#নীল_ডায়েরির_সেই_মেয়েটি
#আরদ্ধিতা_রুহি
#পর্বঃ৪৮
🍁
রাত আনুমানিক তিনটার দিকে ঘরে ঘড়ির কাটা গুনে গুনে এসে থামলো!বেলকনির রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে আরোহী, মুখে লেপ্টে রয়েছে তার তৃপ্তির হাসি।
জীবনের হিসেবের দারগড়ায় আজকে সে পরিপূর্ণ, এই যে তার ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে তার পরিবার, বাচ্চা নিয়ে সে এখন সুখেই আছে!
এই যে তার কলিজার টুকরা দুইটা আদ্র ও আয়রা তারা যেমন মা বাবা পাগল তেমনি আরোহী আঁধারো ছেলে মেয়ে পাগল। বাচ্চারা তাদের প্রাণ, আর এই প্রাণ দু’টোর ও প্রাণ তারা!
চৌধুরী পরিবারের সকলে তাদের অনেক বেশি ভালোবাসে! আর তারা ও যেনো পরিবার ছাড়া কাউকে গুরুত্ব দেয় না!
এই তো সেদিনই আলিশার সাথে রাস্তায় একটা মহিলার সামান্য একটা বিষয় নিয়ে ঝগড়া লেগেছিল, পাশেই আরোহী,আদ্র,আয়রা,তাহমিদ, তাহশিফ ও রাহি তার দুই বছরের ছোট ছেলে রাদিফকে নিয়ে দাঁড়িয়েছিল।
এক পর্যায়ে মহিলাটা রাগের মাথায় আলিশাকে সামান্য ধাক্কা মেরে ছিল।
আর বাচ্চাদের কি রাগ, আদ্র,আয়রা,তাহমিদ ও তাহশিফ মিলে মহিলাটার বাচ্চাটাকে ইচ্ছে মতো ধোলাই দিয়েছে সাথে মহিলাটার শাড়িতে তাদের হাতের আইসক্রিম ছুঁড়ে মেরেছিলো।
ঘটনাটা মনে হতেই আরোহী শব্দ করে হেঁসে উঠলো! হঠাৎ পেটে দুটি হাতের অস্তিত্ব অনুভব করতেই শিউড়ে উঠলো সে! এই স্পর্শ তার কাছে নতুন না হলেও এখনো কেঁপে উঠে সে!
আরোহী তার চুলের ভাঝে গরম নিশ্বাসের অস্তিত্ব পেতেই চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নেয়! আঁধার বাঁকা হেসে বলে উঠে,,,
–‘এতো রাতে পেত্নীদের মতো হাসছো কেনো বউ?’ যদি কোনো পেত্নীর বংশধর তোমায় তাদের সাথে নিয়ে চলে যায় তখন আমার কি হবে একবার ভেবে দেখেছো? রাত বিরাতে এভাবে হাসতে নেই ভূতেরা ও ভয় পেয়ে পালিয়ে যাবে তো।
মুহুর্তের মাঝেই আরোহীর চোখ মুখ শক্ত হয়ে যায়,কোমড় থেকে আঁধারের হাত সরানোর চেষ্টা করে!তবে আঁধার সেটা করতে দেয় না,শক্ত করে চেপে ধরে থাকে আরোহীর কোমড়।
আরোহী হতাশার নিশ্বাস ছেড়ে মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।আঁধার আরোহীকে আরও একটু কাছে টেনে কানের কাছে ফিসফিস করে বলে,,,,
–‘ এভাবে মুখ ফুলালে তোমায় কিন্তু অনেককক হ……ট লাগে বউ।’
আঁধারের কথা শুনে আরোহীর লজ্জায় কান গরম হয়ে যায়, লোকটা দিন দিন লাগাম ছাড়া হয়ে যাচ্ছে!কে বলবে এই লোকটা দুই বাচ্চার বাপ।
–‘আপনি একটা বাজে লোক, সরুন তো!’ রাত বিরাতে এসে ঢং করছেন।
নিজেকে সামলিয়ে বলে আরোহী। আঁধার বাঁকা হেসে আরোহীর ঘাড়ের এক পাশে ছোট ছোট করে দু’টো চুমু দেয়।আরোহী এবার খানিকটা কেঁপে উঠে, কাঁপা কাঁপা হাতে শক্ত করে চেপে ধরে রেলিংটা।
আঁধার আবার একই কাজ করে বসে!আরোহী ছোট আত্মাটা যেনো আবার কেঁপে উঠে।
আঁধার এবার কিছু একটা ভেবে নিজেকে সামলিয়ে নেয় আর স্বাভাবিক ভাবে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আরোহীকে।
আরোহী তখনো চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে আছে।আরোহীকে স্বাভাবিক করতে আঁধার এবার প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলে উঠে,,,
–‘দু’টো বাচ্চার মা হয়ে গেছো এখনো বাচ্চাদের মতো মুখ ফুলিয়ে থাকো,এমনি এমনি তোমায় কি আর সাধে বাচ্চা বলি বলো?’
আরোহী চোখ মুখ কুঁচকিয়ে নেয় এবার।
–‘আমি বাচ্চা নই মিষ্টার চৌধুরী,আমি বাচ্চা হলে আপনার বাচ্চাদের মা হতে পারতাম না কিন্তু!’ বাচ্চারা কখনো বাচ্চা জন্ম দিতে পারে না হু।
মুখ গোমড়া করে বলে আরোহী। আঁধার এবার শব্দ করে হেঁসে উঠে।ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে বলে,,,
–‘তাই তো,ব্যাপারটা তো আমি আগে ভাবিনি!’ কিন্তু তোমার এই টুকুনি শরীরে দু’টো বাচ্চা কিভাবে হলো বলো তো? আরে না না তুমি তো আবার বাচ্চা না বাচ্চা বউ আমার!
ঠাট্টার স্বর আঁধারের। আরোহী এবার মুখ বাকিয়ে তাকায় আঁধারের দিকে।আরোহীর রিয়াকশন দেখে আঁধার শব্দ করে আরেক দফা হেঁসে নেয়।
কিন্তু তার সাথে আরও দু’টো মানুষের হাসির স্বর শুনে চমকে উঠে দু’জনে।
আঁধার আরোহীকে ছেড়ে ঝট করে পেছনে তাকায়, তবে হঠাৎ করেই আঁধারের তাকানো চোখ দুটো বড় বড় হয়ে যায়।আরোহী নিজেও আঁধারের মতো অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায় তাদের দিকে।
আদ্র ও আয়রা তাদের ছোট ছোট দাঁতদ্বয় বের করে খিলখিলিয়ে হেঁসে চলছে তখনো।আঁধারের দৃষ্টি স্বাভাবিক হয়ে যায়, তার বাচ্চাদের এভাবে হাঁসতে দেখলে তার কলিজা ঠান্ডা হয়ে যায়।
আরোহী নিজেও মুচকি হেঁসে তাকায় তার ছোট ছোট দু’টো প্রাণের দিকে।এই তো তার দুই প্রশান্তির দু’টো রাস্তা, যেখানে দেখতে গেলে তার মন প্রাণ জুড়িয়ে যায়।
আঁধার এবার এগিয়ে গিয়ে তাদের সামনে কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়ায়,আর ভ্রু নাচিয়ে বলে উঠে,,,
–‘এই তোরা এখন এই সময় এই খানে কি করছিস রে?’
আদ্র হাসি থামিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,,,
–‘এই তোমরা এখন এই সময় এই খানে কি করছো?’
আরোহী নিজেও খিলখিলিয়ে হেঁসে উঠে, আর আয়রা তার হাসির শব্দ এবার আরও বেড়ে যায়।
আঁধারের ও হাসি পায় তবে সে না হেঁসে মুখ খানিকটা গম্ভীর করে আদ্রের মতো করেই বলে উঠে,,,,
–‘রোমান্স করছিলাম রে বাপ কিন্তু তোরা আর করতে দিলি কই,তোদের জন্য তো আমার বউ থেকেও না থাকার মতো থাকতে হয়।’
আদ্র অদ্ভুত নজরে তাকায় তার পাপার দিকে।আঁধার মায়া মায়া চোখে তাকিয়ে আছে তখনো আদ্রের দিকে,তবে আদ্র যে তার কথার মানে বুঝতে পারেনি সেটা সে ভালো করেই বুঝতে পারছে।
শয়তানি হাসি দিয়ে তাকিয়ে থাকে আদ্রের দিকে সে,আদ্র যে এবার আর তার কথায় তাকে ফাঁসাতে পারবে না সে ভেবেই মনে মনে শান্তি পাচ্ছে সে।
আয়রা একবার আদ্রের দিকে তো একবার তার পাপার দিকে তাকাচ্ছে।
আর আরোহী সে তো লজ্জায় হাসফাস করছে,আর মনে মনে আঁধারের গুষ্টি উদ্ধার করছে। লোকটা ছেলের সামনে কি সব বলছে ভাবতেই তার মেজাজ চারশো চল্লিশ ভোল্টে গরম হয়ে যাচ্ছে।
–‘রোমানস কি পাপা?’
ভ্রুকুঁচকে উল্টো তাকেই প্রশ্ন করে আদ্র।আঁধার চোখ মুখ কুঁচকিয়ে তাকায় আরোহীর দিকে।আরোহী এবার দাঁত কেলিয়ে তাকায় তার দিকে যার অর্থ,যেমন কর্ম তেমন ফল!
আদ্র এবার তার মায়ের দিকে তাকিয়ে আবার তার বাবার দিকে তাকায়।
–‘ওতা লোমাচ হবে বাইয়া!’
আয়রা খানিকটা চেঁচিয়ে বলে উঠে। আরোহী এবার ফিঁক করে হেঁসে ফেলে,আদ্র তার বোনের দিকে তাকিয়ে আবার আঁধারের উদ্দেশ্যে বলে,,,
–‘পাপা কি ওটা?’
আঁধার অসহায় চোখে তাকায় তার ছেলের দিকে,কি বলবে এখন সে! আর তার যে ছেলে উত্তর না দেওয়া অব্দি মানবে ও না।
মাথা চুলকিয়ে আঁধার এবার কিছু একটা ভেবে নেয় তারপর আদ্রকে উদ্দেশ্য করে বলে,,,
–‘তার আগে তুমি বলো এতো রাতে উঠলে কেনো?’ আর বোন কিভাবে জেগে গেলো এখন?
আদ্র আয়রার দিকে একবার তাকিয়ে বলে,,,
–‘আগে তুমি বলো!’
আঁধার হতাশ হয়, এই ছেলেটা তারই মানা যায়? বাপের কথার কোনো মূল্য দেয় না এখনেই,মায়ের মতো হয়েছে!
মাকে তো চুপ করানো যায় তবে তার ছেলেকে চুপ করাতে পারেনি এখন অব্দি আঁধার!
কপাল চাপড়িয়ে আদ্রকে কোলে তুলে নেয় এবার আঁধার!
–‘চল বাপ চল আমার গলা শুকিয়ে গেছে আগে পানি খাবো!’
আঁধারের কথা শুনে আদ্র মাথা নাড়ায়, আঁধার এবার সস্থির নিশ্বাস ছাড়ে! বড় বাঁচা বেঁচে গেছে আজকে নাহলে এ যে ছেলে তাকে প্রশ্ন করতে করতে হয়রান করিয়ে দিতো।
এইসব ভাবতে ভাবতেই আদ্রকে বিছানায় বসিয়ে দেয় সে,কিন্তু আদ্র তার মায়া মায়া কন্ঠ নিয়ে বলে উঠে,,,,
–‘পাপা!’
–‘ইয়েস মাই বয়!’
আদ্রের গালে চুমু দিয়ে বলে আঁধার।
–‘কোলে উঠবো!’
আদ্রের আবদারে আঁধারের মুখে হাসি ফুটে উঠে। আদ্রকে কোলে তুলতেই সে ও আঁধারের গালে একটা চুমু দেয়!
হেঁসে ফেলে আঁধার, তার ছেলের এই অদ্ভুত কাজগুলো তার হৃদয়ে অনেক সময় প্রশান্তি এনে দেয়।
আদ্র তার পাপাকে হাঁসতে দেখে তার পাপার মাথার কাছে পৌঁছাতে চেষ্টা করে।কিন্তু কোলে উঠলেও তার নাগালের বাহিরে সেটা! আঁধার মাথাটা কিছুটা নিচু করে নেয় আদ্রের কাছে,আদ্র মনে হয় খুশি হয়ে যায়!
সে খুশি মনে তার পাপার মাথার চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে বলে,,,
–‘সুন্দর!’
আঁধার মাথা নাড়িয়ে বলে,,,,
–‘আমার বাবা চ্যাম্প ঠিক করে দিয়েছে সুন্দর তো হবেই!’ তো চ্যাম্প এখন কি পাপার সাথে গল্প করবে নাকি ঘুমাবে?
আদ্র তার পাপার গালে হাত দিয়ে আবার বলে,,,
–‘পাপা!’
আঁধার আদ্রকে কোলে নিয়ে পানির গ্লাস থেকে পানি খেতে খেতে বলে,,,
–‘ইয়েস পাপা!’
–‘পানি খাবো?’
শান্ত কন্ঠ আদ্রের।আঁধার হেঁসে ফেলে, আদ্রের এই জিনিসগুলো তার অনেক পছন্দের।সব কাজে তার পাপাকে তার লাগবেই। আদ্রকে পানি খাইয়ে দেয় আঁধার।
আরোহী আয়রাকে কোলে নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে এতোক্ষণ বাবা ছেলের কাহিনি দেখছিলো।
আয়রার দিকে একবার তাকিয়ে দেখে সে ঘুমিয়ে গেছে এতোক্ষণে!
কিন্তু তার এই পাকা ছেলে এখনো তার পাপার সাথে কথা বলছে! এই জন্যই হয়তো বলে বাপ কা বেটা।
আরোহী আয়রাকে বিছানায় শুয়ে দেয়,আদ্র এক পলক তাকায় বোনের দিকে।
–‘এতো জলদি ঘুমিয়ে গেলো ও?’
আঁধারের প্রশ্নে আরোহী হালকা হেসে বলে,,,
–‘হ্যা, আর আপনার ছেলে সে কি এখনে ঘুমাবে নাকি তাকে বাহিরে রেখে আসবো!’
আদ্র তার মায়ের দিকে তাকিয়ে আবার তার পাপার গালে হাত বুলিয়ে বলে,,,
–‘পাপা!’
আরোহী হেঁসে ফেলে, আদ্রের এই কাজটা তার অনেক ভালোলাগে কথায় কথায় মায়া ভড়া কন্ঠে বলে”পাপা” ইসস কি মধুর ডাক!
আর যখন তাকে মাম্মাম বলে ডাকে তখন তো আরোহীর হৃদয় ছুঁয়ে যায়! মাঝে মাঝে তো তার বিশ্বাসই হয়না এই পুচকো পুচকি দু’টো তার।
–‘হুম পাপা!’
আঁধার আদ্রকে নিয়ে বিছানায় বসতে বসতে বলে। আদ্র তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,,,
–‘মাম্মাম বাহিরে রেখে আসবে?’
আঁধার আরোহী দিকে তাকিয়ে চোখ মুখ শক্ত করার চেষ্টা করে বলে,,,
–‘তোমার মাম্মাম পঁচা চ্যাম্প,আমরা তোমার মাম্মামকে বাহিরে রেখে আসবো কেমন!’
আরোহী চোখ পাকিয়ে তাকায় আঁধারের দিকে।আদ্র হেঁসে উঠে। আঁধার আরোহীর দিকে একবার তাকিয়ে আদ্রকে বুকের উপর নিয়ে শুয়ে পড়ে।আদ্র তার পাপার বুকে চুপটি করে শুয়ে আঁকিবুঁকি করতে চেষ্টা করে।
#চলবে?