#নীল_ডায়েরির_সেই_মেয়েটি
#আরদ্ধিতা_রুহি
#পর্বঃ১০
🍁
চেঞ্জ করতে গিয়ে আরোহীর মনে হয় তার গোসল করলেই ভালো হবে, তাই একেবারে গোসল করেই বের হয় সে।
বের হয়ে আসে পাশে আঁধারকে না দেখেই বুঝতে পারে হয়তো বেলকনিতে আছে, তাই চুপচাপ সেও বেলকনিতে চলে যায়।
আঁধার একটা চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে চুপচাপ বসে আছে! আরোহী আঁধারকে কি বলবে, কি বলে ডাকবে কিছুই বুঝতে পারছে না।এরইমধ্যে ধপ করে চোখ খুলে আঁধার! আরোহী হকচকিয়ে যায়,
কিন্তু আঁধার আরোহী দেখে ও না দেখার ভান করে উঠে ঘরে চলে যায়,আঁধারের পেছন পেছন আরোহী নিজেও চলে আসে। আঁধারকে টাওয়াল হাতে নিতে দেখে আরোহী ভ্রুকুঁচকে তাকায় আর ভাবে,,
–‘উনি না একটু আগেই ভার্সিটি থেকে আসে গোসল করলো, আবার গোসল করবেন নাকি?’
আরোহীর ভাবনার মধ্যেই আঁধার আরোহীকে টেনে বিছানায় তার উল্টো দিক করে বসায়।আরোহী এবার অবাক হয়ে যায়! আঁধার আসলে কি করতে চাচ্ছে সেটা বুঝতে চেষ্টা করে,এরইমধ্যে নিজের চুলে কারো হাতের অস্তিত্ব পেতেই চমকে যায় আরোহী।
কিন্তু আঁধার তাকে অবাক করে দিয়ে চুপচাপ টাওয়াল দিয়ে তার দীর্ঘ লম্বা চুলগুলো মুছতে শুরু করে।আরোহীর কাছে এবার সবটা পরিস্কার হয়! মুচকি হেসে চুপ করে বসে থাকে সে।
অনেক সময় পর আঁধার নিজের কাজ শেষ করেই আরোহীকে বলে,,
–‘নিচে চলো আম্মু ডেকে গেছেন আসে।’
বলেই আঁধার চলে যেতে নেয় কিন্তু আরোহী আঁধারের হাত টেনে ধরে বলে,,
–‘আপনি আগে আগে যাচ্ছেন কেনো,একসাথে যেতে বলেছে তো আমাদের!’
আরোহীর কথা শুনে আঁধারের মধ্যে কোনো ভাবাবেগে লক্ষ করা গেলো না সে যেনো শুনতেই পায়নি এমন ভাব করে আরোহীর হাত ধরে নিচে নামতে শুরু করে।
নিচে নামতেই ডাইনিং টেবিলে সবাইকে বসে থাকা দেখেই আঁধারের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে তারা তাদের অপেক্ষায় করছিলো।আদর ও আলিশাকে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আরোহীর অসস্তি হওয়া শুরু হয়, কিন্তু আঁধার তখনও তার হাত ধরেই আছে।
–‘এ কি ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো তোরা? ‘
আঁকলিমা চৌধুরীর কথা শুনে আরোহীর হাত ছেড়ে দেয় আঁধার। আরোহী গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যায় ডাইনিং এর দিকে।একটা চেয়ার টেনে আরোহীকে বসিয়ে দেয় তারেক চৌধুরী! আলিশা এসব দেখে ভ্রুকুঁচকে নেয়।
আরোহীর ডান পাশের চেয়ারেই আঁধার বসে পড়ে কারণ বাম পাশের চেয়ারে আলিশা বসে আছে।কখন কি করবে বা বলবে তার ঠিক নেই।
আঁধার নিজের প্লেটে ভাত বেরে আরোহীর প্লেটেও বেরে দেয়। আলিশা এসব দেখে রাগে ফুঁসে ওঠে। কিন্তু আদর সে মাথা নিচু করে খাওয়া শুরু করে দেয়,কি দরকার চোখ তুলে তাকিয়ে নিজের প্রিয় মানুষটাকে অন্যের সাথে দেখার। কিন্তু মন তো আর মানে না তাই না চাইতেও চোখ তুলে তাকায়।
তাকাতেই দেখে আরোহী আঁধারের দিকে চেয়ে আছে, আদরের কষ্টে বুকটা ফেঁটে যায়।তাই অল্প একটু খেয়েই তার খাওয়া হয়েছে বলে চলে যায়।তারেক চৌধুরী ও আঁকলিমা চৌধুরী ছেলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে! তারা ঠিকই বুঝতে পেরেছে কেনো আদর উঠে চলে গেলো,হাজার হোক তারা তো মা বাবা সন্তানের মুখ দেখেই কষ্টের কথা বলে দিতে পারে তারা।আঁধার নিজেও একপলক আদরের যাওয়ার দিকে তাকায়।
আঁধারের কখনো কখনো মনে হয় তার এই ছোট ভাইটি আরোহী নামক রমনীটিকে অনেক ভালোবাসে, কিন্তু নিজেরই কিছু ভুলের কারণে হারিয়ে ফেলেছে সে। আবার কখনো কখনো মনে হয় সে তো প্রতারক, আরোহীর সাথে ও তার সাথে প্রতারণা করেছে। কিন্তু আসলেই কি তাই!
আঁধার মনে মনে বলে,,উহু অবশ্যই তাই নয়, তবে আরোহী তার বউ শুধু মাত্র তারই।
খাওয়া দাওয়া শেষ হওয়ার পর যে যার রুমে বিশ্রামের জন্য চলে যায়। আরোহী ও আঁধার তাদের রুমে আসে বিশ্রামের জন্য। আরোহী বিছানায় বসে পড়ে আর আঁধার সোফায়। আরোহী আঁধারের রুমে বসে খুঁটিয়ে খাঁটিয়ে তার রুমটি পর্যবেক্ষণ করছে। রুমটি প্রায় অনেকটাই বড় কিন্তু পুরে রুম জুড়ে সাদা আর সাদা দিয়ে ভর্তি।রুমের রং থেকে শুরু করে জালানার পর্দা পর্যন্ত সবকিছু সাদা দিয়ে ভরা ভরা।
আরোহীর মনে ঝট করে একটা প্রশ্ন উদয় হয়,,আচ্ছা এই লোক কি নিজে সাদা বলে তার সবকিছু সাদা সাদা নাকি!
হতেই পারে, জিজ্ঞেস করে দেখবো নাকি?না না থাক পড়ে যদি আবার কিছু বলে!
আঁধার আরোহীকে বেশ অনেকক্ষণ যাবত লক্ষ করছে, আরোহীকে নিজে নিজেই বিরবির করে কিছু বলতে দেখে ভ্রুকুঁচকে তাকায় তার দিকে।
প্রায় অনেকক্ষণ যাবত আরোহীর দিকে তাকিয়ে থাকে আঁধার। মূলত আঁধার আরোহীর ঠোঁটের দিকেই তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করছে আরোহী আসলে কি বিরবির করছে।
–‘ ডোন্ট ওয়ারি সুইটহার্ট আমাদের বেবি ও সাদা সাদাই হবে!’
মুখ চেপে হেসে বলে আঁধার।
আরোহী হতবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলে উঠে,,
–‘এই আপনি আমার কথা শুনলেন কিভাবে?’ আমার কথাতো আমি নিজেই শুনতে পারছি না।
–‘ইট’স সিক্রেট মিসেস চৌধুরী!’
বাঁকা হেসে বলে আঁধার।
আরোহী চোখ ছোট ছোট করে আঁধারের দিকে তাকায়।
–‘আজকে কি আমাকে একটু বেশি সুন্দর লাগছে নাকি?’ সকাল থেকেই দেখছি কেউ একজন হাঁ করে তাকিয়ে আছে।
আরোহীর তাকানোর স্টাইল দেখে আঁধার বলে।
আরোহী উত্তর দেয় না কিন্তু আগের মতো আর তাকায় না মুখ ভেংচি দিয়ে অন্যদিকে তাকায়।
আরোহীর মুখ ভেংচি দেওয়া দেখে আঁধার চোখ মুখ কুঁচকে তাকায় আরোহীর দিকে,যার অর্থ তার সেটা পছন্দ হয়নি!
ফোন বেঁজে উঠায় আরোহীকে আর কিছু বলে না, কিন্তু ফোনের দিকে তাকিয়ে মনে হয় থমকে যায়।
–‘আপনার ফোনটা তো অনেকক্ষণ থেকে বাঁজছে রিসিভ করছেন না কেনো?’
আঁধারকে ফোনের এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে আরোহী। আরোহীর কথায় আঁধার কিছু না বলেই ফোন নিয়ে বাহিরে চলে যায়।
আরোহী হাবলার মতো তাকিয়ে থাকে আঁধারের যাওয়ার দিকে।
আঁধার যাওয়ার পর পরই আলিশা আঁধারের ঘরে আরোহীর কাছে আসে, সে এতোক্ষণ আরোহীকে কখন একা পায় সেটারই অপেক্ষা করছিলো।
–‘বাহ আরো,আসতে না আসেই বরের সাথে রোমান্স করা শুরু করে দিয়েছিস?’ মানতে হবে তোকে, নাহলে আসেই কেউ বরের সাথে এসব করে। বলি তোর লজ্জা করে না?
কারো খোঁচা মারা কথা শুনে চোখ মেলে তাকিয়ে আলিশাকে দেখতে পায় আরোহী। ভাবনার মধ্যে যদিও সব কথা স্পষ্ট শুনতে পায়নি তবে লজ্জা করার কথাটা ঠিকই তার কানে এসেছে।
ভ্রুকুঁচকে আলিশার কথার মানে বুঝার চেষ্টা করে আরোহী। কিন্তু আলিশা ততোক্ষণে আরোহীর কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে।
–‘কিসের লজ্জা করার কথা বলছিস তুই আমায়?’
শান্তস্বরে জিজ্ঞেস করে আরোহী।
এতে যেনো আলিশা আরও তেঁতে উঠে।
–‘ছি ছি তুই এখন ও বুঝতে পারছিস না বুঝি,বুঝবি কেমনে তুই তো বরের সাথে কখন রোমান্স করা যায় সেটাই বুঝবি!’
আলিশার কথায় আরোহীর গাঁ জ্বলে গেলেও নিজেকে সামলিয়ে নেয়।
–‘৫০ বছর আগের গ্রামের শাশুড়ীদের মতো না করে যা বলার সরাসরি বল!’
–‘এসব কি, ভেঁজা চুল এসবের মানে বুঝিনা আমি মনে করেছিস?’
আরোহীর চুলে সামান্য টান দিয়ে বলে আলিশা।
–‘না বুঝার কি আছে, গোসল করলে মানুষের চুল ভেজায় তো থাকবে এমন ভাবে বলছিস মনে হয় তুই কেবল পৃথিবীতে ল্যান্ড করলি!’
আরোহীর কাঠকাঠ জবাবে আলিশা আরোহীর হাত পেছন দিক দিয়ে মুচড়ে ধরে বলে,,
–‘আমায় শেখাতে আসবি না একদম,এতো শরীরের জ্বালা তোর আসেই শুরু করে দিয়েছিস।’ এতো তাড়াতাড়ি আদরকে ভুলে আঁধারকে আপন করে নিলি বাহ..
আলিশা আর কিছু বলার আগেই ঝট করে আলিশার থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে, ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়! আলিশাকে আরোহী।
কিন্তু আরোহীর রাগ মনে হয় কমে না তাই কোন কিছু না ভেবেই আলিশাকে ঠাঁটিয়ে একটা চড় লাগিয়ে দেয়। এতেও যেনো আরোহীর রাগ কমে না, আলিশার চুলের পেছনে হাত ঢুকিয়ে চেপে ধরে বলে,,
–‘তোর মতো নোংরা মনে করবি না আমাকে যে একবার এর সাথে তো একবার ওর সাথে।’ আর কি যেনো বললি লজ্জা, লজ্জা তো তোর করা উচিত! এতো বড় বড় কথা তোর মুখ দিয়ে বের হয় কিভাবে বল তো, যেখানে বিয়ের আগেই পেটে বাচ্চা নিয়ে ঘুরছিস! আর কি যেনো বললি রোমান্সের কথা, আমার বর আমি রোমান্স করি বা যা ইচ্ছে করও তুই বলার কে রে,তোর পারমিশন নিয়ে আমায় রোমান্স করতে হবে।
আরোহীর কথাগুলো শুনে আলিশা চিৎকার করে বলে উঠে,,
–‘আরো তুই ভুল করছিস, তোর এতো বড় সাহস আমার গায়ে হাত তুলিস আবার আমার চুল টেনে ধরেছিস! বড় বোন হই আমি তোর, এর জন্য অনেক সাফার করতে হবে তোকে অনেক..
আলিশার কথা শেষ হওয়ার আগেই আরোহী তার থেকে দ্বিগুন চেঁচিয়ে বলে,,
–‘বোন কিসের বোন তুই আমার,তোর মতো নোংরা মন মানুষিকতা মানুষ কখন ও আমার বোন হতে পারে না, আর কি বললি সাফার করতে হবে,,হাহ্ সাফার কাকে করতে হয় সেটা তো তোকে বুঝাবো আমি।’ ভেবেছিলাম তোকে আর কিছু বলবো না খারাপ ব্যাবহার ও করবো না বাট তুই সেটার যোগ্য না।আমার স্বামীর থেকে দূরে থাকবি তুই, নাহলে তোকে খুন করতে ও আমার হাত কাঁপবে না।আর রইলো বড় এর কথা, মনে রাখিস আমি তোর বড় জ্বা হই।
কথাগুলো বলেই ধাক্কা দিয়ে আলিশাকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। আলিশা রাগে ক্রোধে ফেঁটে পড়ছে। আরোহীকে শিক্ষা দেওয়া যায় কিভাবে সেসব ভাবতে ভাবতেই চলে যায় আলিশা।
ততোক্ষণে আড়াল থেকে দুজন মানুষও বের হয়ে আসে, তারা আলিশা আশা থেকেই সবটা দেখছিলো কিন্তু আরোহী কি করে দেখার জন্য এগিয়ে যায় নি।
–‘তবে যাই বলো আরোহী মামনীকে আমরা যততা শান্ত ও সহজ সরল ভাবি আসলে সে ততোটাও শান্ত নয় কিন্তু। ‘
তারেক চৌধুরীর কথায় আঁকলিমা চৌধুরী বলেন,,
–‘এইরকম একটা মেয়েরই দরকার আমার, এখন আমরা মা মেয়ে মিলে ওই আলিশাকে শিক্ষা দিব বুঝলে?’ তুমি আজই আমজাদ ভাইজানকে ফোন করে বলো যে আরোহী মামনি কয়েকদিন থাকবে এই বাড়িতে?
–‘আমজাদ কি রাজি হবে বলো তো, সে তো ১ বছর আগে আরোহীকে এ বাড়ি আনতেই বারন করেছিলো।’
আঁকলিমা চৌধুরীর কথায় বলেন তারেক চৌধুরী।
আঁকলিমা চৌধুরী কিছু একটা ভাবেন তারপর তারেক চৌধুরীর উদ্দেশ্যে বলেন,,
–‘রাজি হবেন চলো তো তুমি ফোন করো আমি কথা বলবো ওনার সাথে।’
–‘আচ্ছা চলো!’
বলেই আঁকলিমা চৌধুরীকে নিয়ে যান তারেক চৌধুরী।
আর এদিকে আরোহী দরজা বন্ধ করে অঝোর ধারায় কাঁদতে শুরু করে।
যতোই হোক আলিশা তার বড় বোন, নিজের বড় বোনের থেকে এসব কিছু কে আশা করে, কিন্তু আরোহীর ভাগ্যে হয়তো এসব ছাড়া আর কিছুই নেই। ভেবেই আবার কান্নায় ভেঙে পড়ে আরোহী।
#চলবে?