নীলফড়িং পর্ব-১৮

0
434

#ফারহানা_হাওলাদার_প্রকৃতি
#নীলফড়িং
#পর্ব ১৮
.
.
পুস্পিতা একদিন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল, তার সাথে আরও একজন মহিলা ডাক্তার ছিলো। ঠিক তখনই আচমকা একটা বাইক গেল ওদের পাশ থেকে, আর সেই বাইক থেকেই কেউ পুস্পিতার গায়ের থেকে ওড়নাটা টান দিয়ে নিয়ে গেল। পুরো রাস্তায় মানুষ থৈথৈ করছে। সবার চোখ আঁটকে আছে পুস্পিতার দিকে, চোখ থেকেই মনে হচ্ছে সবাই গিলে খাবে পুস্পিতা কে। ভাগ্যিস পুস্পিতা এপ্রোন পড়া ছিলো। পুস্পিতা হাতের ব্যাগটা দিয়ে নিজেকে ঢেকে নিয়ে পাশে তাকাল দেখল এই এলাকার বকাটে ছেলে দাঁত গুলো বের করে হাসছিল বাইকে বসে পুস্পিতার ওড়নাটা তার হাতেই ছিলো। কয়েক দিন ধরেই ছেলেটা আজে বাজে মন্তব্য করত, আজ তো পুরো লেভেল ক্রস করে ফেলল। পুস্পিতা চারিদিকে তাকিয়ে একবার দেখে এগিয়ে গেল সেই ছেলেটার কাছে, সে এখনো হাসছিল দাঁত বের করে, তার সাথে বাকি দুটো ছেলে ও হাসছিল খুব জোরে জোরে। কাছে গিয়ে পুস্পিতা একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো ছেলেটার গালে। থ মেরে গেল চারিদিকে, ছেলেটার হাত থেকে তার ওড়নাটা নিয়ে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বলে উঠল।

……..তোর মতো অসভ্যরা আর পারবে কী বল। শিক্ষা দেওয়ার মতো নেই হয়ত কেউ যার জন্য শিখতেই তো পারিস নি কীভাবে ভদ্র হয়। কীভাবে মেয়েদের সম্মান দিতে হয় তোর থেকে আর কী আশা করা যায়। তোদের মতো মানুষের জন্য মেয়েরা ঠিক করে হাঁটা চলা পর্যন্ত করতে পারে না দিনে দুপুরে। তোদের তো একটা শিক্ষা না দিলেই নয়।

এই বলে পুস্পিতা পুলিশ কে ফোন দিতে নিলো কিন্তু পুস্পিতার সাথের মেয়েটা এসে জোর করে পুস্পিতা কে টেনে নিয়ে যেতে নিলো।

…….এই যে ডাক্তার ম্যাডাম কোথায় যাচ্ছ একটু শুনে যাও গো। আর একটা থাপ্পড় মেরে যাও, ভালোই লাগল তোমার হাতের ছোঁয়া।

ওর কথা শুনে পুস্পিতা আরও ভরকে গেল, পুস্পিতা এগিয়ে আসতে নিলো কিন্তু ওর সাথের মেয়েটা ওকে আসতে দিলো না।

…….পুস্পিতা প্লিজ ওরা বকাটে, বড় লোক বাপের অসভ্য ছেলে। এরা সব সময় এমনই করে। ওরা খুব খারাপ প্লিজ চলো এখান থেকে।

…….তাই বলে এভাবে ছেড়ে দেবো নাকি? তুমি দাঁড়াও আমি পুলিশ কে ডেকে নিচ্ছি।

……আরে পুলিশ আসবে না। শুধু শুধু তুমি আরও অপমানিত হবে, তার থেকে চলো প্লিজ এখান থেকে। আচ্ছা নিজের জন্য না যাও আমার জন্য তো চলো প্লিজ প্লিজ।

পুস্পিতা নিরার কথা শুনে আর কিছু বলল না ওর সাথে রিকশায় উঠে চলে এলো।

বাড়িতে ফিরে পুস্পিতা একটু বসছে একটু হাঁটাহাঁটি করছে, তার প্রচুর অশান্তি লাগছে, এভাবে কেউ ওর ওড়না টেনে নিয়ে গেল, অথচ ও তার কিছুই করতে পারল না। ওর চোখের সামনে শুধু ওই দৃশ্য টাই বহমান। নিজেকে খুব একা মনে হচ্ছে, আজ ফাইয়াজ থাকলে ওর সাথে, ছেলেটা কে একটা উচিৎ শিক্ষা দিয়ে দিত। কিন্তু তার যে এখন একটুও শান্তি লাগছে না। কী করবে সে এখন। সে ব্যাগ থেকে মুঠো ফোনটা বের করে নিলো, ঘড়িতে তখন ২:৩০ মিনিট কাটায় কাটায়। তবে ফাইয়াজ এখন বাড়িতেই আছে তাই সে চট করে ফোন দিয়ে দিলো ফাইয়াজ কে। রিং হচ্ছে।

……..আসসালামু আলাইকুম।

…….. ওয়ালাইকুম আসসালাম। জ্বি ম্যাডাম বলেন।

…….ডাক্তার সাহেব আমার স্বাস্থ্যটা ইদানিং ভালো যাচ্ছে না। একটু চেক করে বলতে পারেন কী হয়েছে?

…….কেনো নয়, বাট ফোনের মাঝে না বলে সামনে আসলে ভালো করে বুঝানো যেত। তা ম্যাডাম লক্ষণ গুলো কী কী? একটু যদি ডিটেইলসে বলতেন?

…….এই যে ঘুম আসে না চোখে, মন কেমন কেমন করে, খাবার খাওয়ার ইচ্ছে নেই। মন বসে না পড়ার টেবিলে। শুধু ফোন নিয়ে সারাক্ষণ বসে থাকতে ইচ্ছে করে। কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হয়না শুধু একজন কে ছাড়া। সারাদিন শয়নে স্বপনে শুধু তাকেই খুঁজে ফিরি এখন বলেন ডাক্তার মশাই এই রোগের চিকিৎসা কী?

…….ওহ সম্ভবত প্রেম রোগ ম্যাডাম। আমার কাছে আসলে ওষুধ দিয়ে দেবো।

…….না আসলে বুঝি দেয়া যাবে না?

…….না আসলে কীভাবে দেবো?

…….খাবার খেয়েছেন?

…….আগে বলো না আসলে কীভাবে দেবো?

…….আপনি চলে আসেন, খুব মিস করছি।

…….আজ তো কোনো ভাবেই সম্ভব নয়, আমারও যে অনেক ইচ্ছে করছে, কিন্তু কী করব বলো, চাকরিটাই তো এমন।

…….হুম বুঝতে পারছি। আচ্ছা বাদ দিন, খেয়েছেন?

…….নাহ। তুমি খেয়েছ?

……এই তো এখন খাবো। কিন্তু আপনি কেনো খান নাই এখনো?

…….তোমার ফোনের অপেক্ষা করছিলাম তাই।

…….ইশ, আচ্ছা তবে আর কথা নয়, এবার গিয়ে খেয়ে আসেন, আমিও খেয়ে আসছি, তারপর অনেক কথা হবে।

……হুম ঠিক আছে।

এরপর ফোন রেখে দুজনেই চলে গেল খাবার খেতে।

খাবার শেষ করে আবার দুজনে প্রেম আলাপনে ব্যস্ত হয়ে গেল।

সন্ধ্যায় পুস্পিতা বসে পড়ছিল ঠিক তখনই নিরা পাশ থেকে বলে উঠল।

…….পুস্পিতা জানো আমার না খুব ভয় করছে।

…….কেনো নিরা?

……..ওই ছেলে গুলো খুব খারাপ।

…….এর থেকে খারাপ মানুষ আমি জীবনে বহুবার দেখেছি, এদের তো পুরা লেভেল খারাপ, আর আমি যাদের দেখেছি, তারা মুখোশ ধারি ছিলো। তাই এখন আর এসব নিয়ে ভয় করি না। তুমি বরং পড়ায় মন দাও।

ওরা দু’জন আবার নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পুস্পিতা, ফাইয়াজের সাথে কথা বলছিল ফোনে, তখন নিরাও তার হাসবেন্ডের সাথে কথা বলছিল। দু’জন দুই রুমে বসে প্রেম আলাপে ব্যস্ত।

আজও যখন টেনিং শেষ করে ওরা দু’জন ফিরছিল, ঠিক তখন ওই বকাটে ছেলেটা এসে দুজনের পথ আটকে দেয়।

…….হ্যালো সুন্দরী ম্যাডাম কেমন আছেন?

…….(পাশ থেকে নিরা) জ্বি আলহামদুলিল্লাহ।

…….খুব ভালো, কিন্তু ম্যাডাম আমি তো আপনাকে জিজ্ঞেস করিনি, আমি তো এই ম্যাডাম কে জিজ্ঞেস করেছি।

ছেলেটার কথা শুনে পুস্পিতা খুব রেগে যাচ্ছিল। যা নিরা খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারছে। তাই নিরা পুস্পিতার হাত চেপে ধরে বলে উঠল।

……আমিও ওরটাই বলেছি।

……ওহ তবে ঠিক আছে।

…….নিরা চলো এখান থেকে।

…….হ্যা হ্যা চলো।

এই বলে ওরা চলে আসছিল ঠিক তখনই ছেলেটা এসে ওদের সামনে দাঁড়িয়ে যায়।

…….এত জলদি কীসের ম্যাডাম আর একটু দাঁড়িয়ে যাও। একটু কথা বলে যাও।

পুস্পিতা এবার প্রচুর রেগে যাচ্ছে যা দেখে নিরা বলে উঠল।

……দেখেন আমাদের একটু তারা আছে। আপনি প্লিজ পথ ছাড়েন, যেদিন সময় থাকবে হাতে সেদিন কথা হবে।

…….ওহ আচ্ছা তাই ঠিক আছে চলে যান। তবে কথা হবে কিন্তু সেদিন।

……জ্বি কেনো নয়।

এরপর ওরা চলে এলো। ওদের ঠিকানায়।

পরদিন থেকে রোজ এভাবেই ছেলেটা ওদের ডিস্টার্ব করতে শুরু করে দিলো। প্রতিদিন ওদের রাস্তা আঁটকে দাঁড়ায়। আর নিরা কিছু না কিছু বলে চলে আসে, যার জন্য ধীরে ধীরে পুস্পিতার রাগ বাড়তে থাকে। পুস্পিতা শুধু মাত্র নিরার জন্য নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে রইল।

এভাবে কিছুদিন চলে যাওয়ার পরে আজ ফাইয়াজ এলো, তাই পুস্পিতা আজ খুব আনন্দিত ছিলো। শুক্রবার সব কিছু বন্ধ থাকায় সারাদিন মনের আনন্দে দুজন ঘুরতে বের হলো। শপিং করতে গেল দুজন, ফাইয়াজ খুব সুন্দর একটা লেমন কালার শাড়ি কিনে দিলো। পুস্পিতাও তাকে সেইম কালারের পাঞ্জাবী কিনে দিলো। দু’জন শপিং করে যখন বের হতে নিলো, ঠিক তখনই ওদের সামনা সামনি একজন মুরুব্বি এসে হাজির হলেন, যাকে দেখে ফাইয়াজ দাঁড়িয়ে গিয়ে পুস্পিতার থেকে একটু সরে দাঁড়াল। তাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল।

……..আসসালামু আলাইকুম চাচ্চু।

…….ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছিস?

……..জ্বি আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি?

…….হ্যা আমি আছি কোনো রকম। আজকাল বেশি একটা ভালো যাচ্ছেনা স্বাস্থ্য। তুই বল এখানে কবে এলি?

……এই তো চাচ্চু আজ সকালেই আসছি।

……তাহলে চল বাসায় চল।

……না আসলে চাচ্চু একটু কাজে আসছিলাম।

……ওহ আচ্ছা। (পুস্পিতার দিকে তাকিয়ে ছিলো যা দেখে ফাইয়াজ বলে উঠল)

……চাচ্চু ও পুস্পিতা, আপনার বউ মা। আর পুস্পিতা ইনি আমার মেজো চাচ্চু।

……আসসালামু আলাইকুম চাচ্চু।

……ওয়ালাইকুম আসসালাম। তা বউ মাকে নিয়ে আসছিস বাসায় যাবি না? এভাবে রাস্তায় বসে পরিচয় করাবি?

……চাচ্চু আসলে বললাম তো একটু কাজের জন্য এসেছি, তাই যেতে পারছি না। আজ রাতেই আবার ফিরতে হবে, তাই রাগ করবেন না চাচ্চু। আবার যেদিন আসবো ইন’শা’আল্লাহ যাওয়ার চেষ্টা করব।

…….হুম ঠিক আছে।

…….চাচ্চু বাসায় সবাই কেমন আছে?

……হ্যা আছে সবাই ভালোই।

……আচ্ছা চাচ্চু তবে এখন আশি?

……আচ্ছা সাবধানে যাস।

এরপর ওরা চলে এলো সেখান থেকে।

……এনাকে তো বিয়েতে দেখলাম না?

……হ্যা আসলে চাচ্চুর আর আব্বুর মাঝে কয়েক বছর আগে একবার খুব রাগারাগি হয়েছিল, যার জন্য সেই থেকে চাচ্চু ঢাকায় চলে আসে, এরপর থেকে আমাদের মধ্যে আর তেমন দেখা হয়না। বা কথাও হয়না। মাঝে মধ্যে (কাজিন) নিবিড় আর নিশা বরিশালে গেলে আমাদের বাসায় যায়, বা আমি ফারিজ এখানে আসলেও গিয়ে দেখা করে আশি চাচ্চু আর কাকি মায়ের সাথে। তাই বিয়েতে ওদের কাউকে দেখনি।

……ওহ আচ্ছা।

…….এখন কোথায় যাবে?

…….খুব ক্ষুধা পেয়েছে কিছু খেয়ে নেই।

…….ঠিক আছে চলো ম্যাডাম।

দুজনে একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে, টুকটাক কিছু খেয়ে নিলো। এরপর আরও অনেক ঘোরাঘুরি করল। আজ সারাদিন দুজন খুব আনন্দ হাসি-ঠাট্টায় মেতে রইল। সন্ধ্যায় রুমে ফিরে এসে দরজা খুলে ভেতরে চলে গেল। রুমটা পুরো অন্ধকার ছিলো। কারণ নিরা আজ তার বাড়ি চলে গেছে। সে প্রতি বৃহস্পতিবার বিকেলে চলে যায়, আবার শনিবার সকাল সকাল চলে আসে, তার বাড়ি বেশি দূরত্বে না থাকার কারণে সে যেতে পারে। মাত্র ২ ঘন্টা সময় লাগে যেতে।

পুস্পিতা দু-কাপ চা করে নিয়ে আসলো দুজনে কাছাকাছি বসে চায়ের সাধ নিলো। একে অপরের সাথে সুখ দুঃখের কথা শেয়ার করল। দুজনে আজ অনেক দিন বাদে এক সাথে হয়েছে, তাই দুজনে অনেক কথা বলল।

……পুস্পিতা একটা কথা রাখবে?

……হুম বলেন?

……শাড়িটা একটু পড়ে আসবে? আমি দেখতে চাই শাড়িটায় তোমাকে কেমন লাগে।

……(.মুচকি হেসে) হুম আপনি বসেন আমি আসছি।

পুস্পিতা গিয়ে শাড়িটা পড়ে খুব সুন্দর করে রেডি হয়ে আসলো। রুম থেকে বের হয়ে আসতেই ফাইয়াজ ওর দিকে তাকিয়েই রইল। কারণ শাড়িটায় খুব সুন্দর মানিয়ে ছিলো পুস্পিতা কে। তার মাঝে খোলা চুল, পুস্পিতা চুল সব সময় বেঁধেই রাখে কিন্তু আজ সে চুল গুলো ছেড়ে দিয়েছে, যার জন্য তাকে আজ বেশ লাগছে। ফাইয়াজ আস্তে আস্তে পুস্পিতার কাছে এগিয়ে গেল।

…….সত্যি আমি যা ভেবেছিলাম তার থেকেও বেশি সুন্দর লাগছে শাড়িটায় তোমায়।

পুস্পিতা লজ্জা পেয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল। যা দেখে ফাইয়াজ হালকা হাঁসল।

…….পুস্পিতা তুমি জানো আজ তোমাকে দেখে আবার নতুন করে তোমার প্রেমে পড়তে ইচ্ছে করছে। কীহ ম্যাডাম প্রেম করবেন নাকি আমার সাথে?

……কেনো নয়।

……তবে ঠিক আছে বাকি যে রয়েছে ১০ দিন এই ১০ দিনে আমরা দু’জন চুটিয়ে প্রেম করব, ঠিক আছে?

……কীভাবে?

…….যেভাবে সবাই প্রেম করে। ফোনে ম্যাসেজ দিয়ে, কল করে, দুজনে এভাবে চুপিচুপি দেখা করে।

…….তা তো সব সময়ই করি।

……হ্যা এখন থেকে সেই কলেজ স্টুডেন্ট হয়ে যাবো দুজন ঠিক আছে?

……আপনিও না?

……আগে বলো করবে প্রেম আমার সাথে?

……হুম।

এরপর দু’জনে আরও কিছুক্ষণ কথা বলল, সময় কাঁটাল দুজন দুজনার সাথে। এভাবেই কাঁটছে হাসি আনন্দে তাদের দিন সময় ক্ষণ।



চলবে………….।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে