নীলাম্বরে জোছনা পর্ব-১২

0
600

#নীলাম্বরে_জোছনা
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -১২

আরহামের চোখে আজ ঘুম নেই। হসপিটালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূর আকাশের চাঁদের সাথে মনে মনে কত কথা সে বলছে। আজ তার হৃদয়ে প্রশান্তি কত দিন, কত মাস, কত অপেক্ষার অবসান ঘটতে চলেছে! আরহাম দুর আকাশের পানে তাকিয়ে বলে, আমার ভিনদেশী তারা, তুমি বলেছিলে যখন পৃথিবীর সব আলো নিভে যায়, তখন #নীলাম্বরে_জোছনা উঁকি দেয়। তোমার মত বাচ্চা একটা মেয়ে কত সহজে কত কঠিন কথা বলেছিলো সেদিন! আমি তোমার কথা আজ উপলব্ধি করতে পারছি। তুমি তো ছিলে আঁধার শেষে আলোর ভিড়ে, তুমি তো ছিলে মেঘে ঢাকা তারার নীলে। তুমি তো আছো আমার হৃদয়ে।এই যে কয়েক বর্ষ দূরে ছিলে তবুও এই হৃদয়ের খুব কাছে ছিলে। তুমি আমার রুপালি চাঁদ সোনালী রোদের হাসি। তোমার অজান্তেই তোমায় ভিষণ ভালোবাসি।

প্রেমে পরলে মানুষ একদম বাচ্চা হয়ে যায়। কি আশ্চর্য একজন ডাক্তার আকাশের সাথে রাতের চাঁদ, তারার সাথে গুন গুন করে কথা বলছে!


আদুরী মানহাকে খাবার খাইয়ে দিয়ে দুজনেই বাহিরে আসলো। মানহা শক্ত করে আদুরীর হাত ধরে আছে। উদ্দেশ্যে এখন মিফতাজের খোঁজ নেয়া। কেবিনের সামনে আসতেই দিশা বেগম তেড়ে আসলেন। মাহমুদ সাহেব নিজের স্ত্রীকে সংযত করে বলেন, যেতে দাও মেয়েটাকে। দেখো ভালোবাসা হলো এমন এক দাওয়া! যা শত বর্ষের রোগ এক মূহুর্তে দূর করে দিতে পারে। দেখো দিশা শারীরিক রোগের চেয়ে মানুষিক রোগে আমরা দূর্বল হয়ে পরি বেশি। তাই যেতে দাও। এই মূহুর্তে আমার ছেলেকে সুস্থ দেখা ছাড়া আর কিছু ভাবতে চাইনা।

মানহা ধীর পায়ে মিফতাজের বেডের পাশে দাঁড়ালো। এই রুমে আরো চারজন রুগি আছে। মানহা নিজের হাত মিফতাজের মাথায় রাখলো। আলতো করে মিফতাজের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। চোখ ভিজে উঠছে। ইতিমধ্যে কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়া শেষ মানহার। শেষ বারের মত প্রিয় মানুষটাকে নয়ন ভরে দেখছে। তাতে কি চোখের তৃষ্ণা মিটছে?নাকি আরো বাড়ছে? এই যে দূরে যাওয়ার কথা ভাবতেই বুকের ভেতর কেমন করে উঠছে। তবুও এই মানুষটাকে ছাড়া পুরো জীবন কাটাতে হবে! মানহা নিজের ঠোঁট এগিয়ে এনে পর পর কয়েকবার মিফতাজের কপালে ভালোবাসা এঁকে দিলো। বারবার ইচ্ছে করছে দীর্ঘ সময় নিয়ে মিফতাজের অধরে অধর মিলিয়ে রাখতে। নিজের ইচ্ছে কে দমিয়ে রেখে মিফতাজের হাতে চুমু খেয়ে বের হয়ে আসলো।
চোখ খুলে কি মিফতাজ দেখতে পাবে তার প্রিয়তমাকে? নাকি আর কখনোই দেখা হবে না, প্রিয় মুখ, আর কখনো স্পর্শ করা হবে না প্রিয় শরীর, আর কখনো অনুভব করা হবে না একে অপরের ভালোবাসা! এখানেই কি তবে শেষ হলো মিফতাজ আর মানহার প্রেম কাহিনী? আর কখনো কি একে অপরের চোখে তাকিয়ে ভালোবাসি বলা হবে না! কি আছে তাদের ভাগ্যে?

এতো সুন্দর মূহুর্তে যদি মিফতাজের জ্ঞান থাকতো, উপভোগ করতে পারতো প্রিয়তমার প্রতিটি স্পর্শ !যদি প্রতিটি মুহূর্ত অনুভব করতে পারতো তবে প্রত্যেকটি স্পর্শ হৃদয় দিয়ে অনুভব করতো। হয়তো মিহতাজের অশান্ত হৃদয় শান্ত হয়ে যেত ভালোবাসার কাঙ্গাল হৃদয়টা কিছুটা ঠাঁই খুঁজে নিতো ! তৃষ্ণার্ত মনটা কিছুটা হলেও জুড়িয়ে যেত।
মানহা গুটি গুটি পায়ে বেরিয়ে আসলো নিচের দিকে তাকিয়ে সোজা চলে আসলো। কিছুটা সামনে আসতেই থমকে দাঁড়ালো। চার চোখ একে অপরকে দেখে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কারো মুখে কোন শব্দ নেই কিন্তু ভেতর থেকে শব্দরা দলা পাকিয়ে এসে যেন আটকে যাচ্ছে! কথা বলার থাকলেও বের হচ্ছে না। বেশ কিছুটা সময় পর মানহা বলে উঠলো, মিস্টার অসুস্থ আপনি!

আমার জীবনে এক আকাশ শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই নেই। মানুষ জীবনে কিছু তো পায় কিন্তু আমি পেলাম শুন্যতা। আচ্ছা এই যে আমার বুকের ভেতর তীব্র ব্যথা হচ্ছে, এই যে না চাইতেই আমার চোখের কার্নিশ বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পরছে। কেউ নেই যে এই কষ্টটুকু বুঝবে কেউ নেই যে নিজ হাতে এই পানিটুকু মুছে দিবে। হেরে যাওয়ার পর বেঁচে থাকার মত কষ্ট আর কিছুতে নেই। সব সময় বুকের তীব্র যন্ত্রণা, সব সময় একাকীত্ব! আমি মৃত তবুও শরীর বেঁচে আছে কি অদ্ভুত!
ডায়েরির পেজে কথাগুলো লিখে ডায়েরিটা বালিশের নিচে রেখে দিলো। ছেলেদের নাকি কাঁদতে নেই! তাহলে আদিলের চোখের কোন বেয়ে নোনা জল কেন পড়ছে? নিজের ভুলের মাশুল নিজেকেই দিতে হয়। আদুরী আমার আদু রানী তুমি আমার হৃদয়ের মধ্য মনি। তুমি না থেকেও রয়ে গেছো আমার নিশ্বাস জুড়ে। আমার প্রার্থনা জুড়ে আমার অনুভবে।


মানহার কথা শুনেও আরহামের মধ্যে কোন হেলদোল নেই। কি বলা উচিৎ তার! সে জেনো অন্য জগতে আছে। মানহা আর কিছু বলবে তার আগেই দিশা বেগমের চিৎকার কানে এলো। মানহা আরহাম দু’জনেই ছুটে সেদিকে গেলো।

হুট করেই মিফতাজের কন্ডিশন খারাপ হয়ে গেছে। এখন বাঁচা মরা কোন কিছুই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।

মানহাকে দেখেই দিশা বেগম ছুটে এসে বলে,যাও আমার ছেলেকে সুস্থ করে দাও। এ সব কিছু তোমার জন্য হয়েছে। না সেদিন তুমি আমার বাড়িতে আসতে আর না আজ এইদিন দেখতে হতো । কি দোষ করেছিলো আমার ছেলেটা? কেন এমন শাস্তি দিচ্ছো। আমার ছেলের কিছু হলে তোমাকে আমি ছাড়বো না মেয়ে।
মানহা নিচে ফ্লোরে বসে পরলো। মিফতাজকে ইমার্জেন্সি ওটিতে নেয়া হচ্ছে। সবাই ছোটাছুটি করছে। মানহা হাঁটুর ভাজে মুখ গুজে কাঁতদে লাগলো। বুঝে পাচ্ছে না হুট করে এমন হলো কি করো? তবে কি প্রকৃতি তার পাপের শাস্তি দিচ্ছে? যে কষ্ট আয়াত পেয়েছে সেই পাপের শাস্তি পাচ্ছে মিফতাজ! কিন্তু পাপতো একা মিফতাজ করেনি। তার সাথে আরো তিনজন ছিলো। সবাই সমান ভাগি। তাহলে মিফতাজ একা কেন শাস্তি পাচ্ছে?

আদুরী মানহাকে উঠানোর চেষ্টা করছে। মানহা চিৎকার করে বলে,কেন আমার সাথে এরকম হলো বলো আপাই কেন? কেন সেই রাতে ওই হায়েনাদের সাথে মিফতাজের থাকতে হলো! কেন এতো ছেলে পৃথিবীতে থাকতে আমার বোনের অপরাধীকে আমার ভালোবাসতে হলো!

আদুরী দু’কদম পিছিয়ে গেলো। কি বলছে মানহা এসব? তাহলে কি সেই রাতে ঘটে গেছে কোন ভয়ংকর রকমের দূর্ঘটনা। কি সেই অতীত? আর সেরকম একটা জঘন্য অতীতের সাথে মিফতাজের যোগসূত্র কিভাবে হতে পারে?
কখনো তো মনে হয়নি মিফতাজ এমন হতে পারে?

মানহা এতোক্ষণ বেহুঁশে অনেক কিছু বলে ফেলেছে।আদুরী মানহার দুই বাহুতে হাত রেখে মানহাকে টানতে টানতে লিফটে নিয়ে আসলো। নিচে নিয়ে এসে একটু সাইডে নিয়ে গেলো। মানহা রোবটের মত স্থীর দাঁড়িয়ে আছে, মনে হচ্ছে সে হাতে তৈরি কোন পুতুল যার কোন অনূভুতি শক্তি নেই!
আদুরী মানহার সামনে দাঁড়িয়ে মানহার থুতনি দরে উঁচু করে বলে,এবার সত্যিটা বল, সেদিন রাতে কি হয়েছিল। আর কে কে এর সাথে জড়িত আছে?

মানহা একি ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করে কোন উত্তর না পেয়ে আদুরী স্ব-জোড়ে মানহার গালে ঠাসসসসস করে একটা চড় বসিয়ে দেয়। হাসপাতাল চত্বরে সিকিউরিটি গার্ড ছাড়া তেমন কেউ নেই।

মানহা তবুও চুপ। কি করে নিজের ভালোবাসার মানুষটার সম্পর্কে নোংরা কথাগুলো বলবে! সেই সত সাহস কি মানহার আছে! যাদের চোখে নিজের ভালোবাসার মানুষের জন্য সম্মান ভালোবাসা দেখেছে। তাদের চোখে মানুষটার জন্য ঘৃণা কি করে দেখবে!

আদুরী মানহার দিকে তাকিয়ে বলে,আমার দিকে তাকা মান,আর বল সেদিন কি হয়েছিল!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে