#নীল_ডায়েরির_সেই_মেয়েটি
#আরদ্ধিতা_রুহি
#পর্বঃ২০
🍁
মাথায় কারো হাতের ছোয়া পেতেই আদরের ঘুম ভেঙ্গে যায়! পিটপিট করে চোখ খুলে তাকায় কিন্তু চোখ খুলতেই এক লাফে বিছানা থেকে নেমে যায়।তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে হয়তো এতো বড় একটা শক সে নিতে পারেনি, সেটাও আবার ঘুম এই ঘুম ঘুম চোখে। আর রমনীটি নিজেও ঝট করে উঠে দাঁড়িয়েছে, আদরকে এভাবে ভুত দেখার মতো চমকে যেতে দেখে সে নিজেও অনেকটা ভয় পেয়ে গেছে!আদর কয়েকবার চোখ পিটপিট করে তাকায় কিন্তু না সে ভুল দেখছে না! এরইমধ্যে আলিশা আদরের কাছে গিয়ে বলে,,,
–‘কি হলো, তুমি এমন ভয় পেলে কেনো?’
–‘না -মানে -আমি -মানে -আসলে!’
–‘কি মানে মানে করছো, দেখেছো ভয় পেয়ে ঘেমে গেছো তো!’
আদরকে আমতা আমতা করতে দেখে আলিশা এগিয়ে গিয়ে নিজের ওরনা দিয়ে আদরের গলার কাছের ঘামগুলো মুছতে মুছতে বলে। কিন্তু আদর আবার এক লাফে পিছনে চলে যায়। আসলে তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে সব, কি হচ্ছে তার সাথে স্বপ্ন দেখছি না আমি!’ নাকি এটা কোনো ভুত জ্বীন ঢোক গিলে মনে মনে বলে আদর।
–‘আর হলোটা কি,এরকম করছো কেনো?’
বিরক্ত হয়ে বলে আলিশা।
–‘তুমি কি আসলেই আশা!’
ঢোক গিলে বলে আদর।
আলিশা বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,,,
–‘সকাল সকাল নাটক করবে না তো, যাও ফ্রেস হয়ে এসো দরকার আছে!’
আলিশার গলায় আগের মতো তেজ শুনে আদর এবার স্বাভাবিক হয়! এইটায় তো তার বউ আশা তবে একটু আগে এতো সুন্দর ব্যাবহার করার মানে কি। প্রশ্নটা করবে না করবে করে ও করেই ফেলে প্রশ্নটা।
–‘একটু আগে তুমি এতো সুন্দর ব্যাবহার করলে কেনো?’
আলিশা হতাশ হয়,
–‘তুমি না কালকে বললে তুমি স্বাভাবিক সম্পর্ক চাও!’ আমি ও চাই আদর, তোমার আদর্শ স্ত্রী হওয়ার চেষ্টা করতে চাই, তোমার সাথে মেনে নিয়ে সম্পর্কটাকে এগিয়ে নিতে চাই আদর, তুমি কি আমায় একটা সুযোগ দিবে না বলো? আমি হাঁপিয়ে গেছি আদর আর পারছি না, তোমায় আর আমাদের বাচ্চাটাকে নিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে চাই আদর।
মাথা নিচু করে কথাগুলো বলে আলিশা। কথাগুলো শুনে আদরের মুখে হাসি ফুটে উঠে, হাসিমুখে এগিয়ে এসে আলিশার থুতনিতে হাত দিয়ে মাথাটা উঁচু করে বলে,,
–‘আমি কিন্তু রোজ তোমায় দিয়ে হাত পাঁ টেঁপাবো, রাজি থাকলে বলো?’
বলেই চোখ টিপ দেয়। আলিশা শব্দ করে হেঁসে উঠে মাথা নারিয়ে আদরকে জড়িয়ে ধরে। আদর ও হেসে একটা হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে,,
–‘এই ছাড়ো, এখনই তুমি আমার সুযোগ নিচ্ছো ছি ছি আমি একটা অবলা পুরুষ।’
আদরের কথা শুনে আলিশা একটা ধাক্কা দেয় আদরকে কিন্তু আদর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে।আলিশাও শক্ত করে ধরে। আদর বলে,,,
–‘আশা তুমি তো আমায় জিজ্ঞেস করলে না এতো সহজে আমি তোমায় মাফ করলাম কেনো?’ আর সবকিছু স্বাভাবিক করতে চাই কেনো?
আদরের কথা শুনে আলিশা চোখ তুলে আদরের দিকে তাকায় আর মনে মনে ভাবে,, আসলেই তো আমি তো এটা ভাবিনি! তবে কি আদর আমার সাথে নাটক করছে, প্রতিশোধ নিচ্ছে!
আলিশাকে চোখ মুখ অন্ধকার করে কিছু ভাবতে দেখে শব্দ করে হেসে উঠে আদর। আলিশা ভাবনা থেকে বের হয়ে এসে আদরকে দেখতে থাকে। আদর নিজের হাসি কন্ট্রোল করে বিছানায় বসে পড়ে আর আলিশাকে একটানে নিয়ে এসে কোলের মধ্যে বসিয়ে বলে,,
–‘রিল্যাক্স, তুমি তো দেখছি সিরিয়াস হয়ে গেছো!’ আমিও একটু সুখে থাকতে চাই আশা, আরো তো ভাইয়ের সাথে সুখেই আছে তাই না? আমার কি তাহলে সুখে থাকার অধিকার নেই বলো? আজকে থেকে সব বাদ শুধু তুমি, আর তুমি শুধু দিন রাত সবসময় আদর আদরই করবে বুঝলে।
আদর কথাগুলো শেষ করেই আলিশাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়, তারপর আলতো হাতে আলিশাকে সরিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়।আলিশার মুখে আজকে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠে, মানুষ মাত্রই তো ভুল! আর যারা ভুল করার পর শুধরে নিয়ে আবার ভালোবাসতে পারে তারা কখনে ছেড়ে যায় না।এতোদিন যা হয়েছে সব বাদ এখন থেকে আদরের কথা মতো সে সবসময়ই আদর আদর করবে।
এরইমধ্যে ওয়াশরুম থেকে আদরের গলার স্বর ভেসে আসে, হাসে আলিশা ছেলেটা আসলেই পাগল। তবে রিলেশন চলাকালীন কখনো আদরকে এরকমটা দেখে নি। আদর যে অনেকটাই ফাজিল সেটা আজকেই বুঝতে পারলো আলিশা।
–‘আশা! ‘
আবার আদরের গলার স্বর শুনে হকচকিয়ে যায় আলিশা, নিজেও আদরের মতো চেঁচিয়ে বলে,,
–‘হ্যা বের করছি তুমি আগে বের হবে তো নাকি!’
ওপাশ থেকে আর আদর কিছু বলে না। আলিশা ও চুপচাপ আলমারি থেকে আদরের জন্য সুন্দর একটা কালো শার্ট বের করে, আজকে ভার্সিটিতে যাবে জনাব, ওই জন্য চেঁচিয়ে শার্ট বের করতে বললো।আলিশার অবশ্য ভালোই লাগলো নিজেকে আদরের বউ বউ মনে হচ্ছে! আদরের প্রয়োজনীয় সবকিছু রেডি করে, নিজের জন্য একটা কালো থ্রিপিস বের করে রাখে। সে ও আজকে আদরের সাথে ভার্সিটিতে যাবে ভেবেছে!আদর ওয়াশরুম থেকে বের হতেই আলিশাকে ছটফট করে কাজ করতে দেখে হাসে। আজকে নিজেকে তার বিবাহিত বলে মনে হচ্ছে। এইতো সকালে কতো ভয়ংকর ভাবে তাকে জাগিয়ে তুলতো এখন আবার সবকিছু রেডি করছে ছটফট করতে করতেই৷ আলিশার চোখ আদরের দিকে পড়তেই বলে উঠে,,,
–‘আঁধার ভাইয়া তোমাকে নিয়ে ছাদে যেতে বলেছে আগে দেখা করে এসে!’
আলিশার মুখে আঁধারকে ভাইয়া বলতে শুনে আদর অবাক হয়, পরক্ষণেই আবার সবকিছু মেনে নিতে চেষ্টা করছে আলিশা সেটা ভেবেই মুচকি হেসে বলে,,
–‘চলে!’
–‘তুমি যাও আমি কফি নিয়ে যাচ্ছি!’
আলিশার কথা শুনে হেসে মাথা নাড়িয়ে চলে যায় আদর।আলিশাও নিচে চলে যায় কফি আনতে।
আরোহী আর আঁধারকে একসাথে দেখে হেসে বলেন মিসেস আঁকলিমা চৌধুরী,,
–‘তোরা একসাথে তার মানে সব রান্না কি তোরাই করেছিস নাকি আরো মা একাই করেছে?’
আঁকলিমা চৌধুরীর কথায় আঁধার ও আরোহী ভ্রুকুঁচকায়।কিন্তু আলিশার কথা মনে হতে দু’জনে দুজনের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলে,,,
–‘ওইটা তো তোমার বউমা করেছে!’
–‘বউ মা মানেই তো আরো নিজেই, এতোকিছু তুই একাই কেনো করতে গেলি মা!’ আমায় ডাকতে পারিসনি?
–‘উফফ আম্মু, নিচে চলো আগে তারপর দেখবে কে করেছে!’
মিসেস আঁকলিমা চৌধুরীর গলা জড়িয়ে ধরে বলে আরোহী। আঁধার ও হেসে বলে,,,
–‘ যাও তোমরা আর হ্যা ছাদে যাচ্ছি কফি দিয়ে আসো ২ কাপ।’
আরোহী মাথা নাড়ায় । মুহুর্তের মধ্যেই মিসেস আঁকলিমা চৌধুরীকে নিয়ে নিচে চলে আসে সে।আর মিসেস আঁকলিমা চৌধুরী কিছুই বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে?
কিচেনের সামনে এসে আরোহী মিসেস আঁকলিমা চৌধুরীকে আঙ্গুল দিয়ে সামনের দিকে দেখিয়ে দেয়। আঁকলিমা চৌধুরী ভুত দেখার মতো চমকে যায় আলিশাকে খাবার সার্ফ করতে দেখে। তিনি আলিশার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আরোহীর দিকে তাকায়।
আরোহী চোখ দিয়ে ইশারায় বুঝায় আজকের সবকিছু আপুই করেছে৷ আঁকলিমা চৌধুরী সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আলিশার দিকে! আরোহী বুঝতে পারে কিন্তু কিছু বলতে পারে না, কি বলবে আলিশা যা করেছে আগে তাতে সবারই সন্দেহ করাটা জায়েজ! আরোহী নিজেও তো প্রথমে সন্দেহ করেছিলো কিন্তু আঁধার সবকিছু স্বাভাবিক ভাবে নিয়েছে এমনকি বিনা সংকোচে আলিশাকে মাফ ও করে দিয়েছে!
আলিশা মিসেস আঁকলিমা চৌধুরীকে দেখতে পেয়েই মাথা নিচু করে নেয়, কি বলবে সে! এই লোকগুলোকে সে কতোটা কষ্ট দিয়েছে, কোন মুখে সামনে তাকাবে সে। আলিশাকে মাথা নিচু করতে দেখে আঁকলিমা চৌধুরী ও কিছু বলেন না গটগট পাঁয়ে উপরে চলে যান আবার।
আরোহী এগিয়ে এসে আলিশার কাঁধে হাত রাখে আলিশা অসহায় চোখে তাকায় আরোহীর দিকে! আরোহী হেসে বলে,,,
–‘সব ঠিক হয়ে যাবে আপু তুই চিন্তা করিস না, এখন চল আঁধার কফি নিয়ে যেতে বলেছে!’
আরোহীর কথা শুনে আলিশা বলে,,,
–‘এই রে আমি তো ভুলেই গেছিলাম, দাঁড়া আমি কফি ঢেলে নেই!’
আদর ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ, আঁধারের আসার অপেক্ষা করছে সে! কিনা আঁধার যে প্রায় অনেকক্ষণ যাবত তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে সেটা তার অজানা! কাঁধে কারো হাতের অস্তিত্ব পেতেই মুচকি হেসে বলে,,,
–‘ভাই তুমি না টাইম পাংচুয়াল, আজকে ২০ মিনিট লেট করে এসেছো!’
–‘আর তুই যে লেট লতিফ, আজকে ২০ মিনিট আগেই চলে এসেছিস বাহ!’
–‘তোমার মতো হওয়ার চেষ্টা করছি তো তাই! ‘
বলেই আঁধারকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে।
–‘এ কি রে তুই কাঁদছিস, ছ্যাহ্ ছেলে মানুষ আবার কাঁদে!’
মন খারাপ হলেও মজার ছলে কথাটি বলে আঁধার। কিন্তু আদর আর কিছু বলে না আগের মতো ঝগড়াও করে না! আঁধার এবার আদরের মাথাটা তুলে চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলে,,,
–‘তুই দেখছি মেয়ে মানুষকেও ফেল করিয়ে দিবি,আরে মেয়েরা ও তো এভাবে কাঁদে না পাগল!’
–‘আই এ্যাম সরি ভাই,আমি আসলে…’
আদরকে বাকি কথা শেষ করতে দেয় না আঁধার তার আগেই বলে উঠে,,,
–‘কোনো পুরোনো কথা না আর সব ভুলে যা আমি ও ভুলে গেছি, নতুন করে সবকিছু শুরু কর! ‘ আলিশা কিন্তু ভালো মেয়ে পরিস্থিতির কারণে হয়তো এমনটা হয়ে গেছিলো।
আলিশা আর আরোহী ছাদের দরজার কাছেই কথাটা শুনে দাঁড়িয়ে যায়।আলিশা আরোহীর দিকে ঘোলাটে চোখে তাকায়। আরোহী মুচকি হেসে বলে,,,
–‘মন খারাপ করো না তো এখন আর কষ্ট পাবে না,কষ্ট পাওয়ার দিন শেষ আমাদের। ‘
আলিশা মাথা নাড়িয়ে বলে,,,
–‘আঁধার এতো ভালো কেনো বল তো আমি ওর সাথে তোর সাথে কতো কি করলাম কিন্তু তবুও আমায় ভালো বলছে সে!’
–‘উনি অনেক ভালো মনের মানুষ আপু! ‘
আঁধারের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে আরোহী। আলিশা আরোহীর মুগ্ধ দৃষ্টির মানে বুঝতে পারে কিন্তু এবার আর তার হিংসে হয় না। খুশি মনে সবটা মেনে নেয় সে, আর আদরের দিকে তাকিয়ে থাকে সে।
–‘তুমি বেস্ট জানো ভাই?’ তুমি আসলেই বেস্ট।
আঁধারকে আবার জড়িয়ে ধরে বলে আদর। আঁধার আদরের পিঠে একটা চাপড় মেরে বলে,,,
–‘ছেহ্ সর মেয়ে মানুষের মতে খালি কথায় কথায় গায়ে পড়ছিস কেনো?’ সর সর আমার বউ দেখলে আমাকে সন্দেহ করবে সর।
আঁধারের কথা শুনে আদর আর একটু আঁধারের কাছে গিয়ে বলে,,,
–‘ তোমায় না একটা চুমু খেতে মন চাচ্ছে খাই!’
আদরের কথা শুনে আঁধার এক লাফে দূরে গিয়ে বলে,,,
–‘তুই কি আমায় আলিশা ভাবছিস নাকি?’ ছেহ্ দিন দিন তোর হাব ভাব কিন্তু ওদের মতো হয়ে যাচ্ছে?
–‘কাদের মতো?’
প্রশ্নটা শুনে আঁধার ও আদর উভয়ই পেছনে তাকায়। প্রশ্নটা আরোহী মুখ ফসকে করে ফেলেছে। আর আলিশা তো এদের দুই ভাইয়ের কান্ড দেখে শুরু থেকেই হাসছে।
আরোহীর কথা শুনে আদর এবার ফিক করে হেসে দিয়ে আঁধারের উদ্দেশ্যে বলে,,,
–‘বলো বলো ভাই ওরাটা কারাাাা?’ আরে আরো জিজ্ঞেস করো তোমার বরকে।
আরোহী আদরকে এমন স্বভাবিক হতে দেখে অবাক হয়ে যায়, তবে তার অস্বস্তি ও হয় কিন্তু সবকিছু স্বাভাবিক রাখতে চেষ্টা করে সে। এরইমধ্যে আঁধার ধুম করে আদরের পিঠে একটা কিল বসিয়ে দিয়ে বলে,,,
–‘ওরা হচ্ছে কারা জানো আরু, এই যে আদরের মতো যারা কথায় কথায় ছেলেদের গায়ে পড়ে!’
আদর রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আঁধারের চুল ধরে টান দেয়, আর আঁধার ও যেনো সুযোগ পেয়ে যায়। টানাটানি করতে করতে ছুটাছুটি শুরু করে। পুরো ছাদে ছুটাছুটি করে না পেরে ছুটাছুটি করতে করতে দুই ভাইয়ে নিচে চলে যায়।আরোহী ভ্রুকুঁচকে তাকিয়ে আছে, ওরাটা কে সে এখন ও বুঝতে পারেনি কিন্তু আলিশা ওদের কান্ড দেখে হাসতে হাসতে পড়ে যাচ্ছে।
এই দুই ভাইয়ের এই রুপ তাদের কাছে অজানা ছিলো এতোদিন। আজকে ধিরে ধিরে সবকিছু প্রকাশ পাচ্ছে। সব সম্পর্কটা ঠিক হচ্ছে।
#চলবে?