নীল জোছনায় ভাসি পর্ব-০২

0
2774

#নীল_জোছনায়_ভাসি (০২)
#লেখা: ইফরাত মিলি
___________________

বাবা বিয়ে করবে বলে কখনও খারাপ লাগেনি আমার, কিন্তু আজ সেজান ভাইয়ার ঠাট্টাপূর্ণ কথায় অনেক মন খারাপ হলো। আমি তার প্রশ্নের প্রত্যুত্তর না দিয়ে বললাম,
“ছেলেটাকে চড় মা’রা তোমার উচিত হয়নি ভাইয়া।”

“কোন ছেলে?”

সেজান ভাইয়ার কণ্ঠে এমন ভাব যেন সে ভুলে গেছে ছেলেটাকে। ভুলে যেতেও পারে। এ রোগ তার আছে অবশ্য।
আমাকে মনে করিয়ে দিতে হলো না, সে মনে পড়ার ভঙ্গি করে বললো,
“ও…ওই ছেলের কথা বলছিস? ওই ছেলের জন্য তোর এত দরদ কেন? তুই কি ওর ভাইয়ের বউ? ওর ভাইকে বিয়ে করলি কবে? দাওয়াত দিলি না তো।”

আমার অভিমান হলো। আমি তার বউ হওয়ার স্বপ্ন দেখি, আর সে কি না আমাকে অন্য লোকের বউ বানিয়ে দিচ্ছে?
সেজান ভাইয়ার মুখভঙ্গি এমন যেন আমি সত্যিই ওই ছেলের ভাইকে বিয়ে করে ফেলেছি, আর তাকে দাওয়াত দিইনি। দাওয়াত না দেওয়ায় সে যেমনি কষ্ট পেয়েছে তেমনি অবাকও হয়েছে। আমি তাকে এড়িয়ে টিউবওয়েলের নিকটে এলাম। সে কোনো কথা না বলে চলে গেল। যেন সত্যিই আমি তাকে দাওয়াত দিইনি বলে সে আমার সঙ্গে আর কথা বলবে না। মানুষটা অদ্ভুত! একটুখানি অদ্ভুত না, অনেকখানি।

পানি ভর্তি জগ ও বোতল নিয়ে ফেরার সময় সিঁড়িতে হঠাৎ প্রাইমারি শিক্ষকের সঙ্গে দেখা হলো।

“মিস তুতু, তোমাদের ঘরে না কি থার্মোমিটার আছে?”

“আছে তো, কেন? আপনার জ্বর এসেছে?”

“আমার না, কবির ভাইয়ের। ইমরান ভাই বললো তোমাদের ঘরে থার্মোমিটার আছে। থার্মোমিটারটা কি দেওয়া যাবে? জ্বর মেপে ঔষধ আনতে হবে।”

আমি কিছু বলার আগেই আচমকা পিছন থেকে কেউ ডেকে উঠলো,
“সেতু।”

পিলে চমকে উঠলো আমার। এটা আপুর গলা। আপু একদম পছন্দ করে না আমি প্রাইমারি শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলি। পিছন ফিরে একবার আপুর দিকে তাকালাম। আপুর চোখে-মুখে চাপা রাগ। এই রাগ সহজে দেখার উপায় নেই। এই যে আমি দেখতে পাচ্ছি, প্রাইমারি শিক্ষক কিন্তু দেখতে পাচ্ছে না। প্রাইমারি শিক্ষকের দিকে ফিরে বললাম,
“আমাদের থার্মোমিটারটা নষ্ট হয়ে গেছে জাবির ভাই। ফার্মেসি থেকে জ্বরটা মাপিয়ে নিবেন প্লিজ।”

বলেই দ্রুত পায়ে উপরে উঠলাম সিঁড়ি বেয়ে। জাবির ভাই হয়তো আমার আচরণে কিছুটা অবাক হয়েছে। হোক গিয়ে। তার অবাক হওয়া নিয়ে ভাববার সময় আমার নেই।

যা ভয় করেছিলাম তাই হলো। আপু ঘরে ফিরেই জাবির ভাইয়ের প্রসঙ্গ তুললো।
“ওই ছেলের সাথে এত কী কথা তোর? নিষেধ করেছি না কথা বলতে? যার তার সাথে কথা বলবি না। এরপর যদি দেখি ওই ছেলের সাথে আবার কথা বলিস তাহলে ঠাটিয়ে থা’প্পড় মে’রে দাঁত ফেলে দেবো।”

আমি কাঁপা স্বরে বললাম,
“আচ্ছা, কথা বলবো না আর।”

আপু রুমে যেতে যেতে বললো,
“মনে হয় যেন আমি কিছু বুঝি না!”

কী বোঝে আপু? আমার আর জাবির ভাইয়ের ভিতর প্রেম প্রেম ভাব জনিত কিছু হচ্ছে বা হবে এটাই বোঝে? কিন্তু এ জন্মে যে সেসব কিছু হবে না। কারণ সেতু নামের মেয়েটি যে রূপকথা নামের মেয়েটির প্রাক্তন প্রেমিকের জন্য নিজের এ জন্ম সঁপেছে!

____________________

সকালবেলা অতি অদ্ভুত একটা দৃশ্য দেখে আমি কিছুক্ষণের জন্য হতবিহ্বল হয়ে গেলাম। বাবা মুখে হালকা কমলা বর্ণের কী একটা পদার্থ মাখছে। মূলত এটা ফেসপ্যাক। আমি দূর থেকে কিছুক্ষণ দেখে বাবার কাছে গেলাম।

“এটা কী মাখছো বাবা?”

“ও সেতু? বস। এটা হচ্ছে গাজর দিয়ে তৈরি এক প্রকার ফেসপ্যাক। খুব ভালো জিনিস, বুঝলি? মুখে দিলে ত্বক টানটান হবে। তুই একটু দিবি?”

“না, আমার ত্বক টানটান করতে হবে না। তুমি নিজের ঘরে বসে এসব না মেখে, বসার ঘরে বসে মাখছো কেন? আপু দেখলে রেগে যাবে।”

“ভালো কথা মনে করিয়ে দিয়েছিস। রূপকথাকে ডাক। রোদে পুড়ে ওর চেহারাটা কেমন কালো হয়ে যাচ্ছে দেখেছিস? এটা মাখলে ত্বকের উজ্জ্বলতাও বাড়ে। বড়োই ভালো জিনিস। আয় তোকেও একটু মেখে দিই। বাবার বিয়েতে রূপচর্চা না করলে আর কখন করবি?”

“তাহলে তুমি বিয়ের জন্য রূপচর্চা করছো? পাত্রী খুঁজে পেয়েছো তোমার?”

বাবার মুখটি গম্ভীর হয়ে গেল। বুঝতে পারলাম পাত্রী খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাবা যেসব শর্ত দিয়েছে তাতে পাত্রী খুঁজে না পাওয়ারই কথা। বাবা হঠাৎ বললো,
“পরশু জামালপুর যাচ্ছি একটা পাত্রী দেখতে। তুই আমার সঙ্গে যাবি সেতু?”

“আপু জানতে পারলে মে’রে ফেলবে আমায়।”

“ওকে জানাবো না। তুই আর আমি চুপিচুপি যাব।”

“চুপিচুপি কাজ করে চোরেরা। আমি চোর হতে পারব না। তুমি একাই চলে যেয়ো।”

“তুই সাথে গেলে যে আমার ভালো লাগতো।”

“গিয়ে হবে কী? পাত্রী তো তোমার পছন্দ হবে না।”

আমি কিচেনে চলে এলাম। নাস্তা তৈরি করতে হবে। নাস্তা বলতে মূল্যবান কোনো নাস্তা নয়। চা আর চায়ের সাথে পাউরুটি, ও একটা ডিম পোচ। গরমকাল, শীতকাল নেই, বারো মাসই আমরা চা খেয়ে অভ্যস্ত। সপ্তাহে তিন দিন দুধ চা করা হয়, বাকি দিনগুলোতে রং চা। আজ দুধ চা তৈরির দিন। ফুটন্ত দুধের ভিতর চা পাতাগুলো ছেড়ে দিলাম। আর তখনই বসার ঘরে আপুর কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। আপু বাবার রূপচর্চার দৃশ্য দেখে ফেলেছে।

_____________________

পরীক্ষা শেষে লেখাপড়া থেকে পাওয়া ছুটির সময়গুলো জীবনের আনন্দদায়ক মুহূর্তের মধ্যে অন্যতম। ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষা শেষ করে আমার সময় খুব ভালো না কাটলেও মোটামুটি ভালোই কাটছিল। কিন্তু আপুর হয়তো আমার এই ভালোটুকু সহ্য হয়নি। আজ কমল স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়তে যাচ্ছি। নিতান্তই অনিচ্ছায়। আমার জীবনে আমার ইচ্ছার চেয়েও আপুর ইচ্ছা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ও যেহেতু বলেছে পড়তে যেতে হবে, তাই যেতেই হবে। কমল স্যারের বাসা ভালো পরিমাণ দূরেই বলতে হয়। আমাদের বাসা থেকে তার বাসায় যেতে পাঁচ টাকার রিকশা ভাড়া। কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পর একটা রিকশা পেলাম। কিন্তু ভাগ্য খারাপ সেজান ভাইয়া রিকশাটা কেড়ে নিলো। যে রিকশায় আমার ওঠার কথা ছিল সে রিকশায় সে তার বন্ধু আনামকে নিয়ে উঠে পড়লো।
আমি বললাম,
“এটা অন্যায় হলো সেজান ভাইয়া।”

সেজান ভাইয়া সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যুত্তর দিলো,
“তুই ছোটো মানুষ। ন্যায়-অন্যায়ের কী বুঝিস?”

সে হঠাৎ পকেট থেকে পাঁচ টাকার একটা নোট বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
“মন খারাপ করিস না। এই টাকা দিয়ে একটা আইসক্রিম কিনে খাস। বড়ো ভাইদের জন্য এরকম সেক্রিফাইস করতে হয়। তাও তো আমি ভালো মানুষ বলে তোকে আইসক্রিম কিনে খাওয়ারও টাকা দিচ্ছি। ধর।”

“আমি আইসক্রিম খাই না।”

“কেন?” সেজান ভাইয়া খুব অবাক হলো আমার কথাটিতে।

“ঠান্ডা খেলে টনসিলে সমস্যা হবে। চিকিৎসার জন্য কি তুমি টাকা দেবে?”

সেজান ভাইয়া পাঁচ টাকার নোটটা যত্নে পকেটে ঢুকিয়ে রেখে বললো,
“পাঁচ টাকা দিয়ে পাঁচ হাজার টাকার কেস খেতে হলে পাঁচ টাকা না দেওয়াই উত্তম। মামা চলো।”

সেজান ভাইয়া রিকশা নিয়ে চলে গেল। আমি অসহায় চোখে রিকশার দিকে চেয়ে রইলাম।
আমাকে অবাক করে দিয়ে রিকশাটা কিছুদূর গিয়ে থেমে গেল। দেখলাম সেজান ভাইয়া ও তার বন্ধু রিকশা থেকে নামছে। রিকশাটা ঘুরে আবার আমার সামনে চলে এলো। রিকশা চালক বললেন,
“ওঠেন আপামনি।”

আমার কী যে ভালো লাগলো বোঝাতে পারবো না। সেজান ভাইয়া রিকশা কেড়ে নিয়েও আমার জন্য আবার রিকশা ফেরত দিয়ে দিলো? আমি রিকশায় উঠে বসলাম। রিকশা যে সময় সেজান ভাইয়াদের অতিক্রম করে চলে আসছিল তখন আমি সেজান ভাইয়াকে ধন্যবাদ জানালাম,
“ধন্যবাদ সেজান ভাইয়া।”

কিন্তু আমি আসলে ভুল মানুষকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম। কারণ কেড়ে নেওয়া রিকশাটা সেজান ভাইয়া আমার জন্য না, নিজের বন্ধুর জন্য ফেরত দিয়েছিল, বন্ধু বলেছিল বলে। এ সম্পর্কে অবগত হলাম রাতে। রাতে ছাদে গেলাম। দেখি সেজান ভাইয়া সিগারেট খাচ্ছে। আমাকে দেখে বললো,
“তখন আমাকে ধন্যবাদ কেন জানিয়েছিলি? বিশেষ কোনো কারণ ছিল? আমি আমার অগোচরে তোর কোনো উপকার করে ফেললাম না কি?”

“অগোচরে উপকার করবে কেন? রিকশা নিয়ে গিয়েও পরে ভুল বুঝতে পেরে রিকশা ফেরত পাঠিয়েছো, এটাও তো একটা উপকার।”

সেজান ভাইয়া হাসলো,
“বোকা মেয়ে! বড়োরা ভুল করে না, ভুল করে ছোটোরা। তুই হলি ছোটো। তুই ভুল করবি। এই যেমন এখনও ভুল করলি। রিকশাটা আনাম ফেরত দিয়েছিল, আমি না।”
বলে খুব আয়েশ করে সিগারেটে টান দিলো।

হঠাৎ রাগ হলো আমার। আনাম কেন? সেজান ভাইয়া পারতো না রিকশাটা ফেরত পাঠাতে?

সেজান ভাইয়া হঠাৎ ভাবিত কণ্ঠে বললো,
“তুই কি রাগছিস?”

“আমি কখনও রাগী না।”

“ভালো ব্যাপার। কখনও রাগবি না। রাগলে মেয়েদের অসুন্দর দেখায়।”

“ভুল বলছো। রাগলে মেয়েদের সুন্দর দেখায়।”

“কে বলেছে?”

“আপুর রাগী মুখ কখনও দেখেছো তুমি?”

আমি হঠাৎ এরকম প্রশ্ন করবো তা বুঝতে পারেনি সেজান ভাইয়া। তাকে অপ্রস্তুত দেখালো। চোখ সরিয়ে নিলো অন্যদিকে। সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বললো,
“না।”

কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। কী যেন উপলব্ধির চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না। এক সময় বললাম,
“একটা কথা বলবো সেজান ভাইয়া?”

“না।”

সে অনুমতি না দিলেও আমি বললাম,
“আমার সামনে আর কখনও সিগারেট খেয়ো না।”

“এটা সিগারেট না বোকা, এটা গাঁজা।”

খুব আহত হলাম সেজান ভাইয়ার কথায়। সেজান ভাইয়া আমার সামনে গাঁজা খাচ্ছে? আবার বলছেও নির্দ্বিধায়? এত খারাপ সে? আর কথা বলতে ইচ্ছা হলো না।
ছাদ থেকে যাওয়ার জন্য যখন তার থেকে কিছুদূর এগোলাম সে বললো,
“এটা সিগারেটই।”

আমি দাঁড়ালাম। তার দিকে ফিরে বললাম,
“মিথ্যা কথা।”

“সত্যি কথা। খেয়ে দেখবি?”

সেজান ভাইয়া আমার দিকে এগিয়ে এলো। আমার মনে হলো সে আমার মুখে সিগারেটটা সত্যি সত্যি ঢুকিয়ে দেবে আর বলবে,
‘একটা টান দিয়ে দেখ।’

কিন্তু সেরকম কিছু সে করলো না। আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে বললো,
“তোর কথা শুনবো কেন? তুই আমার বউ হোস? না কি বোন হোস?”

বলে সিগারেটে টান দিয়ে আমার মুখে সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে চলে গেল।
আমি ভাবলাম, আসলেই তো আমি তার বউ কিংবা বোন নই। কিন্তু কিছু একটা হওয়ার সম্ভাবনা যে অঢেল।
সেজান ভাইয়ার জীবনে এখনও অবধি তো কিছু হলো না। প্রথমে আমার বোনের সাথে তার প্রণয়ের সম্পর্ক হলো। সেটা ভাঙলো। তারপর আরও একজনের সাথে প্রণয়ঘটিত সম্পর্ক হলো। কিন্তু এক মাস যেতে না যেতে সে সম্পর্কও ভেঙে চুরমার। আশরাফ চাচা ও সুমনা চাচি ছেলেকে পতনের দিক থেকে ফেরানোর চিন্তায় ছেলের বিয়ের জন্য প্রায় কয়েকটা সম্বন্ধ দেখেছে, কিন্তু কোনো সম্বন্ধ বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়নি। এক জায়গায় সব ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছিল প্রায়। কিন্তু একদিন সেজান ভাইয়া পাত্রীর সাথে দেখা করে কী বললো কে জানে। পাত্রী সম্বন্ধ ভেঙে দিলো।
কেন কিছুই হচ্ছে না সেজান ভাইয়ার জীবনে? আমার কেন যেন মনে হচ্ছে সেজান ভাইয়ার জীবনে সেতু নামের মেয়েটাই একমাত্র কবি, যে কবি দীর্ঘ প্রণয়কাব্য লেখার অধিকার নিয়ে জন্মেছে। আর সেই প্রণয়কাব্যের দীর্ঘতা শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত।

(চলবে)
________________

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে