে।

আর অপর দিকে আঁধারের খবর আসে, আঁধার ভালো আছে কয়েক ঘন্টার মধ্যে তার সেন্স ফিরে আসবে। ডাক্তাররা আলহামদুলিল্লাহ বলেন সকলে একসাথে, তাদের দু’জনের অবস্থা অনেকটা খারাপ ছিলো!

এখন একজন ভালো আছে এটাই অনেক বড় একটা ব্যাপার।তারপর আরোহীর বাচ্চা বের করা হয়,বাচ্চাগুলো আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে।হয়তো তাদের চেষ্টা সফল হয়েছিলো।

আঁধার যেমন নিজের জীবনের পরোয়া না করে তার আরুকে আগলে রেখেছিলো এটা হয়তো তারই ফল।তবে আরুহীর একটা না দু’টো বাচ্চা হয় একসাথে!

ডাক্তাররা যখন এই খবর দেয় তখন চৌধুরী পরিবারের সকলে খুশিতে কেঁদে উঠে। আরোহী একটা ছেলে ও আর একটা মেয়ে হয়।

ছেলেটা দশ মিনিট আগে বের করা হয়,আর মেয়েটিকে দশ মিনিট পরে তবে আরোহীর কোনো উন্নতি দেখা যায় না!ডাক্তাররা বাচ্চা দু’টোকে ভালো করে চেকআপ করে দেখে তাদের কোনো ক্ষতি হয়নি।

তবে আরোহীকে নিয়ে তারা অনেক টেনশনে পড়ে যায়! ৪৮ ঘন্টার আগে কেউ কিছু বলতে পারবে না!যেহেতু এক্সিডেন্ট ও সিজার একসাথে তাই আরোহীর কন্ডিশন একটু ক্রিটিকাল।

বাচ্চাগুলোকে অবজারভেশনে রাখতে হবে সেই ৪৮ ঘন্টা অব্দি, কারণ সম্পূর্ণ সুস্থ থাকলে ও একটু আশংকা তো থেকেই যায় যেহেতু এক্সিডেন্ট কেইস!

চৌধুরী পরিবার ও শেখ পরিবারে এবার যেনো শোকের ছায়া নেমে আসে।সকলের মুখে বিষাদের ছায়া স্পষ্ট!এরইমধ্যে নীলি ও সোহেল তাদের তিন মাসের ছেলেকে নিয়ে হাজির হয় সেখানে।

রাতুল ও চলে আসে!এরপর তরী ও সাহফিফ ও চলে আসে।তরী ও সাহফিফের বিয়ের তিন মাস হচ্ছে! সাহফিফ তার ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে তারপর তরীকে বিয়ের জন্য রাজি করায়,এরপর দুই পরিবারের সম্মতিতে তাদের বিয়ে হয়ে যায়।

সকলে এসে চুপচাপ বসে পড়ে।আঁকলিমা চৌধুরী ও শাহানাজ শেখ কাঁদতে কাঁদতে নাজেহাল অবস্থা করে ফেলেছেন সাথে শিরিন চৌধুরী ও যোগ দিয়েছেন।রাহি চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে কাঁদতে কাঁদতে।

আর আলিশা গুনগুনিয়ে কাঁদছে বার বার।শিহাব বিরক্ত হয়ে যায় তাদের কান্না দেখে তবে কিছু বলতে পারে না কারণ পরিস্থিতিই এমন!

এভাবেই কেটে যায় চার ঘন্টা তবে না আঁধারের সেন্স ফিরলো আর না আরোহীর।

পরিবারের সকলে এবার ভয় পেয়ে যায়, তারা বার বার আরোহী ও আঁধারের কেবিনে চেক করছে তো আবার দৌড়ে ডাক্তারের কাছে যাচ্ছে।

কিন্তু আশা অনুরুপ ফল পাচ্ছে না।আলিশা এবার আর নিজেকে আটকাতে পারে না,কোলের বাচ্চাটাকে আঁকড়ে ধরে হুহু করে কেঁদে দেয়।

তার বোন ও ভাইয়ের মতো বড়ো ভাশুরের আজকে এই অবস্থা আর সে কিছু করতে পারছে না! আলিশার কান্না দেখে আদরো নিজেকে আর সামলাতে পারে না করিডরেই ধপ করে বসে পড়ে।

শিহাব ও সোহেল দৌড়ে গিয়ে ধরে।

–‘আমার ভাই, আমার আরো!’

বলেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠে সে।সোহেল ও শিহাবের চোখের কোণে পানিরা টুপ করে পড়ে যায়। নীলি আঁধারের কেবিনের কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলছে।

রাতুল দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে কিন্তু তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।তরী রীতিমতো পাগলের মতো কাঁদছে সাহফিফকে আঁকড়ে ধরে।

আর সাহফিফ সে ও কাঁদছে তার বোন নামক ছোট পরীটার জন্য! সেই পরীটা আজকে কতো বড় হয়েছে, দুটো বচ্চার মা হয়ে গেলো কিন্তু এখনো চোখ খুলে তার কলিজার টুকরো বাচ্চাদের দেখতে পেলো না।

আঁকলিমা চৌধুরী ও শাহানাজ শেখ সেন্সলেস হয়ে গেছে তাদের কেবিনে রাখা হয়েছে। শিরিন চৌধুরী নামাজ পড়তে গেছেন।আমজাদ শেখ, তারেক চৌধুরী ও তৌফিক চৌধুরী ও নামাজ পড়তে গেছেন।

এই মুহুর্তে আল্লাহ ছাড়া তাদের আর কেউ সাহায্য করতে পারবে না।নীলিমার তিন মাসের ছোট ছেলেটা শাহরিয়ার নীলয়,সে মায়ের কান্না দেখে নিজেও কেঁদে উঠলো এবার

নীলিমা চোখের পানি মুছে বাচ্চাটাকে বুকের সাথে চেপে রাখলো কিছুক্ষণ এতেই যেনো বাচ্চাটা চুপ হয়ে গেলো।

নীলিমার ছেলের নাম আরোহী ও আঁধার মিলে ঠিক করে রেখেছে।তাদের নাকি এই নামটা অনেক পছন্দের।তাই নীলিমা ও সোহেল কেউই আর আপত্তি করেনি এতে।

লিমা নিজের চোখের পানি মুছে আলিশার ছেলেটার মুখে ফিডার তুলে দেয়!সে ও আজকে কাঁদছে! সকলের এতো ভালো বাসার দু’জন মানুষ আজকে এই পরিস্থিতিতে আছে আর তার না কেঁদে কিভাবে থাকবে!

কি হবে কেউ কিছু বুঝতে পারছিলো না যখন,ঠিক তখনই ম্যাজিকের মতো আঁধারের আগে আরোহীর সেন্স ফিরে আসে।

সকলে অবাকের জায়গায় হতভম্ব হয়ে যায়, যেখানে ৪৮ ঘন্টার আগে ডাক্তার নিজেও কিছু বলতে পারবে না বলছিলো সেখানে ৪ ঘন্টার মাঝেই এটা কি করে সম্ভব।

তবে সকলে একসঙ্গে আল্লাহকে শুকরিয়া জানায়!আল্লাহর হুকুম ছাড়া যেখানে একটা পাতা ও নড়ে না সেখানে এতো বড় একটা ঘটনা অসম্ভব ছিলো।

আরোহীর সেন্স ফেরার সাথে সাথে সে আঁধারকে সবার আগে দেখতে চায়!সকলে ভয় পেয়ে যায় কি বলবে ভেবে পাচ্ছিলো না যখন তখন শিহাব বলেই ফেললো,,,

–‘আরে আরো তোমার যে এইটুকু শরীর থেকে দু’টো টুইনস বাচ্চা হয়েছে তার কি খেয়াল আছে?’

–‘টু-ই-স বাবু!’

অবাক হয়ে থেমে থেমে বলে আরোহী।

–‘হুম আরো মা একটা রাজপুত্র আর একটা রাজকন্যা!’

শিরিন চৌধুরীর কথা শুনে আরোহীর খুশিতে চোখে জ্বল চলে আসে।

–‘তুই দেখবি না আরো?’

রাহির কথা শুনে আরোহী মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলে কিন্তু আবার পরমুহূর্তে আবার বলে,,,

–‘আঁধার কোথায়,ওনাকে একটু ডেকে দে না!’

আরোহীর কথা শুনে সকলের মুখ কালো হয়ে যায়। আরোহী কিছু একটা আন্দাজ করেই আবার বলে উঠে,,,

–‘কিরে ডেকে দে,আঁধার কোথায় ঠিক আছে ও?’

–‘আসলে ভাইয়া একটু বাহিরে গেছে আরো,এসে পড়বে কিছুক্ষণের মধ্যেই!’

রাহির কথা শুনে ভ্রুকুৃচকায় আরোহী, কিছু একটা মনে হতেই এবার উত্তেজিত হয়ে পড়ে সে,,,

–‘ওর মাথায় রক্ত ছিলো, আমাকে বাঁচাতে গিয়ে তো ও!’ আমার আঁধার, আমার আঁধার কোথায়! চুপ করে আছো কেনো সবাই।

–‘তুই উত্তেজিত হস না মা,আঁধার আছে তো!’

শাহানাজ শেখের কথা শুনে আরোহী শান্ত হতে পারে না।আরও চেঁচিয়ে উঠে,,,,

–‘কোথায় আমার আঁধার, আমার আঁধারের কাছে নিয়ে চলো আমায়!নিয়ে চলো।

–‘তুমি শান্ত হও আরো,তোমার এখন চেঁচামেচি করা যাবে না,ভাইয়ের কাছে নিয়ে যাবো আমি তোমায়!’ শান্ত হও আগে।

আদরের কথায় এবার মায়া মায়া চোখে তাকায় আরোহী তার দিকে।আদর চোখ নামিয়ে নেয়, আরোহী এবার শান্ত হয়ে ধির কন্ঠে বলে,,,

–‘তুমি নিয়ে যাবে আমায় ভাইয়া,আমার আঁধারের কাছে নিয়ে যাবে!’

–‘হুম যাবো,তবে তুমি যদি আমার সব কথা শুনো তাহলে!’ শুনবে তো?

আরোহীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে আদর।আরোহী মাথা নাড়িয়ে বলে,,,

–‘হুম!’

–‘এখন রেস্ট নাও তুমি একটু পর ভাইয়ের সাথে দেখা করানোর জন্য নিয়ে যাবো তোমায়,তার জন্য ফিট থাকতে হবে তো তাই না!’

মুখে সামান্য হাসি ঝুলিয়ে বলে আদর।আরোহী আবার মাথা নাড়ায়। ধির কন্ঠে বলে উঠে,,,

–‘আমি ঠিক আছি ভাইয়া তুমি আমায় নিয়ে চলো!’

–‘আমার কথা না শুনলে কিন্তু নিয়ে যাবো না বললাম তো!’

আদরের কথায় আরোহীর মুখ কালো হয়ে যায়। চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে।এরইমধ্যে হতদন্তর করে ছুটে এসে কেউ একজন তাকে ঝাপটে ধরে। চোখ খুলে হতভম্ব হয়ে যায় আরোহী।

সকলে অবাক চোখে তাকায় আঁধারের দিকে,আজকে কি সবকিছু মিরাক্কেলের মতো হচ্ছে তাদের সাথে।এই তো যেই আঁধারের এতোক্ষণ সেন্স ফেরার কোনো হুদিস নেই।

সেই আঁধার দৌড়ে এসে আরোহীকে বুকের মাঝে চেপে ধরে আছে।তবে আরোহী খেয়াল করে আঁধারের হাত থেকে রক্ত পড়ছে,হয়তো ক্যানেলা এক টানে খুলে ছুটে এসেছে তার আরুপাখিকে দেখতে তাই।

আরোহী আঁধারকে ছাড়িয়ে বলে উঠে,,,

–‘রক্ত আঁধার!’

আঁধার নিজেও তাকায় তার হাতের দিকে।শিহাব একটা নার্সকে ডেকে তার হাতে ব্যান্ডেজ করিয়ে নেয়।

এবার সকলের মুখে হাসি ফুটে উঠে। আরোহী ও আঁধারকে একটা কেবিনে সিফট করা হয়,আর সাথে বাচ্চাদের ও।এভাবেই কয়েকটা দিন কেটে যায়, আরোহী, আঁধার ও বাচ্চাদের বাসায় নিয়ে আসা হয়।

এরইমধ্যে সকলে অনেকটা সুস্থ যেহেতু তাই সকলে মিলে একটা ছোট খাটো অনুষ্ঠান করে বাচ্চাদের নামকরণ করা হয়।

ছেলেটার নাম রাখা হয়,, তাশফিদ আদ্র চৌধুরী আর মেয়েটার নাম রাখা হয়,,,তাশফিহা আয়রা চৌধুরী।
দেদে
তবে দু’টো বাচ্চা তাদের জমজ হলেও দু জনের চেহারা সম্পূর্ণ আলাদা।আদ্র পেয়েছে অনেকটা মায়ের মতো চেয়াহা তবে স্বভাব বাবার মতো!

আর আয়রা পেয়েছে বাবার মতো চেহারা তবে স্বভাবটা মায়ের।আদর তাদের শিখিয়েছে সে তাদের বাবাই আর আলিশা তাদের আশা মা।

আর শিহাব ও রাহি শিখিয়েছে শিহাব ছোট বাবা আর রাহি ছোট মা তবে বাচ্চারা ছোট মা বলতে পারে না তাই অনেক সময় মাম্মা বলে।আর আঁধারকে পাপা আর আরোহীকে মাম্মাম বলেই ডাকে।

আরোহীদের যেদিন হাসপাতাল থেকে নিয়ে আশা হয় সেদিন আরোহীর হাতে ডায়েরিটি ছিলো।সে এক্সিডেন্ট অব্দি লিখলেও বাকিটুকু লিখতে পারেনি বাচ্চাদের কান্নার জন্য!

ছোট বেলা থেকেই তার সখ ছিলো বিয়ের পর বর সম্পর্কে ডায়েরিতে লিখে রাখবে সবকিছু যেনো বুড়ো বয়সে নাতী নাতনীদের শুনাতে পারে।

কিন্তু ভুল বসত সেদিন ডায়েরিটি সেখানেই ফেলে আসে।তবে পড়ে আর পায়নি ডায়েরিটি!পুরো হাসপাতালে খুঁজেছিলো তারা কিন্তু ততোক্ষণে হয়তো কেউ নিয়ে গিয়ে ফেলে দিয়েছিলো তাই পায়নি।

অনেক মন খারাপ ছিলো আরোহীর যার কারণে এযকন অব্দি আর কোনো ডায়েরিতেই কিছু লিখতে পারেনি।

এভাবেই দেখতে দেখতে কেটে যায় তিনটি বছর।সকলে হাসি খুশির সাথে জীবনে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে! সাথে পরিবর্তন এসেছে সকলের জীবনেও।

ড্রয়িংরুমে থমথমে পরিবেশ! সবটা শুনে হতভম্ব ক্যারি ও ক্যাথি!তবে কষ্টের মাঝে ও তাদের চোখ মুখে সুখের ছায়া দেখা যায়।সবাই সুখে আছে শুনেই তাদের মনে শান্তি আসলে যেনো।

এরইমধ্যে ক্যাথির নজর যায় সেই অফিসের বাচ্চাটার দিকে যে বাচ্চাটা আরোহীর সাথে গিয়েছিল। দেখতে আরোহীর মতোই অনেকটা,তাহলে কি এটাই আরোহী ও আঁধারের ছেলে আদ্র।

তবে ছেলেটা অনেকটা গম্ভীর এবং এতো ছোট একটা বাচ্চা কি না স্পষ্ট কথা বলতে পারে।আঁধারের কপি,ভেবেই হেঁসে দেয় ক্যাথি।ক্যারি ও এতোক্ষণ হয়তো এই প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজছিলো।

সে ও ক্যাথির মতো নিজের প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেয়ে খুশি হয়ে যায়। হাতের ইশারায় বাচ্চাটাকে তার কাছে ডাকে।

আদ্র গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়ায় ক্যারির।ক্যারি একটু জড়িয়ে ধরতেই আদ্র গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে,,,

–‘তুমি কে?’

ক্যারি হেঁসে ফেলে, বাপের কার্বণ কপি সেটা আবার প্রমাণ করে দিলো আদ্র।

–‘ও হলো আমার ঘরওয়ালির বোন ওরফে তোমার খালামনি!’ সালাম দাও।

আঁধার ফাজলামো সুরে বলে। আদ্র একপলক পাপার দিকে তাকায় তার তবে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলে,,,

–‘আসসালামু আলাইকুম!’

স্পষ্ট আদ্রের কন্ঠস্বর, ক্যারির সাথে ক্যাথি ও তার বাবা মা ও অবাক হয় এতোটা পরিস্কারভাবে এতো ছোট বাচ্চা সালাম দিতে পারে? নিসন্দেহে বাচ্চাটা বাবাকে কপি করে তাই তো সালাম দেওয়ার স্টাইলটা ও বাবার মতো।

#চলবে?

#নীল_ডায়েরির_সেই_মেয়েটি
#আরদ্ধিতা_রুহি
#পর্বঃ৪৭

🍁

ভরদুপুরে বাগানে রোদের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে ক্যারি,আর তার পাশেই একটু অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাতুল।

ক্যারিকে দেখে মনে হচ্ছে সে তার ভাবনায় বিভোর হয়ে আছে,আর রাতুলকে দেখে মনে হচ্ছে সে ক্যারিফিয়া নামক বিদেশি রমনীকে খুঁটিয়ে খাঁটিয়ে দেখতেই ব্যাস্ত!

ক্যারিদের এই বাড়িতে আসার আজকে দশদিন পূর্ণ হয়ে গেলো।অথচ এই বাড়ির মানুষদের ব্যাবহার দেখে মনেই হয় না এনারা তাদের অথিতি, বাড়ির সদস্যদের মতোই তারা ক্যারিদের ট্রিট করে।

এই কয়েকদিনে ক্যারি ও ক্যাথি সকলের প্রিয় হয়ে উঠেছে! আরোহী ও আলিশা তাদের নিজের বোনের মতো ভালোবাসে! আঁধার ও ছোট বোনের মতো তাদের যত্ন করে আর বাড়ির বড়োরা মেয়ের মতো!

তবে এই কয়েকদিনে আদ্র, আয়রা,তাহমিদ ও তাহশিফের সাথে তাদের অনেক ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে! আর সাথে

–‘আরোহী কতো লাকী তাই না মিস্টার রাতুল?’

–‘হুম!’

হঠাৎ করেই ভাবনার মাঝে ক্যারির কন্ঠ শুনে ঘোরের মাঝেই উত্তর দেয় রাতুল।

–‘আঁধার তাকে কতো ভালোবাসে, আর আদর সে ও তো ভালোবাসতো তার আরোকে!’

সামান্য হেঁসেই বলে ক্যারি,,,

–‘হুম!’

রাতুল এখনো ঘোরের মাঝেই আছে তাই ক্যারির সব কথাতেই সায় দিচ্ছে।

–‘আঁধারের মতো কেউ যদি আমার লাইফে আসতো তাহলে হয়তো আমিও তাকে আরোহীর মতোই ভালোবাসতাম!’

উৎসাহ দেখিয়ে বলে ক্যারি।

–‘হুম!’

রাতুলের আবার একই উত্তরে ক্যারির কোনো ভবাবেগ হলো না সে নিজের মতো করেই আবার বলতে শুরু করলো।

–‘আই উইস আমি যদি আরোর জায়গায় থাকতে পারতাম আর আঁধার যদি আমায় ভালোবাসতো।’

–‘হুম!’

রাতুল ঘোরের মাঝেই উত্তর দেয় ঠিকই তবে মুহুর্তের মাঝে তার ধ্যান ভেঙ্গে যায় আর চেঁচিয়ে বলে উঠে সে,,,,

–‘কিহ!’

রাতুলের চিৎকারে ক্যারি তার দিকে তাকায়, রাতুলের শক্ত চোখ মুখ দেখে অবাক হয় সে।রাতুল দু কদম এগিয়ে এসে ক্যারির হাতের বাহুদ্বয় শক্ত করে চেপে ধরে বলে,,,

–‘তুমি কি আঁধারকে ভালোবেসে ফেলেছো নাকি?’ আর যদি এমনটা হয় তবে আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না!’

রাতুলের শক্ত কন্ঠ শুনে ক্যারির মাঝে কোনো ভবাবেগ হলো না সে মুখে হাসির রেস টেনে এনে বললো,,,

–‘কেনো?’ হু আর ইউ? আমার লাইফ আমি কাকে ভালোবাসবো কাকে আমার লাইফে জড়াবো সেটা আমার ব্যাপার! আপনি কে আমায় এসব বলার বলুন তো?

চোখ মুখ শক্ত করে বলে ক্যারি।রাতুল ভেবাচেকা খেয়ে যায়, তবে সে ও পাল্টা জবাবে বলে,,,,

–‘আরো আমার ছোট বোন হয় আর আমার ছোট বোনের লাইফে অনেক প্রবলেম এসেছে, তোমার জন্য নতুন করে আর কোনো প্রবলেম আসতে দিবো না আমি!’

ক্যারির শক্ত চোখ মুখ আরও খানিকটা শক্ত হয়ে যায়।

–‘আই লাভ আঁধার, আই লাভ হিম ভেরি মাচ!’ আমি ওকেই বিয়ে করতে চাই,আপনি আমার ব্যাপারে নাক না গলালেই ভালো করবেন!

কথাটা বলার সাথে সাথেই ক্যারির গালে একটা শক্ত হাতের থাবা পড়ে।হতভম্ব হয়ে যায় ক্যারি!চোখ দিয়ে দুফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে, চোখ তুলে তাকাতেই রাতুলের লাল টকটকে চোখ মুখ সামনে ভেসে ওঠে!

ক্যারি এবার অসহায় চোখে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা আঁধার, আরোহী ও বাকি সবার দিকে তাকায়!ওরা নিজেও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, এমনটা হবে সেটা তাদের ধারণার বাহিরে ছিলো।

রাতুল তখনো চোখ মুখ শক্ত করে তাকিয়ে আছে ক্যারির দিকে।ক্যাথির চোখে পানি এসে যায়,তার বোনকে কেউ এভাবে মারবে সেটা সে কখনোই কল্পনা করে নি!

আরোহী এগিয়ে আসতে ধরলে আঁধার তার হাত টেনে ধরে।

আরোহী দ্বিগুণ অসহায় চোখে তাকায় আঁধারের দিকে,তবে আঁধার তাকে চোখ দিয়ে আস্বস্ত করে!

ছোট আদ্র ভ্রুকুঁচকে একটু দূরেই ভ্রুকুঁচকে তাকিয়ে সকলের কাজ কর্ম দেখছে!

–‘আপনার সাহস হলো কি করে আমায় মারার?’

চোখের পানি মুছে চেঁচিয়ে বলে ক্যারি।রাতুলের এবার হুস ফিরে আসে,সে রাগের মাথায় কি করেছে বুঝতে পেরেই হাসফাস শুরু করে।ক্যারির চোখ জোড়া তখনো ছলছল করছিলো।

–‘আ’ম সরি ক্যারিফিয়া,আসলে….’

আমতা আমতা করে রাতুল।

–‘আই লাভ ইউ রাতুল, আমি আপনাকে ভালোবাসি আর আপনি কি না…!’

বলেই ডুকরে কেঁদে উঠে ক্যারি।রাতুল হতবাক হয়ে যায়, কি বলছে ক্যারি তাহলে আঁধারের কথা কেনো বললো এতোক্ষণ?

শুকনো ঢোক গিলে রাতুল।

–‘আমি তো আপনার মুখ থেকে কথা বের করার জন্য এমনটা বলেছিলাম আর আপনি কি না…!’

চোখের জ্বল মুছে নিয়ে বলে ক্যারি।রাতুল আমতা আমতা করে কিছু বলবে তার আগেই ক্যারি একটা আচর্য জনক কাজ করে বসে।

সবাই হা করে তাকায়,পরমুহূর্তে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা আদ্রের দিকে নজর যায় শিহাবের।সে তখনো ভ্রুকুঁচকে তাকিয়ে আছে ক্যারিদের দিকে।

সকলে উল্টো দিকে ঘুরে যায়, আর শিহাব দৌড়ে গিয়ে আদ্রেকে কোলে তুলে বাড়ির দিকে ছুট লাগায়! রাতুল কয়েক সেকেন্ডের জন্য হতভম্ব হয়ে গেলেও পরমুহূর্তে প্রেয়শীর ডাকে সারা দেয়!

সকলে লজ্জায় পড়ে যায়, ক্যারি যদিও বিদেশে বড় হয়েছে কিন্তু তারা তো আর বিদেশি না তাই তারা লজ্জা যে যার মতো চলে যায়।

কয়েক মিনিট বাদে সরে আসে ক্যারি রাতুলের কাছ থেকে! দু’জনে হাফাতে শুরু করে,রাতুল ঠোঁট মুছে আসে পাশে তাকায়,না কেউ দেখেনি ভেবে সস্থির নিশ্বাস ছাড়ে সে।

–‘আই লাভ ইউ!’

রাতুলের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে ক্যারি!রাতুল ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে বলে,,,

–‘তুমি কি আদৌও বুঝতে পারছো কি বলছো?’

–‘না তবে আপনি হয়তে ভাবছেন আমি বিদেশে বড় হয়েছি কয়েকদিন পড়ে যদি অন্য কাউকে ভালো লাগলে ছেড়ে যাই রাইট?’

রাতুল অবাক হয়ে তাকায় ক্যারির দিকে।ক্যারি আবার বলতে শুরু করে,,,

–‘আমাদের দেশে ভালোবাসা বলতে মনের থেকে বেশি সবাই শরীরকে চেনে, হয়তো আমারো এটাই হতো বাট আমি আরোহীর ডায়েরি পড়ার পর তার লেখা ও তাদের ভালেবাসার প্রেমে পড়েছি রাতুল!’ আমি চাই আরোহীর মতো করে আমায় ও কেউ ভালোবাসুক, আমি ও আরোহীর মতো এক পুরুষে আসক্ত হতে চাই!আপনি যদি আমায় ভালো না বাসেন তাহলে ইটস ওকে আমরা কালকেই ফিরে যাচ্ছি!

ক্যারির কথা শুনে রাতুল মুচকি হেসে বলে,,,

–‘বিয়েটা কি আজকেই করবে নাকি কাল?’

ক্যারি অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়!রাতুল এবার দু কদম ক্যারির দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,,,

–‘নাকি তুমি বিয়ে করতে চাও না আমায়?’

ক্যারি উৎফুল্ল হয়ে লাফিয়ে রাতুলের গলা জড়িয়ে ধরে।রাতুল হেঁসে ক্যারিকে কোলে তুলে ঘুরাতে ঘুরাতেই বলে,,,

–‘আমি কিন্তু তোমায় কাল কোথায় ও যেতে দিচ্ছি না, আর আজকেই বিয়েটা করতে হবে বুঝলে?’ আমি তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি ক্যারিফিয়া, আমার মতো একটা ছেলে কি না এই বিদেশিনী রমনীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে!

ক্যারি মুচকি হেসে রাতুলের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,,,,

–‘ভালোবাসা সুন্দর রাতুল,আমিও সেই ভালোবাসা পেতে চাই উপভোগ করতে চাই!’ আপনার হাতে হাত রেখে আরো ও আঁধারের মতো চলতে চাই।আমি এসেছিলাম আরো ও আঁধারের সাথে দেখা করতে কিন্তু আমার ডেসটিনি আমায় যে এখানে আপনার জন্য টেনে আনবে সেটা আমি কখনো বুঝতে পারিনি রাতুল।আমি চাই না আপনাকে হারাতে,আমি চাই না আপনার ভালোবাসা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে।

কথাগুলো বলতে বলতে ক্যারির গলা ধরে এসেছিলো বার বার,রাতুল এবার একটু সময় নিয়ে ক্যারির কপালে একটা চুমু খায়।

–‘ত্যালি আন্তি তুমি লাতুল আঙ্তেলের তোলে তি তলছো?’

হঠাৎ ছোট বাচ্চার কন্ঠ পেয়ে রাতুল ক্যারিকে ধপ করে নিচে ফেলে দেয়।ক্যারি ব্যাথায় চেঁচিয়ে উঠে, রাতুল চোখ ঘুরাতেই আয়রা,তাহমিদ,তাহশিফ ও নীলয়কে দেখতে পায়!

বাচ্চাগুলো ক্যারিকে দেখে খিলখিল করে হেঁসে উঠে!ক্যারি নিজের ব্যাথার কথা ভুলে গিয়ে রাতুলের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকায়!

রাতুল অসহায় চোখে একবার ক্যারির দিকে তাকাচ্ছে তো একবার বাচ্চাগুলোর দিকে।

এরইমধ্যে একটা ছোট হাত এগিয়ে দেয় ক্যারির দিকে কেউ। ক্যারি চোখ ঘুরাতেই আদ্রের দিকে নজর যায় তার!আদ্র গম্ভীর মুখ করে তারই দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।

–‘তুমি হাসবে না?’

ক্যারি ব্যাথাযুক্ত কন্ঠে আদ্রের দিকে প্রশ্নটি ছুঁড়ে দেয়!আদ্র ভ্রুকুঁচকে তাকায় তার দিকে।ক্যারির মুখে এবার হাসি ফুটে উঠে!

বাচ্চাটার সবকিছু তার কাছে অনেক ভালো লাগে,এই যে এখন ভ্রুকুঁচকে তাকালো সেটাও তার কাছে চমৎকার লাগলো।

ছেলেটা কিছুটা গম্ভীর আবার একটু বেশিই হাসিখুশি! তবে তাকে অনেক সময় বড়দের মতো গম্ভীর চেহারা করতে দেখা যায় সেটা না!

হয়তো সে বড়দের মতো করে সবকিছু করার চেষ্টা করে তাই।এইটুকু একটা ছেলে যে নিজের হাতে ভাত খেতে পারে না তবে তার বোনকে মাঝে মাঝে নিজের হাতে তুলে দু’টো দু’টো করে ভাত খাইয়ে দেয়!

বোনকে সবসময় আগলে রাখার চেষ্টা করে,চর কাপড় তো বাবার সাথে মিলিয়ে পড়ে সবসময়। বাবার স্টাইল কপি করে সে সবসময়।

আর আয়রা সে এখনই যেনো ছন্নছাড়া, আর অগোছালো! ফাজিলের হাড্ডি, সবসময় ফাজলামো করাই তার কাজ!বাড়ির সকলের নয়নের মনি সে! তাহমিদ, তাহশিফ ও আদ্র তারা তিন ভাইয়েই হয়েছে বোন ভক্ত!তাদের বোন হলে আর কিছু লাগে না!

–‘কি হলো উঠো!’

আদ্রের কথায় ক্যারির ধ্যান ভাঙ্গে!সে আদ্রের দিকে তাকায় একবার তার হাতের দিকে তাকায়!পরমুহূর্তে আদ্রকে কাছে টেনে নেয়,মিষ্টি হেসে তার গাল টেনে দেয়।

#চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে