#নীল_জোছনায়_ভাসি (০৬)
#লেখা: ইফরাত মিলি
___________________
“কাদা উঠানে চিহ্ন তো পড়বেই জাবির ভাই।” কথাটা বলে আমি হেসে ফেললাম।
জাবির ভাই নিরাশ হলো। কারণ সে ভাবছে আমি তার কথার মানে বুঝতে পারিনি। কিন্তু আসলে তো আমি বুঝেছি।
জাবির ভাই ছাতা আর বোতল উঠিয়ে নিলো। কল চেপে ধুয়ে নিলো শরীরের সমস্ত কাদা। তারপর উপরে চলে গেল। আমিও যাচ্ছিলাম। সিঁড়িতে পা রাখতেই সুমনা চাচি ডাকলো। পাকন পিঠা দিলো এক বাটি। জিজ্ঞেস করলাম,
“তোমার ছেলের বিয়ে কবে?”
চাচি হাসলো। বললো,
“সব ঠিক থাকলে হবে ইনশাআল্লাহ। দোয়া কর, যেন তাড়াতাড়ি ওর বিয়েটা দিতে পারি।”
চাচির হাসি মুখ দেখে আমার ভালো লাগলো না। মনে চিন্তা ভিড় করলো, যদি সত্যিই বিয়েটা হয়ে যায়? আমি দোয়ার বদলে বদদোয়া করলাম যেন সেজান ভাইয়ার বিয়ে ওই নীলিমা মেয়েটার সঙ্গে না হয়।
___________________
তাশরীফ নামের যে ছেলেটাকে আপু বাড়িতে নিয়ে এসেছিল, সে ছেলেটার সঙ্গে আপুর সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না ইদানীং কাল। ছেলেটা এখন আর আপুকে কল দেয় না, দেখাও করে না। এসবের মূল কারণ বাবার বিয়ে। সে জানতে পেরেছে বাবা বিয়ে করার জন্য পাত্রী দেখছে, তারপর থেকেই এরকম আচরণ শুরু করেছে। আপু নাওয়াখাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে প্রায়। সারাটা দিন মনমরা হয়ে থাকে। একদিন সকালে বাবার সাথে রাগারাগি হলো ওর।
“তোমার জন্য হলো এসব, তোমার পাগলামির জন্য। তাশরীফ ভালো ছেলে ছিল। ওর সাথে বিয়ে হলে আমি ভালো থাকতাম। বিয়ে বিয়ে করে তুমি সব নষ্ট করলে। তুমি কী চাও? চাও কী তুমি?”
আপুর চেহারা লাল হয়ে উঠেছে। রাগ করলে মাঝে মাঝে ওর চেহারা লাল হয়ে যায়।
বাবা বললো,
“তুই কি ব্লাইন্ড হয়ে গেছিস রূপকথা? ঠোঁট দেখিসনি ছেলের? ও সিগারেট খায়। আমি আমার মেয়েকে কখনোই একটা সিগারেট খোর ছেলের সাথে বিয়ে দেবো না।”
বাবার এ কথায় আমার কপালে ভাঁজ পড়লো। সেজান ভাইয়াও যে সিগারেট খায়! আর শুধু সিগারেট না, সে তো এর পাশাপাশি আরও অনেক কিছু খায়। বাবা কি তাহলে তার সাথে আমার বিয়ে দেবে না?
“সিগারেট আজকাল কে না খায়? অধিকাংশ মানুষই সিগারেট খায়।” আপু জবাব দিলো।
“যে ছেলে সিগারেট খায় না, আমি সেই ছেলের সঙ্গে তোর বিয়ে দেবো।”
আপু কিছু বললো না। কেমন এক বিদঘুটে চাহনিতে বাবাকে দেখলো।
বাবা বললো,
“তাছাড়া ও একটা মিথ্যুক। সেদিন কী বলে গেল? ও না কি দাদা বাড়ি যাবে। সব মিথ্যা। মিথ্যা ছুতো দিয়ে চলে গেছে সেদিন। আসলে তো ও দাদাবাড়ি যায়নি।”
“মিথ্যা ছুতো দিয়ে যাবে না তো কি তোমার আজেবাজে কথা শোনার জন্য বসে থাকবে?” আপুর চোখে হঠাৎ অশ্রু দেখা গেল। কাঁদো কণ্ঠে বললো,
“এটা কী করলে বাবা? যা হলো ভালো হলো না।”
বাবা সন্দিহান চোখে তাকালো,
“তুই কি ওকে ভালোবাসিস?”
আপু উত্তর দিলো না।
বাবা বললো,
“আমার মেয়ে হয়ে তুই ওই চাইনিজ বয়কে কীভাবে ভালোবাসতে পারিস?”
আপু আবার কেঁদে উঠলো। বললো,
“বাবা, ও চাইনিজ নয়।”
বাবা চিন্তায় পড়লো। চাইনিজ না হলে ও ছেলে কী? একটুক্ষণ ভেবে বললো,
“কোরিয়ান কিংবা জাপানিজও হতে পারে। তুই কি ভেবেছিস কোরিয়ান, জাপানিজ হলে ওকে আমি মেনে নেবো? ওই ছেলের সাথে তুই জীবন কাটাতে পারবি না। সবার সাথে জীবন কাটানো যায় না…”
বাবা এখন জ্ঞান দেওয়া শুরু করবে, আপু সেটা বোঝা মাত্রই কোনো কথা না বলে উঠে চলে গেল।
কথার মাঝখানে উঠে যাওয়ায় বাবা নিরাশ হলো।
“মেয়েটা একদম মায়ের মতো হয়েছে!” বলে আমার দিকে তাকালো,
“তোর মা’ও কথার মাঝে এভাবে চলে যেত। এটা ভালো স্বভাব নয়। তুই কখনও এমন স্বভাবধারী হবি না।”
আমি অকস্মাৎ বাবাকে প্রশ্ন করলাম,
“মায়ের নাকও তো বোঁচা ছিল বাবা, তাহলে নাক বোঁচা মেয়ে বিয়ে করতে সমস্যা কোথায়?”
বাবা প্রশ্ন শুনে নীরব হয়ে গেল।
প্রশ্নটা করে কি বাবার মন খারাপ করে দিলাম? বাবা দুঃখ পেলে আমিও দুঃখ পাবো। আমি ধরে নিয়েছিলাম বাবা কোনো উত্তর দেবে না, কিন্তু সে উত্তর দিলো। খুব শান্ত স্বরে ডাকলো,
“সেতু, জীবনে এমন কিছু বিষয় আছে যা একবার জীবনে আসাই উত্তম।”
আমার চোখে অশ্রু জমলো। কেন যেন খুব কষ্ট অনুভব হচ্ছে। জানতে চাইলাম,
“মাকে অনেক মিস করো তাই না?”
“হঠাৎ মায়ের কথা তুলছিস কেন?”
আমি আর মায়ের প্রসঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছি না। বেশি কিছু বলতে গেলে বাবা কেঁদে ফেলবে! বাবার অশ্রুসজল চোখ দেখা মর্মচ্ছেদী ব্যাপার হবে আমার জন্য।
_____________________
এই মুহূর্তে আমি একটা দৃশ্য দেখছি। দৃশ্যটা দেখছি আমার রুমের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে। আপু ছাত্র পড়াতে যাচ্ছিল, বাড়ির সম্মুখে হঠাৎ সেজান ভাইয়ার সাথে দেখা। এখন ওদের মাঝে বাক্য বিনিময় চলছে। না ‘বাক্য বিনিময়’ শব্দ দুটো ঠিক যাচ্ছে না, এর থেকে কথা কাটাকাটি বললে ব্যাপারটা মানানসই হয়। সেজান ভাইয়ার দুটো লাল গোলাপের গাছ আছে। আজ সকাল থেকে সেই গাছ থেকে মোট তিনটি ফুল মিসিং হয়ে গেছে। সকালবেলা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আমি ফুলগুলো নিয়েছি কি না। আমি নিইনি। আমি জানতাম না গাছ সে লাগিয়েছে, ভাবতাম জেবিন লাগিয়েছে। কারণ সেজান ভাইয়া ফুল গাছ লাগানোর মতো মানুষ নয়। যখন জানতে পারলাম সে লাগিয়েছে তখন বেশ অবাকই হয়েছি। আমার খুব ভালো লাগছে আপু এবং তার ভিতর চলমান ঝগড়াটুকু।
“তুই নিসনি তাহলে কে নিয়েছে? এই বিল্ডিংয়ের ভিতর তুই-ই সেরা চোর। আমি কি ভুলে গেছি ছোটোবেলার কথা? আমাকে নিয়ে রফিক মামার বাড়িতে লেবু চুরি করতে যাসনি? এই চোর তুই ছাড়া আর কেউ না। তিনটা ফুল নিয়েছিস, তিনটা ফুলের দাম তিনশ টাকা। ত্রিশ টাকা ছাড় দিলাম। দুশো সত্তর টাকা দে।”
“আজেবাজে কথা বলিস না সেজান, মে’রে হাড্ডি ভে’ঙে ফেলবো কিন্তু। কে চুরি করেছে? আমার কী ঠ্যাকা পড়েছে ফুল চুরি করার, তাও আবার তোর গাছ থেকে। মানহানির মামলা করে দেবো কিন্তু।”
“কর মামলা, দেখি কে জিতে, একজন চোর না কি একজন ভালো মানুষ।”
আপু হেসে ফেললো,
“তুই ভালো মানুষ? খু’নের দায়ে হাজতে গিয়েছিলি তা কি সবাই ভুলে গেছে?”
“আমি খু’ন করিনি আর হাজতেও যাইনি। হাজতে যাবি তো তুই, চুরির দায়ে।”
“আমার মেজাজ কিন্তু এখন সত্যিই অনেক খারাপ হয়ে যাচ্ছে সেজান।”
“টাকা দে জলদি।”
“ধুর!” আপু বিরক্তিতে শব্দটা উচ্চারণ করে সেজান ভাইয়াকে ঠ্যালা মে’রে চলে গেল।
সেজান ভাইয়া বলে উঠলো,
“ত্রিশ টাকা ছাড় দিয়েছিলাম, এখন সেটাও দেবো না। তিনশ টাকাই আদায় করে ছাড়বো। তুই দিবি না হলে তোর বাপ দেবে।”
মাঝে মাঝে ওদের ঝগড়া দেখলে মনে হয় ওদের ভিতরকার সম্পর্কটা এখনও শেষ হয়নি। ভালোবাসা থাকলেই এমন দুষ্টুমিষ্টি ঝগড়া হওয়া সম্ভব। কিন্তু ওদের ভালোবাসার অনেক আগেই ইতি ঘটে গেছে। আমার সন্দেহ হলো, ওদের ভিতর আসলেই কি ভালোবাসা ছিল? আমি জানি ভালোবাসার কখনও ইতি ঘটে না। তাহলে কি ওদের মাঝে প্রকৃত ভালোবাসা ছিল না? কী জানি। আমার এসব নিয়ে ভাবার কিছু নেই। আমি যেটা ভাবছি সেটা হলো, কদিন পর সেজান ভাইয়ার ফুল গাছ দুটোও চুরি হয়ে যাবে। ফুল কে চুরি করেছে জানি না, তবে গাছ চোর আমি হবো।
রুমে এসে তৈরি হয়ে নিলাম। কালো রঙের একটা থ্রি পিস পরে মুখে ক্রিম আর হালকা পাউডার মেখে নিলাম। আমার সাজ এই পর্যন্তই। ওড়নাটা দিয়ে মাথায় এক প্যাঁচ দিয়ে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। জুতোর ফিতা বাঁধছিলাম সদর দরজার সামনে বসে। জাবির ভাই এসে সামনে দাঁড়ালো। কিছু বললো না। আমি দাঁড়ানোর পর বললো,
“কালো রং কেন পরেছো মিস তুতু? কালো রং শোকের প্রতীক জানো না? আজ তো একুশে ফেব্রুয়ারি নয়।”
আমি তার কথায় অবাক হলাম। কালো রং শোকের প্রতীক বলে কি কালো রং পরা যাবে না? এটা কেমন আজব কথা! লোকটা কি জ্বরের ঘোরে আবোল-তাবোল বকতে শুরু করেছে? জিজ্ঞেস করলাম,
“আপনার না কি জ্বর এসেছে?”
জাবির ভাই হাসলো। এমনভাবে হাসলো যেন জ্বর আসা কোনো লজ্জার ব্যাপার।
আমি অবাক হয়ে বললাম,
“হাসছেন কেন?”
সে মুখ গম্ভীর করে বললো,
“এখন ঠিক আছে?”
“না, ঠিক নেই। আপনি মানুষটাই গোলমেলে।”
জাবির ভাই মন খারাপের ভাণ করে বললো,
“এই গোলমেলে মানুষটার কেন জ্বর আসে বলো তো? জ্বর কি জানে না এই গোলমেলে মানুষটার জ্বর এলে কপালে হাত রাখার কেউ নেই?”
এ কথা বলার পর হঠাৎ আবার বললো,
“মিস তুতু, তুমি কি আমার কপালে একবার হাত রাখবে?”
অপ্রস্তুত হলাম তার কথায়। চকিতে হাত দুটো পিছনে সরিয়ে ফেললাম। তা দেখে সে হাসলো। বললো,
“কপালে হাত রাখার মানুষ থাকলে আমিও চাইতাম জ্বর আসুক, কিন্তু এখন আমি এই বেয়াদব জ্বরটাকে একদম সহ্য করতে পারছি না।”
সে আর কিছু বললো না। আমাকে অতিক্রম করে চলে গেল।
নিচ তলায় এসে দেখলাম দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে সুমনা চাচি ও আনাম ভাইয়া কথা বলছে। আনাম ভাইয়াকে দেখলেই এখন লজ্জা লাগে আমার। সে আমাকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে নিজের ছাতা দিয়েছিল, অথচ তার সেই ছাতাও বাতাসের কারণে ভেঙে গেছে। আমি অবশ্য তাকে নতুন একটা ছাতা দিয়েছিলাম, কিন্তু সে নেয়নি। বলেছে,
“ছাতাটা তুমি নাওনি, আমি দিয়েছি। ছাতাটা তুমি ভাঙণি, বাতাসে ভেঙেছে। যখন তুমি কিছুই করোনি, তাহলে নতুন ছাতা কেন দেবে? ওই ভাঙা ছাতাটাই আমি চাই।”
এরপর আমি তাকে তার ভাঙা ছাতাটা ফেরত দিয়ে দিয়েছি। আসলেই তার ছাতা ভেঙেছে এতে আমার কোনো দোষ নেই। কিন্তু তবুও নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। সে চাচির সাথে কথা শেষ করে চলে যাচ্ছিল। আমার অপরাধী মন মুখ খোলালো আমার,
“আনাম ভাইয়া, আপনার ছাতা কিন্তু সত্যিই আমি ভাঙিনি।”
আনাম ভাইয়া দাঁড়ালো। পিছন ফিরে তাকিয়ে বললো,
“বাতাসে ভেঙেছে।”
“আপনি নতুন ছাতাটা নিয়ে নিন।”
আনাম ভাইয়া মৃদু হাসলো, কিছু বললো না। চলে গেল।
(চলবে)