নীল জোছনায় ভাসি পর্ব-১৪ এবং শেষ পর্ব

0
3409

#নীল_জোছনায়_ভাসি (১৪/শেষ পর্ব)
#লেখা: ইফরাত মিলি
___________________

বিয়ের সাতাশ তম দিন। সন্ধ্যার পর গিয়েছিলাম স্বামীর সাথে শপিং করতে। সে-ই নিয়ে গিয়েছিল। নিজের পছন্দ অনুযায়ী চারটা থ্রিপিস কিনে দিয়েছে। আমাকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে সে চলে গেছে, বাড়ির ভিতরে আসেনি। আমিও খুব আন্তরিকহীন, একবারও তাকে বাড়ির ভিতরে আসার জন্য বললাম না।
ঘরে এসে দরজা খোলা পেলাম। বাবা এখন প্রায়ই দরজা খুলে রাখে। যাই হোক আজ বাবাকে দরজা খুলে রাখা প্রসঙ্গে কিছুই বললাম না। টেবিলের উপর খাবারের প্যাকেটগুলো রাখলাম। আনাম ভাইয়ার সাথে রেস্টুরেন্টে খেয়েছিলাম। বাবার জন্যও খাবার নিয়ে এসেছি।

রুমে গিয়ে ফ্রেশ হলাম। ঘরের ভিতর বাবার কোনো সাড়াশব্দই নেই। আমি বসার ঘরে বসে বার কয়েক ডাকলাম। কিন্তু কোনো সাড়া পেলাম না। এবার তার রুমে গিয়ে দেখতে হলো। বাবা রুমেও নেই। কী সাংঘাতিক! দরজা খোলা রেখে সে কোথায় চলে গিয়েছে?
আমি ছাদে এলাম বাবার সন্ধানে। বাবা যেমন এখন প্রায়ই দরজা খোলা রাখে, তেমনি প্রায়ই ছাদেও আসে। আমার ছাদে আসা বৃথা গেল না। বাবা মাদুর পেতে ছাদে বসে আছে। আমি ডাকলাম,
“বাবা!”

বাবা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো,
“সেতু, এদিকে আয়। বস।”

আমি বাবার পাশে বসলাম। বাবার দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখলাম বাবা চাঁদের দিকে চেয়ে আছে। আমার মনে হলো বাবার পাশে এই মুহূর্তে আমি না থেকে একজন নতুন মা থাকলে ভালো হতো। কিন্তু বাবার এত এত শর্ত সাপেক্ষে পাত্রী খুঁজে পাওয়াই তো দুষ্কর।
বাবা হঠাৎ বললো,
“হেমায়েত ভাই মারা গেছে শুনেছিস?”

হেমায়েত চাচা আমাদের পাশের বাড়িতে থাকতো। ওনার মারা যাওয়ার পাঁচ দিন হয়ে গেছে। বাবা হঠাৎ হেমায়েত চাচার কথা তুলছে কেন? বললাম,
“সে তো পাঁচ দিন আগে মারা গেছে।”

বাবা বললো,
“পাঁচ দিন হয়ে গেছে? ও না পরশু মারা গেল?”

“না বাবা। পাঁচ দিন হয়ে গেছে।”

“ওহ। জানিস ও মারা যাওয়ার পর ওর বউ-বাচ্চারা খুব কেঁদেছে। বিশেষ করে মেয়েগুলো কী যে কেঁদেছে যদি দেখতি! আমি মরে গেলে তোরাও কি ওরকম কাঁদবি?”

“হঠাৎ এসব কী জানতে চাইছো! চুপ করো। অন্য কিছু নিয়ে কথা বলি।”

“অন্য কিছু কেন? জানিস আমার কী মনে হয়?”

“কী মনে হয়?”

“আমি খুব শীঘ্রই মারা যাব!”

“বাবা!” আমি শিউরে উঠলাম, “থামো। নিচে চলো।”

বাবা থামলো না। বললো,
“আমার অনেকদিন ধরে এমন মনে হচ্ছে। সেজন্যই তো তোদের বিয়ে-শাদি দিয়ে দিলাম। আমি মরে গেলেও তোদের মাথার উপর যাতে কারো হাত থাকে সেজন্য। ভালো করেছি না?”

আমার হঠাৎ খুব ভয় করছে। বাবা এসব আবোল-তাবোল বকতে শুরু করেছে কেন?
বাবা আরও বললো,
“গুলশানে যে জমি কিনেছিলাম ওটা তোদের দুই বোনের নামে রেজিস্ট্রি করে দিয়েছে। এছাড়াও সব সম্পত্তি তোদের দুজনের নামে উইল করে রেখেছি। আমার মৃত্যুর পর অন্য কেউ সম্পত্তির দাবি নিয়ে আসুক আমি চাই না।”

বাবার কথায় আমার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এসব কথা শুনতে একদম ভালো লাগছে না। এসব বলা ভালো লক্ষণও নয়। বাবা আরও বললো,
“জানিস, বেশ কিছুদিন ধরে তোর মাকে স্বপ্নে দেখছি। ও ঘরের ভিতর ঘুরে বেড়ায়। কোনো ভুল করলে দিব্যি শাসন করে। কিন্তু মৃত মানুষ কি শাসন করতে পারে বল? তোর মা খুব ভালো মানুষ ছিল। একটু রাগী ছিল বটে, কিন্তু ওর মনটা খুব ভালো ছিল।”

একটা বিষয় জানতে ইচ্ছা করলো খুব,
“একটা কথা জিজ্ঞেস করবো বাবা?”

“কর।”

“তোমার আসলে দ্বিতীয় বিয়ে করার কোনো ইচ্ছা ছিল না, তাই না? সেজন্যই অত সব শর্ত রেখেছিলে, ঠিক বলছি আমি?”

বাবা হাসলো, কিছু বললো না। যেন হাসির মাঝেই উত্তর দিয়ে দিলো। আর আমি সেই উত্তর ধরতে পারলাম, বাবার বিয়ে করার ইচ্ছা ছিল না। করিম চাচা বিয়ের কথা বলায় বাবা অত সব শর্ত রেখে মিছিমিছি পাত্রী খুঁজে বেরিয়েছে। আমার চোখ বেয়ে পানি পড়লেই বাবা বললো,
“কাঁদছিস কেন মা?”

আমি কান্না চোখেই বললাম,
“তোমায় খুব ভালোবাসি বাবা!”

আমরা অনেকক্ষণ ছাদে বসে কথা বললাম। অনেক পুরোনো স্মৃতিও ঘাঁটলাম। মজার এবং কষ্টের উভয়ই। যখন ছাদ থেকে নামলাম তখন রাত এগারোটা বাজে। বাবা বাসায় এসে খাবার খেয়ে ঘুমাতে গেল। আমি ঘুমানোর পূর্বে কিছুক্ষণ আপুর সঙ্গে কথা বললাম।

রাত একটায় আমার ঘুম ভেঙে গেল হঠাৎ। কল চাপার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। এই শব্দেই ঘুম ভেঙেছে কি না বুঝতে পারছি না। কল চাপা ব্যক্তিটা নিশ্চয়ই সেজান ভাইয়া। আবারও কি মদ খেয়ে মাতলামো শুরু করেছে? আর কিছুক্ষণ পর হয়তো আনাম ভাইয়া এসে তাকে নিয়ে যাবে, যদি সেজান ভাইয়ার মদ খাওয়ার সংবাদ তার কানে পৌঁছে থাকে। আর যদি আনাম ভাইয়া না জানে তবে আজ সারারাত সে বাইরেই থাকবে।
আমি বিছানা ছেড়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালাম। কিন্তু আমি অবাক হয়ে গেলাম এটা দেখে যে, সেজান ভাইয়া নয়, কল চাপছে আমার বাবা। এত রাতে বাবা কল পাড়ে কী করছে? বাবার সাথে তিনটা বালতি দেখতে পাচ্ছি। এত রাতে সে পানি আনতে গেছে? আমি ডাকলাম,
“বাবা, ওখানে কী করছো তুমি?”

বাবা এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। মূলত কে ডাকছে তাকে খুঁজছে। কিন্তু তাকে বাবা বলে আমি ছাড়া আর কে ডাকবে?
কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর সে দ্বিতীয় তলার ব্যালকনিতে তাকালো। বললো,
“ঘরে এক ফোঁটাও পানি নেই। আমি গোসল করবো কী দিয়ে?”

আমি বাবার কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। ঘরে এক ফোঁটাও পানি নেই মানে? পানিতে তো ট্যাংক ভরপুর আছে। আর এত রাতে বাবা গোসল করবে? তাও আবার কল থেকে পানি এনে? বলছে কী এসব? বাবা কখনও কল থেকে পানি এনে গোসল করে না। গোসল করার জন্য ট্যাংক ভর্তি পানি তো রয়েছেই। বাবা সব সময় বাথরুমেই গোসল করে। সেজান ভাইয়া ছাড়া আর কেউই কলে গোসল করে না। আমি বললাম,
“এখনই ঘরে এসো বাবা। তোমার সাহস তো অনেক, এত রাতে বাইরে নেমেছো।”

বাবা আমার কথা কানে লাগালো না। দেখলাম এক বালতি পানি সে নিজের গায়ে ঢেলে দিলো।
আমি আতঙ্কিত কণ্ঠে ডেকে উঠলাম,
“বাবা!”

বাবাকে এরকম উন্মাদের মতো কখনও করতে দেখিনি। তার হঠাৎ এরকম আচরণ আমাকে ভয় পাইয়ে দেওয়ার জন্য আসলেই যথেষ্ট। আচ্ছা, ওটা আসলেই বাবা তো? না কি আমার হ্যালুসিনেশন হচ্ছে? আমি দ্রুত পায়ে বাবার রুমে গেলাম। না হ্যালুসিনেশন নয়, বাবা আসলেই রুমে নেই। ঘরের সদর দরজাও খোলা।
আমি দ্বিতীয় তলা থেকে নেমে এলাম। এত রাতে নিচে নামতে একটু ভয় অবশ্য করছিল। কিন্তু বাবাকে ঘরে তো নিয়ে যেতে হবে। আমি আসতে আসতে বাবা হয়তো আরও কয়েক বালতি পানি গায়ে ঢেলে নিয়েছে। সে এখন ভিজে একাকার।

“এত রাতে এ কেমন পাগলামি বাবা? ঘরে চলো। তুমি তো সবার ঘুম ভাঙিয়ে দেবে।”

বাবা ইতোমধ্যে মানুষের ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে। দেখলাম সেজান ভাইয়া ও সুমনা চাচি ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। আশরাফ চাচার ঘুমও হয়তো ভাঙতো। কিন্তু ডাক্তার ওনাকে ঘুমের ঔষধ দিয়েছে বলে উনি এখনও ঘুমাচ্ছেন। তৃতীয় তলায় হয়তো শব্দ পৌঁছয়নি বলে তাদের ঘুমে ব্যাঘাত হয়নি।
সেজান ভাইয়া বললো,
“এত রাতে তোরা বাপ-মেয়ে মিলে কী করছিস এখানে? জিন-ভূত ধরছিস না কি?”

সুমনা চাচি বিস্ময় কণ্ঠে বললো,
“ভাইজান, আপনি ভিজেছেন কীভাবে?”

বাবা বললো,
“আমি তো গোসল করছি। কী করবো বলো তো সেজানের মা, গোসল করবো কিন্তু ঘরে এক ফোঁটা পানি নেই। তাই তো গোসল করার জন্য এখানে আসতে হলো। গরমে একটু স্বস্তি পাচ্ছি না। খুব অস্থির লাগছে।”

আমি বললাম,
“ঘরে তো পানি আছে বাবা। ট্যাংকে তো অনেক পানি আছে।”

চাচি ও সেজান ভাইয়ার ভ্রু কুঁচকে গেছে। সেজান ভাইয়া প্রশ্নবিদ্ধ চোখে আমার দিকে তাকালো। আমি বললাম,
“জানি না বাবার কী হয়েছে। কল চাপার শব্দে ঘুম ভেঙে গেলে ব্যালকনিতে গিয়ে দেখি বাবা কল পাড়ে। তারপর নিচে এলাম।”

চাচি আমাকে নিজের কাছে টেনে ফিসফিস করে বললো,
“তোর বাবাকে জিনে ধরেনি তো?”

“কী বলছো চাচি?”

সেজান ভাইয়া বাবার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,
“চাচা, ঘরে চলুন।”

বাবা কল থেকে নেমে এলো। সেজান ভাইয়ার সমক্ষে দাঁড়িয়ে বললো,
“সেজান, বাবা, ওই অসভ্য ছেলে-পেলেদের সাথে ঘুরিস না। মদ, সিগারেট খাস না। এসব খেলে ক্যানসার হয়। এসব খেয়ে মানুষ ঠাস ঠাস করে মরে যাচ্ছে। হেমায়েত ভাইয়ের ছোটো ছেলেটা কিন্তু এখন হাসপাতালে ভর্তি। ওর ক্যানসার হয়েছে। বাবার মৃত্যুতেও কিন্তু আসতে পারেনি। আগের মতো ভালো হয়ে যা তুই।”

“আচ্ছা চাচা, ভালো হবো। আপনি এখন ঘরে চলুন।”

বাবা যাওয়া দিয়ে আবার দাঁড়ালো।
“বালতি তিনটা…”

সেজান ভাইয়া বললো,
“আমি নিয়ে আসছি।”

“পানি ভরে আনবি কিন্তু।”

আমি বাবার সাথে সাথে উপরে এলাম। বাবা নিজের রুমে ঢুকলে সদর দরজায় এসে দাঁড়ালাম। সেজান ভাইয়া সত্যিই একটা বালতিতে পানি ভরে নিয়ে এসেছে। যাওয়ার আগে আমার চিন্তিত মুখখানিতে তাকিয়ে বলে গেল,
“তোর বাবাকে ভালো ডাক্তার দেখাস। মাথায় কোনো সমস্যা-টমস্যা হয়েছে বোধহয়।”

সেজান ভাইয়ার কথা ফেলে দেওয়ার মতো নয়। হয়তো আসলেই বাবার মাথায় সমস্যা হয়েছে। না হলে হঠাৎ এরকম কাণ্ড করার মানে কী?
__________________

রাতে ঠান্ডা পানিতে গোসল করার ফলে বাবার শরীরের ভালো উন্নতিই হলো। সকালবেলা তার গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো। আপুকে রাতের ঘটনা জানালে রাগারাগি করবে বলে ওকে এসব সম্পর্কে কিছুই জানালাম না। জ্বর মেপে বাবার জন্য ঔষধ আনতে গেলাম। ফার্মেসির সামনে আনাম ভাইয়ার সঙ্গে দেখা হলো। সে রিকশা থামিয়ে বললো,
“এখানে কী করছো তুমি?”

“বাবার জ্বর এসেছে, তাই ওষুধ নিতে এসেছি।”

“জ্বর এসেছে? আমাকে জানাওনি কেন?”

“আপনি কি ডাক্তার? কী লাভ হতো আপনাকে জানিয়ে?”

“ডাক্তার তো নই, শ্বশুরের জামাই বাবা তো আমি।”

আনাম ভাইয়া রিকশা থেকে নেমে ঔষদের টাকা দিয়ে দিলো। নিষেধ করলাম কিন্তু তাও দিলো। খুব বেশি জোর দিয়ে নিষেধ অবশ্য করিনি। সে এখন আমার স্বামী। স্ত্রীর বদলে সে টাকা দিতেই পারে। সে আর আমি রিকশায় উঠে বসলাম।

“আপনি কোথায় যাচ্ছিলেন?”

“তোমাদের বাড়িতেই যাচ্ছিলাম।”

“কেন?”

“ওই বাড়িতে আমার বউ থাকে। বউয়ের সাথে দেখা করতে যেতে পারি না?”

“আপনি আমার সাথে দেখা করতে যাচ্ছিলেন?”

“তা অবশ্য যাচ্ছিলাম না। সেজানের সাথে কথা বলতে যাচ্ছি। ওর একটা কাজ নিয়ে কথা বলতে আরকি।”

“সেজান ভাইয়া কি চাকরি করবে?”

“আশরাফ আঙ্কল একটা কাজ দেখতে বলেছিলেন ওর জন্য। এখন ও করবে কি না সেটা তো ওর ইচ্ছা।”

আমি জানি সেজান ভাইয়ার জন্য কাজ দেখা বৃথা। সে তো কাজ করার ছেলে না। বসে বসে বাবার টাকা নষ্ট করতেই সে ভালোবাসে। সেজান ভাইয়া কি ভালো হবে না? আমি এখনও চাই সে ভালো হোক।

______________________

সকাল সাতটার ভিতর আমি রান্না করে ফেললাম। না ভাত, মাছ, গোশত কিছুই রান্না করিনি। সুপ ও সেমাই পিঠা বানিয়েছি। গতকাল বাবা সেমাই পিঠা বানানোর কথা বলেছিল। তাই বানালাম।
আপু গত রাতে শ্বশুর বাড়িতে চলে গেছে, বাবার জ্বর শুনে এসেছিল। কিন্তু বিদেশ থেকে মেহমান আসায় ওর রাত্রি কালেই শ্বশুরালয়ে যেতে হয়েছে।
বাবার শরীর খুব খারাপ। ডাক্তার দেখিয়েছি। ডাক্তার বলেছে তেমন কোনো সমস্যা নয়। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে।রাত্রি কালের করা ওই পাগলামির জন্য বাবাকে এতটা ভুগতে হবে সেটা বোধহয় বাবাও আশা করেনি। গতরাতে যখন তাকে ভাত খাইয়ে দিচ্ছিলাম তখন বলেছিল,
“তোর মা ভাত খেয়েছে?”

বাবা হুটহাট করেই মায়ের কথা বলছে। কাল বিকেলে তার পাশে অনেকক্ষণ বসে ছিলাম। এক সময় হঠাৎ বললো,
“বেলি ফুলের সুগন্ধিটা ফেলে দে তো সেতু।”

আমাদের ঘরে বেলি ফুলের সুগন্ধি কেউ ব্যবহার করে না। বললাম,
“বেলি ফুলের সুগন্ধি কোথায় পেলে বাবা?”

“তোর মা বেলিফুলের সুগন্ধি ব্যবহার করে। কী বাজে স্মেল! তুই ঘ্রাণ পাচ্ছিস না?”
বলেই বাবা নাক চেপেছিল। আমি বুঝতে পারছি না বাবার কী হয়েছে। তাকে কি মনোরোগ বিশেষজ্ঞর কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত? খুব চিন্তায় আছি বাবাকে নিয়ে।

সুপ ও সেমাই পিঠার বাটি নিয়ে বাবার রুমে এলাম। বাবা এখনও ঘুমাচ্ছে। আমি ভেবেছিলাম সে আরও আগেই ঘুম থেকে উঠে গেছে। আমি ডাকলাম,
“বাবা!”

বাবা সাড়া দিলো না। আরও দুইবার ডাকলাম তবুও বাবা জাগলো না। ভাবলাম, থাক আরও কিছুটা সময় ঘুমাক। সে এখন অসুস্থ, ঘুমের প্রয়োজন আছে। আমি খাবারের ট্রে নিয়ে বেরিয়ে এলাম।

সাড়ে আটটায় আবারও এলাম বাবার রুমে। বাবা এখনও ঘুমাচ্ছে। অথচ বাবা ফজরের নামাজের পর এত সময় কখনও ঘুমায় না। বেশ কয়বার ডাকলাম। কিন্তু বাবার ঘুম ভাঙছেই না। হাত ধরে হালকা নাড়লাম। আর এ সময় খেয়াল করলাম বাবার হাত প্রচণ্ড ঠান্ডা। ভালো করে স্পর্শ করে দেখলাম, হ্যাঁ, ঠান্ডা। দুই হাতই প্রচণ্ড ঠান্ডা। আমার হৃৎপিণ্ড প্রবল বেগে লাফাতে শুরু করলো। ভয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম কীয়ৎক্ষণের জন্য। অতঃপর আরও অনেকবার ডাকলাম। হাত ধরে নাড়লাম। কিন্তু বাবা নিশ্চল। আমি এবার চিন্তা আর ভয়ে কেঁদে ফেললাম। দিশেহারা হয়ে পড়লাম।

“বাবা ওঠো। ওঠো প্লিজ। আবারও কি নতুন মজা করছো তুমি? ওঠো। এই মজাটা বাজে! প্লিজ ওঠো। বাবা!”

বাবা আমার কথা শুনছে না। আমি বললাম,
“বাবা, ফেসপ্যাক মাখবে মুখে? বানিয়ে আনবো? গাজরের ফেসপ্যাক? তাহলে ওঠো।”

আমার হাত-পা কাঁপছে। কী করবো আমি? বাবা এত নিথর কেন?
আমি দৌড়ে ঘর থেকে বের হলাম। চেঁচিয়ে ডাকলাম সুমনা চাচিকে,
“সুমনা চাচি!”

আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম না, ডাকতে ডাকতে নিচে নামতে লাগলাম।
সিঁড়িতে জাবির ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলো। সে আমাকে হন্তদন্ত হয়ে নামতে ও এত জোরে ডাকতে, কাঁদতে দেখে চিন্তিত স্বরে বললো,
“কী হয়েছে মিস তুতু?”

কেঁদে কেঁদে তাকে জানালাম,
“জাবির ভাই, বাবা…আমার বাবা কথা বলছে না, চোখ মেলছে না! বাবার শরীর ঠান্ডা! আপনি একবার চলুন।”

জাবির ভাই এসব শুনে দ্রুত পায়ে আমাদের ঘরে এলো। ততক্ষণে সুমনা চাচিও এসে গেছে। তার একটু পর সেজান ভাইয়াও এলো। হৃৎপিণ্ডটা খুব জোরেই লাফাচ্ছে আমার। চোখ থেকে নীরব অশ্রুর ধারা থেকে থেকে গড়িয়ে নামছে। খুব খারাপ একটা অনুভূতি হচ্ছে।
জাবির ভাই বাবার পালস চেক করছে। প্রথমে বাম হাত চেক করলো, তারপর ডান হাতেরও। অবশেষে সে পিছন ফিরে তাকালো আমার দিকে। তার দৃষ্টি দেখে আমার হৃৎস্পন্দন থেমে যেতে চাইলো। তার আর মুখে কিছু ব্যক্ত করতে হলো না। সে মুখে না বলেও চোখের ভাষায় একটা ভয়াবহ সত্য আমাকে জানিয়ে দিলো। আমি দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি হারিয়ে ফেললাম, পড়ে গেলাম ফ্লোরে। সত্যি সত্যি দম বন্ধ লাগছে। এটা কীভাবে হতে পারে? না, এটা সত্যি না। দু চোখ বন্ধ করে ফেললাম। এটা কেবলই একটা দুঃস্বপ্ন। ঘুম ভাঙলেই এই দুঃস্বপ্নের ইতি ঘটবে। ঘুমটা ভেঙে যাক, এখনই ভাঙুক। কিন্তু আমার ঘুমটা আজ ভাঙছে না। চোখ মেলে তাকিয়েও নিজেকে দুঃস্বপ্নের মাঝে আবিষ্কার করলাম। হৃ’ৎপিণ্ডটা যেন কেউ অ’স্ত্রের আ’ঘাতে ছিঁড়েফুঁড়ে ফেলছে। যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলাম আমি। রুমের ভিতর থাকা বাকি তিনজন স্তব্ধ হয়ে গেছে। আমি কাঁদলাম। জীবনে এই প্রথম এত কাঁদছি। এই কষ্ট জীবনের সবচেয়ে বড়ো কষ্ট। যাকে জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসি সেই মানুষটা…সেই মানুষটা কি আমাকে ছেড়ে চলে গেল?
আমি মেঝে থেকে উঠে দাঁড়ালাম। ত্রস্ত পায়ে গিয়ে দাঁড়ালাম বাবার শিয়রে। মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম,
“বাবা, আমাকে শুনতে পাচ্ছ? বাবা, ওঠো। প্লিজ! আমি তোমায় ছাড়া থাকতে পারবো না। প্লিজ এরকম করো না!”

বাবা সাড়া দিচ্ছে না! আমি ভাবতে পারছি না এই মানুষটা আর কখনও আমাকে সেতু বলে ডাকবে না, মা বলে ডাকবে না! এই মানুষটার করা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাগলামি আর দেখতে পাবো না! বাবার সঙ্গে আর একসাথে ফেসপ্যাক মাখা হবে না! খারাপ রান্না খেয়ে কেউ আর আমার প্রশংসা করবে না!

“তুমি এরকম করতে পারো না বাবা। চোখ খোলো। আমি কষ্ট পাচ্ছি! আমার কষ্ট হচ্ছে। আল্লাহ… আল্লাহ আমার বাবাকে আপনি জাগিয়ে দিন!”

সুমনা চাচি এসে আমার মাথায় হাত রাখলো।
“চাচি বাবাকে উঠতে বলো। আমি বাবাকে ছাড়া কীভাবে থাকবো? আমি পারবো না। চাচি কিছু করো!”

আমি সেজান ভাইয়ার দিকে এগিয়ে গেলাম,
“ডাক্তার ডাকো সেজান ভাইয়া। বাবার কিছু হয়নি। ডাক্তার এলে বাবা ভালো হয়ে যাবে।”

সেজান ভাইয়ার চোখে জল। ঢিমে কণ্ঠে বললো,
“ডাক্তাররা সব সমাধান করতে পারে না সেতু!”

আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম,
“না, বাবার কিছু হয়নি!”
আমি জাবির ভাইয়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললাম,
“জাবির ভাই, ডাক্তার ডাকুন। ডাক্তার এলে বাবা সুস্থ হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি ডাকুন। বাবাকে জাগিয়ে তুলুন জাবির ভাই!”
চাচির দিকে ফিরলাম,
“চাচি, ডাক্তার ডাকো। বাবা…বাবাকে জাগিয়ে তুলতে হবে। নয়তো আমি মরে যাব চাচি! কিছু করো, একটা কিছু করো। আমি মরে যাব চাচি!”

আমি কান্নায় ভেঙে পড়লাম। সুমনা চাচি আমাকে আগলে ধরে রাখলো।
আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য স্থানীয় মেডিকেল ডায়াগনস্টিক থেকে একজন ডাক্তারকে আনা হলো। কিন্তু আমার বাবা জাগলো না। চোখ মেলে হেসে দিয়ে বললো না,
‘কীরে মা ভয় পেয়েছিলি? আমি তোকে ছেড়ে যেতে পারি?’
চোখ খুললো না বাবা! ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখে যখন বাবাকে মৃত ঘোষণা করলো, ঠিক তখনই আমার পুরো পৃথিবী ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। আমি অনুভব করলাম আর একটুর জন্য আমার হৃৎপিণ্ড নিজ স্থান থেকে খসে পড়েনি। বাবা মারা গেছে? এটা কীভাবে হয়? না, এটা সত্যি না। এটা মিথ্যা।
ডাক্তারকে বললাম,
“বাবা মরে গেছে? কী বলছেন? কীসের ডাক্তার আপনি? আপনার সার্টিফিকেট আছে? আপনি একজন ভুয়া ডাক্তার। আপনার সাহস তো কম নয়, আপনি ভুয়া ডাক্তার হয়ে আমার বাবার চিকিৎসা করতে এসেছেন! সেজান ভাইয়া, তুমি ভুয়া ডাক্তার ধরে এনেছো?”

ডাক্তার সাহেব কিছু বলতে উদ্যত হলে আমি চেঁচিয়ে উঠলাম,
“চুপ করুন আপনি। আর এক মুহূর্ত আপনি আমাদের বাড়িতে থাকবেন না। আপনার সাহস কীভাবে হলো বাবাকে মৃত বলার? আমার বাবা শুধু একটু অসুস্থ, বুঝেছেন? বেরিয়ে যান আপনি। সেজান ভাইয়া, অ্যাম্বুলেন্স ডাকো। বাবাকে হাসপাতালে নিতে হবে। হাসপাতালে নিয়ে গেলে বাবা ভালো হয়ে যাবে। অ্যাম্বুলেন্স ডাকো। তাড়াতাড়ি।”

ডাক্তার সাহেব আমার কথার পর আর দাঁড়িয়ে থাকলো না, বেরিয়ে গেল হনহন করে।
সেজান ভাইয়া অ্যাম্বুলেন্স ডাকছে না, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

“কী হলো? অ্যাম্বুলেন্স ডাকছো না? বাবাকে সুস্থ করে তুলতে হবে। অ্যাম্বুলেন্স ডাকো।”

কেউ আমার কথা শুনছে না। আমি বাবার কাছে গেলাম। বাবার এক হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বললাম,
“তোমার কিছু হবে না বাবা। তুমি ভালো হয়ে যাবে। একবার চোখ মেলো। একবার তাকাও আমার দিকে। প্লিজ বাবা, একবার তাকাও। প্লিজ! চোখ খোলো বাবা! বাবা, প্লিজ!”

কান্নায় আমার গলা আটকে আসছে। আমি বাবার হাত খুব শক্ত করে ধরে রেখেছি। আমার মনে হচ্ছে আমি হাত ছেড়ে দিলেই বাবা আমার থেকে খুব দূরে চলে যাবে। আমার ভয় করছে। আমি বাবার হাত ছাড়বো না। আমি বাবার মুখটি আর দেখতে পাচ্ছি না। ক্রমশ সব ঝাপসা হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে আমি খুব দূরে সরে যাচ্ছি, অন্ধকারের রাজ্যে। এত অন্ধকার! আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না। আমার মাথাটা নুয়ে পড়লো। শক্ত কিছুর সঙ্গে আঘাত লাগলো মাথায়। সম্ভবত খাটের কিনারার অংশ হবে। আমি অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। হাত দুর্বল হয়ে পড়ছে। অন্য একটি হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরার শক্তি আর নেই। তবুও আমি যতটা সম্ভব বাবার হাতটিকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে আছি। বাবার হাত ছাড়বো না। কিন্তু আমি এটাও টের পাচ্ছি, আমার হাতের বন্ধন ঢিলে হয়ে আসছে। আমি কি মারা যাচ্ছি? না কি জ্ঞান হারাচ্ছি? জ্ঞান হারালে চলবে না, বাবা তাহলে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে!

“বাবা!”
আমি বাবাকে ডাকলাম, কিন্তু সে ডাকে কোনো শব্দ হলো না, কেবল ওষ্ঠাধর কাঁপলো।

______________________

[সাত মাস পর]

আমি এখন এ ঘরের মালিক, আবার আমি এ ঘরের অতিথিও। আবারও প্রায় এক মাস পর আমি নিজের ঘরে ফিরে এসেছি। এটা আমার ঘর। এ ঘরে আমার জন্ম হয়েছিল, আমি এ ঘরেই বড়ো হয়েছি। এ ঘর, এ বাড়ি আমার সুখ-দুঃখের সাক্ষী। ছাদ, পেয়ারা তলা আমার পরম আপন দুটি স্থান। সবকিছু আগে কত সুন্দর ছিল! কিন্তু এখন? এখন সবকিছু কেমন মলিন, ফ্যাকাশে! এ বাড়িতে এলে এখন আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। পুরোনো স্মৃতিরা ঝাপটে ধরে আমায়। আমার চারপাশ ঘিরে স্মৃতিদের হাহাকার!

বাবার মৃত্যুর পর আমি শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে থেকেছি। বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় তলাটা মানবহীন শূন্য পড়ে ছিল। বাড়ির মালিক অন্য মানুষের কাছে বাড়ি ভাড়া দেওয়ার জন্য উতলা হয়ে উঠেছিল। কিন্তু যে বাড়িতে এত এত স্মৃতি, সে বাড়ি অন্য কাউকে দিয়ে দিই কী করে? স্ত্রী হিসেবে আনাম ভাইয়ার কাছে সে বার প্রথম একটি জিনিস চেয়েছিলাম। এই বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় ফ্লোরটি চেয়েছিলাম। যেখানে এক সময় বাবার সঙ্গে আমরা দুই বোন থাকতাম। আনাম ভাইয়া আমার চাওয়া অপূর্ণ রাখেনি। সে আমার নামে দ্বিতীয় তলাটি কিনেছে। খুব বেশি দাম নয় ফ্লোরটির। তবে এটা আমার কাছে খুব দামি। এত দামি কিছু আমি ছেড়ে দিতে রাজি নই। আমরা দুই বোন এক সঙ্গে এ বাড়িতে কিছুদিনের জন্য থাকতে আসি। আপুকে খুব কঠিন মনের মেয়ে ভাবতাম। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর বুঝতে পেরেছি আপুর মন কতখানি নরম। ও সব সময় বাবার সঙ্গে রাগারাগি করতো, কিন্তু ওর সেই রাগটাও ছিল একটা ভালোবাসা। এ বাড়িতে এলে আপু বাবার রুমের দিকে তাকিয়ে থাকে, কখনও ভিতরে ঢুকে বসে থাকে। ওকে কাঁদতেও দেখা যায়।
বাবার রুমটি আগের মতোই আছে। বাবা থাকতে যেমন ছিল, রুমটি সেরকম করে গুছিয়ে রেখেছি। আমি বাবাকে অনুভব করতে পারি। মনে হয় বাবা আমাকে দেখছে। আমি যেন সব সময় বাবার সঙ্গেই আছি।

বাবার মৃত্যুর সাত মাস পেরিয়ে গেছে। সেই সঙ্গে বদলে গেছে অনেক কিছু। আমরাও বদলে গেছি। বাবার মৃত্যু যে পরিবর্তনটা আমাদের মাঝে এনে দিয়েছে, সেই পরিবর্তনটুকু কাটিয়ে উঠতে পারিনি আমরা। হয়তো ওঠা সম্ভবও না।
বাড়ির পিছনের পেয়ারা তলাটা আর নেই, নেই বেলি ফুলের গাছগুলোও। পেয়ারা গাছগুলো বাড়ির মালিক কেটে ফেলেছে, আর বেলিফুলগুলো মরেছে অযত্নে। আমি নেই যে, কে যত্ন করবে ওদের? তাও ভেবেছিলাম সেজান ভাইয়া নাহয় জাবির ভাই কেউ একজন বেলিফুল গাছের খেয়াল রাখবে। কেউ রাখেনি হয়তো। জাবির ভাই তো এ বাড়ি ছেড়ে চলেই গেছে। একটা হাই স্কুলে চাকরি হয়েছে তার। স্কুলের কাছে একটা বাসা নিয়ে থাকে। এখান থেকে অনেক দূরে। জাবির ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয় না।
সেজান ভাইয়া? সে আগের মতোই আছে। এখনও মদ, সিগারেট নিয়ে তার জীবন। আমার বেলি ফুল গাছগুলোর যত্ন তো সে নেয়নি, নিজের গোলাপ গাছ দুটোও অযত্নে হারিয়েছে। গোলাপ গাছ দুটোও মরে গেছে। এখন আশেপাশে কোনো রং নেই, সবকিছু সাদা-কালো।

আপুর বিকেলে আসার কথা ছিল, কিন্তু শাশুড়ি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় আসতে পারলো না। আমি সকালেই এসেছি। আনাম ভাইয়া অফিস থেকে এখানে এসেছে। সেও আমার সঙ্গে কিছুদিন বেড়াবে এখানে। এখন রাত একটা বেজে পঁচিশ মিনিট। আমি দাঁড়িয়ে আছি ব্যালকনিতে। আনাম ভাইয়া ঘুমাচ্ছে। আনাম ভাইয়ার সঙ্গে ভালোই আছি আমি। সে ভালো মানুষ। তার পরিবারের সবাইও খুব ভালো। ভেবেছিলাম ও বাড়িতে গিয়ে থাকতে কষ্ট হবে। কিন্তু না, আনাম ভাইয়া ও আমার শ্বশুর-শাশুড়ি তাদের সঙ্গে আমাকে সহজেই মানিয়ে নিতে শিখিয়েছে।হয়তো তাদের মেয়ে নেই বলে তারা আমাকে এত ভালোবাসে। আনাম ভাইয়াও আমাকে ভালোবাসে। তার সাথে সাত মাস কাটানো জার্নিতে আমি এটুকু বুঝতে সক্ষম হয়েছি। ধীরে ধীরে ভালোবাসা তৈরি হবে এটাই স্বাভাবিক। তবে আমি তাকে ভালোবাসি কি না জানি না। তবে তার প্রতি আমার অনেক শ্রদ্ধা। একটা সম্পর্কে যেমন ভালোবাসা থাকা উচিত, তেমনি শ্রদ্ধাও থাকা উচিত।
উঠানের মাঝে একটি জ্বলন শিখা দেখা যাচ্ছে। ওটা সিগারেটের আলো। অন্ধকারে সিগারেটের আলো প্রখর দেখায়, তবে উঠোনের লাইটটা জ্বলছে বলে আলোটা ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। এত রাতে ইজি চেয়ারে শুয়ে সিগারেট খাওয়া বোধহয় সেজান ভাইয়ার দ্বারাই সম্ভব! আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। মানুষটা সত্যিই আর ভালো হলো না! আমার এখন আর এটা বলারও অধিকার নেই, ‘ভালো হয়ে যাও সেজান ভাইয়া, আমার জন্য হলেও হও।’
এটা বলার অধিকার বহু আগে হারিয়েছি! আমার মনে হয় আমি এখনও ভালোবাসি সেজান ভাইয়াকে! এটা আমার অন্যায় হচ্ছে। স্বামী থাকতে অন্য কাউকে ভালোবাসা অন্যায়। আমি যত দ্রুত সম্ভব তার প্রতি এই ভালোবাসার অনুভূতি হারাতে চাই!

“ওখানে কী করছো সেতু?”
রুমের ভিতর থেকে আনাম ভাইয়ার ঘুম জড়ানো গলা শুনতে পেলাম। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম আনাম ভাইয়া ওপাশ ফিরে চোখ বুজেছে আবারও। তার মাথা ব্যথা নেই তার বউ এত রাতে এখানে দাঁড়িয়ে আছে বলে। সে জানে তার বউ এ বাড়িতে এসে কয়েকটা রাত এরকমভাবে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে অথবা বসে কাটাবে। সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে আমার এই স্বভাবের সঙ্গে। তবে প্রথম যেদিন দেখেছিল সেদিন ভয় পেয়েছিল। এত রাতে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়ে থাকা আদৌ কোনো ভালো লক্ষণ? এটা জিনে ধরার লক্ষণও হতে পারে।
আমি রুমের ভিতর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আনলাম। কলের দিকে দৃষ্টি পড়তেই বাবার কথা মনে পড়লো। চোখ থেকে টপ টপিয়ে জলের ধারা নেমে গেল কয়েক ফোঁটা। আমি কান্না চোখে হাসলাম। কলটা কিছুক্ষণ আগেও শূন্য ছিল, এখন শূন্য নেই। ওখানে আমার বাবা দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক সেই দৃশ্য, যেটা সে মৃত্যুর একদিন আগে করেছিল। রাতের বেলা কলে গিয়েছিল গোসল করতে। সেই দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি আমি। বাবার সাথে তিনটা বালতি। সে কল চেপে পানি ভর্তি করছে বালতিতে। বালতির অর্ধেকটা ভরলেই সে বালতির পানিটুকু নিজের গায়ে ঢেলে নিলো। আমি ডুকরে কেঁদে উঠলাম। বাবা আমার দিকে তাকালো। আমি বিড়বিড় করে বললাম,
“ভিজো না বাবা। ঠান্ডা লেগে যাবে তোমার। জ্বর আসবে!”

(সমাপ্ত)

__________________

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে