নীলাম্বরে জোছনা পর্ব-২০ এবং শেষ পর্ব

0
550

#নীলাম্বরে_জোছনা
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -২০

দিনটা ছিলো রবিবার, ব্যাস্ত নগরীর ব্যাস্ত মানুষের ভিড়ে। মিফতাজ সবে মাত্র আদালত থেকে ফিরেছে। ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিলো সোফায়। তিন বছরের এক বাচ্চা মেয়ে বাবা, বাবা বলে ছুটে আসলো মিফতাজের কাছে। এক হাতে বাচ্চাটাকে আগলে নিয়ে আদুরে চুমু খায় মিফতাজ। মনের অজান্তেই চোখ থেকে টুপ করে এক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরে।

কোমড়ে ওড়না গুজে নিজের বরের জন্য শরবত বানাতে ব্যাস্ত এক রমনী। ফ্রীজ থেকে বরফের টুকরো নিয়ে শরবতে দিয়ে গ্লাসটা নিয়ে মিফতাজের সামনে ধরলো। মিফতাজ হাত বাড়িয়ে শরবতের গ্লাস নিয়ে চুমুক দিতে দিতে বলে, তোমার প্রতি আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো।
‘এভাবে কেন বলছেন, আপনি আমার পিতৃহারা সন্তানটাকে পিতৃ পরিচয় দিয়েছেন,সারাজীবন আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো।

‘আজ দশ বছর হয়ে গেলো আমার প্রিয় মানুষটা আর পৃথিবীতে নেই। সেদিনটা আজও ভুলতে পারিনা। যে মানুষটা আমাকে ম্যাসেজ করে বললো,আমি আসছি আমার হৃদয়। হৃদয় ছাড়া আমি যে জলহীন মাছের মত বেঁচে আছি! এবার আমি ফিরবো, শুধু তোমার জন্য না! আমার নিজের জন্য। এবার আমি বাঁচবো,আমাদের জন্য।
এইযে মিস্টার,এয়ারপোর্টে এক গুচ্ছ ফুল নিয়ে ওয়েট করবেন। আমি আসছি।

এই শুনো, আমি না তোমাকে একদম অনেক ভালোবাসি, অনেক মানে অনেক। জানো তোমাকে ছেড়ে এসে আমিও ভালো নেই, কিন্তু কি করবো বলো,তোমার মা যেদিন বলল,আমার জন্য তোমার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে! আমি ভাবলাম অভাগা যেদিকে তাকায় সেদিকেই দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়! তাই চলে আসলাম। কিন্তু তোমার ভালোবাসা আমাকে আবার ফেরাতে বাধ্য করলো।

‘তোমাকে একটু বেশিই ভালোবাসি আমার ভালোবাসা।

‘আমি তার ম্যাসেজের রিপ্লাই না দিয়ে অভিমান করে রইলাম। কখনো ভাবিনি সে অভিমান আর কোনদিন ভাঙবে না। আর কোনদিন বলবে না। জান এতো রাগ করো কেন! জানোনা রাগ করার অধিকার শুধু মেয়েদের। রাগ ছাড়ো জান আর আমাকে চুমু খাও।

‘শাফা বললো,কি হয়েছিল তার!আপনি আমাকে আঝো বললেন না সে কিভাবে মারা গেলো!

আদুরী আদিলকে বললো,কাল মানহার মৃত্যু বার্ষিকি আমরা যাবো মিফতাজের বাসায়। জানোই তো আজিমপুর এতিমখানায় প্রতিবার দোয়ার আয়োজন করে। কথাগুলো বলতে বলতে চোখ থেকে অশ্রু ঝড়তে লাগলো।
আদিল আলতো হাতে আদুরীর চোখের জল মুছে দিয়ে বলে,মন খারাপ করে না, কেউ সারাজীবন থাকে না।

‘আমি যে শেষবারের মত আমার বোনটাকে জড়িয়ে ধরে সরি বলতে পারিনি! আমি বলতে পারলাম না তোকে বড্ড ভালোবাসি আমার মান। পরিস্থিতি হয়তো আমার দ্বারা তোকে কষ্ট দিয়েছে। কিন্তু নিজের ভুল বুঝতে পেরে শতবার অনুতপ্ত হয়েছি। আমার বোনটা সেই ছোট থেকে কষ্ট পাচ্ছে। সব কষ্ট থেকে এভাবে মুক্তি নিলো! আমি নিজেকে বোঝাতে পারিনা। আমার বোনটা আর নেই। মাঝে মাঝে মনে হয় এই হয়তো পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলবে, তুমি আমার বেস্ট বনু। তোমার জন্য এত্তো ভালোবাসা৷

আদিল আদুরীকে জড়িয়ে ধরে বলে,কাঁদে না এখন মানহার জন্য দোয়া জরুরি। দোয়া করো বোনটা পরপারে ভালো থাকুক।

আদুরী আরো জোড়ে কেঁদে উঠলো, আদুরীর ছেলে অয়ন দৌঁড়ে এসে বলে, বাবা আম্মু কাঁদছে কেন!
আদুরী আদিলকে ছেড়ে নিজের চোখের পানি মুছে অয়নকে চুমু দিয়ে বলে, বাবা তুমি যাও তো দাদুমনির কাছে, আম্মুর মাথাটা ব্যাথা করছে।


আজিমপুর এতিমখানায়ও সবাই একত্রিত। সবাই মিলে বাচ্চাদের খাইয়ে দোয়া পড়িয়ে বিদায় নিচ্ছে। মিফতাজ একটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আনমনে তাকিয়ে আছে শুন্যে। আরহাম এসে মিফতাজের কাঁধে হাত রাখলো,ব্যাথাতুর কন্ঠে বললো,আমাকে ক্ষমা করে দে তাজ! তোর কাছো তোর ভালোবাসাকে ফেরাতে পারিনি।

‘আমি জানতাম ও ফিরবে না। দেখো সত্যি ফিরলো না। যখন না ফেরার দেশে চলেই যাবে, তবে কেন বললো ফিরছে! বলো না? ও আমাকে ফিরবে বলে ফাঁকি কেন দিলো? আমি ওর সাথে কখনো কথা বলবো না কখনো না। চোখের কোন ভিজে গেছে। হৃদয়ে কি সে দহন, কেউ কি বুঝবে?
দুরে দাঁড়িয়ে আছে অতি বৃদ্ধ একজন লোক। লাঠি ভর দিয়ে এদিকটায় এগিয়ে আসছে।
আরহাম জড়িয়ে নিলো মিফতাজকে। কিন্তু এ তে কি আর হৃদয়ের দহন কমে?
চোখ বন্ধ করতেই ভেসে উঠলো বিভৎস সেই দিন।

দুপুর তিনটে বাজে সংবাদ দেখছিলো একটা প্লেন ক্রাশড করে দূর্ঘটনা প্রায় দু’শো মানুষ নিহত হয়৷ সে সময় এতো পাত্তা দেয়নি কেউ।

রাত নয়টায় বাংলাদেশে ল্যান্ড করার কথা মানহা যে প্লেনে আছে সেটার।
মানহার অপেক্ষা আজ তার সব প্রিয়জন অপেক্ষ্য মান। বাদ পরেননি দিশা বেগম, রুনা বেগমও।
সবাই অধির আগ্রহে অপেক্ষায় আছে প্রিয়মুখটির। কিন্তু দশটা বেজে গেলেও কোন খবর না পেয়ে।
বিমান কতৃপক্ষের কাছে জিজ্ঞেস করে।তখন তাদের থেকে জানতে পারে বিমান দূর্ঘটনার কথা। সাথে সাথে পাগলের মত ছুটতে থাকে হসপিটালে৷ কিন্তু জীবিত পেলো না। পেলো মর্গে। কি সুন্দর হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে আছে। মিফতাজ মানহাকে কোলে তুলে নিয়ে ছোটাছুটি শুরু করে, চিৎকার করে ডাক্টার ডাকতে থাকে। ঠোঁটে, গালে, কপালে অজস্র চুমতে ভরিয়ে দিচ্ছে প্রিয়তমাকে। আরহাম, আদি এসে থামায় মিফতাজকে। সবাই সবার মত দুঃখ বিলাস করতে ব্যাস্ত কেউ ফিরে দেখলো না। একজন৷ অসহায় বাবাকে৷ যেয়ে একটি বার তার মেয়েকে চোখের দেখা দেখতে চেয়েছিলো।
রেবেকা বেগম স্বামীর পিছু পিছু। রাহাত সাহেব দৌড়ে আসলেন। মিফতাজের কোল থেকে নিজের কোলে মানহার মাথাটা তুলে নিলেন। কপালে চুমু দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, মা, মারে একবার তাকা মা, শুধু একবার তাকা তোর চোখের মধ্যে নিজের মুখটা দেখি। এই অপরাধী বৃদ্ধ বাবাকে আর কষ্ট দিসনা মা। একবার বাবা বল!
মিফতাজ সেন্সলেস হয়ে গেছে।
‘মানহা হয়তো বুঝতে পারেনি।সে সময়ের আগে এসে সবাইকে যে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল।সেটাই তার দেয়া জীবনের শেষ সারপ্রাইজ। জীবনের শেষ সময় প্রিয় মানুষটার মুখটাও দেখা হলো না। বলা হলো না কত না বলা কথা। আর কখনো সে সব বলা হবে না। বছর পেরিয়ে যুগ পার হয়ে যাবে।তবে মানহার আর কখনো ফিরে আসা হবে না। পৃথিবীতের বুক থেকে মানহার অধ্যায়ের সমাপ্তি।
তবে সে যদি জানতো সে এখনো বেঁচে আছে মিফতাজের হৃদয়ের দহন হয়ে। সে যদি বুঝতো একটা মানুষ এখনো কারণে অকারণে তার কথা ভেবে দীর্ঘ শ্বাস নেয়। জানা হবে না তার চলে যাওয়া কতটা ক্ষত তৈরি করলো তার প্রিয়দের মনে!

✨আজ বাসায় ফিরতে ফিরতে মিফতাজের রাত একটা বেজে গেলো। শাফা চেয়েরা বসে ছিলো। মিফতাজ শাফাকে এতো রাতে জেগে থাকতে দেখে বলে,কতবার বলেছি রাত জাগবেননা আমার জন্য!
‘আপনি মানুন আর না মানুন আর বিয়েটা যে ভাবেই হোক হয়েছে। আপনার দুঃখগুলোর ভাগ নিতে চাই। যেভাবে আপনি আমার আর আমার মেয়ের জীবনে খুশিতে ভরিয়ে দিয়েছেন৷ আমি৷ আপনার জীবনে তার সামান্য সুখ এনে দিতে চাই!
‘সবার কপালে সুখ থাকে না। বেঁচে থাকার তাগিতে বেঁচে আছি। না আছে বেঁচে থাকার ইচ্ছে। আর সুখ তো সেখানে বিলাসিতা। আমার মানুষটা তার সাথে সব নিয়ে গেছে। আপনি জানেন আমার মানহাটা জীবনে তেমন কোন সুখ পায়নি! ভেবেছিলাম বিয়ের পর পৃথিবীর সব সুখ তার পায়ে ঢেলে দেবো। কিন্তু কথায় আছে, মানুষ পুরো পৃথিবীর সাথে লড়াই করতে পারে, কিন্তু ভাগ্যের সাথে লড়তে পারেনা। কারণ ভাগ্য তো উপরওয়ালা লিখে রাখেন৷ আমি আমার নিজের জন্য কিছু চাইনা। আমার মালিক আমার প্রিয়তমাকে পরপারে সুখে রাখলেই হবে।আপনিও এই দোয়াটুকু করবেন।

‘শাফা আর কথা বাড়ালো না। তিন বছরেও মানুষটার মনের কাছেও যেতে পারেনি। তবুও চেষ্টা করে যাবে।হয়তো মনে না হোক তাের শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে তার সাথে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবে। শাফার মাঝে মাঝে হিংসে হয় মানহাকে। সে কতটা ভাগ্যবতী কেউ তাকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। অনেক মানুষ মরে যেও জিতে যায়, মানহা হয়তো তাদের দলের। নয়তো চলে যাওয়ার দশ বছর পরেও সে একি রকম ভাবে মিফতাজের হৃদয়ে বসবাস করছে!

‘হয়তো কোন একদিন মেনে নেবে মিফতাজ শাফাকে। তবে তার হৃদয় জুড়ে চিরকাল বিচরণ করবে মানহা।
সব সমাপ্তি সুখের হয়না।চাইলেই জীবনটা কল্পনার মত সুন্দর হয় না। কিছু কিছু গল্প এভাবেই অসমাপ্ত রয়ে যায়!
সব আঁধার কেটে হয়তো #নীলাম্বরে_জোছনা উঁকি দেয় না।

সমাপ্তি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে