নীল জোছনায় ভাসি পর্ব-১২

0
1700

#নীল_জোছনায়_ভাসি (১২)
#লেখা: ইফরাত মিলি
___________________

গতকাল অবধিও আমার এমন ভয়ংকর অনুভূতি হয়নি, যেটা এখন হচ্ছে। ভীষণ উদ্বিগ্নতা, ভীষণ এক যন্ত্রণা আস্তে আস্তে যেন খড়কুটো দিয়ে বাসা বেঁধে চলেছে আমার ভিতরে। অনেক বার কান্না না করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু এরই মধ্যে থেকে থেকে কেঁদে ফেলেছি অনেকবার। কিন্তু কান্না কোনো কিছুর সমাধান নয়। আমাকে এর সমাধান সম্পর্কে ভাবতে হবে। কথা বলতে হবে বাবার সাথে। আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিলাম। না অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে না আমাকে।
বাবার রুমে যাওয়ার আগে এক কাপ চা তৈরি করে নিলাম। দরজায় গিয়ে দাঁড়াতেই বাবা বললো,
“ভিতরে আয়।”

আমি অনুমতি পেয়ে ভিতরে ঢুকলাম। বাবা কী যেন হিসাবনিকাশ করছে খাতা, কলম ও ক্যালকুলেটর নিয়ে। হিসাবটা ব্যাবসা সংক্রান্ত। আমি চায়ের কাপটা বাবার সামনে রাখলাম। বাবা আমার দিকে তাকালো।

“কিছু বলবি?”

ইতস্তত বোধ করছি। বাবাকে কীভাবে বলবো আমি বিয়ে করতে ইচ্ছুক না? তার চেয়েও বেশি চিন্তিত বাবাকে কীভাবে বোঝাবো কোন কারণে আমি অনিচ্ছুক সেটা নিয়ে। আমি দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছি দেখে বাবাই হঠাৎ বললো,
“পাত্র কি তোর পছন্দ হয়নি? আমি তো ভেবেছিলাম ওকে তোর খুব পছন্দ হবে।”

বাবার কথায় আমি আরও বেশি দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়লাম। পাত্র পছন্দ হয়নি এটা বলা ভীষণ অযৌক্তিক হবে। কারণ পাত্র পছন্দ না হওয়ার একটা বড়োসড়ো কারণ দেখাতে হবে। কী কারণ দেখাবো আমি? বাবা খুব ভালো করে আনাম ভাইয়ার খোঁজখবর নিয়েছে, পাত্র অপছন্দ করার কোনো কারণ থাকলে বাবা নিজেই পছন্দ করতো না। সুতরাং পাত্র পছন্দ হয়নি বাবার সামনে এ কথা বলা বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু যেটা বলতে এসেছি সেটা আমাকে বলতে হবে।
কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই বাবা বললো,
“তোকে আমি আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দেখে রাখতে পারবো। যদি তুই দুঃখে থাকিস তাহলে তোর দুঃখ দূর করারও চেষ্টা করতে পারবো। কিন্তু যদি আমি মারা যাই? আমি চিন্তা করি না তারপর তুই কী রকম থাকবি তা নিয়ে। কারণ আমি জানি তোর দেখভাল করার জন্য একটা ভালো মানুষের নিকট আমি তোকে রেখে যাব। আমি আশা রাখি সে তোর দুঃখ দূর করার চেষ্টা করবে না, বরং তোর কাছে দুঃখ ঘেঁষতে দেবে না।”
বলতে বলতে আনন্দে বাবার চোখ জলপূর্ণ হয়ে উঠলো। আমার কথাটা চাপা পড়ে গেল তার চোখের ওই আনন্দ অশ্রুর দুর্বার শক্তির নিচে। বাবা বললো,
“ছেলেটাকে আমার কী যে ভালো লাগে তোকে বোঝাতে পারবো না মা। আগে যখন ও সেজানের সাথে দেখা করতে এ বাড়িতে আসতো, ওর সাথে মাঝে মাঝেই দেখা হতো আমার। কুশল বিনিময় হতো। ওর প্রতি আমি মায়া অনুভব করতাম। কেন করতাম? হয়তো ওর সাথে জামাই-শ্বশুর সম্পর্কে আবদ্ধ হবো বলেই মায়াটা জন্মে গিয়েছিল।”

বাবা হাসলো। তার হাসির মাঝে স্নিগ্ধতা। আমার মনে হলো কেবল মায়া না, বাবার হয়তো আনাম ভাইয়ার প্রতি ভালোবাসাও জন্মে গেছে। এটা ভেবে আমার খুব খারাপ লাগলো। আমার বলতে চাওয়া কথাগুলো হারিয়ে গেল বাবার আনন্দ, স্নিগ্ধ হাসির জন্য। আমার ইচ্ছা করলো না এই মানুষটার আনন্দকে ধ্বংস করে দিতে। বাবার স্নিগ্ধ হাসির মায়া মুখটা আমি বহুদিন পর দেখেছি। ইচ্ছা হলো না এই উজ্জ্বল মুখখানিতে অমাবস্যার অন্ধকার নামাতে। আমি কিছু না বলে বেরিয়ে এলাম।
আপু কিচেন থেকে রুমে ফিরছিল। আমাকে দেখে অবাক হয়ে বললো,
“কাঁদছিস কেন?”

“আমি এখন বিয়ের কনে। আমি যখন তখন কাঁদতে পারি। ‘কেন কাঁদছি’ আমাকে এ প্রশ্ন করা এখন অনুচিত।”

আমি ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। ছাদে গিয়ে হাই স্কুলের একজন শিক্ষককে দেখে নিচে নেমে এলাম আবার। যাওয়ার স্থান বলতে ছাদ আর পেয়ারা তলাই রয়েছে আমার। প্রথম স্থানটিতে থাকতে না পেরে দ্বিতীয় স্থানে এলাম। কিন্তু এখানেও একজন আমার আগে থেকে উপস্থিত। আমাকে দেখেই সে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেল। যেন আমি তাকে চেয়ারে বসার অপরাধে মস্ত বড়ো কোনো শাস্তি দেবো। আমি এখানেও দাঁড়াতে চাইলাম না। আমি চলে যাব বুঝতে পেরে জাবির ভাই বললো,
“তুমি থাকো, আমি যাচ্ছি।”

আমি কিছু বললাম না। এসে চেয়ারে বসলাম। কিন্তু সে গেল না। কিছু বলছেও না। কেবল দাঁড়িয়ে আছে।

“যাবেন না?”

“একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে কি খুব বেশি সমস্যা হবে?”

“না। তবে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন না।”

“উহুঁ, বেশিক্ষণ দাঁড়াবো না। কেবল একটুক্ষণ।” জাবির ভাই কিছু সময়ের বিরতি নিয়ে বললো,
“বিয়ে কবে?”

“জানি না। আজ আমাকে আনাম ভাইয়ার পরিবারের লোকজন দেখতে আসবে। হয়তো আজই ঠিক হবে বিয়ের তারিখ! কবে বিয়ে হলে ভালো হয় বলুন তো?”

প্রশ্নটা করে তাকে আ’ঘাত করলাম বোধহয়। কারণ দ্রুতই সে কোনো উত্তর দিলো না। উত্তর দিতে এক মিনিটের মতো লাগলো,
“যত দ্রুত সম্ভব!”

আমি হাসলাম। যদিও কান্না পাচ্ছে। বললাম,
“আমরা যা চাই তা আমাদের থেকে এত দূরবর্তী কেন হয় জাবির ভাই? আমরা তো খুব দামি কিছু চাই না। আমাদের চাওয়া খুব সাধারণ। তবু কেন সেই সাধারণ কিছু পেতে এত অসাধারণ কষ্ট?”

জাবির ভাই কিছু বললো না। সে এখনও দাঁড়িয়ে আছে। অথচ বলেছিল একটুক্ষণ পরই চলে যাবে।

“সেদিন কী যেন একটা বলতে চেয়েছিলেন জাবির ভাই?”

“কবে?”

“সেদিন, আপনার বোন আছে কি না প্রশ্ন করার পর। হয়তো এ বাড়িতে আর বেশিদিন থাকবো না। আপনার সাথে খুব একটা যোগাযোগও থাকবে না।”

জাবির ভাই নিষ্প্রভ হেসে বললো,
“যেমন অনেক পন্যদ্রব্যের মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যায়, তেমনি কিছু কথারও মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যায় মিস তুতু। আমার কথার মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে! কিছু বলার নেই আমার।”

জাবির ভাই একটু থেমে আবার বললো,
“যাই। হয়তো একটুক্ষণের চেয়ে বেশি থেকে ফেলেছি, সেজন্য দুঃখিত আমি!”

জাবির ভাই চলে গেল।
পেয়ারা তলায় চোখ বন্ধ করে বসে রইলাম। সেজান ভাইয়ার চেহারা মনে পড়তেই চোখের পাতা কাঁপলো। চোখ মেললাম। মনে একটা প্রশ্ন জাগলো, পণ্যদ্রব্যের মতো কি ভালোবাসারও মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়া সম্ভব?

__________________

মুখে কৃত্রিম হাসি এঁটে রাখা কষ্টসাধ্য কাজ। তবে এই কাজটি সেজান ভাইয়া খুব ভালো পারে। বসার ঘরে আমি যতক্ষণ ছিলাম, বেশিরভাগ সময়ই তার কৃত্রিম হাসির উপর আমার চোখ ছিল। কিন্তু সে বোধহয় জানে না আমি তার কৃত্রিম হাসির আড়ালে থাকা আসল অবস্থা সম্পর্কে জানি। আনাম ভাইয়াদের সঙ্গে সঙ্গেই সে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে কী মনে করেই একবার রুমের দরজায় দাঁড়ানো আমার দিকে তাকিয়েছিল। তার মুখে তখন কৃত্রিম হাসিও ছিল না। ভুল করে কি মনের প্রকৃত অবস্থা আমাকে দেখিয়ে ফেললো?
দরজা থেকে সরে রুমে প্রবেশ করলাম। আয়নার সামনে এসে দাঁড়াতেই নাকফুলটার উপর দৃষ্টি পড়লো। নাকফুল, আংটি ও একটি চেইন পরিয়ে যাওয়া হয়েছে আমাকে। তারমানে বিয়ের এক ধাপ এগোনো হয়েছে! বিয়েও হবে খুব শীঘ্র। আগামী শুক্রবার। তবে অনুষ্ঠান হবে না। অনুষ্ঠান ছাড়া কাজি ডেকে এমনি বিয়ে পড়ানো হবে। কারণ আমি এখনই শ্বশুর বাড়ি চলে যাচ্ছি না। বিয়ের পরও বাবার কাছেই থাকবো। যখন আমি স্থায়ীভাবে শ্বশুর বাড়িতে থাকার জন্য যাব তখন অনুষ্ঠান করে এক সঙ্গে পাঠানো হবে। এই কাজটা অন্তত বাবা ভালো করেছে, এখনই শ্বশুর বাড়িতে পাঠিয়ে দিচ্ছে না আমাকে।
সেজান ভাইয়ার কথা মনে পড়ে হাসি পাচ্ছে, আবার কষ্টও লাগছে। সে হাসি হাসি মুখ করে আনাম ভাইয়ার পরিবারের সবাইকে বলেছে,
‘আমাদের সেতু খুব ভালো মেয়ে।’

আসলেই কি সেতু খুব ভালো মেয়ে? উহুঁ, সেতু ভালো মেয়ে নয়। সেতু খারাপ, বোকা! আর সেজন্যই তো সেজান নামের ছেলেটাকে ভালোবাসে! সেতু খুব বোকা। খুব! ভাবতে ভাবতে নিজের মনে হাসছিলাম। আপু এসেই আমার হাসি মুখটা দেখে ফেললো আর বললো,
“তোর হয়েছে কী? জিনে ধরা মানুষের মতো করছিস কেন?”

আপুর দিকে তাকিয়ে আবারও হাসলাম। বললাম,
“আমি জিন। মামুন সাহেবদের বাসায় থাকা সেইজন আমি। আমি আম্বিয়া।”

আপুর ভ্রু কুঁচকে উঠলো। গভীর বিস্ময়ের দৃষ্টি মেলে আমাকে দেখছে। বোঝার চেষ্টা করছে কী হয়েছে আমার। কিন্তু ও বুঝতে পারলো না আমাকে। আমার হাসি মুখের দুর্বোধ্য জালে আটকে হতভম্ব হয়ে গেল।
আমি শুয়ে পড়লাম বিছানায়। ঘুম পাচ্ছে। কত দিন ঠিকভাবে ঘুমাইনি আমি। কত ঘুম জমা হয়ে আছে। আজ আমি ঘুমাবো। অনেক ঘুমাবো।

ঘুম ভাঙলো সাড়ে এগারোটায়। তাও বাবা ডেকে তুলেছে। পিটপিট করে চোখ মেলতেই বাবা বললো,
“ভাত খাবি না? ওঠ।”

আমি ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে গিয়ে দেখলাম বাবা আমার জন্য খাবার বেড়ে রেখেছে। আজকের রাতের রান্না আমি করিনি। আমি তো ঘুমাচ্ছিলাম। আপু রান্না করেছে হয়তো। খেয়ে বুঝলাম, না আপু রান্না করেনি। রান্না করেছে বাবা। আপুর রান্নার আর বাবার রান্নার স্বাদ ভিন্ন। সত্যি বলতে গেলে বলতে হয় বাবার রান্নার স্বাদ অনেক বেশি ভালো। আমি কবে যে এরকম চমৎকার রান্না করতে পারবো জানি না। বাজে রান্না খাইয়ে শ্বশুর বাড়ির সবাইকে বিরক্ত করে ফেলবো না কি!
ভাত খাওয়া শেষ হলে বাবা এক গ্লাস গরম দুধও খেতে দিলো। আমি খেলাম। বাবার সঙ্গে কখনও খাবার নিয়ে দ্বন্দ্ব করি না। দ্বন্দ্বে ঠকে যাওয়ার দৃঢ় সম্ভাবনা থাকে। আমার ঠকতে ভালো লাগে না।
বাবা আমাকে প্লেট ধুতে দিলো না। বললো সে ধুবে। বিয়ের আগে কি মেয়েদের প্রতি বাবাদের ভালোবাসা বেড়ে যায়?

সেজান ভাইয়া উঠোনে। মদ খেয়েছে সে। মদ খেলে একা একা বকবক করতে থাকে। আজও করছে। আমি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছি। সে কিছুক্ষণ হাঁটছে, আবার ইজি চেয়ারে বসছে। সিগারেট ধরাচ্ছে। কয়েক টান খেয়ে ফেলে দিচ্ছে আবার। হাঁটতে হাঁটতে সে হঠাৎ আমার ব্যালকনিতে তাকালো। এক হাত কপালে ঠেকিয়ে যেরকম ভাবে আকাশ দেখে থাকে মানুষ, সেও সেরকম করে আমার দিকে তাকালো। বললো,
“ওখানে কে?” তার মুখ হাসিতে ঝলমল করে উঠলো,
“সেতু?”

“আমি নই।”

“নিচে আয়।”

“না।”

সেজান ভাইয়া রাগ করলো। আরও একবার হুকুম করলো নিচে যাওয়ার জন্য। আমি সম্মত না হলে সে হঠাৎ একটা ইটের টুকরো উঠিয়ে নিলো।

“আয়। আর না হলে মাথা ফা’টিয়ে দেবো।”

সেজান ভাইয়া নেশার ঘোরে ইটের টুকরোটা ছুঁড়ে মা’রলে, আর তাতে আমার কপাল কেটে র’ক্ত বের হলে আমি খুব বেশি অবাক হবো না। কিন্তু সে কি সত্যিই পারবে আমার মাথা ফা’টাতে? তার ওই ছোট্ট বক্ষস্থলে কি সে সেই সাহস বহন করে? আমি তাকে নিতান্তই অবহেলায় রাখতে চাইলাম। রুমে আসা দিলেই সে ডাকলো,
“সেতু!”

আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। তার কণ্ঠস্বরে পরিবর্তন। খুব কোমল, আবেগ জড়িত। ফিরে তাকালেই সে বললো,
“সেতু, তুই…”
এটুকু বলেই সে থেমে গেল। যেন ভাবছে কী ভুল করছে সে। ভেবে উঠতে না পেরে আবারও বললো,
“তুই…”
কিন্তু এর পরের অংশটুকু সে বলছে না। এবার হয়তো বুঝতে পারলো আসলেই কিছু একটা ভুল করছে, তাই থেমে গেল।
এ পর্যায়ে খুব অভিমান হলো আমার। আমার চোখও অভিমান করলো। চোখের অভিমান হয়ে বিন্দু বিন্দু জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো। আর হৃদয়ের অভিমান থেকে বললাম,
“সময়ের কথা সময়েই বলে দিতে হয় সেজান ভাইয়া। অসময়ে সেটার কোনো মূল্য থাকে না!”

কথাগুলো আস্তে বললাম বলে সেজান ভাইয়া শুনতে পেল না।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে