নীলাকাশ_কালো_মেঘ part_19 (শেষ পর্ব)

0
1897

নীলাকাশ_কালো_মেঘ part_19 (শেষ পর্ব)
#adrin_anisha
.
অন্ধকার একটা রুমে টেবিলের উপর হাত রেখে বসে আছে আয়ান। মাথার উপর ছোট একটা লাইট বাতাসে নড়ছে। গরমে,চিন্তায়,ভয়ে ঘেমে একাকার হয়ে গেছে সে। টেবিলের সামনের চেয়ারটায় বসে আছে পুলিশের ওসি। হাতে লাঠি আর চোখে রাগ।
তবুও নিজেকে শান্ত রেখে বলল,
– বল আমাকে খুলে, ঠিক কি হয়েছিলো?
আয়ান নিজের সামনে থাকা গ্লাসের পুরোটা পানি খেয়ে নিল। তারপর হাত দিয়ে ঘাম মুছে বলতে লাগলো,
– আমি নীলাকে ভালোবাসি৷ অনেক অনেক ভালোবাসি। ওর ক্ষতি করার কথা আমি কল্পনাও করতে পারি না। কিছুদিন আগে ওর বাবা এসে আমায় বলেছিলেন আমি যেন নীলাকে আর বিরক্ত না করি। আমার ভালোবাসা নীলার বিরক্তির কারণ হোক সেটা আমি চাইনি। তাই আর বিরক্ত করিনি ওকে। তবে ওকে না দেখেও থাকতে পারছিলাম না। সবসময় মনে হতো যেন আমার নীলার কোনো ক্ষতি না হয়ে যায়। তাই দূর থেকেই ওকে প্রতিদিন একবার করে দেখে আসতাম। এর আগেও আমি সারাক্ষন নীলার উপর নজর রাখতাম যেন কেও ওকে ডিস্টার্ব না করতে পারে। ওর স্কুলেও গিয়েছিলাম। ওর ক্লাসের কিছু ছেলেদের টাকা দিয়েছিলাম যেন নীলাকে কেও বিরক্ত করলে আমাকে সাথে সাথে জানায়। নীলা যখন স্কুল থেকে বাসায় যেত আর বাসা থেকে স্কুলে আসতো তখনো আমি ওর উপর নজর রাখতাম। ও নিজেও জানতো না। ওকে যতবার কোনো ছেলে বিরক্ত করার চেষ্টা করেছে, আমি ততবার সবাইকে ওর থেকে দূরে রেখেছি। কখনো বুঝিয়েছি, কখনো পুলিশের ভয় দেখেয়েছি। হোক সেটা রাব্বি, দীপ, রিফাত বা অন্যকেউ।
আয়ানকে থামিয়ে দিয়ে ওসি বললেন,
– এক মিনিট, এরা সবাই নীলাকে বিরক্ত করতো?
আয়ান শান্ত গলায় বলল,
– নাহ, বিরক্ত করার সুযোগই পায়নি। তার আগেই আমি ওদের সাবধান করে দিয়েছি। তবে শুধু একজনই ছিলো যে বিনা বাধায় আমার নীলাকে বিরক্ত করেছে। মেঘ। মেঘের কথা আমি জানতে পারিনি, ওর স্কুলের কেউই কখনো আমাকে ওর ব্যাপারে কিছু বলেনি। আর তাই আজ আমার নীলার এই অবস্থা হলো।
কথাটা বলেই কাঁদতে শুরু করলো আয়ান।
– তারমানে তুমি বলতে চাও এসেছে ব মেঘ করেছে? কিন্তু এই মেঘ টা কে?
আয়ান এবার রাগে মুখ শক্ত করে বলল,
– মেঘ নীলার সিনিয়র। নীলা আর মেঘের ক্লাস মুখোমুখি। যেদিন থেকে নীলা ভর্তি হয়েছে সেদিন থেকেই ওর নজর নীলার উপর পড়েছে। অনেক জ্বালিয়েছে ও নীলাকে। এমনকি একদিন এসে নীলার ক্লাসে ঢুকে ওর সামনে হাত পর্যন্ত কেটেছে। কিন্তু তখনো আমি কিছুই জানতে পারি নি। আজ ঈদ, তাই নীলা কেমন সেজেছে একবারের জন্য তা দেখিতে গিয়েছিলাম। মাঝপথে ফোন এলো একটা। নীলার ক্লাসেরই একটা ছেলের ফোন ছিল। ফোন রিসিভ করতেই ও আমাকে সব খুলে বলল, আর এটাও বলল যে নীলাকে আজ মেঘ খুন করার প্ল্যান করেছে। আমি আর সময় নষ্ট না করে তখনই দৌড় দিলাম। টেনশানে গাড়িতে ওঠার কথাও মাথায় আসে নি। কথায় আছে “চোর পালালে বুদ্ধি হয়”। আমি গিয়ে দেখি নীলা রাস্তায় পড়ে আছে আর একটা ছেলে হাতে ছুড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাথে ছিল মেঘ, ওর মুখে শয়তানি হাসি। আমি একটু ও দেরী না করে ওদের দিকে দৌড়ে গেলাম। আমাকে দেখেই ওরা দৌড় দিল। আমি নীলার দিকে একবার থেমে দেখলান দূরে ওর বন্ধুরা আসছে। আমি আর সময় নষ্ট না করে মেঘের পেছনে দৌড়ালাম। সবচেয়ে দুঃখের কথা কি জানেন স্যার? ওখানে প্রায় ১০-১৫ জন লোক ছিলো৷ সবাই দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছিলো একজনও যদি সাহস করে এগিয়ে আসতো তাহলে আজকে আমার নীলাকে এতো কষ্ট সহ্য করতে হতো না।
কথাটা বলেই একটা হতাশার নিশ্বাস ছাড়লো আয়ান।
ওসির চোখে এখন আয়ানের প্রতি বিশ্বাস ভর করলো, কারণ ওর সব কথাগুলো মিলে যাচ্ছে হুবুহু বাকি সবার সাথে। কিন্তু মনে কোনো এক অজানা ভয় আসলো, ভ্রু কুঁচকে বলল,
– তাহলে মেঘকে কে কি তুমি ধরতে পেরেছো? কোথায় এখন সে?
আয়ান একনজর ওসির দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে বলল,
– সরি, আইন নিজের হাতে নেয়ার জন্য।
আয়ান কথা শুনে ওসি কোনো এক অজানা ভয় নিয়ে আয়ানের দিকে তাকায়। আয়ান জানে কি সেই তাকানোর মানে।
মুচকি হেসে বলল,
– না না, চিন্তা করবেন না, ওকে আমি একেবারে মেরে ফেলেনি। শুধু আমার নীলাকে ছোঁয়ার অপরাধে আধমরা করে দিয়েছি।

আয়ানের কথা শেষ হতেই, আকাশ আর আকাশের বাবা এসে ঢুকলো রুমে। আকাশ সোজা এসে আয়ানের গলা চেপে ধরল৷ আয়ান আকাশের থেকে নিজেকে সরানোর কোনো চেষ্টাই করছে না বরং হাসছে। আকাশের চোখেও সে সেই ভালোবাসা দেখতে দেখিতে পাচ্ছে যা ও নিজের চোখে দেখতে পায়।
ওসি আর আকাশের বাবা এসে আকাশের হাত থেকে আয়ানকে ছাড়িয়ে নেয়। তারপর সব খুলে বলে যে আয়ান নীলাকে মারতে নয় বাঁচাতে এসেছিলো।
– আমাদের অফিসাররা গেছেন মেঘকে ধরে আনতে। আজ আয়ানের জন্যই মেঘ এতো সহজে ধরা পড়লো।
আকাশ রাগে হাত মুষ্ঠি করে টেবিলের উপর জোরে এক ঘুষি মারলো।
– আমি ছাড়বো না ওই মেঘকে।
– নাহ তার আর প্রয়োজন হবে না। আয়ান অলরেডি ওকে আধমরা করে দিয়েছে।
.
কিছুক্ষন পর মেঘকে আর আরেকটা ছেলেকা ধরে নিয়ে আসলো পুলিশ।
– তাহলে এবার বলে ফেলো কেন করলে এমন? শুনেছিলাম তুমি নাকি ওকে ভালোবাসো?
মেঘ মুচকি হেসে বলল,
– নিজের ভালোবাসাকে যদি অন্যের হয়ে যেতে দেখেন কেমন লাগবে আপনার? আমারো ভালো লাগেনি। এতো ভালোবাসি আমি ওকে আর ও কি না বুঝতেই চাইলো না? তাই আমিই সব প্ল্যান করেছি৷ ও আমার বন্ধু রাজিব, ছোটবেলায়ই ওর দুলাভাইকে খুন করে পলাতক হয়েছে। তাই এই খানেও ওকেই আমি কাজে লাগিয়েছি।
পাশে থাকা রাজিবের দিকে তাকিয়ে বলল মেঘ। ভয়ে একদম চুপসে গেছে সে।
ওসি একনজর রাজিবের দিকে তাকিয়ে আবার মেঘের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– কিন্তু মারতে চাইলে কেন?
– যাকে আমি ভালোবাসি সে আমার হবে না এটা আমি মেনে নিতে পারব না। আমার না হলে আমি ওকে কারো হতে দেবো না।
আয়ান আর আকাশ এতোক্ষন দূর থেকে সব শুনছিলো।
এবার রাগে মুখ শক্ত করে ঠাস করে একটা চড় মারলো মেঘকে আকাশ,
– তোর মনে হয় এটা ভালোবাসা? ভালোবাসার মানে জানিস তুই? ভালোবাসা মানে সেক্রিফাইস, যেটা আয়ান করেছে। ভালোবাসা মানে ভালোবাসার মানুষের খুশির জন্য যদি ওর থেকে দূরে সরে থাকতে হয় তাহলে তাই করা, যেমন টা আয়ান করেছে। ভালোবাসা মানে নিজের জীবনের বাজি রেখে হলেও ভালোবাসার জীবন বাঁচানো যেমনটা আয়ান করেছে। ভালোবাসা মানে ভালোবাসার মানুষকে সব রকমের বিপদ থেকে দূরে রাখা যেমনটা আয়ান করেছে। তুই যেটা করেছিস সেটা ভালোবাসা নয় বরং একটা নেশা, একটা আসক্তি। নেশাখোর যেমন নেশা না করতে পারলে হিংস্র হয়ে যায় তুই ও তেমনি অমানুষ হয়ে গেছিস।
পুলিশ এসে মেঘকে আর রাজিব কে নিয়ে যায় জেলের দিকে। যেতে যেতে মেঘ শুধু একটা কথাই ভাবলো, সত্যিই কি নীলাকে ও ভালোবেসেছিলো? নাকি সত্যিই ও একটা আসক্তির মাঝে ছিলো?

আকাশের দিকে মুচকি হেসে এগিয়ে আসে আয়ান। আকাশের হাত ধরে ওর এক কাধে হাত দিয়ে বলে,
– কে কাকে বেশি ভালোবাসে সেটা বড় কথা নয় আকাশ। বড় কথা হচ্ছে নীলার মনে কে আছে? নীলার মনে তুমি আছো আকাশ। আমি দেখেছি তোমাকে আর নীলাকে বৃষ্টিতে ভিজতে। শুধু তাই না নীলার চোখে যে ভালোবাসাটা আমি এতোদিন দেখতে চেয়েছি সেটা আমি সেদিন দেখেছিলাম৷ তবে তোমার জন্য। ভালো রেখো ওকে আকাশ।
কথা গুলো বলেই চলে গেল আকাশ। আকাশ বুঝতে পারলো না ঠিক কতটা ভালোবাসলে এভাবে ভালোবাসাকে অন্যের হাতে তুলে দেয়া যায়? তবে যেতে যেতে আয়ানের ভেজা চোখ দুটো মোটেও চোখ এড়ালো না আকাশের।
.
জ্ঞান ফিরেছে নীলার। চোখ খুলে ঘরে বুঝিতে পারলো না সে কোথায়? আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। নিজের দিকে তাকাতেই মনে পড়লো,

“রাস্তার উপর যখন মার খেতে খেতে শরীরটা প্রায় অসার হয়ে আসে নীলার তখন মেঘ আসে নীলার কাছে। উবু হয়ে নীলার মুখটা নিজের দিকে ফিরিয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে মেঘ বলল,
– কি ভেবেছিলি? আমাকে ঠকাবি? এবার দেখ তোর আমি কি অবস্থা করি, আমার না হলে তোকে আমি আর কারো হতে দেব না।
কথাটা বলেই নীলার পেটে একটা লাথি মারলো মেঘ। ”

সাথে সাথে চিৎকারে করে উঠলো নীলা। নীলার চিৎকার শুনে সবাই নীলার রুমে ঢুকলো। সবাইকে এভাবে নিজের সামনে দেখে মনে যেন সাহস খুঁজে পেল নীলা। বাবার হাতটা অনেক কষ্টে ধরে বলল,
– বাবা, ভাবিনি তোমাদের আর কোনোদিনো দেখতে পাবো।
নীলার কথা শুনে সবাই কেঁদে দিল।
.
.
.
(আমাদের বাস্তব জীবনেও নীলার মতো হাজার হাজার মেয়েকে সহ্য করতে হয় মেঘের মতো ছেলেদের যন্ত্রনা। শুধু আফসোস, আয়ানের মতো মানুষ শুধু হাজারে একটা মেয়ের কপালেই থাকে।)

সমাপ্ত

(গল্পের এন্ডিং টা কেমন হয়েছে জানিনা। গল্পের উদ্দেশ্য ছিলো এমন ধরনের এক তরফা ভালোবাসার ভূল ধারণা ভাঙা। যেমনই লাগুক, সবার থেকেই একটা রিভিউ আশা করছি। ধন্যবাদ)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে