নীলাম্বরে জোছনা পর্ব-১৮

0
637

#নীলাম্বরে_জোছনা
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -১৮

মিফতাজ বসে আছে রেডিও স্টেশনে।আজ সে তার হৃদয়ে লুকানো সব কথা বলবে।

আরজে রাজ বলল,এখন আমাদের সাথে তার জীবনে ঘটে যাওয়া না বলা গল্প শুনাবেন মিফতাজ আয়মান। সো আর কথা না বাড়িয়ে আমরা চলে যাবো গল্পে।

‘সময়টা ছিলো বর্ষাকাল। সকাল সাতটায় ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় ধোঁয়া ওঠা কফির সাথে বৃষ্টি উপভোগ করছিলাম। হুট করে আমার চোখ গেলে আমাদের মেইন গেটের বাহিরে একটা মেয়ে কাক ভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার চেহারায় রাজ্যের বিরক্তি প্রকাশ পাচ্ছে। হলদে ফর্সা গায়ে গোলাপি কুর্তি,ব্ল্যাক হিজাবে আবৃত মাথা, ডাগর ডাগর চাহনি দিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে কিছু দেখছে। আমি নিজেই নিচে আসলাম। ছাতা নিয়ে এসে দেখি দারোয়ান চাচা ঘুমোচ্ছে। চাবি নিয়ে গেট খুলে দিতেই মেয়েটি আমার দিকে দৃষ্টি দিলো চার চোখ কয়েক সেকেন্ডের জন্য এক হলো। জানিনা সে চোখে আমি কি দেখেছিলাম। মেয়েটির কথায় হুশ আসলো।
সে যেনো আমার হৃদয় হরণ কারী কন্ঠ। সে বলল,আরহাম নামের কাউকে চেনেন?
‘হুম কেনো চিনবো না আমার ভাই।
‘আচ্ছা এই প্যাকেটটা তাকে পৌঁছে দিবেন।
আমি নিলাম। তাকে কিছু বলবো তার আগেই সে সিএনজিতে যেয়ে বসলো। আমি কি নামে ডাকবো। সেটা ভাবতে ভাবতে সে আমার দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলো!

নিজের রুমের এসে ভাবতে লাগলাম শুনেছি প্রেমে পড়তে কয়েক মূহুর্ত লাগে। আবার হাজার বছরেও প্রেম হয় না! তবে আজ কি আমি মূহুর্তেই প্রেমে পড়ে গেলাম!
তারপর শহরের অলিতে গলিতে কত খুঁজেছি তাকে। হুট করে তার দেখা পেয়ে যাই বসুন্ধরায়। সেখান থেকে আলাপ। তারপর ধীরে ধীরে প্রেম, ভালোবাসা। তবে একটা গভীর প্রাচীর ছিলো আমাদের মধ্যে! সেটা শুধু আমি জানতাম। আমি বার কয়েক চেষ্টা করেছি বলার। কিন্তু আমার মন আমাকে বাঁধা দিয়েছে। বারবার মনে হতো সে যদি ভুল বুঝে আমাকে ছেড়ে চলে যায়! ভালোবাসা মানুষকে নির্বোধ বানিয়ে দেয়।আমি বোকার মত তার কাছ থেকে সত্যটা লুকিয়ে গেলাম যে ভয়ে, আজ সে ঠিক আমাকে ভুল বুঝে চলে গেছে।
আমি জানি আমার প্রিয় মানুষটি আজ এই গল্প শুনছে। তাকে বলতে চাই, একটা সুযোগ দিতে পারতে! ভুল বুঝে দূরে ঠেলে না দিয়ে একটু কাছে ডেকে বলতে পরতে, সব ভুলগুলো মুছে ফেলো। আবার নতুন করে শুরু করি। শুনেছি কাউকে ভালোবাসলে তার খারাপ ভালো দু’টোকেই বাসতে হয়! তবে কি তুমি আমায় ভালোবাসোনি!
‘তারপর কি হলো? আর কি সেই সত্য! জানতে হলে কান পেতে রাখুন রেডিও এফমে। আমরা শীগ্রই ফিরছি।

‘ফিরে এসেছি ব্রেকের পর, আমাদের সাথে আছে আজকের অতিথি, এডভোকেট মিফতাজ আয়মান। তো দেরি না করে চলে যাবো গল্পে।

‘আমরা কলেজ ফ্রেন্ডরা মিলি একটা পার্টি করছিলাম। হুট করে সেখানে ঝামেলা শুরু হলো তাও দু’টো মেয়ের সাথে। আমরা মোটামুটি সবাই ওভার ড্রাংক। আমি বিষয়টা প্রথমে পাত্তা দেয়নি। কিন্তু বেশ খানিক সময় পার হয়ে গেলেও বাকিদের কারো খবর না পেয়ে বাহিরে বের হয়ে আসি। সিঁড়িতে দু’টো ওড়না জুতো এসব পরে থাকতে দেখে টলতে টলতে ছাদে যাই।

ততক্ষণে ওরা মেয়ে দু’টোর সাথে জবরদস্তি করা শুরু করে দিয়েছে। ছাদে তেমন লাইট নেই বললেই চলে, আবছা আলো। আমি কোন মতে ওদের বলছিলাম, কি করছিস ওদের ছেড়ে দে, এসব ঠিক না। কথা শেষ করার আগেই একটা মেয়ের আত্ম চিৎকার কানে আসলো। হুট করে মনে হলো আমার নেশা কিছুটা কেটে গেছে, এতো হৃদয়বিদারক ছিলো সেই চিৎকার। আমি মাথা ঝাড়া দিয়ে সামনে যেতে যেতে আরেকটা মেয়ে আমার চোখের সামনে ছাদ থেকে লাফ দিলো । আমি তাকে বাঁচাতে চেয়েও পারলাম না। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। প্রথমে ড্রাইভার কে কল করি। তারপর তার সাহায্যে দু’জনকে নিকটতম হসপিটালে ভর্তি করি। দু’জনেই আমাকে দেখে। তবে একজন অপরাধী হিসেবে অপরজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে।

সেদিনের পর নিজেকে পাল্টে ফেলি।অপরাধ না করেও ওই কেসের আসামী হই। নিজেকে বাঁচাতে চেহারায় হালকা পরিবর্তন আনি।অনেক টাকা নষ্ট করে কেস থেকে মুক্তি পেলেও। অপরাধ না করে সারা জীবন নিজের মুখ লুকিয়ে রাখি অপরাধীর মত। নিজের ভালোবাসার মানুষের চোখে ঘৃণা দেখার সাহস ছিলো না বলে, কখনো তাকে কিছু বলিনি। কারন একমাত্র আয়াত বলতে পারতো আমি নির্দোষ। সেই আয়াত মেয়েটা মানসিক ভারসাম্যহীন।

আমি কেবল বিনা অপরাধে শাস্তি পেয়ে গেলাম। কেউ আমাকে বুঝতে চাইলো না। প্রথমে বাবা। তারপরে ভালাবাসার মানুষটা। আসলে সম্পর্ক যেটাই হোক বিশ্বাস থাকাটা জরুরি। বিশ্বাস ছাড়া সম্পর্ক ভিত্তিহীন।

‘যেদিন সে আমাকে না জানিয়ে উধাও হলো! তারপরেও আমি তাকে উন্মাদের মত খুঁজেছি। কিন্তু যখন জানতে পারলাম আমাকে ঘৃনা করে আমার আড়ালে চলে গেছে, তাই ভাবলাম তাকে তার মত থাকতে দেয়।

‘শেষে শুধু একটা কথাই বলবো, আমার প্রিয়তমার উদ্দেশ্য, তোমাকে ভালোবেসেছি, ভালোবাসি, ভালোবাসবো!
তবে আর ফেরাতে চাইবো না। আর বলবো না একবার ভালোবাসো! তুমি তোমার মত ভালো থাকো।
হয়তো কিছু মানুষকে সবটুকু উজার করে ভালোবাসলেও, সেই মানুষটার বিন্দু মাত্র ভালোবাসা পাওয়া যায় না।

✨মানহা হাউমাউ করে কান্না শুরু করো দিলো, হারলি নিজের রুম থেকে ছুটে এসে বলে,কি হয়েছে তোমার? তুমি এভাবে কাঁদছো কেন!

‘মানহা হারলি কে জড়িয়ে ধরে বলে,বলতে পারো আমার সাথেই কেন এমন হয়! যখন যাকে আগলে ধরে বাঁচতে চাই, সেই দুরে সরে যায়।
মায়ের মৃত্যুর পর বাবার বুকে আশ্রয় চেয়েছিলাম সে ছুরে ফেলে দিয়েছিলো৷ আর আজ নিজের দোষে সবচেয়ে কাছের মানুষটাকে হারিয়ে ফেললাম।
‘তুমি কেদোঁ না। সব ঠিক হয়ে যাব।
‘কিছু ঠিক হবে না! যে মানুষটাকে ভুল বুঝে এতো কষ্ট দিয়েছি তার কাছে কোন মুখে দাঁড়াবো! আমি এতোটা স্বার্থপর না। আমি পারবো না তাজের মুখোমুখি হতে! সারাজীবন এই বিরহে পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে যাবো।তুমি জানো ওআমাকে বলতে চেয়েছিল, আমি শুনিনি। শেষবার ওর চেহারা অব্দি দেখিনি। যখন জানতে পেরেছিলো আমি আর নেই। তখন পাগলের মত আমাকে এ শহর ও শহর খুঁজ ফিরেছে। আমি ওর ভালোবাসার যোগ্য না। আমার সাথে একদম ঠিক হয়েছে। আমি এটার যোগ্য!

✨রুনা বেগম আজ খুব আনন্দিত। আজ তার দুই মেয়ের জীবনে শুধু সুখের জোয়ার। রতন সাহেব বিষন্ন মনে তাকিয়ে আছেন নিজের স্ত্রির দিকে। যেনো হৃদয় চিড়ে বের হচ্ছে না বলা কথাগুলো।
রুনা বেগম কপট রাগ দেখিয়ে বলে,কেমন বাবা তুমি! নিজের মেয়েদের আনন্দে মুখ গোমড়া করে রেখেছো? তা তোমার আদরের ভাইজির কথা মনে পরছে বুঝি! যেয়ে দেখো সে ঠিকি ভালো আছে। বিদেশে মেয়েরা কত কি করে বেড়ায় দেখোনা খবরে!
রতন সাহেব খুব ধৈর্যশীল একজন মানুষ। কিন্তু আজ যেনো তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো। টেবিলের উপরে সাজিয়ে রাখা প্লেট, গ্লাস,জগ সব ফেলে দিলেন। মূহুর্তে ফ্লোরে সেসব ছড়িয়ে পরলো। গর্জন তুলে বললেন, দেখবো না কেন সবই তো দেখি। তোমার মত মানুষ নিয়ে যে এতো বছর সংসার করছে, সে তো কত কিছুই দেখছে!মা মরা মেয়েটার মা না হতে পারো একজন মেয়ে হিসেবে তো মেয়েটার প্রতি একটু মায়া দেখাতে পারতে! তোমরা মা’মেয়েরা সব স্বার্থপর। আজকের পর থেকে তোমাদের সাথে আমি কোন রকম সম্পর্ক রাখবো না!
‘যাও যাও দেখি কত দূর যেতে পারো। নিজের মেয়ের চেয়ে অন্যের মেয়ের জন্য দরদ উতলে পরছে। যার বাবাই পরিচয় না দিয়ে ফেলে রেখে গেছে তাকে নিয়ে কম মাতামাতি তো আর কম করলে না। একটা অপয়া মেয়ে। আগে উপস্থিত থেকে জ্বালিয়েছে। এখন চলে গিয়েও শান্তি দিচ্ছে না। মরে গেলে যদি শান্তি পাই।
শেষের কথাটা শেষ হওয়ার আগেই রতন সাহেব স্ব জোড় চড় বসিয়ে দিলেন৷ আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে গলা চেপে ধরলেন। রুনা বেগম হাসফাস করছে। বড় কোন দূর্ঘটনা ঘটার আগেই, একজন বলে উঠলো, এ বয়সে এসব কি করছেন?

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে