#নীল_জোছনায়_ভাসি (০৪)
#লেখা: ইফরাত মিলি
___________________
দিন বিদায় নিচ্ছে। চারিদিকে ঘনিয়ে আসছে অন্ধকার। এরই মধ্যে বিল্ডিংয়ের তিনটা ফ্লোরেই জ্বলে উঠেছে বাতি। নিচে কল চাপার শব্দ হচ্ছে। নিশ্চয়ই গোসল করছে সেজান ভাইয়া। আপু এসে পৌঁছবে আরও কিছুক্ষণ পর। ঘরে আমি একা। মাঝে মাঝে একা থাকতে খারাপ লাগে, আবার মাঝে মাঝে মনে হয় একা থাকাই আনন্দের। আসলে একা থাকার মাঝে কোনো আনন্দ নেই। কী করে সময় কাটানো যায় ভাবছি। কেক বানিয়ে সময় কাটানো যায়।
আমাদের ঘরে বিটার আছে। কিন্তু আমি সব সময়ই একটু ব্যতিক্রম। বিটার দিয়ে ডিম বিট না করে কাঁটাচামচের সাহায্যে ডিম বিট করছি। এটা যেমন পরিশ্রমের কাজ, তেমনি সময়ের ব্যাপার আছে।
কিছুক্ষণ বিট করার পর আমার হাত ব্যথা হয়ে গেল। কিন্তু এখনও ফোম তৈরির ধারে কাছে যেতে পারিনি।
কলিং বেলের শব্দ হলো। তার মানে আপু এসে গেছে।
আমি দরজা খুলে দিয়েই বুঝতে পারলাম আপু রেগে আছে কোনো কারণে। ও রাগ করলে আমি বুঝতে পারি। কম রাগ করলেও, বেশি রাগ করলেও। আপু বেশিই রাগ করে আছে এখন। ভিতরে ঢুকে সোফায় বসে পড়লো ও। আমি চিন্তিত বোধ করছি। কী কারণে আপু এত রাগ?
দরজার ছিটকিনি আটকে আপুর সামনে এসে দাঁড়ালাম।
“কী হয়েছে আপু?”
“কিছু হয়নি, তুই যা।”
আপু এ কথাটাও বললো রাগ কণ্ঠে। অথচ বলছে কিছু হয়নি। আপুকে আর কিছু বলার সাহস হলো না আমার। রান্না ঘরে চলে এলাম। ডিম বিট করার জন্য কাঁটাচামচ ধরতেই অমনি আপু ডাকলো,
“সেতু, এদিকে আয়।”
আমি তড়িৎ পায়ে ছুটে এলাম। আমি আসতেই আপু উঠে দাঁড়ালো।
“কাছে আয়।”
আমি সরল মনে কাছে গেলাম। আপু ঠাস করে একটা চ’ড় বসিয়ে দিলো আমার গালে! আমি ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারলাম না। অবাক হয়ে তাকালাম।
আপু বললো,
“পেয়ারা তলায় যাস জাবিরকে দেখতে? এত জঘন্য হয়ে গেছিস? ছি! মানুষজন এখন আমাকে ধরে ধরে বলছে, তোর বোন জাবিরকে দেখতে পেয়ারা তলায় গিয়ে বসে থাকে। আর কখনও যদি পেয়ারা তলায় যাস মে’রে ঠ্যাং ভে’ঙে দেবো। তখন ওই জাবির-ফাবির কেউ আসবে না তোর ভাঙা ঠ্যাং দেখতে।”
আপু এক শ্বাসে কথাগুলো বলে রাগে ফুঁসতে লাগলো।
আমি বুঝতে পারলাম না আপু এসব কার কাছে শুনে এসেছে। আমার চোখে পানি এসে গেল। কান্না চোখে জানতে চাইলাম,
“তোমাকে কে বলেছে এসব?”
“যে দেখেছে সে বলেছে। আমার জীবনে এত খারাপ দিন এসে গেছে যে এখন ওই সেজানও আমাকে কথা শোনাবে? তোর কারণে আজ এসব শুনতে হলো।”
“সেজান ভাইয়া বলেছে?”
আমার খুব মন খারাপ হলো, সাথে রাগ। সেজান ভাইয়া আপুকে এই মিথ্যা কথাটা বলতে পারলো? আমি জাবির ভাইকে দেখার জন্য পেয়ারা তলায় গিয়ে বসে থাকি? সে কতদিন দেখেছে আমাকে এমন করতে?
আপু আরও কিছু বলতে উদ্যত হলো। কিন্তু আমি তা না শুনেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। আমি এখন অনেকক্ষণ কাঁদবো। আর আমার কাঁদার জন্য সবচেয়ে ভালো স্থানটি হলো ছাদ।
কিন্তু ছাদে এসেও শান্তি পেলাম না। সেজান ভাইয়া আগে থেকেই ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। সিগারেট টানছিল। পায়ের শব্দ শুনতে পেয়েই তাকালো আমার দিকে। হাতের সিগারেটটা ফেলে দিলো ছাদ থেকে। আমার দিকে চেয়ে হেসে বললো,
“কেমন আছিস?”
আমি তার দিকে তেড়ে গিয়ে বললাম,
“আমি জাবির ভাইকে দেখার জন্য পেয়ারা তলায় গিয়ে বসে থাকি?”
“উহুঁ একদম না। কে বললো এসব?” সেজান ভাইয়ার গলায় বিস্ময়ের ছাপ।
“তুমি বলেছো। আপুকে কেন বলেছো এসব? তুমি দেখেছো আমাকে অমন করতে?”
“দেখিনি? আজই তো দেখলাম। ওর দিকে বার বার তাকাচ্ছিলি।”
“বার বার কোথায়? মাত্র দুই বার তাকিয়েছি। তাই বলে কি আমি ওনাকে দেখার জন্য যাই?”
সেজান ভাইয়া হাসলো। বললো,
“রূপকথা মে’রেছে?”
আমি কেঁদে ফেললাম। বললাম,
“তুমি একটা বাজে মানুষ!”
এ কথা শুনেও হাসলো সেজান ভাইয়া। আগের চেয়ে দীর্ঘ হাসি। তারপর হঠাৎই তার হাসি নিভে গেল। ভীষণ নিবিড় গলায় বললো,
“একটা ব্যাপার খেয়াল করেছিস সেতু? তোকে দেখা মাত্রই আমি সিগারেট ফেলে দিয়েছি। কেন ফেললাম বল তো?”
আমার কান্না থেমে গেল। আসলেই তো তাই। জানতে চাইলাম,
“কেন ফেলে দিয়েছো?”
“সেটাই তো, ফেললাম কেন? আমিও জানি না। শুধু মনে হলো, ফেলে দিই।”
সেজান ভাইয়া দূরে সরে গেল। অনেক দূরে। কিন্তু আমি ওই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলাম। এক সেকেন্ড থেকে এক মিনিট, তারপরও অনেক সময়। আমার তাকে বলতে ইচ্ছা হলো,
‘কেন শুনলে আমার কথা? আমি তো তোমার বউ কিংবা বোন নই।’
কিন্তু কিছু বললাম না। চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিচে এলাম। আমার কিছুক্ষণ আগের কিছুই মনে রইল না। আমি একদম আগের মতো। কেক বানিয়ে ফেললাম। আপুর রুমে নিয়ে গেলাম আপুকে খাওয়াতে। কেকের পিরিচ রেখে যখন চলে আসা দিলাম আপু বললো,
“বেশি ব্যথা পেয়েছিস সেতু?”
আমি হেসে বললাম,
“কম ব্যথা পেলে কি বেশি ব্যথা পাওয়ার ব্যবস্থা করবে?”
আপু হতাশার গলায় বললো,
“এমন কেন করিস বল তো? তোকে তো নিষেধ করেছি জাবিরের সাথে কথা বলতে। যদি শুনি তুই জাবিরকে দেখার জন্য ওখানে যাস তাহলে আমার মেজাজ খারাপ হবে না? বল।”
“হবে।”
“তাহলে? একটা কথা শোন সেতু, কাউকে পছন্দ করতে হলে হয় তার চেহারা সুন্দর হতে হয়, আর না হলে আর্থিক অবস্থা সুন্দর হতে হয়। বুঝেছিস?”
“সেজান ভাইয়াকে তাহলে কেন পছন্দ করেছিলে? সে তো জাবির ভাইয়ের চেয়ে খুব বেশি সুন্দর না, আর খুব বেশি ধনীও না।”
আপুর মুখ হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। রাগান্বিত কণ্ঠে বললো,
“তুই যাবি? না থা’প্পড় খাবি?”
আমার থা’প্পড় খেতে ইচ্ছা হলো না, আমি চলেই এলাম।
কেউ একজন দরজা ধাক্কাচ্ছে। আমি ভালো করেই বুঝতে পারলাম বাবা এসেছে। কারণ একমাত্র বাবাই কলিং বেল না চেপে এরকমভাবে দরজা ধাক্কায়। তাও এত জোরে ধাক্কায় মাঝে মাঝে ভাবী বাবার এমন ধাক্কানোর ফলে দরজাটা একদিন খুলে পড়ে যাবে। দৌড়ে এসে দরজা খুললাম। বাবা ভিতরে এসে বসলো। তার হাতে দুটো ব্যাগ দেখতে পেলাম। আমাকে বললো,
“এক গ্লাস গরম পানি নিয়ে আয় তো সেতু।”
গরম পানি? বাবা কি ঠান্ডা পানির বদলে গরম পানি বলে ফেললো? আমি প্রশ্ন করবো ভাবলাম, আবার করলাম না। রান্না ঘরে গিয়ে ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি বের করে নরমাল পানির সাথে খানিকটা মিশিয়ে নিয়ে এলাম। বাবা খেলো। গরম পানি নিয়ে আর কিছু বললো না।
বাবা ব্যাগের ভিতর থেকে লাল খয়েরি রঙের একটা শাড়ি বের করে বললো,
“শাড়িটা কেমন?”
আমি বললাম,
“ভালো। নতুন মায়ের জন্য?”
“আরে না, তোর জন্য।”
আমি বিস্মিত হলাম। বাবা আমার জন্য শাড়ি এনেছে?
হাসি মুখে শাড়িটা নিলাম। বাবার কাছ থেকে এটাই প্রথম পাওয়া শাড়ি। আপুর জন্যও একটা শাড়ি এনেছে। আপুরটা লাল রঙের। তবে আমি হঠাৎ করে বাবার শাড়ি উপহারের কারণ বুঝতে পারছি না। তবে আমার বাবা মি. আনিস উল্লাহর কোনো কিছু করতে খুব কমই কারণ লাগে।
__________________
সকাল সাতটা। আমি ও বাবা কলার ফেসপ্যাক মুখে দিয়ে বসার ঘরে বসে আছি। আপু এখনও ঘুম থেকে ওঠেনি। উঠে আমাদের এরকম দেখলে রোজকার মতো একটু চ্যাঁচামেচি করবে। বাবা চোখে দুটো শসার পিসও দিয়ে রেখেছে। আমি দিইনি। ফেসপ্যাক দিয়ে কথা না বলাই ভালো। কিন্তু আমার কথা না বলে থাকতে ভালো লাগছে না। অনেকক্ষণ তো হলো চুপ করে আছি। ফেসপ্যাকও প্রায় শুকিয়ে এসেছে। বাবাকে ডাকলাম,
“বাবা।”
বাবার সাড়াশব্দ নেই। ঘুমিয়ে গেছে? এবার একটু জোরেই ডাকলাম,
“বাবা।”
বাবা ধরফড়িয়ে উঠলো। শসা পড়ে গেল চোখ থেকে। বললো,
“চোর এসেছে? হ্যাঁ রে চোর এসেছে না কি?”
“দিনের বেলা তোমার ঘরে চুরি করতে আসবে এমন বুকের পাটা কোনো চোরের আছে?”
বাবা আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বললো,
“ও এখন দিন?”
“করিম চাচা নতুন পাত্রী দেখেছে?”
“না। ও ব্যাটা মুখেই শুধু ফটর ফটর বুঝলি? আসলে কোনো কাজের না।”
“তাহলে অন্য ঘটক দেখছো না কেন?”
“অন্য ঘটক দেখলে করিম ভাই মনে দুঃখ পাবে না?”
আমি মাথা নেড়ে বললাম,
“তা অবশ্য পাবে।”
দরজার বাইরে থেকে কেউ ডাকলো। সুমনা চাচির গলা। বাবা যেমন কলিং বেল চাপে না, তেমনি সুমনা চাচিও না। এক্ষেত্রে দুজনের ভিতর পার্থক্য হলো- একজন দরজা ধাক্কিয়ে দরজা ভাঙার জোগাড় করে, অন্যজন ডেকে ডেকে নিজের আগমনের উপস্থিতি জানায়।
আমি দরজা খুলতেই চাচি বললো,
“এটা কী মেখেছিস?”
“কলার ফেসপ্যাক। খুব ভালো জিনিস। তুমি মাখবে?”
“আমার কি এসব মাখার বয়স আছে?”
“থাকবে না কেন? বাবাও তো মাখছে।”
“ও মা! তাই না কি?”
“হ্যাঁ, দেখবে? ভিতরে এসো।”
সুমনা চাচি ভিতরে এলো। বাবাকে একবার দেখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
“দেখে তো ভালো জিনিসই মনে হচ্ছে।”
বাবা বললো,
“ভালো জিনিস মানে, দারুণ ভালো।”
আমি আর বাবা দেওয়ার পরও অনেকখানি ফেসপ্যাক রয়ে গেছে। বাবা ফেসপ্যাকের বাটিটা চাচির হাতে দিয়ে বললো,
“এই নাও, ঘরে গিয়ে লাগাবে, দেখবে কদিন পর নিজেকেই নিজে চিনতে পারবে না।”
চাচি খুশি হয়ে বাটিটা নিলো। আমার কাছে এসে বললো,
“সেতু, বিকেলে আমার সঙ্গে এক জায়গায় যাবি?”
“কোথায়?”
“সেজানের জন্য পাত্রী দেখতে।”
বুকের ভিতরে যাতনা অনুভব করলাম! কিন্তু সেজান ভাইয়ার জন্য পাত্রী দেখা এটা নতুন কিছু নয়।
“আমার যেতে হবে কেন?”
“একা একা যেতে কি ভালো লাগবে? জেবিন গেছে মামার বাড়ি। তোর চাচা রাতের আগে ফিরবে না। মেয়ের বাড়ি বেশি দূর নয়। আমাদের বাড়ি থেকে সাতটা বাড়ি রেখেই। নাম নীলিমা। তুই চিনিস?”
“না।”
“করিম ভাই বললো খুব সুন্দর মেয়ে। আমি দেখিনি। কী আশ্চর্য! সাতটা বাড়ি রেখেই অথচ দেখিনি! তুই যাবি না সাথে?”
আমি কিছু বলার আগেই বাবা বললো,
“যাবে না কেন? যাবে। বিয়ে-শাদিতে থাকাও পুণ্যের কাজ।”
চাচি হাসলো। আমার দিকে ফিরে বললো,
“বিকেলে তৈরি হয়ে থাকিস, আমি এসে নিয়ে যাব।”
আমি কিছু বললাম না।
চাচি চলে গেল। সে খুশিতে গদগদ। মনে হচ্ছে যেন ছেলের বিয়েটা এবার হয়েই যাবে। কিন্তু আসলেই কি সেজান ভাইয়ার বিয়ে হবে?
(চলবে)