নীল জোছনায় ভাসি পর্ব-০৮

0
1852

#নীল_জোছনায়_ভাসি (০৮)
#লেখা: ইফরাত মিলি
___________________

সেজান ভাইয়ার গোলাপ গাছ দুটো চুরি হয়ে গেছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে সে যখন এই চুরির ঘটনা সম্পর্কে অবগত হলো তখন তার চেহারা দেখার মতো ছিল।সে সকালে বিল্ডিংয়ের সবাইকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে জানিয়ে দিয়েছে যে, সে চোর উদ্ঘাটনের জন্য চালপড়া খাওয়াবে। সবাইকে খেতে হবে। আমি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ তার চ্যাঁচামেচি শুনলাম। তারপর চুরি করে আনা গাছ দুটোয় পানি দিলাম। গাছ দুটো এখন থেকে আমার কাছেই থাকবে। আপুকে কি জানানো উচিত আমি সেজান ভাইয়ার গাছ চুরি করেছি? আপু জানলে খুশি হতো। কিন্তু ওকে বললে এক কান থেকে দু কান হতে পারে। না, আমি ঝুঁকি নিতে আগ্রহী নই।

রাতে ছাদে গিয়ে দেখলাম প্রাইমারি শিক্ষক আগে থেকেই ছাদে আছে। সে বোধহয় তার মায়ের সঙ্গে কথা বলছে। আমি এই লোকটার থেকে দূরে থাকার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। দুই মিনিটের মতো দাঁড়িয়েই আমি চলে যেতে উদ্যত হলাম, প্রাইমারি শিক্ষক ঠিক সেই সময়েই বলে উঠলো,
“চলে যাচ্ছ কেন মিস তুতু?”

তার ফোনে কথা শেষ হওয়ার আগে যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আটকা পড়ে গেলাম। বললাম,
“এমনি।”

“এমনি? বলছো না কেন আমার কারণে চলে যাচ্ছ? তোমার আপু কি আমার আশেপাশে আসতেও নিষেধ করেছে?”

“হুম, আপনি একজন নিষিদ্ধ পুরুষ।”

জাবির ভাই হেসে ফেললো,
“ভালো বলেছো। নিষিদ্ধ পুরুষ। দারুণ উপাধি কিন্তু।”

জাবির ভাইয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একটুখানি হাসলাম। সে বললো,
“নিচে যাওয়া খুব বেশি জরুরি না হলে, কিছুক্ষণ থেকে যাও।”

কারো পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। কেউ একজন ছাদে আসছে। আপু হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। ও যদি দেখে আমি আর জাবির ভাই এক সঙ্গে ছাদে তাহলে নির্ঘাত মে’রে র’ক্তাক্ত করবে আমায়। মনে মনে প্রার্থনা করলাম যেন এটা আপু না হয়। মানুষটি ততক্ষণে ছাদে চলে এসেছে। আপু নয়, সেজান ভাইয়া। তবে তার আগমনও সর্বনাশের চেয়ে কিছু কম নয়।
সে আমাকে দেখে বললো,
“তুই? ভালো হয়েছে। হাত পাত দেখি।”

আমি কোনো কারণ জানতে না চেয়েই হাত পাতলাম। সেজান ভাইয়া নিজের পকেট থেকে কিছু চাল বের করে আমার হাতে দিলো।

“চালপড়া?” আমি জানতে চাইলাম।

“হ্যাঁ, খা।”

“তুমি আমাকে সন্দেহ করছো?”

“হ্যাঁ, খা তাড়াতাড়ি। দেখি গাছ চোর তুই কি না।”

চালপড়া সম্পর্কে আমার ধারণা নেই। এটা খেলে কী হবে তাও জানি না। এটা খেলে কি আসলেই আমি ধরা পড়ে যাব? একটু ভয় করছিল, তবুও কৌতূহলের বশে চালগুলো খেলাম। কিন্তু চাল খাওয়ার পরও আমার কিছু হলো না।
সেজান ভাইয়া কপাল, ভ্রু এক সঙ্গে কুঁচকে আমাকে দারুণ বিস্ময়ে দেখছে।

“তাহলে তুই চোর না?”

“আমার কি চোর হওয়ার কথা ছিল?”

সেজান ভাইয়া আশা ক্ষুণ্ণ হলো। সে বোধহয় আমাকে চোর হিসেবে খুব আশা করেছিল। কিন্তু চাল খেয়ে যেহেতু আমার কিছু হয়নি তাই চোর তো আমি না। কিন্তু আসল চোর তো আমিই, তাহলে চালপড়া খেয়ে কিছু হচ্ছে না কেন?
সেজান ভাইয়া আশাহত হয়ে চলে গেল।

জাবির ভাই ওদিকে সরে দাঁড়ানো ছিল বলে সেজান ভাইয়া তাকে লক্ষ করেনি। ভালোই হয়েছে, আবার আপুর কাছে বানিয়ে কী মিথ্যা বলতো কে জানে। জাবির ভাই হঠাৎ আমাকে চমকে দিয়ে বললো,
“সেজানের ফুল গাছ কেন চুরি করলে মিস তুতু?”

অবাক হয়ে জাবির ভাইয়ের দিকে চেয়ে রইলাম। সে কীভাবে জানলো সেজান ভাইয়ার গাছ আমি নিয়েছি? জানতে ইচ্ছা করলো না। হয়তো যে সময় নিয়েছি সে দেখেছে। তার প্রশ্ন প্রসঙ্গে বললাম,
“আমি চাই না ওই গাছ দুটোর ফুল আমি ব্যতীত অন্য কেউ স্পর্শ করুক।”

জাবির ভাই ভাবিত গলায় বললো,
“তুমি কি ওই গাছের মালিককে ভালোবাসো?”

জাবির ভাইয়ের প্রশ্নে আবারও চমকালাম। জাবির ভাই উত্তরের অপেক্ষা করে চেয়ে আছে। কিন্তু আমি উত্তর না দিয়ে বললাম,
“বাবা ইদানীং খুব নাক ডাকে। আপনার কি জানা আছে নাক ডাকা রোগ নিরাময়ের উপায় কী?”

আমি প্রশ্নের উত্তর না দেওয়ায় জাবির ভাই খুশি হলো না। অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নিয়ে আমাকে অবহেলা করার চেষ্টা করে বললো,
“চলে যাও, চলে যাওয়া খুব বেশি জরুরি না হলেও।”

জাবির ভাই কি কষ্ট পাচ্ছে? আমার মন খারাপ হলো। মানুষটা আমাকে সত্যিই পছন্দ করে। কিন্তু আমি তাকে সেরকম ভাবে কখনও পছন্দ করতে পারবো না। তাকে আর বিরক্ত করলাম না। আমার উপস্থিতি হয়তো তাকে আরও বেশি কষ্ট দেবে।

___________________

জনাব ইমাইদ হাসানের সঙ্গেই আপুর বিয়ের প্রসঙ্গ এগোচ্ছে। আজ বিকেলে তার পরিবারের লোকজন এসে আনুষ্ঠানিক ভাবে আংটি পরিয়ে গিয়েছে। আপুকে ভীষণ খুশি খুশি দেখায় ইদানীংকাল। এখানে সম্বন্ধ হওয়ায় ও দারুণ খুশি। ভেবেছিলাম বাবার বিয়েটা হয়তো আগে খাওয়া হবে, কিন্তু তার আগে বাবার মেয়ের বিয়ে খাবো। বাবা যে শর্তাবলি রেখেছে তাতে বাবার জন্য পাত্রী কি পাওয়া যাবে? মনে হচ্ছে না খুব শীঘ্রই পাওয়া যাবে। কয়েকদিন ধরে লক্ষ করে বুঝলাম বাবা নিজের জন্য পাত্রী না দেখে মেয়ের বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ওদিকে বাবাকে আমি যে পাত্রীর কথা বলেছিলাম সে পাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে। যদিও বাবার সে পাত্রী পছন্দ হতো না, কারণ সে পাত্রী ফর্সা ছিল। বাবা তো শর্ত রেখেছে পাত্রীকে শ্যাম বর্ণের হতে হবে।

সন্ধ্যা থেকেই আপু তাশরীফকে নিয়ে গজগজ করছে।
“ও আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করেছে তাই না? আমাকে অবহেলা করছে তাই না? এখন কী হলো? ওকে কী প্রয়োজন আমার? আল্লাহর রহমতে ওর চেয়ে অনেক সুন্দর একজনকে পেতে চলেছি ইনশাআল্লাহ।”

আপু কিছুক্ষণ একা বকবক করার পর হঠাৎ কল দিলো তাশরীফের কাছে। না ও সচরাচর যে সিম ব্যবহার করে সে সিম দিয়ে দিলো না। মোবাইলে থাকা অন্য নতুন একটি সিম দিয়ে কল দিলো।
ভেবেছিলাম রাগের বশে তাশরীফকে অনেক কিছু বলবে। গালিও হয়তো দেবে। কিন্তু ও খুব শান্ত ভাবেই কথা বললো। তারপর যে কথাটুকু বলার জন্য আসলে কল দিয়েছে সেই মূল কথাটুকু বললো,
“কী ভুল ছিল আমার? আমার বাবা বিয়ে করবে বলে আমাকে ছেড়ে গেছো, তাই না? সে বিয়ে করবে তাতে কী হয়েছে? এই কারণে তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে? হ্যাঁ, ভালো করেছো ছেড়ে গেছো। হয়তো এমনই হওয়ার ছিল। ভালো একজনকে জীবনে পেয়েছি আমি। খুব শীঘ্রই আমার বিয়ে। বিয়েতে এসো প্লিজ, আমার বরকে দেখে যেয়ো।”

আপু আর কিছু না বলে কল কাটলো। আমি দেখলাম ও কাঁদছে। কান্নাটা কি তাশরীফের কারণে? না কি ভালো একজনকে জীবনে পেতে চলেছে তাই? এটাকে কী যেন বলা হয়? হ্যাঁ, আনন্দ অশ্রু। আপুর চোখে এখন যা আছে তা কি তবে আনন্দের অশ্রু?
আমার চোখ বেয়েও অশ্রু নামলো। তবে তা মোটেই আনন্দের নয়, ভীষণ দুঃখের। আপু এই বাড়ি থেকে চলে গেলে আমি আর বাবা কীভাবে থাকবো? কে বকাবকি করবে আমাদের?

_____________________

ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে। তবে বাতাস, বজ্রপাত যে হচ্ছে না তাতেই রক্ষা। পরনের সেলোয়ার হাঁটু পর্যন্ত ভিজি ভিজি করছে। পানি জমেছে রাস্তায়। একটা গাড়ি আমার পাশ কাটিয়ে চলে গেল। গাড়িটা খুব দ্রুত গতিতে যাচ্ছিল বলে রাস্তার নোংরা পানি ছিটকে এলো আমার গায়ে। চোখ-মুখ কুঁচকালাম। কথাও শোনালাম একটা-দুটো। যদিও গাড়ি চালক শুনেছে বলে মনে হয় না।
একটা রিকশা এসে থামলো আমার সামনে। রিকশায় সেজান ভাইয়া বসা। প্রথমে তাকে খেয়াল করিনি। যখন সে ডাকলো তখন খেয়াল করলাম।

“সেতু…”

আমি তাকাতেই সে বললো,
“রিকশায় ওঠ। একসাথে যাই।”

আমি আর সেজান ভাইয়া কখনও এক রিকশায় চড়িনি। একদিন খুব প্রয়োজন ছিল একটা রিকশার, তাকে বলেছিলাম তার ঠিক করা রিকশায় আমাকে একটু স্থান দিতে। কিন্তু সে দেয়নি। বলেছিল,
‘হেঁটে হেঁটে যা। ছোটো মানুষদের রিকশায় চড়তে হবে কেন? পায়ে শক্তি নেই? এই বয়সে হেঁটে হেঁটে মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিবি তা না!’

আজ তার এত উদারতার মানে সত্যিই বুঝতে পারছি না আমি। তার সাথে এক রিকশায় বাড়ি ফিরতে আগ্রহ বোধ করছি না। তাই বললাম,
“রিকশার প্রয়োজন নেই। আমার পায়ে শক্তি আছে। আমি হেঁটেই যেতে পারবো।”

সে চোখ গরম করে তাকালো,
“কথা শুনছিস না কেন? ওঠ বলছি।”

আমি উঠলাম। বসা মাত্রই সে বললো,
“তোর বোনের না কি কদিন পরে বিয়ে?”

“এসব জানবে বলে রিকশায় উঠতে বলেছো? কী করবে বিয়ে ভাঙবে আমার বোনের?”

“আশ্চর্য! বিয়ে ভাঙবো কেন? ও বিয়ে করলে আমার কী তাতে?”

“তোমার বিয়ে কবে?”

“হবে।”

“কবে?”

“তোকে বলতে হবে?”

“নীলিমাকেই বিয়ে করবে?”

“না।”

“তাহলে কাকে?”

“তোকে কেন বলবো? বিয়ে যখন করবো তখন দেখতে পাবি।”

মন খারাপ হয়ে গেল আমার। সেজান ভাইয়ার কি তবে পছন্দের মানুষ আছে? যদি একদিন হঠাৎ করে কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করে নিয়ে এসে বলে, ‘সেতু, দেখ তো তোর ভাবি সুন্দর কি না।’ তখন আমি কী করবো? আমার চোখ ভিজে উঠলো। সেজান ভাইয়া কি সত্যিই এমন সাংঘাতিক কিছু করবে? পর মুহূর্তে মনে হলো, না, সেজান ভাইয়ার জীবনে এমন কিছু হওয়ার সম্ভাবনা বোধ হয় নেই। কারণ তার জীবনে…

“আচ্ছা, তোর বোনের বিয়েতে কী উপহার দেওয়া যায় বল তো?”

তার প্রশ্নে ভাবনা কাটলো। বললাম,
“বিছানার চাদর।”

সে বিপুল বিস্ময়ে বললো,
“বিছানার চাদর? এটা একটা গিফট হলো?”

“হলো না কেন? বিছানার চাদরে লেখা থাকবে ‘Don’t forget me’, বা বাংলাতে ‘ভুলো না আমায়’।”

“এসব হাবিজাবি লেখা চাদর আমি উপহার দেবো কেন? আমি পাগল না কি তোর বোন পাগল?”

“পাগল হলে তুমিই হবে, আপু খুব বুদ্ধিমান।”

“পাগল তো তুই, তাই এরকম ফালতু উপহারের আইডিয়া দিচ্ছিস। আমার কি মনে হয় জানিস? তোর মাথায় নাইনটি পার্সেন্ট হচ্ছে ফাঁকা অংশ, আর টেন পার্সেন্ট ঘিলু।”

আমি আর কথা বললাম না। একটা নাটকে দেখেছিলাম সাবেক প্রেমিকার বিয়েতে Dont forget me লেখা বিছানার চাদর উপহার দিতে, সেটাই বললাম তাকে।
রিকশা বাড়ির সামনে থামলো। সেজান ভাইয়া আমার হাত থেকে ছাতাটা নিয়ে নেমে গেল। বললো,
“পঞ্চাশ টাকা ভাড়া, দিয়ে দিস।”

বলে সে বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেল। আমি হতবিহ্বল হয়ে গেলাম। মানে কী? সেজান ভাইয়া কি আমার ঘাড়ে নিজের ভাড়া চাপিয়ে দেবে বলে নিয়ে এসেছে? আমি বুঝতে পারলাম, এটাই তার উদ্দেশ্য ছিল। কী খারাপ মানুষ! ভাড়া না দিয়েও এখন উপায় নেই। আমি ভাড়া দিয়ে রিকশা থেকে নামলাম। সেজান ভাইয়া ছাতাটাও নিয়ে গেছে, রিকশা থেকে নামতেই ভিজে যেতে হলো তাই। আমি দৌড়ে বাড়ির ভিতর ঢুকলাম। দেখলাম সে আমার ছাতাটা কাদার ভিতর ফেলে রেখেছে।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে