নীল_ডায়েরির_সেই_মেয়েটি পর্ব-৪০+৪১

0
640

#নীল_ডায়েরির_সেই_মেয়েটি
#আরদ্ধিতা_রুহি
#পর্বঃ৪০

🍁

আজকের সকালটা অন্য রকম ভাবে শুরু হলো সকলের,,,

চৌধুরী পরিবারের আজকে উৎসবের দিন , আর হবে নাই বা কেনো? একসাথে কালকে দ্বিগুণ খুশির খবর পেলো আর আজকে আরও একটা যোগ হয়ে গেলো তারা কি আর খুশি না হয়ে থাকতে পারে?

তাহশিফ ও তাহমিদকে দেখতে এসেছে আঁধারের নানার পরিবারের সকলেই, তবে তারা এসে যে এতো বড় আর একটা খুশির সংবাদ পাবে সেটা বুঝতে পারেনি।

সকলে আজকে ভিষণ খুশি, আরোহীর যত্নের জন্য সকলেই আজকে যেনো উঠে পড়ে লেগেছে।

আরোহী অনেকটায় অবাক হয়ে গেছে, কারণ একদিন হলো তারা শুনেছে কিন্তু তাদের যত্ন দেখে মনে হচ্ছে তারা কতোদিন থেকে এই দিনটারই অপেক্ষা করছিলো।

আরোহীর আজকে নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে! সকলের এতো ভালোবাসা এতো কেয়ার সব তো শুধু মাত্র তারই জন্যই তাহলে সে তো ভাগ্যবতীই হলো নাকি!

আঁধারের মামী সুরাইয়া বেগম তিনি ও আজকে আরোহীকে কাছে টেনে আদর করে দিয়ে বলেছেন,,,,”স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে থাক মা,আর পারলে তোমার এই খারাপ মাটাকে ক্ষমা করে দিয়ো”।

আরোহী তাকে জড়িয়ে ধরে বেশ কিছুক্ষণ থাকার পর স্বাভাবিক হয়ে গেছে তার সাথে।মহিলাটা আসলে যতোটা কঠোর দেখিয়ে ছিলো তাকে তিনি তার থেকে আরও কয়েকগুন ভালো।

আরোহী ভিষণ খুশি, কিন্তু সকলের মাঝে সে আঁধারের সাথে তার খুশিটা ভাগ করতে পারছে না ভেবেই অস্থির হচ্ছে বার বার সে।

আমজাদ শেখ তো হাঁড়ি হাঁড়ি মিষ্টি নিয়ে এসেছেন সাথে তারেক চৌধুরী ও সেম কাজটায় করেছেন!এখন সেগুলো মহল্লায় ও আত্মীয়দের বাড়িতে পাঠানো হচ্ছে।

আঁকলিমা চৌধুরী আরোহীকে রীতিমতো দুই প্লেট ফল খাইয়ে ফেলেছেন। আরোহী অবশ্য বিরক্ত হচ্ছে না তার বরং ভালোই লাগছে এসব।

আঁধার বার বার আরোহীর আশে পাশে ঘুরঘুর করছে, তবে একা পাচ্ছে না এখন আর তার বউকে।অসহায় চোখে বার বার আরোহীর দিকে তাকাচ্ছে সে।

আরোহী কেনো জানি না আজকে এইসব কাহিনি মজাই লাগছে।বিশেষ করে আঁধারের অসহায় চাহনি, ভেবেই হেঁসে কুটিকুটি খাচ্ছে সে।

আরোহীর হাঁসি দেখে দু’বার অবশ্য আঁধার চোখ রাঙ্গানি ও দিয়েছে তবে কাজ হয়নি!আজকে হয়তো আরোহীর হাসার দিন তাই তো আঁধারের চোখ রাঙ্গানি হোক কিংবা রাগী চাহনি হোক কোনটাই আজকে আরোহীকে ভয় পাইয়ে দিতে পারে নি।

রাহি আর শিহাব তো এখনই আরোহী ও আঁধারের বাচ্চার নামের প্লানিং এ লেগে পড়েছে।নাম ঠিক করছে কম তারা কিন্তু ঝগড়া করছে বেশি।

এরইমধ্যে তৌহিদ চৌধুরী ও তারেক চৌধুরীর সব ঝামেলা ভুল বোঝা বুঝি মিটেও গেছে।বাচ্চারা আবদার করেছে তারা একই সঙ্গে থাকবে, তাই তো চৌধুরী ম্যানশনে সকলে একসঙ্গে থাকবে বলে ঠিক করেছে।

যেহেতু শিহাবরা থাকবে তাহলে রাহিও থাকবে তাই আরোহীর খুশি আরও কয়েকগুন বেড়ে গেছে যেনো আজকে।তৌহিদ চৌধুরী কালকেই এখানে চলে আসবেন বলেছেন।

রাতে,,,,

আরোহী একা একা বসে আছে বিছানায় হেলান দিয়ে,আঁধার অফিসের ফাইল ঘাটাঘাটি করছে!আরোহী মনে হয় এবার ক্ষানিকটা বিরক্ত হয়,তাই তো একটা বিরক্তিকর চাহনি নিক্ষেপ করে আবার চুপচাপ বসে থাকে।

তবে এতে আঁধারের কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় না,সে নির্বাক হয়ে নিজের কাজই করছে!মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে কাজ ছাড়া তার আশে পাশে কিছুই নেই,তাই এক মুহূর্তের জন্য কাজ না করলে সে মরে মরে শহীদ হয়ে যাবে।

–‘এই যে?’

আরোহীর শান্ত কন্ঠস্বর।আঁধার তাকায় না,তবে মাথা নাড়ায়! যার অর্থ নাটক না করে বলে ফেলো।আরোহীর বিরক্ত যেনো এবার খানিকটা বেড়ে যায়, তবে সে প্রকাশ করে না সেটা।

আবার আঁধারের উদ্দেশ্যে বলে সে,,,

–‘ঘুমাবো তো!’

–‘ঘুমাও!’

নির্লিপ্ত কণ্ঠস্বর আঁধারের।

–‘আপনি কখন ঘুমাবেন?’

খানিকটা চেঁচিয়ে বলে উঠে এবার আরোহী। আঁধার একটা ভ্রু উঁচু করে সামান্য তাকায়, তবে আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিতে দিতেই বলে উঠে,,,,

–‘কাজ শেষ করেই, তুমি ঘুমাও না!’

–‘না আপনি এখনই ঘুমাবেন আর সেটা ও আমার সাথেই!’

জেদি কন্ঠে বলে উঠে এবার আরোহী। আঁধার নিজের কাজ করতে করতে বলে,,,,

–‘কাজ আছে অনেক আরু, ঘুমাও তুমি আমি আসছি একটু পর!’

–‘আপনি এখন এ এসে শুয়ে পড়বেন, এখন মানে এখন!’ নাহলে আমিও ঘুমাবো না।

–‘জেদ করো না আরু শুয়ে পড়ো তুমি রাত জাগা তোমার আর বেবির দু’জনের জন্যই ভালো না!’

কিছুটা শক্ত কন্ঠে বলে উঠে আঁধার। আরোহীর এবার কান্না পায়, তবুও নিজেকে শান্ত করে আবার বলে,,,,

–‘বললাম তো আপনি না আসলে আমি ঘুমাবো না!’

ব্যাস আঁধারকে রাগানোর জন্য এই একটা কথায় যথেষ্ট ছিলো। রাগে ফুঁসে উঠে হাতে থাকা ফাইলটা আঁছাড় মেরে বলে উঠে আঁধার,,,,,

–‘কথা বুঝিস না তুই, এক কথা কয়বার বলার লাগে তোকে?’ ঘুমাবি না তো কি করবি রাত জেগে,নাচবি? থা’পড়ায় সোজা করে দিবো একদম বেয়াদব মেয়ে! চুপচাপ শুয়ে পড় বেশি কাহিনি করবি তো বাগানে অন্ধকারে রেখে আসবো!’

আঁধারের ধমক খেয়ে আরোহী আর নিজেও আটকাতে পারে না,চোখ দিয়ে অনবরত পানি বের হয় তার!কিন্তু আঁধার সেদিকে খেয়াল না দিয়ে আবার ধমকে উঠে,,,,

–‘কথা কানে যায়নি তোমার,এখনো বসে আছো কেনো?’

ভয়ে কেঁপে উঠে আরোহী চুপচাপ শুয়ে পড়ে, আর একটা বাক্য ও ব্যায় করে না। তবে আঁধার ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে,হাত মুষ্টি বদ্ধ করে রাগ কমানোর চেষ্টা করে।

এরইমধ্যে আরোহী বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়, শক্ত চোখে তাকায় আঁধার। তবে আরোহী সেদিকে পাত্তা না দিয়েই চোখের পানি মুছে ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে রাগে জেঁদে দরজা খুলে বের হয়ে যায়।

আঁধার সবটাই দাঁড়িয়ে দেখে তবে সে কি প্রতিক্রিয়া দিবে বুঝতে পারে না।চোখ বন্ধ করে নিজেকে শক্ত করে সে ও আরোহীর পেছন পেছন এগিয়ে যায়।

আরোহী গেস্ট রুমে ঢুকে কেবল দরজা আঁটকে দিবে তার আগেই আঁধার হাত দিয়ে আঁটকে দেয়। আরোহী আঁধারকে দেখে ভয় পেয়ে যায়,কারণ আঁধারের রাগ সম্পর্কে তার ধারণা আছে।

তবে মুখে সেটা প্রকাশ করে না বরং আবার দরজা লাগানোর চেষ্টা করে। আঁধার এবার তাকে এক হাতে আগলিয়ে ভেতরে ঢুকে যায়!

আরোহী তাকায় তার দিকে,আঁধারকে রক্তচক্ষু নিয়ে তার দিকে তাকাতে দেখে মিইয়ে যায় এবার সে।তবে পরক্ষণেই নিজেও শক্ত চোখে তার দিকে তাকায়।

নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে সে তবে পারে না,আঁধারের কাছে সে যে চুনোপুঁটি সেটা সে কেনো সকলেই ভালো করে জানে। তাই আর বেকার চেষ্টা না করে মুখ উল্টো দিকে ঘুরিয়ে নেয়।

আঁধার আর সময় ব্যায় না করেই ঝট করে কোলে তুলে নেয় তার অভিমানী প্রেয়শীকে।তবে এবার আরোহী নিজেই মুখ ফুটে বলে,,,,

–‘যাবো না কোথাও আমি নামান আমায়!’

–‘অনুমতি চেয়েছি নাকি?’

শক্ত কন্ঠ আঁধারের।আরোহী কেঁদে ফেলে, আঁধার সামনে এগুতে শুরু করে। এরইমধ্যে আরোহী চেঁচিয়ে বলে উঠে,,,,

–‘আমি আপনাকে আমায় ছোঁয়ার অনুমতি দেই নি মিস্টার চৌধুরী, নামান আমায় নাহলে ভালো হবে না কিন্তু!’

–‘তাশরিফ আঁধার চৌধুরীর কারো অনুমতির দরকার বা প্রয়োজন হয় না!’ আর তোমার ক্ষেত্রে তো নাহহই।

খানিকটা উপহাসের সুরে বলে আঁধার। আরোহী আবার চেঁচিয়ে উঠে,,,,

–‘নামাবেন আপনি?’ নাকি কামড়িয়ে দেবো!’

–‘চেঁচিয়ো না আরুপাখি সকলে কি ভাববে বলো তো তুমি যে ছোট বাচ্চা সেটা কি সকলে দেখানোটা জরুরি?’ আর কামড়া কামড়ি রুমে গিয়ে করো যতো ইচ্ছে।

নরম সুরে বলে এবার আঁধার, আরোহী আর তর্কে জড়ায় না তবে কান্না থামায় না!

আরোহীকে বিছানায় শুয়ে দেয় আঁধার, দিয়েই আবার বাহিরে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর হাতে এক গ্লাস জুস নিয়ে আসে।

–‘নাও খেয়ে নাও এতোক্ষণ চেঁচামেচি করে গলা শুঁকিয়ে গেছে নিশ্চয়ই!’

জুসের গ্লাসটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে আঁধার, আরোহী কোনো বাহানা ছাড়াই নিয়ে নেয় কারণ তার আসলেই গলা শুঁকিয়ে গেছে।

এবার দরজা বন্ধ করে এসে আরোহীর পাশে ধপ করে শুয়ে পড়ে, আঁধারকে গাঁ ঘেসে শুতে দেখেই আর একটু বিছানার কিনারে সরে যায় আরোহী।

আঁধার সময় ব্যায় না করে টেনে জড়িয়ে ধরে। আরোহী ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট শুরু করে তবে আঁধার আরও শক্ত করে ধরে।

–‘বেকার এনার্জিগুলো নষ্ট করছো কেনো জান, তুমি ভালো করেই জানো দূরে যাওয়ার ক্ষমতা তোমার নেই!’ আর যেতে চাইলেও আমি যেতে দিবো না।

বলেই শব্দ করে আরোহী কপালে চুমু খায় আঁধার। আরোহীর ছটফট এবার থেমে যায়,তবে কথা বলে না।তাই আঁধার নিজেই বলা শুরু করে,,,,

–‘সরি আরুপাখি, অফিসের একটা প্রজেক্ট নষ্ট হয়ে গেছে তাই মাথাটা গরম ছিলো!’ তাই একটু রাগ দেখিয়ে ফেলেছি, এই যে এতো গুলো সরি।

হাত দিয়ে দেখিয়ে বলে আঁধার। আরোহী তবুও শক্ত হয়ে থাকে।আঁধার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,,,,

–‘আচ্ছা তুমি যেটা শাস্তি দিবে সেটাই মেনে নিবো তবুও এমন করে না,আমি তোমায় কতোটা ভালোবাসি সেটা কি তুমি জানো না বলো?’ তোমার ভালোর জন্যই তো রাগ দেখালাম, তোমারো তো বোঝা উচিত আমার অফিসের চাপ যাচ্ছে একটু।

মন খারাপ করে নেয় এবার আঁধার, আরোহীর মায়া হয়। ভালোবাসার মানুষটাকে কষ্ট দিতে তার কি আর ভালো লাগে নাকি উহু একদম লাগে না তাই তো গলে যায় সে ও।আঁধারকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,,,,

–‘ভালোবাসি!’

আঁধার নিজেও পরম আবেশে প্রেয়শীকে আর একটু জড়িয়ে নিয়ে বলে,,,,

–‘আমিও তোমায় ভালোবাসি বাবুর আম্মু, অনেক ভালোবাসি!’

আরোহীর মনে প্রশান্তি বয়ে যায়।আঁধারের বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে নেয় সে,এখন একটা প্রশান্তিময় ঘুম দিবে সে।

#চলবে?

#নীল_ডায়েরির_সেই_মেয়েটি
#আরদ্ধিতা_রুহি
#পর্বঃ৪১

🍁

দেখতে দেখতেই কেটে গেছে অনেক কয়টা মাস, এই তো আজকে আরোহীর প্রেগন্যান্সির আট মাস পূর্ণ হয়ে নয় মাসে পড়লো।

এই নয় মাসে চৌধুরী ম্যানশনের অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়ে গেছে!সাথে পরিবর্তন হয়েছে সকলের ও, এই তো এখন সবাই আরোহীকে বেশি আদর ভালোবাসা দেয়!

যেমন আঁকলিমা চৌধুরী, তিনি আরোহী কি খাবে, কখন কি করবে কখন গোসল করবে এবং আরোহী কোথায় যাবে সেটার ও খেয়াল তিনি নিজ দায়িত্বে রাখেন।

তারেক চৌধুরী, তিনি তো অফিস থেকে আসার সময় আরোহী ও আলিশার জন্য চটপটি, ফুঁসকা,চকলেট এক এক দিন এক এক ধরনের খাবার নিয়ে আসেন।

আঁধার আজকাল বেশিভাগ সময়ই ব্যাস্তটার সাথে কাঁটায়, এইতো কিছুদিন আগেই ভার্সিটির ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা শেষ হলো তার।তারপর অফিস নিয়েই ব্যাস্ত হয়েগেছে পুরোদমে!

তবে অফিসে থাকাকালীন সময়ে হাজার বার আরোহীকে ফোন দিয়ে বিরক্ত করে সে।মাঝে মাঝে আরোহীর মনে হয় তাদের নতুন নতুন প্রেম চলছে।

আলিশার বাচ্চাদের বয়স এখন ছয়মাস কারণ আরোহী যেহেতু সেদিন তিন মাসের প্রেগন্যান্ট ছিলো তাই তাদের ছয় মাস হয়ে গেছে। পিচ্চিরা এখন আধো আধো গলায় কথা বলতে পারে, তবে এখনো হাঁটা শিখেনি।

আলিশা বাচ্চা কাচ্চা সামলিয়ে সেও আরোহীর খেয়াল রাখতে কোনো ত্রুটি রাখে না,সাথে আদর ও।

তাই আরোহীর আর নিজেকে একা একা লাগে না,তবে তার মুড সুয়িং হয় প্রচুর।হুট হাট আঁধারকে বিরক্ত করা,সাথে সকলে বিরক্ত করা তার অভ্যেসে পরিনত হয়েছে যেনো।

তবে কেউ বিরক্ত হয় না তার এই সব আবদারে কিংবা পরিবর্তনে।শাহনাজ শেখ ও আমজাদ শেখ দুদিন পর পর এসে মেয়ে ও নাতীদের দেখে যান।

আলিশার বাচ্চারা যেনো এখন সকলের প্রাণ হয়ে উঠেছে, সকলে তাদের সবসময় মাথায় তুলে রাখে। আর সব থেকে বেশি তো আঁধার!

আরোহী যদিও কোলে নিতে পারেনা তবে বসে বুকের মাঝে চেপে ধরে বসে থাকে।বাচ্চাগুলোর গাঁ থেকে সে কেমন একটা নিজের বাচ্চা বাচ্চা গন্ধ পায়,তাদের যখন বুকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে মনে হয় সে কতো সুখী একজন মানুষ।

দীর্ঘ নয় মাসের কথা ভেবে আনমনে হেসে উঠে আরোহী।লিমা ভুত দেখার মতো চমকে তাকিয়ে থাকে আরোহীর দিকে,আরোহীর হঠাৎ করে মনে হয় কেউ তাকে গভীর চাহনিতে দেখছে!

চোখ ঘুরাতেই লিমাকে এমন ভুত দেখার মতো চমকে তার দিকে তাকাতে দেখে সামান্য হাসার চেষ্টা করে আরোহী!

–‘আমার জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে আয় তো লিমা, আর হ্যা আমায় ভুতে টুতে ধরেনি কিছু মধুর সময়ের কথা ভেবে হাসছিলাম।’

আরোহীর কথা শুনে লিমা এবার স্বাভাবিক হয়, মাথা নাড়িয়ে চলে যায়। আরোহী আবার হেঁসে ফেলে, লিমার রিয়াকশন দেখে অন্য সময় হলে আরোহী গড়াগড়ি দিয়ে হাসতো কিন্তু এখন হাসলো না।

এখন প্রায় সন্ধ্যা হতে চললো, আরোহীর বিরক্ত লাগছে একা একা বসে থাকতে। বাহিরে যেতে ইচ্ছে করছে তার,কিন্তু সে চাইলেও এখন একা একা উঠে বাহিরে যেতে পারবে না।

কারণ এই নয় মাসে আরোহীর শরীীের অনেকটা পরিবর্তন এসেছে, এই তো হাত পা ফুলে আঙ্গুল ফুলে কলা গাছের মতো হয়েছে!

সাথে আগের থেকেও শরীরটা অনেকটা ভারী হয়েছে,পেটটা অনেকটা ফুলে গেছে।আরোহীর ভাষায়, মোটা হয়ে গেছে আগের থেকে দ্বিগুন আরোহী!

তাই এখন আর আরোহী কারো সাহায্য ছাড়া নড়া চড়া ও করতে পারে না আর হাঁটা তো দূরের কথা! দীর্ঘস্বাস ছেড়ে মন খারাপ করেই বসে থাকে আরোহী লিমার অপেক্ষায়।

!
!

রাত যখন নয়টা আঁধার বাসায় আসে।ক্লান্ত পায়ে যখন আঁধার রুমে ঢুকতে ঢুকতে গলার টাই ঢিলে করছিলো তখন নজর যায় বেডের দিকে!

আরোহীকে এলোমেলো ভাবে ঘুমাতে দেখে অবাক হয় না,কারণ এই নয় মাসে সে আরোহীকে নতুন নতুন ভাবে আবিষ্কার করেছে!

হাতের কোর্টটা ও অফিস ব্যাগটা সোফায় রেখে, হাত ঘড়ি খুলতে খুলতেই বিছানার দিকে এগিয়ে যায় সে! ঘড়িটা টেবিলে রেখেই আরোহীর দিকে ঝুঁকে তার কপালে দীর্ঘ সময় নিয়ে একটা চুমু দেয়!

তারপর একে একে তার দু’গালে চুমু দেয়, তারপর ধিরে ধিরে পুরো মুখেই চুমু দিয়ে এসে ঠোঁটের কাছে এসেই থেমে যায়!

পরক্ষণেই ঠোঁটেও ছোট একটা চুমু দিয়ে সরে যায় সে।অফিস থেকে এসেই তার প্রতিদিনের রুটিন এটা,তবে আরোহী আজ অব্দি বুঝতে পারেনি যে আঁধার তার ঘুমের সুযোগ নিয়ে কি কি করে!

এবার গলার টাই ও শার্টের বোতাম খুলে শার্ট ও টাই সোফায় রেখে টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায় আঁধার! তার ফ্রেশ হওয়া দরকার আগে।

ফ্রেশ হয়ে আঁধার নিচে চলে যায়,মিসেস আঁকলিমা চৌধুরী ও বাকি সবাই তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন খাবার টেবিলে। আঁধার এক পলক ঘড়ির দিকে তাকায়,দশটা বাজে।

সে এসেছিলো নয়টায় আর এ বাড়ির সকলে ঠিক সাড়ে নয়টায় ডিনার করে! তবে আজকে তার ও আদরের আসতে দেরি হওয়াতে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো, ভেবেই মনটা প্রশান্তিতে ভরে যায় তার!

একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ে সেও।

–‘আরো মা কি খেয়েছে আঁকলি?’ ও কোথায় দেখছি না যে?

আঁকলিমা চৌধুরীর উদ্দ্যেশে কথাটা বলপন তারেক চৌধুরী। আঁকলিমা চৌধুরী হেঁসে বলে উঠেন,,,,

–‘হ্যা খেতে চাচ্ছিলো না জোড় করে খাইয়ে দিয়েছি,মেয়েটা তো তোমাদের অপেক্ষায় ছিলো অনেকক্ষণ, কিন্তু তোমরা আসতে লেট করছিলে তাই খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি!’

–‘ঠিক করছো একদম!’ আর আমরা দাদুভাইরা কোথা আলিশা মা আজকে এতো চুপচাপ কেনো তারা?’ কোথায় দেখছি না যে তাদের?

শেষের কথাটা আলিশাকে উদ্দেশ্য করে বললেন তারেক চৌধুরী।

–‘ওরা ও ঘুমিয়েছে আব্বু খেয়ে!’ নাহলে শান্তি মতো খেতে দিতো নাকি তোমাদের, আশার মতোই বিচ্ছু হয়েছে ছেলে দু’টো।

আলিশা কিছু বলবে তার আগেই আদর ফট করে কথাটা বলে ফেললো।আলিশা চোখ রাঙ্গিয়ে তাকিয়ে আছে আদরের দিকে। আঁধার ফিঁক করে হেঁসে ফেলেছে।

–‘তোমার মতোই তোমার ছেলেরা বিচ্ছু হয়েছে আলিশা মার কথা কেনো বলছো তুমি কি কম জ্বালিয়েছিলে আমাদের নাকি!’

তারেক চৌধুরীর কথায় এবার আলিশা ও আঁধার একসাথে হেঁসে ফেলে। আদর মুখ গোমড়া করে বসে থাকে। আঁকলিমা চৌধুরী সকলকে ধমকে বলেন,,,,

–‘খাওয়ার সময় কোনো কথা না চুপচাপ খেয়ে নাও সকলে।’

তারপর আর তাদের কারো কোনো কথা হয় না, সকলে খেয়ে দেয়ে চুপচাপ উঠে চলে যায়।

!

!

রাতে হঠাৎ করেই আরোহীর ঘুম ভেঙে যায়, নিজেকে আঁধারের বুকে আবিষ্কার করতেই টনক নড়ে তার!ঘড়ির দিকে চোখ যেতেই তিনটা চার বাজে দেখতেই চোখ কপালে উঠে যায় তার।

তার মানে আজকে ও আঁধার কখন আসছে সে বুঝতে পারেনি,আঁধার তো তাকে ডাকতে পারতো কিন্তু ডাকে নি তো আবার মন খারাপ হয়ে যায় আরোহী! কিন্তু পরক্ষণেই কিছু একটা ভেবে আঁধারকে ডাক দেয়।

–‘এই উঠেন না, এই যে!’

ধরপড়িয়ে উঠে বসে আঁধার।

–‘ কি-কি হয়েছে আরুপাখি, কোথায় পেইন হচ্ছে?’ বেশি ব্যাথা করছে, ডাক্তারের কাছে নিতে হবে তো!’

আঁধারকে ছটফট করতে দেখে দীর্ঘস্বাস ছাড়ে আরোহী। এটা নতুন না প্রথম মাস থেকেই দেখে আসছে সে, হাসি পায় তার!

যখন প্রথম আরোহী জানতে পেরেছিলো সে প্রেগন্যান্ট তারপর একদিন হঠাৎ করেই আঁধারকে রাতে ডাকতেই এই কথাগুলো শুনে সেদিন খুব হেঁসেছিলো আরোহী।

তিন মাসেই নাকি লেবার পইন উঠে,পড়ে আঁধার ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মাথা চুলকিয়ে বলেছিলো,,,,”আমি কি জানি নাকি,ফাস্ট টাইম তাই এমন হচ্ছে এর আগে আর একটা বিয়ে করলে ভালো হতো!”

–‘কি হলো আরু,এই আরু!’

আঁধারের ডাকে হকচকিয়ে যায় আরোহী,,,,,

–‘খিদে পেয়েছে আমার!’

ঠোঁট উল্টে বলে আরোহী, আঁধার শান্ত হয়।বুকে হাত দিয়ে বলে,,,,

–‘কি খাবে বলো?’

–‘চটপটি!’

চোখ মুখ উজ্জ্বল করে বলে আরোহী। আঁধার এক পলক ঘড়ির দিকে তাকায় তারপর মুখটা ছোট করে বলে,,,,,

–‘এতো রাতে কোথায় পাবো, দোকান খোলা নেই তো।’

–‘আমি জানি না আমি চটপটি খাবো মানে খাবোই আর এখনই!’

আরোহীর জেদি কন্ঠস্বর শুনে আঁধার কিছু একটা ভেবে বলে,,,,,

–‘আচ্ছা তুমি নামবে না কিন্তু আমি নিয়ে আসতেছি কেমন!’

কথাটা বলেই আরোহীর কপালে একটা চুমু দিয়ে বের হয়ে যায় সে।

কিছুক্ষণ পর এক ঘন্টা হবে হয়তো,,,আঁধার একটা বাটিতে গরম গরম চটপটি নিয়ে চলে আসে।আরোহী ফোনে গেইম খেলছিলো আঁধারকে হাতের বাটিটা পাশেই রাখতে দেখে চোখ তুলে তাকায় সে।

গরম গরম চটপটি দেখে তার জিহ্বায় জ্বল চলে আসে,তবে অবাক হয়ে যায় সে।

–‘এতো রাতে কোথায় পেলেন?’

–‘রান্না করে নিয়ে আসলাম ম্যাডাম,এখন আমার কপালের ঘাম গুলো মুছে দেন তো!’

ক্লান্ত কন্ঠে বলে আঁধার। আরোহী অবাকের থেকে ও অবাক হয়।

–‘আপনি রান্না করলেন?’

এগিয়ে এসে আঁধারের গলা ও মুখের ঘাম ওড়না দিয়ে মুছতে মুছতে বলে আরোহী। বাটিটা হাতে নিয়ে চামুচে চটপটি উঠিয়ে ফুঁ দিয়ে আরোহীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে আঁধার,,,,,

–‘ ইউটিউব দেখে রান্না করছি, কেমন হয়েছে খেয়ে বলো তো!’

মুখে নিতেই আরোহী এক গ্লাস পানি নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে নেয়।আঁধার অবাক হয়ে বলে,,,,

–‘কি হলো ভালো হয়নি?’

আরোহী এক পলক আঁধারকে দেখে মিষ্টি হেসে বলে,,,,

–‘একটু লবণ কম হ’য়েছে তবে ঠিক আছে আমার অনেক পছন্দ হয়েছে! ‘

আরোহীর কথায় আঁধার এক চামুচ মুখে নিতেই ফেলে দেয়,,,,,,

–‘একটু লবণ কম হয়েছে বলছো আরু আমি তো লবণই দেইনি!’ এই খাবার খেতে হবে না তোমার,আমি আলাদা বানিয়ে আনছি।

–‘আরে এটা কেমন কথা আপনি এতো কষ্ট করে মাঝ রাতে আমার জন্য রান্না করলেন আর সেটা আমি খাবো না এটা হয় নাকি!’ আলাদা বানাতে হবে না আমি এটাই খাবো আপনি লবণ নিয়ে আসুন একটু যান।

আঁধার জানে তার আরু কথা শুনবে না তাই বিনা বাক্যে লবণ আনতে চলে যায়।

#চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে