#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_আগস্ট_২০২০
#গল্প – নীল কষ্ট
#কলমে – সুরাইয়া নিপা
#মূল গল্প:
ইতু আজ কলেজ থেকে ফিরেছে খুব খুশী মনে। বাড়ি ফিরেও তার মায়ের সাথে খুব ভাল মেজাজে কথা বলছে। ইতুর মা রোকেয়া বেগম মেয়ের হাসিমাখা মুখ দেখেই বুঝতে পারলেন যে মেয়ের মনে কিছু রঙিন প্রজাপতি উড়ছে। তবে তিনি ইতুকে কিছু জিজ্ঞেস করলেন না কারণ জানেন যে ইতুর বাবা ইসহাক বশির বাড়ি আসার আগে সে মুখ খুলবে না। তাই তিনি চুপ করেই অপেক্ষা করলেন সন্ধ্যায় ইতুর বাবা বাড়ি আসা পর্যন্ত।
ইতু লালমাটিয়া কলেজের ছাত্রী। এবার অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে, উদ্ভিদ বিজ্ঞানে পড়ে। মা বাবার একমাত্র সন্তান সে। ইতুর সবচেয়ে কাছের বন্ধু তার বাবা। বাবার কাছেই তার রাজ্যের আবদার।
সন্ধ্যায় ইসহাক সাহেব বাড়ি ফিরলেন। যথারীতি ইতু ছুটে গিয়ে দরজা খুলে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। সেই ছোট্ট থেকে তার একই অভ্যাস। ইসহাক সাহেব জুতো খুলে বেডরুমে গেলেন ফ্রেশ হতে। এদিকে রোকেয়া বেগম খাবার গরম করে টেবিলে পরিবেশন করেন। ইতু তার মা কে সাহায্য করে।
আধাঘন্টা পরে ইসহাক সাহেব টেবিলে খেতে বসলেন। ইতু বসলো বাবার পাশের চেয়ারে। ইতুর মা ওদের সামনে দাড়িয়ে। প্রতিদিন ইতু শুধু বসে থাকে আর ওর মা খাবার তুলে দেন। কিন্তু আজ ইতু নিজে তার বাবার প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছে। ইসহাক সাহেবের মনে হল ইতু তাঁকে কিছু বলতে চায়। ইতুর হাস্যোজ্জ্বল চেহারার দিকে তাকিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “কিছু বলবি, মা?” ইতু শুধু একগাল হাসি নিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকলো। রোকেয়া বেগম তাদের দিকে তাকিয়ে আছেন ঘটনা জানার জন্য। ইসহাক সাহেব আবার বললেন, ” কিছু বলার থাকলে বল। এতো সংকোচ কিসের? ” এবার ইতু মুখ খুললো, ” বাবা, ডিপার্টমেন্ট থেকে কক্সবাজার নিয়ে যাবে। আমি যাব তো?”
” হ্যাঁ, যাবি। ব্যস, এই কথা?”
” খরচ পাঁচ হাজার। আর বাড়তি কিছু টাকাও লাগবে শপিং এর জন্য ”
” ইতুর মা, ইতুর যা টাকা লাগে দিয়ে দিও।”
রোকেয়া বেগম এতক্ষণে কথা বললেন, ” ঠিক আছে, দিয়ে দিব। এই কথাটা ও আমাকেও বলতে পারতো।”
ইতু খুশী মনে খবরটা বান্ধবীকে দিতে গেল।
এর পরের একটা সপ্তাহ ইতু বান্ধবীদের সাথে শপিং করলো এবং সমুদ্রসৈকতে গিয়ে কী কী করবে তার পরিকল্পনা করতে থাকলো। ট্যুরের দিন সকাল থেকেই তার গোছগাছ চলে। বিকেলে তারা উপস্থিত হল কলেজ ক্যাম্পাসে। সন্ধ্যায় তারা রওনা হল কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে।
পরদিন দুপুরে ওরা পৌঁছালো কক্সবাজার। হোটেলে মালামাল রেখে বেরিয়ে পড়লো সমুদ্রস্নানের জন্য। স্নানশেষে সৈকতে হাঁটার সময় ইতুর পায়ে কিছু একটা বাধলো। সে থমকে দাঁড়ালো আর বালু সরিয়ে দেখলো একটা কাঁচের শিশি বালুতে আটকে আছে। শিশির ভেতরে একটা মোড়ানো নীল রঙের চিরকুট আছে। কাগজে লেখা একটা শব্দ ই বোঝা যাচ্ছে, ‘ প্রিয়তমা ‘। কৌতুহলবশত ইতু শিশিটা নিয়ে হোটেলে ফিরলো। ডিনার শেষে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে সে শিশির মুখ খুলে মোড়ানো কাগজটা বের করলো। কাগজটিতে মুক্তাক্ষরে লেখা আছে,
‘ প্রিয়তমা,
মনের মণিকোঠায় আমি রেখেছি যে তোমায়,
দিন গুনি শুধু তোমার অপেক্ষায়
জানিনা তুমি লুকিয়ে আছো কোথায়…
— নীল
মোবাইল : 019** ** ** ** ‘
ইতুর ইচ্ছে হল তখনই নাম্বারটায় কল করতে। কিন্তু আবার ভাবলো যে ফোন করে কী বলবে! কেউ টের পেয়ে গেলেই বা কী বলবে! তাই চিরকুটটা নিজের ব্যাগে রেখে ঘুমিয়ে পড়লো।
আরও একদিন কক্সবাজারে থেকে তার পরদিন বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে রওনা হল তারা। বাড়ি পৌঁছে সেই রাতেই ইতু ঐ নাম্বারে ফোন করলো। বেশ কয়েকবার রিং হয়ে কেটে গেল কিন্তু কেউ ফোন রিসিভ করলো না। হতাশ হয়ে ইতু মোবাইল রেখে ঘুমিয়ে পড়লো। ভ্রমনের ক্লান্তি থাকায় খুব তাড়াতাড়ি গভীর ঘুমে ঢলে পড়লো সে।
পরদিন সকাল ১০ টার সময় ইতুর ঘুম ভাঙলো। আড়মোড়া ভেঙে উঠে গিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে দেখল তার মা তখন রান্না করছেন এবং বাবা অফিসে চলে গেছেন। মেয়েকে দেখে রোকেয়া বেগম বললেন, “উঠেছিস? যা, হাতমুখ ধুয়ে এসে নাস্তা করে নে। ইতু নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে আবার বিছানায় বসলো। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো ঐ চিরকুটের নাম্বার থেকে ২ টা মিসড্ কল। সে মনে মনে ভাবলো, ” কখন কল এসেছিল, আমি টেরই পেলাম না!” বেশ উত্তেজিত মনে সে নাম্বারটি ডায়াল করলো। এবার একবারেই ফোন ধরলো ওপারের ব্যক্তি,
” হ্যালো”
“মনের মনিকোঠায় আমি রেখেছিযে তোমায়
দিন গুনি শুধু তোমার অপেক্ষায়
জানিনা তুমি লুকিয়ে আছো কোথায়।”
“কে?”
” আমি প্রিয়তমা। আপনি কি নীল? ”
” জি, আমিই নীল। আপনি চরণগুলো কোথায় পেলেন?”
” আপনি যেখানে রেখে এসেছিলেন, সেখানে। ভুলে গেছেন নাকি?”
” না, তবে বিশ্বাস করতে পারছিনা। এরকম তো শুধু গল্প বা নাটকেই সম্ভব।”
” জীবণের গল্প তো মাঝে মাঝে নাটককেও হার মানায়।”
” তাই তো দেখছি! আসলে ঘটনা হল, আমি বন্ধুদের সাথে কক্সবাজার বেড়াতে গিয়েছিলাম। সৈকতে হাঁটছিলাম,হাতে ছিল জুসের বোতলটা। কী মনে করে যেন কাগজে দুইলাইন লিখে বোতলে ভরে ছুঁড়ে দিলাম সাগরে। ভেবেছিলাম ঢেউয়ে ভেসে নিরুদ্দেশে চলে যাবে। তা না গিয়ে ঘুরেফিরে এই সৈকতেই আটকে ছিল!”
” সত্যি করে বলেনতো, কোন রূপনগরের রাজকন্যার জন্য অপেক্ষা করছিলেন কি?”
” একদম ই না। আসলে ভেবেছিলাম এই ছেলেমানুষী কাজের কোন প্রত্যুত্তর কখনো পাব না।”
” আমিও কৌতুহলবশত ফোন করেছি, আমার জীবণে এমন কিছু আমি আগে দেখিনি বা শুনিনিতো তাই। যাইহোক, বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত।”
” আমি বিরক্ত হইনি, একটু বিস্মিত হয়েছি মাত্র।”
” ঠিক আছে, রাখছি তাহলে।”
এই বলেই ইতু ফোন কেটে দিল। কেন যেন নিজের কাছেই বিষয়টা বিরক্তিকর লাগছে ওর। চিরকুটটা বইয়ের মধ্যে রেখে সে ওয়াশরুমে চলে গেল।
দুইদিনের ছুটির শেষে কলেজে ক্লাস শুরু হল। ইতু নিত্যদিনের কাজের মধ্যে ব্যস্ত হয়ে গেল এবং চিরকুট ও নীলের কথা ভুলেই গেল। দিন দশেক পর একদিন সে কলেজ শেষে বাড়ি ফিরছে। পথেই তার মোবাইল রিংটোন বেজে উঠল। ইতু মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে সেই চিরকুটের নাম্বার থেকেই ফোন। সে ফোন রিসিভ করলো –
” হ্যালো ”
” জি, কেমন আছেন?”
” হুম ভালো, আপনি?”
” ভালোই তবে একটু অপরাধবোধে ভুগছি।”
” অপরাধবোধের কারণ?”
” সেদিন আপনি কল করলেন আর আমি কেমন অদ্ভুত আচরণ করলাম। আমি সত্যিই দুঃখিত। সেদিনের ঘটনায় এতবেশি অবাক হয়েছিলাম যে কী বলব বুঝতে পারছিলাম না।”
” ঠিক আছে, কোন ব্যাপার না।”
” আমরা পরিচিতি তো হতে পারি। আমি নীল, চট্টগ্রামে থাকি। ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে মাস্টার্স করছি।”
” আমি ইতু। অনার্স সেকেন্ড ইয়ার, বোটানি।”
এভাবেই শুরু হয় পরিচয় পর্ব। তারপর বন্ধুত্ব। প্রতিদিন কথা হতে থাকে দুজনার। কথায় কথায় সম্বোধন টা আপনি থেকে তুমিতে চলে আসে। একটা বিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরী হয় দুজনের মধ্যে। একদিন নীল সরাসরি প্রস্তাব দেয় ইতুকে-
” আমরা কি জীবনসঙ্গী হতে পারিনা?”
ইতু অনেক্ষণ চুপ থেকে দীর্ঘশ্বাসের সাথে বলে, ” খুব ভয় হয়।”
” কিসের ভয়?”
” তুমি যে নীল, নীল মানেই তো বেদনা, কষ্ট।”
” আকাশের নীলে মুক্তি মেলে
সাগরের নীলে বিশালতা,
প্রশান্তি লুকিয়ে থাকে নীল নয়নের ঝিলে
তবে নীলে কেন শুধু বেদনার প্রগাঢ়তা?”
“তোমার কাব্যের কাছে আমি নির্বাক।”
” বেশ, তোমার ভয় দূর করে দিই। জুলাই এর ৪ তারিখ আমার জন্মদিন। সেদিন আমি ঢাকা আসবো, তোমার সাথে কাটাবো সারাদিন। আর সেদিন থেকেই নীল হবে আমাদের ভালোবাসার রং, তোমার বিশ্বাসের রং।”
” সত্যিই আসবে? বেশ তবে আমিও সেদিন নীল শাড়ি পরবো। সাথে নীল চুড়ি আর নীল টিপ। তোমাকেও নীল পাঞ্জাবি পরতে হবে।”
” তুমি যা চাও তাই হবে।”
কথামতো ৪ জুলাই নীল সকালে রওনা দিয়েছে ঢাকার পথে। কিছুক্ষণ পরপর ইতুকে ফোন করে জানাচ্ছে কতদূরে আছে। ইতুও কথামতো নীলাম্বরী সাজে নিজেকে সাজাচ্ছে তার নীলের জন্য।
বিকেল ৪ টায় ইতু অপেক্ষা করছে হাতিরঝিলে, হাতে সেই চিরকুটটি নিয়ে। সেখানেই নীলের আসার কথা।
এদিকে নীল বাস থেকে নেমেছে আরামবাগে। তার মোবাইল বেজে উঠলো। ইতু ফোন করেছে। ফোন রিসিভ করবে ঠিক সেই মূহুর্তে কে যেন ছোঁ মেরে তার হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে এক নিমিষে উধাও হয়ে গেল। আশেপাশে তাকিয়ে কোন টেলিফোন বুথ চোখে পড়লোনা যেখান থেকে ইতুকে একটা কল করা যায়, বলা যায়, “এই তো চলেই এসেছি তোমার কাছে।”
ফুটপাত ধরে কিছুটা হেঁটে রাস্তার ওপারে বাস কাউন্টার। রাস্তাটা বেশ ফাঁকা, দূরে একটা গাড়ি আসছে দেখে নীল জেব্রা ক্রসিং পার হতে রাস্তায় নামলো। কিন্তু সেই দূরের গাড়িটাই দ্রুতগতিতে এসে নীলকে পিষে দিয়ে চলে গেল। তার নীলরঙা পাঞ্জাবীটা লালরঙা রক্ত মিশে কালো হয়ে গেল।
সন্ধ্যা সাতটা বাজে। ইতু অনবরত ডায়াল করে যাচ্ছে নীলের নাম্বারে। নাহ্, ফোন বন্ধ বলছে। এক অজানা শংকায় ইতুর হাত পা অসাড় হয়ে আসছে। তবে কি নীল আজ সারাদিন ইতুর সাথে ছলনা করলো!
ইতু স্থির দাঁড়িয়ে আছে নীল শাড়ি, চুড়ি আর টিপ পরে। তার হাত থেকে চিরকুটটি উড়ে গিয়ে পড়লো ঝিলের জলে। হালকা স্রোতে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল ধীরে ধীরে। ইতু শুধু ঠাঁই দাড়িয়ে রইল ছলছল চোখ আর একবুক নীল কষ্ট নিয়ে।
(সমাপ্ত)